উড়াও শতাবতী (১০) মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
১৫ মে ২০১৮ ১৮:৩১
দ্বিতীয় অধ্যায়
সাঁ সাঁ বাতাসের বিপরীতে বড় বড় পা ফেলে বাড়ির পথে এগুচ্ছে গর্ডন। চুলগুলো উড়িয়ে পেছনে ঠেলে দিয়েছে দমকা হাওয়া। এতে তার প্রসস্ত কপাল আরও বড় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। উল্টোদিক থেকে আসা পথিকদের সামনে ভাবসাবের কমতি হয়ে না যায় সে ব্যাপারে চুড়ান্ত সচেতন। আর তেমনটা হচ্ছে না বলেই সে নিশ্চিত। এখন যে ওভারকোটটি পরে নেই, আর তা যে স্রেফ ইচ্ছা করেই- সেটা ওরা বুঝতে পারছে বলেই ঠাহর করছে গর্ডন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে মোটে ১৫ শিলিংয়ের ছেঁড়াখোঁড়া ওভারকোটটি সে পরতেই চায়নি।
উইলোবেড রোড, এনডব্লিউ-কে বস্তি এলাকা বলা যাবে না, তবে ঘিঞ্জি বটে। আসল বস্তির দেখা মিলবে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথে। টেনামেন্টের ঘরগুলোতে এক বিছানায় পরিবারের পাঁচজন করে শোয়। কেউ মারা গেলে যতদিন সৎকার না হচ্ছে ততদিন রাতে মরদেহ নিয়েই ঘুমোয় তারা। গলি পথে ভাঙ্গাচোরা দেয়ালের ওপর পনেরো বয়ষ্কা ছুকরিদের ঠেসে ধরে ষোল বয়ষ্ক ছোকরারা জাপ্টাজাপ্টি করে, চুমু খায়। সে তুলনায় উইলোবেড রোড কিছুটা হলেও নিম্ন-মধ্যবিত্তের ভদ্রস্ততা ধরে রাখতে পেরেছে। একটি বাড়িতে-তো ডেন্টিস্টের নামফলকও চোখে পড়বে। জানালায় লেসওয়ালা পর্দা ঝোলে দুই-তৃতীয়াংশ বাড়িতে। তার মাঝেই একটি বাড়ি। সবুজাভ ফলকের ওপর রূপালি হরফে ‘অ্যাপার্টমেন্টস’ লেখা বাড়িটির জানালা গলিয়ে বাইরে ঝুলে থাকা শতাবতীর পাতাগুলো চোখে পড়ে।
মিসেস উইসবিচ, গর্ডনের বাড়িওয়ালী। ঘর ভাড়া দিতে একা থাকেন এমন ভদ্রলোকেদেরই পছন্দ তার। পছন্দ নয়, বলতে হবে এর ব্যত্যয়ই হয় না। ঘর বলতে একেকটা কামরা, এক বিছানা। তাতেই বসা, তাতেই ঘুম। গ্যাস লাইটের আলো। রুম গরম করার ব্যবস্থা নিজ নিজ থাকলেও গোসল সবার এক গিজারে। আঁধারাচ্ছন্ন ডাইনিং রুমে সবার খাবারের ব্যবস্থা। থকথকে জমে থাকা সসের বোতলগুলো টেবিলের মাঝ বরাবর শোভা নষ্ট করে চলে। অপরাহ্নিক ডিনার সারতেই এখন ঘরে ফেরা গর্ডনের। এ জন্য সপ্তাহে তাকে গুনতে হয় ২৭ পেন্স ৬ পেনি।
দরজায় ৩১’র নম্বর প্লেট। ওপরের ফাঁক গলে গ্যাসলাইটের হলুদ আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। পকেট থেকে চাবি বের করে কি-হোলে বসালো গর্ডন। এ ধরনের তালাগুলো একবাক্যে খুলে যাবে এমনটা হবার নয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন ছোট্ট হলওয়েটি বস্তুত হাঁটার পথমাত্র-ঢুকতেই থালাবাসন ধোয়া পানি, বাঁধা-কপি, ছাতরা ধরা পাটি, আর স্যাঁতস্যঁতে শয়ণকক্ষের গন্ধরা মিলে একযোগে একটা ভুরভুরে বোঁটকা গন্ধ উপহার দিলো। হলস্ট্যান্ডের ওপর একদা নকশাখচিত টোল খাওয়া ট্রেটির ওপর নজর পড়লো গর্ডনের। নিশ্চয়ই কোনো চিঠি নেই। মনটাকে আগেভাগেই বলে রেখেছে, কোনো চিঠির প্রত্যাশা যেন না করে, কিন্তু মন কি আর তার কথা শোনে? প্রত্যাশা করেই চলে।
বেদনার নয় যেন একটা টকটক অনুভূতি ধরে থাকলো বুকটা জুড়ে। একটা চিঠি রোজমেরি লিখতেই পারতো! আজ চারদিন হলো কোনো চিঠি নেই! ম্যাগাজিনগুলোকে বেশ ক’টা কবিতা পাঠিয়েছিলো, ওরাও কোনো উত্তর দিচ্ছে না। ঘরে ফিরে একটি চিঠি পেলে আজ এই সন্ধ্যাটা তার জন্য সহনীয় হয়ে উঠলেও উঠতে পারতো। কীই বা এমন চিঠি সে পায়! সপ্তাহে চার কিংবা পাঁচটি, তার বেশি তো নয়! পেতোই না হয় আজও একটা!
হলের বামদিকে বৈঠকখানা। অব্যবহারে পড়ে থাকে। এরপর সিঁড়ি। এর পেছনটা দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পথ নেমে গেছে। মিসেস উইসবিচের ঘরও ওই পথেই। সে পর্যন্ত অবশ্য অন্য কেউ মাড়ায় না। গর্ডন ভেতরে ঢুকতেই প্যাসেজের শেষ মাথায় দরজাটি ফুট খানেক ফাঁকা হয়ে গেলো। তা গলিয়ে বের হয়ে এলো মিসেস উইসবিচের মুখখানি। গর্ডনের ওপর সন্দ্বিগ্ধতার ঘিনঘিনে দৃষ্টি ফেলে রাখলো কিয়ৎক্ষণ। আবার ভেতরে ঢুকে গেলো মাথাটি। রাত ১১টার আগে এই পথে ঘরে ঢুকবেন কিংবা বের হবেন মানেই হচ্ছে- এমন সন্দেহমাখা দৃষ্টি আপনাকে পড়ে নেবে। মিসেস উইসবিচ আসলে কী দেখেন তা বোঝা দায়। হতে পারে- কোনো নারীর হাত বগলদাবা করে আপনি ঢুকে পড়লেন কী না, সেটাই দেখার বিষয়। এ এক কুটিলমনা নারী। বয়স পয়তাল্লিশের কাছাকাছি, মোটাসোটা হলেও বেশ সচল। গোলাপি মুখমণ্ডলের গড়নটা খারাপ নয়, ধুসর-সুন্দর চুল তবে ভয়াবহ এক সন্দ্বিগদ্ধতা মুখমণ্ডলে ঝুলে থাকে সারাক্ষণ, যেন ভীষণ অসন্তোষ তার মনে।