Friday 29 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাঙালির দুর্গা উৎসব:সমাজ-সংস্কৃতির কালপরিক্রমা


১৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:৫৫

দুর্গাপূজা আজ একটি ধর্মীয় উৎসব শুধু নয়; এটি সামাজিক উৎসব। জাতি-ধর্ম-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষের অংশগ্রহণে এটি মানুষের সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তি এবং জনগণের চাহিদা পাল্টে গেলেও এর মধ্যে লোকশিল্প বেঁচে আছে। রিচার্ড জে ফস্টার বলেছেন, ‘পূজা পবিত্র প্রত্যাশায় শুরু হয়, আর পবিত্র আনুগত্যে শেষ হয়।’

প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিচারে সিন্ধু সভ্যতার আমল থেকে মাতৃকা দেবী পূজিত হচ্ছেন। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো নগর দুটির খনন স্তূপ থেকে (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১০০০ বছর) নারী বা দেবী মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রাক-বৈদিক যুগে যেসব দেবতার পরিচয় পাওয়া যায়, তারা বেশিরভাগ ছিলেন পুরুষ। এই সময়ে হিন্দু ধর্মের প্রধান উপাস্য দেবতা তিনজন- ব্রহ্মা, বিষুষ্ণ, মহেশ্বর যথাক্রমে সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। পরবর্তী সময়ে বিষুষ্ণ ও নারায়ণ এক হয়ে যান এবং বিষুষ্ণ নামকে কেন্দ্র করে যে ধর্মান্দোলন হয়, তাতে বিষুষ্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা এবং বৈষ্ণব ধর্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আবার বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপশি শৈব ও শাক্ত মতবাদ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। নারায়ণ-বিষুষ্ণ-শিব প্রভৃতি পৌরাণিক দেবতার স্বাঙ্গীকরণের মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মে যে নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়, তাতে হিন্দু ধর্মে স্বীকৃতি দিয়ে শক্তি পূজার ভিত্তি স্থাপিত হয়। বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী, শিবের পত্নী উমা প্রভৃতি দেবীর পূজা শুরু হয়। তাই আমাদের শক্তিদেবী পুরুষ দেবতার স্ত্রীরূপ।

বিজ্ঞাপন

পুরুষ দেবতার তেজ বা শক্তি থেকে এসব দেবীর সৃষ্টি। তাই তো রুদ্রের শক্তি হিসেবে রুদ্রাণী, সব অশুভনাশিনী দানবঘাতিনী এবং একই দেবতা শিব যখন সৌম্যরূপে কল্পিত হয়েছেন তখন শক্তিদেবী স্নিগ্ধ-মঙ্গলময়ী-অভয়দায়িনী। এখানেই বোধ হয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শক্তিপূজার সঙ্গে আমাদের দেশের শক্তিপূজার পার্থক্য সূচিত হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সভ্যতা দেবীকে শুধু উর্বরা শক্তির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করলেও আমাদের দেবী পুরুষ দেবতার তেজ বা শক্তি থেকে সৃষ্ট। নবপত্রিকা ৯টি উদ্ভিদের সমন্বয়ে গঠিত শস্য দেবী মনে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু, ধান গাছের সমূল-সপত্র অথবা সপত্র-শাখা একত্র করে এক জোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বাঁধা হয়। কলাগাছটি লাল পাড়ের শাড়ি জড়িয়ে, ঘোমটা দিয়ে বধূ মূর্তিতে গণেশের বাম পাশে দুর্গাপূজার সময় রাখা হয়। আসলে নবপত্রিকা নবদুর্গা হিসেবে স্থাপিত হয় এবং প্রতিটি উদ্ভিদ দেবী দুর্গার প্রতিরূপ হিসাবে স্বীকৃত। যেমন কলাগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী, কচুগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা, হলুদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা, জয়ন্তীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী, বেলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা, ডালিমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদণ্ডিকা, অশোকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা, মানকচুর অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুন্ডা, ধানগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী।

বিজ্ঞাপন

শশীভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় তার ‘ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এই শস্য বধূ বা নবপত্রিকা দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজিত হন এবং শারদীয় পূজা শস্য পূজারই নামান্তর। আর এই শস্যদেবী পৃথিবী মাতার রূপভেদ। সুতরাং দুর্গাপূজার মধ্যে আমরা আমাদের আদিমাতা পৃথিবীর পূজা করে থাকি, বলা যেতে পারে।

বর্তমানে যে শারদীয়া দুর্গা মূর্তি পূজিতা হন, সেটি হাজার বছরের অধিক সময় ধরে বিভিন্ন মূর্তির মিশ্রণে অন্ত্য-মধ্যযুগে এসে বর্তমান রূপ লাভ করেছে, বলা যায়। অসংখ্য লৌকিক ও আঞ্চলিক দেব-দেবীর নাম পৌরাণিক দেব-দেবীর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, রণরঙ্গিণী জগত মাতার দেখ মহারণ/দশদিকে তার দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ।

আমাদের লোকাচার সংস্কৃতিতে অনেক বিষয় খুব বেশি আলোচিত হয় এবং সেসব বিষয়ও আমাদের জানা প্রয়োজন।

(ক) স্নেহময়ী মা: মাতৃকেন্দ্রিক ধর্মবিশ্বাসের গর্বিত প্রতীককে সামগ্রিকতায় আনতে মাতৃরূপে পুত্র-কন্যাসহ রণরঙ্গিণী দুর্গাকে হাজির করা হয়েছে। রোমের যুদ্ধের দেবী বোলানো মাতৃরূপে পূজিতা হন। ভারতবর্ষে শক্তিময়ী মায়ের বন্দনা বিরল নয়। ব্যাবিলনে পূজিতা ‘ওয়ার্ল্ড মাদার’ এই ধারণায় সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবীর সন্ধান দেয়। গ্রিস, এশিয়া মাইনর, ইজিপ্ট প্রভৃতি দেশেও যেসব মাতৃদেবীর সন্ধান মেলে তার সঙ্গে ‘উমা’ (দুর্গার আরেক নাম) তুলনীয় বলা যেতে পারে।

(খ) ঘরের মেয়ে: দুর্গার জনপ্রিয়তা ভালোবাসার ধন হিসেবে। প্রতিমা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে বাঙালি হৃদয়ের আত্মীয়-বিচ্ছেদ বেদনার তীব্রতা লক্ষ্য করার মতো। সে সময় ভক্তের চোখের জলের সঙ্গে বিদায়ী মেয়ের (বা মায়ের) চোখের জল একাকার হয়ে যায়।

(গ) কুমারীপূজা: দুর্গাপূজার সময় কুমারীপূজার কথাটিও উল্লেখের দাবি রাখে। কারণ কুমারী শক্তিই সৃষ্টির মূল দেবী। এটি শাস্ত্রীয় ও বাস্তবায়িত রূপ, জীবন্ত দেবীর আরাধনা, দেবীর বিশাল রূপকে ছোট আকারে শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে প্রতীক হিসেবে পূজা। তাই তো রামকৃষ্ণ দেব সারদা দেবীকে ষোড়শীরূপে পূজা করেছেন। মহাভারতের ভীষ্ফ্ম পর্বে অর্জুন দেবী কুমারীপূজা করেন। ভারতের বাইরে ভুটান, নেপাল, মিসর, গ্রিস, ইতালি প্রভৃতি দেশে কুমারীপূজার সন্ধান পাওয়া যায়।

দুর্গাপূজা আজ একটি ধর্মীয় উৎসব শুধু নয়; এটি সামাজিক উৎসব। জাতি-ধর্ম-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষের অংশগ্রহণে এটি মানুষের সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তি এবং জনগণের চাহিদা পাল্টে গেলেও এর মধ্যে লোকশিল্প বেঁচে আছে। লেখাটির ইতি টানতে চাই রিচার্ড জে ফস্টারের একটি উক্তি দিয়ে- ‘পূজা পবিত্র প্রত্যাশায় শুরু হয়, আর পবিত্র আনুগত্যে শেষ হয়।’

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর