আহীর আলমের বাম পা
১৫ মে ২০১৮ ১৩:৪১
মনি হায়দার ।।
নিজের বাম পায়ের দিকে অবাক তাকিয়ে আছেন আহীর আলম।
আহারে আমার প্রিয় বাম পা! তুই কোনো আমার সঙ্গে এমন করছিস রে ভাই? আহীর আলম বিছানায় বসে নিজের বাম পাটাকে উচুঁ করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পরেন, আহারে আমার পা! আমার বাম পা! কতো আদরের পা আমার তুই। বাথরুমে গেলে কতো আদর করে তোকে গোসল করাই, সাবান মাখি, গামছা দিয়ে মুছি।
বছর দশেক আগে আহীর আলম হঠাৎ কোমরে একটা ব্যথা পান। মতিঝিলের একটা অফিসে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ে যখন টার্ন নিতে গেলেন, কোমরের মাঝখানে হঠাৎ শব্দ উৎপাদন হলো, মঝচ। খুব পাত্তা দিলেন না তিনি। শৈশব থেকে এই চল্লিশ বছর জীবনে ওই রকম কতো মঝচ শব্দ উঠেছে কোমর থেকে, কি হয়েছে? তিনি আরও দুতলা অতিক্রম করে কাজের ডেক্সে গেলেন, কাজ সারলেন। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নামার সময়ে মনে হলো, কোমর কোমরের মতো কাজ করছে না। হাটতে আড়ষ্টবোধ করছেন। কোমরে চিন চিন ব্যথা হচ্ছে। আহীর আলম গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না ব্যথা। তিনি গেলেন আর একটি অফিসে। জরুরী কাজ। ফেলে রাখা সম্ভব নয়। সেই কাজ সেরে যখন বিকেলে বাসায় গেলেন, বাসার কলিংবেল টিপে দাঁড়ালেন, আসলে তখন আর তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। স্ত্রী আফরিন দরজা খুলে প্রায় ইংরেজি অক্ষর এসের মতো বাকা একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়েছিলেন।
বাসার ভেতরে ঢুকে বিছানায় বসতে গিয়ে আহীর টের পেলেন, তিনি বসতেও পারছেন না। বসতে গলেই মনে হয়ে, কোমরের উপরের অংশ কোমরের নীচের অংশে ঢুকে যাচ্ছে। তিনি অবশ আলুর বস্তার মতো বিছনায় শুয়ে পরলেন এবং আরাম পেলেন। রাতের মধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন তিনি এখন স্বাভাবিক মানুষ নন। বসতে পারছেন না, বাথরুমে যেতে পারছেন না, যেতে পারছেন কিন্তু ছাগলের মতো চারহাতপায়ে, খেতে পারছেন না ডান হাতে, খাইয়ে দিতে হচ্ছে একজনকে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেহঘড়ি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বন্ধ করে, আহীর আলমকে একটা নির্বোধ জন্তুতে পরিনত করেছে। চোখ ফেটে পানি আসছে, হায় একি হলো? আমি কি সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলাম? এই সংসার, স্ত্রী ছেলে মেয়ে আত্মীয়-স্বজনের কাছে…।
গভীর রাতে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। পরের দিন সকালে আহীর আলমকে অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় ছোট ভাই ইরফান। ডাক্তার কয়েকটা ঔষধ আর ব্যায়াম দিলেন। বাসায় এসে আহীর আলম ঔষধ খেয়ে ডাক্তারের শিখিয়ে দেয়া ব্যায়াম করতে শুরু করলেন। কিন্তু মনের ভেতরে সংশয়, কোমরের এই মারাত্মাক ব্যথা আর কোমরের মধ্যে কোমর ডেবে যাওয়ার ঘটনা কিভাবে ব্যায়ামে আর ঔষধে সারবে? এটা কি করে সম্ভব? কিন্তু আহীর আলম দুদিন পরে অনুভব করলেন কোমরের ব্যথা অনেকটা কম। তিনি ঔষধ আর ব্যায়ামের কাছে নিজিকে নিবেদন করলেন।
কয়েক দিনের মধ্যে সত্তুর ভাগ ভালো হলেন আহীর। গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার একটা ঔষধ পরিবর্তন করে দিলেন আর বললেন ব্যায়ামটা চালিয়ে যেতে। ছটফট টাইপের মানুষ আহীরের পক্ষে ঔষধ খাওয়া যতো সহজ নিয়ম মেনে ব্যায়াম করা প্রায় অসম্ভব। ব্যাথাটা আবার এক বছর দুই বছর ছয় মাস পরে জেগে ওঠে প্রবল বেগে, আবার ডাক্তারের কাছে যায়। এতোদিনে ডাক্তার পরিচিত হয়েছে।
ডাক্তার আখতারুজ্জামান হাসেন, আবার এলেন?
না এসে পারি না যে! পাল্টা হাসে আহীর ব্যথা সহ্য করে।
কিন্তু ডাক্তারের কাছে আপনি নিয়মত আসুন, ডাক্তার হয়েও আমি চাই না।
আমি জানি। কিন্তু আমিতো আমাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না।
সেটা আপনার ফেসবুকের ছবি দেখে বুঝতে পারছি। দিন দুনিয়া ঘুরে বেড়ান ভালো, কিন্তু কোমরকে ঠিক রেখে ঘুরতে আপনাকে কে নিষেধ করেছে?
আমি যখন ঘুরে বেড়াই, তখন কোমরের ব্যথা আমার মনে থাকে না।
তা হলে কি আর করা। বিছানায় শুয়ে পড়ুন। ডাক্তার আখতার হাত পা কোমরের ব্যথা নানাভাবে পরীক্ষা শেষে মুখ গম্ভীর করে বলেন, এইবার আপনাকে একটা এমআরআই করতে হবে।
ডাক্তারের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে, তার নির্দেশিত ল্যাবে গিয়ে হাজির আহীর আলম পরের দিন সকালে। এমআরআই জিনিসটা সর্ম্পকে কোনো ধারণা ছিল না। আগেতো করানো হয়নি। কিন্তু যখন টেকনিশিয়ানরা একটা যন্ত্র কবরের মধ্যে সোজা সুইয়ে দিয়ে ভেতরে চালান করে দেয় তাকে, প্রথমে চমকে উঠেছিলেন আহীর। কোথায় পাঠাচ্ছে আমাকে? আর কানের দুই পাশে দিয়ে দিয়েছে দুটো কানতালা। যাতে যন্ত্র উৎপাদিত বিকট শব্দ কানে না ঢোকে। গোটা ঘরটা এতোটাই বরফ শীতল ঠান্ডা যে, কবরের ভেতবে ঢোকার সময়ে টেকনিশিয়ান পুরো শরীরটাকে পাতলা কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। আর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে একটা সুইচ। প্রয়োজন হলে টিপে দেবেন।
আচ্ছা।
আর শোনেন, যদি বার বার তিনবার বিরক্ত করেন, মানে সুইচ টেপেন আপনার কাজ আমরা বন্ধ করে দেবো। আবার নতুন করে আসতে হবে।
কবরের মধ্যে ঢুকে আহীর আলমের মনে হলো, তিনি কথা বলতে পারছেন না। ছোট্ট এই কুঠরির মধ্যে শরীরটা এমন আটোসাটোভাবে ঢুকে আছে, নাড়াতে পারছেন না। একটা বন্ধ ঘরে একলা কতক্ষণ থাকা যায়? মনে হচ্ছে গভীর নির্জন নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে । এই নির্জন অঞ্চলে যদি একটা বাঘ বা কুমির এসে হামলে পরে! আহীর আর ভাবতে পারছেন না। কানের দুপাশে কানতালা অতিক্রম করে অদ্ভুত বিচিত্র শব্দ কানে আসছে। আহীর আলম যন্ত্র কবরের ভেতরে শুয়ে ভাবছে, আমিতো একলা এসেছি হাসপাতালে। কাউকে জানাইনি। এই যন্ত্র কবরের মধ্যে যদি মরে যাই? শরীরের সব গোপন কারাখানার নিঁখুত ছবি তোলার যন্ত্র যারা বানিয়েছে, তারা কেমন? যন্ত্র তৈরী করার সময়ে কি কি বিষয়ে তারা ভেবেছিল? ভাবনার মধ্যে আহীর অনুভব করলেন, এই কবরে শুয়ে থাকাটা বেশ আরামের। একটা ঘুম ঘুম ভাব এসেছে দুচোখে ঘুম এসেছে। ঠিক এই সময়ে আহীরকে টেনে বাইরে আনে টেশনিশিয়ানরা।
কাজ শেষ?
হ্যাঁ। নামুন।
আহীর উচু বেঞ্চ থেকে নেমে রুমের বাইরে এসে দাঁড়ায়। তাহলে? মৃত্যু বা কবর এই রকম? ভালোইতো, যদি এইভাবে মারা যাওয়া যায়! টেকশনিয়ান জানায়, আগামীকাল দুপুরের পর রিপোর্ট পাবেন।
আহীর মৃত্যুভাবনাকে সঙ্গে করে বাইরে আসে হাসপাতালের। বাহ, বাইরের মানুষদের কী ভীষণ ব্যস্ততা। মানুষদের ব্যস্ততার মধ্যে মিশে যান আহীর আলম নিজেও। পরের দিন রিপোর্ট এনে ডাক্তার আকতার কে দেখালে, ডাক্তার হাসি হাসি মুখে বলেন, যা ভেবেছিলাম ভাই।
কী ভেবেছিলেন?
অপারেশন লাগবে, টেবিলের উপর এমআরআই রিপোর্ট বিছিয়ে দেখান ডাক্তার আঙুল নির্দেশ করে, এই যে আপনার মেরুদন্ড। এইখানে ছয় নম্বর উপরে ডিক্স উঠে গেছে। উপরে উঠে আপনার স্পাইনাল কডের উপর আঘাত করছে। ফলে আপনি হাঁটতে পারছেন না। অপরারেশন করে এই ডিক্সটাকে জায়গামতো ফিট করে দেবো।
হাসাপাতালে কতো দিন থাকতে হবে?
দশদিন।
দশদিন পর ওকে?
হ্যাঁ,আপনি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বাসায় চলে যাবেন।
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ যখন অস্বাভাবিক অসুস্থ হয়, তখন ডাক্তারকেই বিশ্বাস করতে হয়। এ ছাড়া সামনে কোনো পথ খোলা থাকে না। আহীর আলম নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। ছেলে মেয়েরা স্কুল কলেজে পড়ছে। নিয়মিত একটা চাকরি করেন। অসুস্থ হয়ে, বিশেষ করে হাঁটতে না পারা একজন মানুষের পক্ষে অভিশাপ ছাড়া কি হতে পারে? একমাত্র শুয়ে থাকলেই একটু ভালো লাগে। দাঁড়ালে কিংবা বসলে মনে হয়, গোটা শরীরের ভেতরে শত শত পেরেক ঠুকছে কেউ। অস্থির যন্ত্রনায় ছটঁফট করতে করতে আহীর আলম এসে ভর্তি হলেন ডাক্তার আকতারুজ্জামানের হাসপাতালে। ভর্তির পরের দিনই অপারেশন করলেন ডাক্তার। অপারেশনের পর বললেন, আপনার ভেতরের যখমটা অনেক। আর একদিন অপারেশন করতে হবে।
আর একদিন? আহীরের মনটা দমে যায়। এই শালা ডাক্তারদের কাছে এলে, নানা ঝামেলা তৈরী করে রোগীদের উপর বাড়তি চাপ দেবেই। যখন ভর্তির কথা হচ্ছিল, তখন বলেনি যে, অপারেশনটা ক্রিটিক্যাল। দুইবার অপারেশন লাগতে পারে। অপারেশনের টেবিলে শুইয়ে বলছে, আর একটা লাগবে। টাকাও বাড়বে। মনটা খিচরে যায়। বিবিক্ত মন নিয়ে কেবিনে আসে আহীর আলম। দুই দিন পরে আর একটা অপারেশন হয়।
হাসপাতালে আহীর আলমকে থাকতে হয়েছিল আঠাশ দিন। অথচ ডাক্তার অপারেশনের আগে বলেছিল, থাকতে হবে দশদিন। মূল সমস্যা হচ্ছিল, সোজা হয়ে হাঁটতে পারছিলেন না। ডানে বাঁকা হয়ে হাঁটছিলেন আহীর। ব্যপারটা যে স্বাভাবিক না, বুঝতে পেরেছিল ডাক্তার। শুরু হলো বাঁকা সোজা করানোর জন্য থেরাপী। এক নাগারে কয়েকদিন চললো থেরাপী, ঔষধে কিন্তু লাভ তেমন হচ্ছিল না। ওদিকে সংসারেও বাড়ছিল জটিলতা। স্ত্রী রেবেকা একটা স্কুলে পড়ায়। পাচ্ছিল না ছুটি। ছেলেটা একদিন এসে আর আসেনি। বাসায় শুয়ে বসে সময় কাটায়। অথচ বাবা হাসপাতালে..। মেয়েটা স্কুল দিচ্ছে ফাঁকি। নিজের অফিসেরও ছুটির সমস্যা আছে। শেষে, জোর করেই বাসায় চলে আসে আহীর আলম। বাসায় আসার পর অনুভব করেনম বাম পাটা, হাটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ভারী হয়ে আছে। কয়েক মিনিট হাঁটলে বাম পাটাকে আর তুলুতে পারেন না। মনে হয় ওজন অনেক বেড়ে যায়, সঙ্গে শুরু হয় মাংসপেশীর ভেতরে তীব্র ব্যথা। বুঝতে পারছেন আহীর, ক্রমশ একটা জটিল টানেলের মধ্যে ঢুকে পরছেন তিনি। সঙ্গে সংসারও। ডাক্তারের কাছে তিনি একই কথা বলছেন, রেস্ট আর থেরাপী হচ্ছে আপনার একমাত্র চিকিৎসা।
ঠিক আছে, কিন্তু কতোদিন চলবে এই থেরাপী চিকিৎসা?
যতদিন ভালো না হন, নির্বিকার উল্টর ডাক্তার আখতারুজ্জামানের।
মনে হচ্ছে, ডাক্তারের কাছে আসাটাও পছন্দ করছেন না। অথচ গ্যাড়াকলে আটকে গেছেন আহীর আলম। যে আহীর আলম পুরো ঢাকা শহর চিনেছেন পায়ের উপর ভর করে, হেঁটে হেঁটে, সেই পা এখন বিপরীত। পা আর হাঁটতে চায় না। অফিস থেকে আরও দশ দিনের ছুটি নিয়েছেন। সারাদিন বাসায়, বাসায়ও না কেবলমাত্র ড্রয়িংরুমে বসে, টিভি দেখে, বই পড়ে একটা মানুষ কতোটা সুস্থ থাকতে পারে? অস্থির অপেক্ষা, কখন কবে পা ফেলে আগের মতো স্বাভাবিক হাঁটতে পারবেন? ড্রয়িংরুমের দারজায় দাঁড়িয়ে দেখে বাইরের মানুষের হাঁটাচলা। কি চমৎকার, মানুষগুলো নির্বিকার হেঁটে যাচ্ছে. কথা বলছে। আর আহীর আলম? আহীর আলম বাম পায়ের উপর জীবনের সমস্তকিছু ছেড়ে দিয়ে বাসার মধ্যে সেদ্ধ আলুর মতো বসে আছেন। স্ত্রী রেবেকাও বিরক্ত। অথচ এই রেবেকা কতো বলতো, অফিসের পর বাইরে তোমার কি কাজ? কেবলতো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা? সন্ধ্যার পর বাসায় চলে আসো। মেয়েটাকে নিয়ে একটু পড়াতে বসতে পারো..
রেবেকার এই আর্তি আহীরের মনে রেখাপাত করেছে। হ্যাঁ, রেবেকাতো ঠিকই বলেছে। বাসায় এসে মেয়েটাকে নিয়ে সত্যি বসা দরকার। মেয়েটা পড়ায় খুব ফাঁকি দিচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে বাইরের আড্ডা কমিয়ে দেবো। কিন্তু আহীর আলম এই সিদ্ধান্ত কোনোদিন বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। বন্ধুরা আগেই পথ আটকে থাকে। নিজেরও কিছু কাজ থাকে। একবার আড্ডায় বসলে কখন যে সময় কেটে যায়! সেই আহীর আলম এখন বাসায়, দিনরাত বাসায়। কিন্তু বাসার সবাই কিছুটা হলেও বিরক্ত। স্থান কাল পাত্র ভেদে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। গতকাল সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আহীর আলম বাথরুমে গেলেন, জামাটা গায়ে দিয়ে বাইরে বের হলেন। কতোদিন পত্রিকা স্ট্যান্ডে যান না। বিশেষ বিশেষ দিনে তিনটা চারটে পত্রিকা এনে সারাদিন ধরে পড়েন। কেউ কি জানতে চেয়েছে, সেই মানুষটি আসছে না কেনো? বুঝতে পারেন আহীর, দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের তুলনায় তিনি কতো সামান্য। কতো অকিঞ্চিৎকর? কে কাকে মনে রেখেছে? নিজের পিতাকে মনে পড়ে? জন্মদাতা পিতা কতো ভালোবাসতেন, সেই কবে তিনি মারা গেছেন, দিনেতো ভালো সপ্তাহে একবারও মনে পড়ে না। বাবার বাবা, দাদার নামটা প্রায়ই ভুলে যান আহীর আলম। অনেক কষ্ট করে মনে করেন। দাদীর নামটা তো জানেেই না। অথচা তাদের কারণেই, এই পৃথিবীর…। পত্রিকা স্ট্যান্ডে হেঁটে এলেন। যদিও খুব কষ্ট হচ্ছিল বাম পাটা ফেলতে, কিন্তু লোকে যেন বুঝতে না পারে, এই যে মানুষটা আসছে হেঁটে, তার বাম পা ফেলে হাঁটতে পারছে না। কিন্তু কি আশ্চর্য, পত্রিকার স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই পত্রিকাওয়ালা ছেলেটা প্রশ্ন করে, কি হয়েছে আপনার? খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন কেনো?
পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে আাহীর আলম বলেন, পায়ে ব্যথা পেয়েছি।
আর কেউ জানতে চাইলো না খুঁড়িয়ে হাঁটার ঘটনাটা। দোকান থেকে বছরের পর বছর চাল ডাল আটা কেনেন, যে দোকানদারের কাছ থেকে পিঁয়াজ মরিচ কেনেন, যে মুচি শংকর, প্রায় দুই এক মাস পর জুতো রং করে, যে চায়ের দোকানে বসে ছুটির দিনে চা পান করেন, কেউ তাকায়নি একবারও। জিজ্ঞেসতো পরের ঘটনা। আহীর আলম আসলে বিপরীত ভাবনায় তাড়িত, তিনি চেয়েছিলেন কেউ যেনো বুঝতে পারে, বাম পায়ের কষ্টটা। তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। অথচ পত্রিকা নিয়ে বাসায় আসার পরে মনে হচ্ছে, তিনি সংসারে খুব ফালতু আর অপ্রয়েজনীয়। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে মনে হলো শরীর থেকে বাম পা টা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তীব্র ব্যথায় হাউমাউ কাঁদতে পারছেন না। শরীরের সঙ্গে শরীরের এ কেমন শত্রুতা? বাসায় ঢুকে দেখলেন, স্ত্রী এখনও গভীর ঘুমে। মেয়ে আর ছেলে চলে গেছে স্কুল আর ইউনিভারসিটিতে। না, বাম পা আর শরীরে রাখবেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে বিছানা থেকে নামেন। ধীরে ধীরে রান্নাঘরে ঢুকে হাতে নিলেন বটি। বসলেন মেজেতে বাম পা ছড়িয়ে।
প্রিয় বাম পা আমার.. তোকে নিয়ে আমি মাইলের পর মাইল হেঁটেছি, কতো দেখেছি, কতো চিনেছি.. আজ তোকে আর আমি আমার সঙ্গে রাখবো না, জীবনের কতো কিছুইতো চলে গেছে, আরও যাবে.. তুইও যা..আহীর আলম বাম পায়ের উপর চালিয়ে দিলেন বটি, একের পর এক, যেভাবে কোরবানীর গরুর পা কাটেন কসাই , সেইভাবে…অবাক ঘটনা, পা কেটে প্রবল রক্ত বের হচ্ছে, কিন্তু তিনি একরত্তিও ব্যথা পাচ্ছেন না।
ব্যথা কেনো পাচ্ছি না? আহীর আলম আরও জোরে, শরীরের যাবতীয় শক্তি নিয়ে পায়ের উপর বটি চালাচ্ছেন, শরীর থেকে বাম পা প্রায় বিচ্ছিন্ন, কিন্তু ব্যথা নেই..।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে রান্নাঘর, রান্নাঘরের দরজা পার হয়ে রক্ত ছুটে যাচ্ছে বড় রাস্তার দিকে…