ছায়াদাহ
১৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:৪৩
১.
১২ বছর পর সে আকাশের দিকে তাকালো সরাসরি। ১২টা বছর! সে আকাশ দেখতে ভালোবাসতো কি না এ প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করা উচিত হবে না। আকাশ থাকে মাথার ওপর, বাতাস বয়ে যায়, জল ছুঁয়ে যায় মৃতকোষ।
জীবন বয়ে যায়। অনেকদিন পর সে জীবনের কাছে এসেছে, আকাশের কাছে এসেছে।
জেলখানায় থাকলে তবে বোঝা যায় খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার তাৎপর্য। একটা সময় তার মনে হতো, তাকে শুধু যদি একটা আলোকজ্জ্বল ঘরে দক্ষিণ খোলা জানালার পাশে বসে থাকতে দেয়া হতো চব্বিশ ঘন্টা, তাহলে সে আর কিছু চাইতো না বাকি জীবনে। এখন সে মুক্ত। পার্কের বেঞ্চে বসে যতক্ষণ ইচ্ছা তাকিয়ে দেখতে পারে আকাশ, দেখতে পারে সবুজ, শুনতে পারে কিচিরমিচির। পৃথিবীতে নিশ্চয়ই এখনও পাখিরা গান গাওয়া বন্ধ করে নি? পনের বছর জেল খেটে বের হবার পর একজন অনুভূতিশীল মানুষের মুক্তির অবারিত আনন্দ বুকে নিয়ে প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়া শেষ করার জন্যে পার্ক একটি চমৎকার জায়গা। প্রাণভরে আকাশ দেখে নেয়ার পরে সে অনুভব করলো যে আকাশ-বাতাস আর পাখিরা জীবনের সব ক্ষত মুছে দিতে পারে না। পনের বছরে সে হারিয়েছে অনেক কিছু। প্রেম, বন্ধুত্ব, আর্থিক স্বচ্ছলতার সুযোগ। বয়স অবশ্য এখনও খুব একটু বেশি হয় নি। সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনাটার সাথে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সে যখন জড়িয়ে যায়, তখন তার বয়স ছিলো বাইশ। মামলা-মোকদ্দমা, সাক্ষ্য-বিচার শেষে এক বছর পর রায় হলো, পনের বছরের সাজা। উত্তম ব্যবহারের প্রতিদান হিসেবে সে তিন বছরের শাস্তি মওকুফ হয়ে গেলো। তাহলে এখন তার বয়স দাঁড়াচ্ছে গিয়ে পয়ত্রিশ। এখন আর স্থগিত হয়ে থাকা ডিগ্রিটা বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। নতুন কোনো ভাষা শেখা বা গিটারে দক্ষতা আরো বাড়ানোর পেছনেও অতটা সময় দেয়ার কথা ভাববে না। ঘটে যতটুক বুদ্ধি আর শরীরে যতটুকু শক্তি আছে, তা দিয়ে একটা ব্যবসা সে দাঁড় করিয়ে নিতে পারবে। হতে পারে সেটা প্লাস্টিকের সামগ্রী বিক্রয়ের, অথবা মধ্যপ্রাচ্যে মানুষ পাঠানোর। সে জানে, জীবন নিয়ে আশাবাদী হতে দোষ নেই, আর ঘুরে দাঁড়ানো এতটা অসম্ভব কিছুও না। সবই হবে। শুধু পাওয়া যাবে না হারানো মানুষটাকে।
মনিকা এখন কোথায় আছে? তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? জীবন পূনর্নির্মাণ সম্ভব। হতাশা কাটিয়ে মূল স্রোতে মিশে যাওয়া অবাস্তব কোনো লক্ষ্য না। যা কিছু হারিয়েছে, তার সবই পুনরুদ্ধার করার মতো মনোবল তার আছে। পরিশ্রমের সাথে একটু সৌভাগ্যের পরশ চাই শুধু। তবে পৃথিবীর সব সৌভাগ্য তার পায়ে লুটিয়ে পড়লেও মনিকাকে পাওয়া যাবে না। বারো বছর অপেক্ষা করে থাকার কিছু নেই। এতদিন কোনো যোগাযোগও হয় নি। মনিকা মিশে গেছে হাওয়ায়। হয়তো বা হীরকচূর্ণ হয়ে মিশে গেছে ধূলিকণায়, হয়তো বা ছেড়া ফুলের পাঁপড়ি হয়ে পদপিষ্ট হচ্ছে এঁদোপথে। জানার উপায় নেই। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসা সম্ভব হয় নি। তাকে জানানো যায় নি আগামী বছরগুলিতে সে কোথায় থাকতে যাচ্ছে। মনিকা নিশ্চয়ই ভেবেছে, খুব ঠকিয়ে পালালো ছেলেটা! এরপরেও কী করে আশা করা যায় যে মনিকা এতদিনেও তার জন্যে অপেক্ষা করে রইবে? বংশবিস্তারের তীব্র স্পৃহা নিয়ে মানবজাতি পাগলপারা হয়ে খুঁজতে থাকে উর্বর অংশীদার। মনিকাই বা বাদ যাবে কেন? মনিকার প্রতি তার কোনো দাবী নেই সঙ্গত কারণেই। তবে এই অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা সহজে যাবে না, হয়তো বা কখনই না, নিজের সংসার হলেও না, সন্তান সন্ততি হলেও না। জেলে যখন ছিলো তখন খাওয়া-পরা, আকাশ দেখতে না পারার যন্ত্রণা, আরামদায়ক তোষক-বালিশের অভাব, এগুলি থেকে মুক্তির অপেক্ষায় দিন গোণাই মুখ্য ছিলো। মনিকাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট একটা সময় গৌণ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কষ্ট থেকে মানবজাতির মুক্তি কখনই মেলে না। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই সে প্রাণভরে আকাশ দেখা শেষ করে সে রওনা দিলো তার বাসস্থানের উদ্দেশে।
তবুও জীবন চলে যায়। অথবা চালিয়ে নিতে হয়। তাই না?
২.
কিছুদিনের ভেতর আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করার জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবস্থা করে দিল। আইডি কার্ড, ব্যাংক একাউন্ট, মোবাইল ফোন সব হয়েছে। বারো বছরে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়া পৃথিবীর নিয়মকানুন রপ্ত করে মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার কসরত করতে গিয়ে সে কিছুটা লাঘব করতে পারলো তার অন্তর্লীন বেদনা। এই জগৎ এখন আরো প্রতিযোগিতাময়, মানুষজন আরো কৌশলী। এদের সাথে টিকে থাকতে হলে নিজেকে হালনাগাদ করার বিকল্প নেই। ব্যাংক থেকে ডেবিট কার্ড নিয়ে এসে মোবাইল ফোনটা পকেটে করে রিকশায় করে যেতে যেতে তার মনটা এমন কী কিছুটা ফুরফুরে হয়ে গেলো! অপ্রাপ্তি, বেদনা, অবক্ষয়ের মধ্যেও রোদ এসে ঝলকনি দেয়, মৃদু বাতাস বয়, ফুলার রোডের বুক চিড়ে তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায় জীবনের দিকে।
মন্দ কী! জীবন কি আর থেমে থাকতে পারে?
পাশে একটা এটিএম বুথ দেখে তার শখ হলো কিছু টাকা তুলতে। দরকার নেই, তবুও। কিছু নগদ টাকা থাকুক না পকেটে! মন ভালো থাকবে এতে। রিকশা থামিয়ে সে ঢুকে গেলো বুথে। পিনটা যেন কত? ৪৯৯৩। এটিএম মেশিনটা প্রথমে একটু বুঝে নিতে কষ্ট হলো তার। বাটনের বদলে এখানে হাতের স্পর্শ দিয়ে কাজ চালাতে হয়।
Please insert your card.
নারীকন্ঠে বার্তা এলো।
যান্ত্রিক কণ্ঠ, কিন্তু ঠিক যান্ত্রিকও না। একটু কেমন যেন কাব্যিক, একটু যেন গোলমেলে? গোলমেলেই বা হবে কেন?
Enter your PIN
এটা মনিকার কণ্ঠ। এজন্যেই গোলমেলে লাগছিলো। এক লহমায় সে চলে গেলো ভালোবাসার দিনগুলিতে।
-প্লিজ ফোন রাখো।
একবার কোনো এক ঝগড়াঝাটির সময় এমন সুরেই বলেছিলো মেয়েটা। তার কথায় ঝাঁজ ফুটতো না তেমন। একটু আদুরে ধাতব ঝংকার থাকতো। আচ্ছা, ঝগড়াটা যেন কী নিয়ে ছিলো? মনে পড়ছে না। উদ্যানে আসার কথা বলে দেরি করে ফেলেছিলো? না কি অন্য নারীর দিকে অযাচিত আগ্রহে তাকিয়ে ছিলো? মনিকা, তুমি না হয় একেবারেই চলে যেতে! এই ডিজিটাল কারাগারে অদৃশ্য হয়ে থেকে আমাকে অস্থির করে কী আনন্দ পাচ্ছো বলো? সে অনুযোগ করে বলে। জবাব আসে-
-Please select your account type.
চুপ করো মনিকা! ভালো লাগছে না এসব। আর কত ভুগতে হবে আমাকে?
-Select your amount
এইসব বিচ্ছিরি কালো কৌতুক আর ভালো লাগছে না তার। মুঠো পাকিয়ে ঘুষি বাগিয়ে এটিএম মেশিনটাকে ভেঙে ফেলতে চাইলো সে।
-আপনের কি আরো সময় লাগবো?
বিলম্ব দেখে তদন্ত করতে আসা গার্ড দেখে মেশিনটার দিকে মারমুখী ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করছে সে।
-মেশিনটায় একটু সমস্যা হচ্ছে। বাজে মেশিন। অনেক পুরোনো না কি?
অভিযোগ জানালো সে।
-কী কন পুরানো! সেইদিন আইসা লাগায়া দিয়া গেছে। কী সমস্যা হইছে দেখি?
কর্তব্যসচেতন গার্ড এগিয়ে আসে সরেজমিনে দেখার জন্যে।
-এই তো এখন কাজ করছে। মেশিনের ওপর আসলে বিশ্বাস করা যায় না।
স্বগতোক্তি করলো সে।
বিদ্রুপ আর সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকা গার্ডটাকে। অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বাঁচতে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে যাচ্ছিলো সে কার্ডটা ফেলেই। তখন মনিকা তাকে বললো,
Please take your card
আহা মনিকা! আমার মনিকা! তুমি এখনও আগের মতোই খেয়ল করে চলো আমাকে। নাহ, তোমার চলে যাওয়ার অভাব কখনই পূরণ হবার নয়। আমি না হয় তোমার স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতাম, এসব ডিজিটাল কারসাজি দিয়ে আমাকে ভড়কে দিয়ে কী পেলে বলো! এখন আমি চাইলেই তোমাকে শুনতে পারবো বারবার। সেই একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দ আমার স্মৃতির দীঘিতে একেকসময় একেকরকম সঞ্চালন তৈরি করবে। এইটুকু জটিলতা না থাকলে আমার জীবন সহজতর হতো। তারপরেও, শেষপর্যন্ত তোমাকে ধন্যবাদই দিবো। ফিরে ফিরে কোথাও আসার একটা উপলক্ষ্য তো করে দিলে তুমি! এটা আমার দরকার ছিলো।
ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে যায় সরোষে অপেক্ষমান রিকশাওলার দিকে। এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার জন্যে তাকে কৈফিয়ত এবং ক্ষতিপুরণ দিতে হবে নিশ্চয়ই!
৩.
ফুলার রোডের সেই এটিএম বুথটা তার বাসা থেকে বেশ দূরে। তার বাসা থেকে নিকটতম দূরত্বে ওটাই অবস্থিত। তার কার্ড দিয়ে অন্য ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তোলা যায় না। এই সমস্যা দূর করতে সে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলো ব্যাংকে। বুথের অপ্রতলুতা কেন, তার জবাব চাইছিলো সে। তারা প্রথমে তাকে পাত্তাই দিতে চায় নি। এ টেবিল ও টেবিল ঘুরিয়েছে। কোনো টেবিলের কেউই জানে না কার কাছে গেলে সঠিক সমাধান পাওয়া যাবে। এই ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারে নি। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করে এসেছে ব্যাংকের লোকজনের সাথে। একজন একটা সহজ এবং যৌক্তিক পরামর্শ দিয়েছিলো। সেটা হলো, কার্ডটা আপগ্রেড করে ফেলা। তাহলে যেকোনো বুথ থেকেই টাকা তুলতে পারবে। এরকম একটা সহজ সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে বলেই ব্যাংকের লোকেরা আশা করেছিলো। সেও প্রায় মেনেই নিতে চলেছিলো, কিন্তু চকিতে তার মনে আবার সংশয় তৈরি হলো। অন্য ব্যাংকের বুথেও কি মনিকার কণ্ঠ থাকবে? যদি না থাকে, তাহলে তো লাভ নেই। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে অযথা তর্ক শুরু করলো সে। আরেকটু হলে তো মারামারিই লেগে যেতো। সিকিউরিটিকে ডাকতে বাধ্য হয়েছিলো তারা।
এই চণ্ডাল রাগটাই তার বড় শত্রু। এর কারণেই বারো বছর…
তবে শেষ পর্যন্ত সে মাথা ঠান্ডা করে যৌক্তিক ভাবনায় মনোনিবেশ করতে সক্ষম হলো, এবং পরেরদিন কার্ড আপডেট করতে দিয়ে দিলো। ছোট্ট চৌখুপিগুলিতে গিয়ে সে ক্ষণিকের জন্যে যন্ত্রের কাছ থেকে উপহার নেবে বেঁচে থাকার রশদ।
আজকে সে নতুন কার্ড পেয়েছে। ব্যাংকে কিছু টাকা জমা দিয়েছে। যেন প্রয়োজনে তোলা যায়। অল্প কিছু টাকা জমা দেয়া হয়েছিলো, সেটা প্রায় শেষের পথে। ক্লাস পালানো কিশোর ছেলে যেমন গোপনে প্রেমপত্র লুকিয়ে রেখে ঢিপঢিপ বুকে অপেক্ষা করে প্রেমিকার জন্যে, নতুন কার্ডটা হাতে নিয়ে তার অবস্থাও অনেকটাই সেরকম হলো। তবে সে তো এখন পরিণত মধ্যবয়স্ক পুরুষ। তার অত তাড়াহুড়ো করলে কি চলে? সে সময় জমা রাখলো বিকেলের জন্যে। এখন সে ভালো শার্ট পরে নেই। সুগন্ধী দেয়া হয় নি। চুল হয়ে আছে উশকোখুশকো আর নোংরা। এভাবে কি মনিকার কাছে যাওয়া যায়?
একটা আয়েশী ভাতঘুম শেষে শরীরভরা আরামদায়ক আলস্য নিয়ে সে বিকেলে ঘুম থেকে উঠে তৃপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে রইলো জানালা ভরা আকাশের দিকে। আকাশ আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে আসছে তার জীবনে। অসময়ে স্নান করতে ঢুকে সময় কাটালো বেশ খানিকক্ষণ। যত্ন নিয়ে শ্যাম্পু করলো। অযাচিত লোমগুলি চেছে নিলো। মুখমণ্ডলকে উজ্জ্বল করার জন্যে ব্যবহার করলো প্রসাধন। মনে পড়লো, এইসব প্রসাধনের নাম তাকে মনিকাই শিখিয়েছিলো। সে তাকে বলেছিলো কোনো এক সোমবারের সন্ধ্যায়,
-এরপর সেলুনে গেলে ফেসওয়াশটা করে নিও। গ্লেজ দিবে তোমার মুখ।
সে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলো। এসব মেয়েলী আবদারকে পাত্তা না দেয়ার মতো পুরুষালী ব্যক্তিত্ব তার যথাযথভাবেই ছিলো। এখন বয়স হয়েছে। একজন সত্যিকারের পুরুষ হওয়ার জন্যে নমনীয়তা আর কোমলতার প্রয়োজনীয়তা সে অনুধাবন করেছে। শুষ্ক ঠোঁটে ভ্যাসলিন মেখে ফলাফলটা সন্তোষজনক মনে না হওয়াতে তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেললো। ঠোঁটটা কেমন ফোলাফোলা লাগছে। মনিকা থাকলে নিশ্চয়ই ফিক করে হেসে দিয়ে বলতো, “এ মা, কেমন গাম্বুশ দেখাচ্ছে!”। থাকগে, অত কায়দাকেতা করার সময় নেই তার। একদিনে সব শেখা যায় না। ঘড়ি দেখে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেলো সে।
দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বাসার কাছেই একটা বুথ আছে। সরকারী ব্যাংকের। চেহারা-ছবি ভালো না। তাতে কিছু এসেও যায় না। যেতে পথে দেখা হলো এলাকার একজন বয়োজৈষ্ঠের সাথে।
-কই যাও সাইজাগুইজা?
কৌতূহলে, অথবা নিছক অর্থহীন সৌজন্যতার খাতিরে করা প্রশ্নটি তার।
-এই তো, এদিকেই।
বলতে গিয়ে ঢোক গিললো সে। কাউকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। অবশ্য বুঝলেও বা কী এসে যায়! বারো বছর আগের লাজলজ্জা কি এখন আর অবশিষ্ট আছে? সমাজে এখন বেড়ে গেছে অবক্ষয়। এ নিয়ে একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কলাম পড়েছে সে সেইদিন পত্রিকায়।
সরকারী ব্যাংকের বুথটায় কার্ড ঢোকানো, টাকা বের করা, সব ঠিকঠাকভাবেই সম্পন্ন হলো বটে, তবে সেখানে কোনো কণ্ঠ ছিলো না কারও। একটা এটিএম মেশিন কীভাবে কন্ঠস্বর ব্যতীত চালু করতে পারে এরা? মানুষের কতটা সমস্যা হতে পারে এতে এগুলি তারা একবারও ভাববে না? এ ব্যাপারে কার সাথে যোগাযোগ করা যায়? ভেবে বের করতে হবে তাকে। বিরসমুখে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে কর্তব্যরত গার্ডের দিকে কড়াচোখে তাকিয়ে সে গেলো পরবর্তী বুথে। এটা অন্য একটা ব্যাংকের। বেসরকারী। এই বুথটায় ঠাঁটবাট আছে। বাইরে উদ্ভিন্নযৌবনা মডেলকন্যার ছবি টানানো আছে। সে উক্ত ব্যাংকের সাথে লেনদেন করার আহবান করছে। সাড়া দেয়া যাক তবে সে আহবানে!
লাজুক ভঙ্গিতে কার্ড ঢোকালো সে।
-Please insert your card correctly.
ধমক দেয়ার ভঙ্গিতে বললো এখানকার নারীটা। কার্ড উল্টোভাবে ঢুকিয়েছে তাতে এভাবে ধমকানোর কী আছে? মনিকা হলে কখনই এভাবে বলতো না। এই ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ভালো না। এদের সাথে সে আর জীবনেও লেনদেন করবে না। এই পণ করে সে গটগট করে বুথ থেকে বের হয়ে এলো। তাকে শেষপর্যন্ত ফুলার রোডের ঐ বুথটাতেই যেতে হবে, বুঝতে পারছে। মনিকা অপেক্ষা করে আছে। অন্যখানে সময়ক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। একটা যান্ত্রিক যান ডাকলো সে। ভাড়া যা চাইলো তাতেই রাজী হয়ে উঠে গেলো।
দেরি হয়ে যাচ্ছে।
৪.
এক বছরের মধ্যে সে মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে তার জীবন। সবাই তাকে বলে আগের চেয়ে অনেক নিয়ন্ত্রণসম্পন্ন, ধৈর্যশীল এবং ইতিবাচক। জেল থেকে বের হবার পর প্রযুক্তি বিষয়ক যেসব দ্বন্দ্ব তাকে মানসিক দোদুল্যমানতার মধ্যে ফেলেছিলো, সেসব থেকে সে এখন মুক্ত। মানে প্রায় মুক্ত। অতীত এবং অবসেশন নিয়ে পড়ে থাকার মানে নেই। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। নিজের একটা সংসারের অভাব অনুভব করে সে। এখন সে মোটামুটি প্রস্তুত একটি পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার জন্যে। আজ সে যাচ্ছে একটি কফিশপে। বিয়ের পাত্রী দেখতে। ওখানে দু পরিবারের মানুষজনই আছে। কিছুক্ষণ খাবার দাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করার পর তাদের দুজনকে নিভৃতে কথা বলার সময় দেয়া হবে, এটাই পরিকল্পনা সবার। জৈবিক তাগিদে এবং নিজের জীবনকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে বিয়ের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না বটে, তবে লাজুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার রহস্য ভাঙার সেই দুর্নিবার আকর্ষণ আর সে অনুভব করছে না। হতেই পারে এটা। এখন তো আর সে অপক্ক তরুণ নেই! জীবনে ঘটে গেছে কত বাঁকবদল, কতভাবে খেয়েছে পোড়! জেলখাটা একজন আসামীর জন্যে; এমনও না যে একদম নিরপরাধ ছিলো-, এরকম কারো জন্যে কনে পাওয়া কঠিন বটে। তবে পারিবারিক খুঁটি আর সমাজে শক্ত অবস্থানের জেরে সেটাও অতিক্রম করা সম্ভব। শুধু জেল খাটার গল্পটায় একটু বাড়তি নাটকীয়তা যোগ করতে হবে, যেন তার প্রতি ওদের সহানুভূতি জন্মে। সে প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে।
লজ্জা ভেঙে মেয়েটা অনেক কথাই বললো। পছন্দ-অপছন্দ, অতীত, সবকিছু নিয়ে খোলাখুলি আলাপ হলো। এরকমই ভালো। এই বয়সে লাজনম্র মনিকার আশা করে লাভ আছে? হিসাব করেই না হয় রচনা করা হবে প্রেম আর যৌনতার নতুন অধ্যায়। মেয়েটাকে ভালোই লাগলো তার। মেয়েটারও হয়তো বা মন্দ লাগে নি তাকে খুব একটা। ফোন নাম্বার বিনিময় হলো। রাতে কথা হবে নিশ্চয়ই! হয়তো কিছু একটা ঘটবে সুন্দর।
মেয়েটার নাম তানিয়া। তানিয়া রাশিয়ান নাম। তুমি কি এসেছো তুন্দ্রার বরফ থেকে, তানিয়া?
৫.
চাঁদের আলোয় আলোকিত রাজপথে সে হেঁটে চলেছে ফুরফুরে মনে। অনুভব করছে কিছুটা চঞ্চলতা। অনেকদিন পর তার মনে হচ্ছে শরীরের আড়ষ্টতাগুলো ভাংছে। এমন একটা জীবনের জন্যেই না সে গত তের বছর অপেক্ষায় ছিলো? রাজধানীর রাজপথে বেশিক্ষণ স্বস্তিতে হাঁটার জো নেই। এ ওর গায়ে এসে পড়বে, সে হাঁটবে ধীরে সামনের জায়গা দখল করে, ফুটপাথে কেউ উঠিয়ে দেবে মোটরবাইক, চাঁদের ছায়া খন্ডিত হয়ে পড়ে থাকবে নর্দমার পাশে। অনেকক্ষণ হেঁটে একটু জিরোবার জন্যে সে বেঞ্চে বসে। অযথাই ফোন নিয়ে বসে থাকে। তানিয়া যদি নিজ থেকে আগে ফোন করে বসে, তাহলে কেমন হবে? মেয়েরা সবসময় কেন ভেবে নেয় যে ছেলেরাই উদ্যোগী হবে সবসময়? কিংবা একটা মেসেজও তো দিতে পারতো সে? “পৌঁছেছেন?’লিখে। মনিকা তো প্রথম দেখাতেই জিজ্ঞেস করেছিলো। আহ, থাক! মনিকার সাথে তুলনা করাটা অনুচিত। এর চেয়ে বরং দেখা যাক আজ কত স্টেপ হাঁটা হলো।
পাঁচ হাজার? মোটে?
নাহ এত কম হবার কথা নয়। স্মার্টওয়াচটা সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ব্লু টুথ চালু করলো সে।
Searching for devices
Anushkas headband
Samsung z 21 smartwatch
Monica_Moni 1983 band
Connect Now?
স্থবির হয়ে তাকিয়ে রইলো সে। তৃতীয় ডিভাইসটা মনিকার, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মনিকা আছে তার পঞ্চাশ ফুট ব্যাসার্ধের মধ্যে। পড়ে আছে একটি ফিটনেস ব্যান্ড। খুব স্বাস্থ্যসচেতন হয়েছে সে? কোথায় তুমি মনিকা?
ডানে?
বায়ে?
সামনে?
না পেছনে?
কেন সে স্থির হয়ে আছে ব্লুটুথের রেঞ্জের মধ্যেই? কেন যাচ্ছে না এই সীমানার বাইরে? সামনে বিজয় সরণীর কুখ্যাত সিগন্যাল। কতক্ষণ এখানে মনিকার বাহন দাঁড়িয়ে থাকবে ঠিক আছে? মাথা নিচু করে বসে রইলো সে। চোখ তুললেই যেন উন্মোচিত হবে রহস্য সুড়ঙ্গের অবগুন্ঠন। সে ধীরে ধীরে চোখ তুলে চাইলো। দুই কোটি মানুষের এই শহরে মনিকাকে একবার, এই একবারই হয়তো দেখার সুযোগ আসবে। মনিকা হয়তো চলে যাচ্ছে শহর ছেড়ে আজই। হয়তো সে আর ফিরবে না। হয়তো সে কালই চলে যাবে যশোর বা কুমিল্লায় কর্মস্থলে বা স্বামীর ঘরে। হয়তো আজ সে অবকাশযাপন শেষে ফিরে যাচ্ছে ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডে। অথবা এমনও হতে পারে, প্রতিদিন এই পথ ধরে এই সময়েই সে বাড়ি ফেরে তার ব্লুটুথ হেডফোনে গান শুনতে শুনতে। মনিকা গান শুনতে ভালোবাসতো। সে কি এখনও তাকে দেয়া গানগুলি শোনে? সে যখন শোনে “You could be my unintended” তার কি কিছু মনে পড়ে?
মনিকা, মনে পড়ে?
ফোন বাজছে। তানিয়া ফোন করেছে। সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। মনিকা চলে যাচ্ছে।
তার আবার এই অসময়ে আকাশ দেখার তৃষ্ণা হলো। বুক পেতে অন্ধকার দূর করার প্রয়াসে ব্রতচারী চাঁদটাকে একটা মেঘ এসে নিখুঁতভাবে দুইভাগ করে দিতে যাচ্ছে।
খন্ডিত চাঁদের ছায়ায় নতুন বাঁকবদলে শঙ্কিত হয়ে বসে থাকা জীবনকে ধরে ওঠানো যাবে কি আর?
রিং বেজে চলে ফোনের। বাজুক। বেজে চলুক। সিগন্যালটা ছাড়বে ছাড়বে মনে হচ্ছে এখন। ট্রাফিক পুলিশ উদ্যত বাঁশি নিয়ে। স্টার্ট দিয়ে বসে আছে ড্রাইভারেরা, গর্জন করাচ্ছে যন্ত্রদানবদের।
দেখা যাক আর কতক্ষণ থাকে ব্লু টুথের ডিভাইস লিস্টে সেই নামটা। যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ না হয় দাঁড়িয়েই থাকবে শাহীন।
১২ বছর জেলে কাটিয়েছে যে দুঃসহ সময়, তার কাছে এ আর এমন কী!