তুলসীগাছটি যে রাতে নিহত হলো
১৯ অক্টোবর ২০২৩ ২০:১৩
বন্ধু রূপান্তর রায়চৌধুরী কয়েক দিন ধরেই আমার সময় চাচ্ছিল, আমি জানি ও কী বলবে! ওর নতুন লেখার প্রথম পাঠক বা শ্রোতা আমাকে না বানালে যেন ভাত হজম হয় না। সেই রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর থেকেই ও আমার সহচর। ওর গল্প বা নিবন্ধের মুগ্ধ পাঠক আমি। মনে মনে একটু ইতিবাচক হিংসেও করি- ওর মতো যদি লিখতে পারতাম! ইদানিং ও গল্পে বেশ নিরীক্ষা করছে। ওর মুখেই শুনতে পাই কয়েকটি ইজমের নাম। এই রিয়ালিজম, র রিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম, পোস্ট মর্ডানিজম, সুর রিয়ালিজম প্রভৃতি। আমার মন্দ লাগে না। মনোযোগ দিয়ে এসব বিষয় শুনি। আনন্দ পাই। মনের নতুন জানালা খুলে যায়। নতুন কিছু দিগন্ত দেখতে পাই। পরিবর্তিত বিশে^র সঙ্গে নিজেকে প্রবাহিত করতে না পারলে নিজে পিছিয়ে থাকব বা ও থাকবে প্রায়ই জোর দিয়ে বলে। কয়েকদিন ঘুর ঘুর করে ও একদিন ঠিকই আমার সময় বের করে নেয়। শরতের এক বিকেলে এই জেলা শহরের ঈদগাঁ মাঠে পার্টির মিটিং শেষে আামরা বসি। লেখাটা মোবাইলে লিখে এনেছে।
রূপান্তর প্রেক্ষাপটটা যখন বলল তখন আমি একটু চমকে যাই। এত পুরনো প্রেক্ষাপট! সে সময়টাও ছিল বেশ রক্তাক্ত। একাত্তরের পর ওদের জীবনে এমন নিকষ দিন আর কখনো আসেনি। ও নিজেও কখনো ভাবেনি বা ভাবে না এ ‘সংখ্যাতত্ত্ব’। দেশের সংবিধানে এমন কোনো শব্দও নেই। চলতি শতকের প্রথম বছরের প্রেক্ষাপট নিয়ে কেন নতুন করে লিখল তা আমি বুঝতে পারছি না। আবার হেলাও করতে পারছি না। এই শতকের প্রথম বছরটাই এসেছিল অশুভ শক্তির কাঁধে ভর করে। দেশে তখন নির্মল ও শান্ত বাতাসকে কলুষিত ও অগ্নিময় করে তুলেছে রাজশক্তি। পূর্ণিমার দেহ রক্তাক্ত হয় অমাবশ্যার শরাঘাতে। তাদের পরমমিত্র তখন একাত্তরের পরাজয়ের পর গর্তে লুকানো কালসাপ। তারা খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে আসে মিত্রের হাত ধরে নতুন রূপে, পুরনো স্বভাবে। রূপান্তর জাানাল লেখাটা ওই সময়েই লেখা, এতদিন কাউকেই জানায়নি বা কোথাও প্রকাশ করেনি। কেন করেনি এর সদুত্তরও ওর অজানা। জানতে চাইলাম ও কিছু বলে না।
আমি ক্ষুদ্র এক রাজনৈতিককর্মী, বন্ধু রূপান্তর রায়চৌধুরী সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিচিত মুখ। মনে হয় লেখায় আমার চেয়ে বেশি রাজনীতি সচেতন সে। যাহোক, ও গল্পটি শুরু করল। শর্ত দিলো গল্পের মাঝে একটিও শব্দ করা যাবে না, কোনো প্রশ্নও নয়। ওকে একটানা পড়ে যেতে দিতে হবে। আমি বললাম, তথাস্তু! আমি মনোযোগ দিলাম, ও শুরু করল:
‘পালক ঝরে দেখতে দেখতে কেমন কাক হয়ে গেল ময়ূরটা। কর্কশ স্বরে একটানা ডেকে উপদ্রব সৃষ্টি করে মাথার উপর ঘুরতে থাকে। একটু উপরে উঠতেই হঠাৎ উধাও! স্বস্তি বুঝি ফিরে পাওয়া গেল। নাহ,্ পরক্ষণেই দেখা গেল একঝাঁক শকুন; সঙ্গে কাকটিও। ওর বুঝতে বাকি থাকল না এটা কাকেরই আহবান। কিন্তু শকুনগুলো ওর দিকে ধেয়ে আসছে কেন? কিছুটা থমকে দাঁড়ায়, দম নেয়, বুঝতে চেষ্টা করে। হ্যাঁ, ওর দিকেই তো আসছে। নিরাপদ দূরত্বে থাকতেই ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। প্রায় কাছাকাছি আসতেই আত্মরক্ষার্থে দৌড় দেয়। ছুটতে গিয়ে আলো হারায়। আকাশে তাকাতেই দেখে কখ- কালো মেঘ সূর্য ঢেকে দিয়েছে। অন্ধকারটুকু যেন শুধু ওর মাথার ওপর। আশেপাশে আলো, অথচ ওর মাথার ওপর অন্ধকার! কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারে না। অন্ধকার সাঁতরে কোনো রকমে ঘরে ঢোকে। ঢুকতেই আত্মার পানি শুকিয়ে যায়।
মুহূর্তেই ঘরখানা খাঁচা হয়ে গেল! মুক্তির জন্য ছটফটায়; পথ খোঁজে। আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ক্লান্ত চোখে দেখতে পায় একটি বিশাল অজগর গ্রাস করতে ওর দিকে তেড়ে আসছে। ভয়ে হাত-পা কাঁপতে থাকে; চোখ বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ার্ত স্বর কণ্ঠনালী ফেটে গোঙরায় ‘ও মা…’ বলে।
‘কীরে অনিতা, কী?
ওই যে মা!’
পাশে শোয়া মা অনিতাকে ধাক্কা দেয়। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। ‘কিছু স্বপ্নে দেহে ভয় পাইছিস? বলে কপালে মাথায় সোহাগ বিলায়। ‘মা সাপ-শকুন’ ঘোরের মধ্যেই বলতে থাকে অনিতা।
‘কোন্ জা’গা সাপ-শকুন, স্বপ্নে কী না কী দেহিছিস?। উঠে বয় জল খা, সব ঠিক অয়ে যাবেনে।’
মা উঠে হারিকেন উসকে দেয়। পিতলের কলস থেকে কাঁসার গ্লাসে জল ঢালে। অনিতা জল খেয়ে পাশ বদল করে শোয়। এখনও শরীরটা কাঁপছে। স্বপ্নের কথা ভাবছে আর শিউরে উঠছে। এত ভয়ংকর স্বপ্ন ও কেন দেখল? তবে কি কোনো…! ভাবনার দরিয়ায় খাবি খায়। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থাকে, এপাশ ওপাশ করে; ঘুম ধরা দেয় না। ওপাড়া থেকে ভেসে আসা ভোরের আজানের শব্দে ঘুম আরও দূরে চলে যায়। আস্তে উঠে বসে। চৌকির নিচ থেকে হারিকেনটা তুলে টেবিলে রাখে। বইয়ের দিকে নজর পড়তেই কান্না চেপে বসে বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। অনিমেষ তাকিয়ে থাকে বইগুলোর দিকে। ক’দিন কলেজে যেতে পারছে না। বাবা-মা যেতে দিচ্ছে না। তালুকদার বাড়ির লোকজন এখন আগের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ও বাড়ির মাসুদ, সতেজ সেদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় পথ আগলে যা বলেছিল তা কউকে বলা যায় না। সারা পথ শুধু চোখের জল ফেলেছে। সেদিনের সেই ঘটনা আর আজকের স্বপ্ন ওকে আজাবে ফেলে দেয়। ছটফটাতে থাকে। শরীরের অস্থির রক্ত ছোটাছুটি করে। জানালা দিয়ে দেখে বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। ভোরের নরম আলো হাতছানি দিয়ে ডাকে। শীতল বাতাসের জন্য দেহ-মন তৃষ্ণার্ত হয়। অনিতা বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রতিদিনের মতো পুকুরপাড়ে শিউলি তলায় এগিয়ে যায়।
পুকুরপাড়ে পালানে চোখ পড়তেই আঁৎকে ওঠে। পা আটকে যায় মাটিতে। ভারাক্রান্ত আবেগ উল্টো কাজ করে; শক্তি ফিরিয়ে দেয়। বাবা-মাকে ডাকতে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির দিকে ছোটে। পথে একবার হোঁচট খেতে খেতে টাল সামলায়। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠোনে গিয়ে পড়ে। ‘ও মা, ও বাবা তাড়াতাড়ি ওঠো; দেখে আসো আমাগের এত বড় সর্বনাশ করল কারা! অনিতার বর্ণনা শুনে সরুবালা আর জিতেন কু-ু পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। পালানে চোখ পড়তেই স্বামী-স্ত্রীর কণ্ঠ থেকে একসঙ্গে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে, ‘হায় হায়রে, ও ভগবান! এমন ক্ষতি আমাগের কারা করল?’ জিতেন দৌড়ে জমিতে নেমে পড়ে। আর্তকণ্ঠ বাতাসে ছড়ায়, ‘আমি তো কারো কোনোদিন ক্ষতি করি নেই। আমার ক্ষতি করবি ক্যা? আর কয়দিন পরেই পান তুলতি পারতাম। এমন পাকা গাছগুলো কারা কাটলোরে ভগবান! কেটে ফেলা পানগাছগুলোর গায়ে আদর বিলাতে বিলাতে জমির এপাশ ওপাশ ছুটতে থাকে। বুকটা হু হু করে ওঠে। বুকের হুতাশনে হৃৎপি- গলে চোখ দিয়ে ঝরে। এক সময় নির্বাক হয়ে বসে পড়ে। সরুবালা-অনিতা এগিয়ে যায়। দুরাচার অস্ত্র থেকে পানের কচি গাছটিও রেহাই পায়নি। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে তাবৎ পাটখড়ি, বাঁশ, চাটাই। বিধ্বস্ত পানের বরজ থেকে ¯ী¿-কন্যার হাত ধরে টলতে টলতে ঘরে ফেরে জিতেন।
ঘটনাটি পাড়ায় জানাজানি হলেও এ পাড়ার তেমন কেউ আর এগিয়ে আসে না। আত্মার টানে তো নয়ই, অন্তত সৌজন্যের খাতিরে জমিটুকু দেখতে কিংবা প্রবোধ দিতে কেউ আসে না।
জিতেন ভাবে, আগে তো এমন ছিল না। যে কারো সামান্য বিপদে এগিয়ে আসতো। সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে একই পরিবারে যেন ছিল এ পাড়ার সবাই। পাড়াজুড়ে শোকের মৌনতা। সন্ত্রস্ত প্রতিটি প্রাণী, ফসলসহ মাটি পর্যন্ত। অজানা আশঙ্কার প্রতি সবার নিরুপায় সমর্পণের প্রস্তুতি। দিন কেটে যায় বুকের ধড়ফড়ানি নিয়ে। সন্ধ্যা নেমে আসে চরাচরজুড়ে। ও পাড়ার মসজিদের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে; এ পাড়ায় শঙ্খ-উলুধ্বনি বাজে না। চারদিকে ঝিঁঝির ডাক করুণ হয়ে বাজে।
অনিতা পুজোর ঘরে। চোখ বুজে নীরব বন্দনায় মত্ত। বাবা-মা বারান্দায় চৌকির ওপর। বাড়ির অদূরে হঠাৎ বিকট আওয়াজে অনিতার ধ্যান ভাঙে। বারান্দায় সরুবালা জিতেনের হাত চেপে ধরে। ঘরের পাশে তেঁতুল গাছ থেকে হুতুম পেঁচা ভয়ে উড়ে যায়। পুজোর ঘর থেকে ত্রস্তস্বরে অনিতা বলে ওঠে, ‘বাবা, ইডা কীসের আওয়াজ? জিতেনও ঠাহর করতে পারে না। এটা কীসের আওয়াজ। আবার যখন আরও কাছে আরেকটা হলো, তখন সে ধরতে পারলো শব্দটা কীসের। তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। এরকম আওয়াজ তো শুনেছিল ’৭১-এ। সেদিন ছিল শবে বরাতের রাত। ছোট ভাই দিলীপের বন্ধু ওপাড়ার ওহিদ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মা’র হাতের হালুয়া-রুটি খেতে গোপনে রাতে এসেছিল। দিলীপ ছিল পাহারায়। কীভাবে যেন ওপাড়ারই পাকিস্তানি দালাল ফজলু ওরফে ফজা তালুকদার খবর পেয়ে যায়। দিলীপ ওহিদকে দৌড়ে খবর দেবার আগেই ফজা তালুকদারের লোকদের হাতে ধরা পড়ে। মা’র সামনে বসে রুটি-হালুয়া খাওয়া অবস্থায়ই তালুকদারের লোকেরা গুলি করে। প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ওহিদ নিজের অস্ত্রটা ধরার আগেই দ্বিতীয় গুলিটা দেহ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তবুও কী ক্ষমতাবলে বেঁচে থাকে। নিজে গুলি চালাবার আগেই ওদের হাতে ধরা পড়ে। মধুখালী হাই স্কুলে পাকিস্তানি ক্যাম্পে ওদের নিয়ে যাওয়া হয়। বুটের লাথি, লাঠিপেটা, বেয়নেটের খোঁচার সঙ্গে লবণের ছিটায়ও বাকি যোদ্ধাদের খবর বের করতে পারেনি ওহিদ-দিলীপের মুখ থেকে। ওহিদ পরদিন সকালে আর দিলীপ বিকালে শহিদি বরণ করে। অনেকেই বলেছিল জিতেনকে ওপারে চলে যেতে। জিতেন বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে, ছোট ভাইয়ের রক্তচিহ্ন মুছে যেতে চায়নি।
তারপর তো স্বাধীন। ফজা তালুকদার প্রায় ৩/৪ বছর কোথায় আত্মগোপন করে ছিল জানা যায়নি। হঠাৎ একদিন গ্রামে উপস্থিত। তারপর আবার দোর্দ- প্রতাপে ঔদ্ধত্যে লাগামহীন ষাঁড়ের মতো মাঠঘাট দলতে শুরু করা। যখন যে সরকার আসে তার লেজ ধরে হাঁটে। বেশ সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে অঘোষিতভাবে তৈরি হয়েছে তালুকদার বাহিনী। জিতেনদের পাড়ায় সবাই জানে-বোঝে কেন তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। জেনে-বুঝে-দেখেও তা প্রকাশ করতে পারছে না।
গত নির্বাচনের পর ছেলেটা জেলা শহরের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে গ্রামে ফিরতে পারছে না; মেয়েটার কলেজে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। পথে ওই তালুকদার বাড়ির ছেলেরাই মেয়েকে কুশ্রাব্য শুনিয়েছে। এবার নির্বাচনে তালুকদাররাই জিতেছে।
ওহিদকে গুলি করার শব্দের সঙ্গে আজকের আওয়াজের অদ্ভুত মিল খুঁজে পায় জিতেন। জিতেনের স্মৃতিকাতরতার রেশ কাটতে না কাটতেই একদল যুবক বাড়ির উঠোনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। জিতেন উঠে দাঁড়ায়।
‘তুমরা কারা, কী চাও?’
‘তোর বাপ আমরা, শালা মালাউনির বাচ্চা!’
অন্ধকারেই বুঝতে পারে তারই ছেলের বয়সী ফজা তালুকদারের ছোট ছেলে মতিন। রক্তে মশাল জ্বলে ওঠে। ক্ষণিকেই আবার নিভে যায়। মতিন বলে, ‘তোগেরে না কইছিলাম ভোট দিবার যাবিনে। তাও ভোট দিতি গেছিলি? কই ভেলা মার্কায় ভোট দিয়ে তো জিততি পারলিনে! দিছি তোগের ভেলা ডুবায়ে।’ সঙ্গীরা উল্লাসমেশা হাসিতে ফেটে পড়ে। সরুবালা নরম সুরে কাতরতা মিশিয়ে বলে, ‘কী যে কও বাবারা, তুমরা নিষেদ করে যাবার পর সেন্টারেই যাই নেই।’ ওদের ঢোকার পরক্ষণেই অনিতা পুজোর ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ও একটু তেতে ওঠে, ‘আমাগের পছন্দের মার্কায় ভোট দিলিও নাম হয়ে হয়ে গেছে আমরা ভেলা মার্কায় ভোট দিছি। আপনাগেরে এসব ধারণা ঠিক না।’
নির্বাচনের আগে সেদিনের কথা মনে পড়ে যায় জিতেনের। রাতে মতিন তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করেছিল; জানে মারার হুমকি দিয়ে যায়। অদূরে অল্প অন্ধকারে দাঁড়ানো ছিল বুটপরা কিংবা খাকি-সাদা মিশেলে পোশাক পরা কিছু লোক। হাতে উদ্যত সঙ্গীন। অন্ধকারে পোশাকের রং ঠিকমতো ঠাউরে উঠতে পারছিল না জিতেন। মতিনের ইশারার অপেক্ষা না করে একজন হঠাৎ শ্যাঁত করে উঠোনের তুলসীগাছটা রামদার কোপে দু’ভাগ করে ফেলে। কজন গোয়ালে গরুর দড়ি খুলে দেয়। দু’-তিনজন টিনের বেড়া কোপাতে থাকে। জিতেনকে কজন ধরে উঠোনের বাইরে নিয়ে যায়। সরুবালাকে বাকি কজন টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় ঘরের পাশে তেঁতুলতলায়। অন্ধকার থেকে সরুবালার কণ্ঠ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে, ‘ভগবানের দোহাই, তুমরা আমার ছাওয়ালের বয়সি। এমন কাম কইরো না, ভগবান সইবিনে, তুমাগের আল্লা সহ্য করবিনে।’ এ বাড়ির আর্তস্বর পাড়ায় পৌঁছায় কি না জানা যায় না। এপাড়া ওপাড়া যে ভয়ংকর নীরব তা বোঝা যায়। এবার পুজোর ঘরে ঢোকে মতিন। ছোট মুর্তিগুলো হাতের হকিস্টিক দিয়ে ভাঙতে থাকে। বাঁধানো ছবিগুলো চুরমার হয়। ’৭১ থেকে রাখা বঙ্গবন্ধুর ছবি গিয়ে পড়ে দশভুজা দুর্গার ছবির ওপর।
তাণ্ডব শেষে ঘরে ঢোকে। দরজার আড়াল থেকে ঝড়ের দাপটে কম্পমান পাখির মতো অনিতাকে টেনে বিছানায় ফেলে দেয়। দরজায় খিল আটতে হয় না। দরজায় জোটের একজন ছোট অস্ত্রটা বের করে দাঁড়ায়। ঘর থেকে অনিতার বিপন্ন স্বর বেরিয়ে আসে, ‘মতিন ভাই, এর জন্যি কি ভোট দিয়ে কলেজে আপনারে ভিপি বানাইছিলাম! আপনার পায়ে ধরি, ভগবানের দোহাই… আমার সর্বনাশ করবেন না… ও মাগো! ওরে ভগবান!
মতিন কৃতকর্মের উগ্র অনুভূতি নিয়ে সদম্ভে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ইতোমধ্যে উঠোনে আহত শক্তিহীন জিতেন কোনোমতে এসে দাঁড়িয়েছে। মতিন জিতেনের গলা চেপে ধরে বলে, ‘দুই দিনির মধ্যি বাড়ি ছাড়বি, দ্যাশ ছাড়বি। এ দ্যাশ তোগের না; তোগের দ্যাশে চলে যাবি। এ জাগা থাকলি…’ কোমর থেকে ছোট আগ্নেয় অস্ত্রটা জিতেনের বুকে ঠেকায়। তারপর সবাই উল্লসিত পায়ে বেরিয়ে যায়। বিধ্বস্ত জিতেন মাটিতে বসে পড়ে। সমস্ত শরীর কেঁদে ওঠে। শরীর ফেটে বেরিয়ে আসতে চায় কান্না। কিন্তু মরুভূমি চোখ সাহায্য করে না। কাটা তুলসীগাছ হাতের মুঠোয় পুরে বুকের সঙ্গে মেশায়। কণ্ঠ ফেটে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।
‘ও ভগবান তুমি আছো, নাকি নাই! এর বিচার কিডা করবি? ওরা কয়ে গিল এই বাড়িঘর, দ্যাশ নাকি আমাগের না। এই বাড়ি, এই দ্যাশ আমার বাপ-দাদার। এহানে আমার নাড়িপোঁতা। এই দ্যাশের জন্যি ভাই জীবন দেছে। এই দ্যাশ আমাগের না, তাইলি আমার দ্যাশ কোন্ডা … কোনডা … কোনডা…! এই দ্যাশ ছাইড়ে আমরা কোন্ অপরাধে যাব… কী জন্যি যাব … কোন জাগা যাব?’’