Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সন্ধ্যে নামার আগে


১৯ অক্টোবর ২০২৩ ২১:২৮

আজও দুপুরের ভাত খেয়ে উঠতে উঠতে বিকেল হয়ে গেলো। আজকাল রোজই এমন অবেলা হচ্ছে। সকালে হালিমা এসে থালাবাসন মেজে রুটি ভাজি করে দিয়ে যায়। রহিমা এসে করে ঘর মোছা কাপড় ধোয়া বাথরুম পরিস্কার এর ভারী কাজ৷ এরপরে আর বাকি থাকে শুধু রান্না টুকুন৷ দুজনের সংসারের রান্নাই বা আর কতটুকু, তবু রোজ বেলা গড়িয়ে যায় রান্নাঘরে।

গুনে গুনে ছত্রিশ টা বছর এই রান্নাঘরেই কেটে গেলো, আঙুলের করে আঙুল রেখে হিসাব করে দেখে রাণী। বিয়ের বয়স এর সমান তার পাকাপোক্ত রাঁধুনি জীবন। কুড়ি বছর বয়সে বুড়ি হয়ে যাবার অপবাদ নিয়ে যখন তড়িঘড়ি করে তার বিয়েটা হলো তখন পর্যন্ত রান্নাঘরের সাথে তার পরিচয় ছিলনা। বড় যৌথ পরিবারে চিরকাল মা জেঠি কাকী পিসিরা রান্না করেছে। রাণী সেলাই করেছে, ঘর গুছিয়েছে, বাগান করেছে, পূজো দিয়েছে দুই বেলা। কিন্তু জীবনের প্রথম কুড়ি বছর সে রান্না কখনো করেনি। অথচ সেই কী না কাটিয়ে দিল ছত্রিশ বছর চুলোর পাশে৷

বিজ্ঞাপন

বৌভাতের দিনই শ্বাশুড়িমা রাঁধতে বসিয়েছিলেন।লাকড়ির চুলায় রাঁধতে বসে অথই সমুদ্রে পড়েছিল সে। মাসি শ্বাশুড়ি এসে সেদিন না দাঁড়ালে সে যাত্রা উদ্ধার ছিল না তার। তারপর বিয়ের সপ্তাহ না গড়াতেই বরের সাথে ঢাকায় আসা। অল্প ক’টাকা বেতনের, অল্প কিছু বাসনের, অল্প কয়েক আসবাবের সংসার শুরু করা। সকালের রুটি টা গোল আর পাতলা হতোনা কিছুতেই। ভাজিতে তেল উপচে যেতো, মাছ মাংস রান্নার ঝাল আন্দাজ করতে পারতোনা, ডাল হতো আলুনি আর আলু ভর্তা হয়ে যেত নুন পোড়া। তারওপরে ছোট দেবর এসে যোগ দিল সে সংসারে বছর না ঘুরতেই। এসেই সে রুটিন বেঁধে দিলো- সকাল আটটায় নাস্তা, দুপুর একটায় ভাত আর রাত আটটায় রাতের খাবার। এর বাইরে গেলেই বেঁধে যেত ধুন্ধুমার কান্ড। ভাইকে ভাত দিতে দেরি হবার নালিশ শুনে রেগে গিয়ে চুলার উপরে উথলানো ডালের পাতিল লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল রঞ্জিত, সেই পোড়া দাগ তো আজো ঢাকা আছে, তার রাঁধুনি হয়ে ওঠার সাক্ষী হয়ে। তারপর শমিত জন্মাতেই পরীক্ষা আরো কঠিন হলো। ছেলে কোলে নিয়ে রান্না,কাটাবাছা, ধোয়া, সবাইকে দিয়ে তার জন্য থাকতো বাটির তলানি টুকু অথবা সেই যে ভাত পুড়ে গিয়েছিল বলে অলক্ষী বলে চুল টেনে দেয়াটা, এটাই তার বরাদ্দ বলে রাণী মেনেই নিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

অথচ সময়ে সব কেমন ভোজবাজির মতো বদলে গেলো। তালুকদার বাড়ির ছোট মেয়ে রাণী দেখতে দেখতে দারুণ রান্না শিখে গেলো। তার হাতের মাছের কালিয়া খেয়ে রঞ্জিত এর কলিগ রা বলতো আহা! সেই নালিশ করা দেবর দম বিরিয়ানি খেয়ে বলতো আহা! মেজদার বন্ধুরা সর্ষে ইলিশ খেয়ে গ্রামময় সুখ্যাত করে বলতো রাণী বড় ভালো রাঁধে। শমিত অন্য কারো হাতের পায়েশ খেয়ে মুখ কুঁচকে বলতো মায়ের মতো নয়!

সেই যে লোকের মুখে আহা শোনার নেশায় ধরলো, চুল টানার বদলে প্রশংসা পাবার লোভে মন উতলা হলো, তাতেই রান্নাঘরে আটকে গেলো পা। সকালে উঠেই জলখাবার থেকে শুরু করে দুপুরের অষ্টব্যঞ্জন সাজিয়ে খাইয়ে ঘামে ভেজা মুখ নিয়ে দরজায় দাঁড়াতেই রিয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যখন বলে বেয়ান এর রান্না তুলনাহীন, ওই টুকুই শুধু পাওয়া হয়ে রইলো। এর বিনিময়ে ছত্রিশ টা বছর ধরে সে শুধু রেঁধেই গেলো। স্বামীর জন্য, শ্বশুর ভাসুর দেবরের জন্য, ভাই ভাগ্নের জন্য, ছেলের জন্য, মেয়ের জন্য, ছেলে মেয়ের বন্ধুদের জন্য, তাদের বৈবাহিক আত্মীয়দের জন্য৷ সবাই জেনেছে রাণী রাঁধতে ভালোবাসে, সবাই জেনেছে রাণী রাঁধতে ভালো পারে৷ এমন কি নিমন্ত্রণ বাড়িতেও কেউ না কেউ বলেছে রেজালা টা রানী ই রাঁধুক। অথচ, কাউকে আর বলা হয়নি, আজকাল রাণীর আর একদম রাঁধতে ভাল লাগে না। আজকাল রাণীর খুব আর সবার মতো স্রেফ হাত ধুয়ে এসে খেতে বসতে ইচ্ছে করে।

ক্লান্তিটা বহুদিন ধরেই দানা বেঁধেছিল৷ কিন্ত দরজা খুলে সেটা বেরিয়ে এলো সেদিন যেদিন মেয়ে রিয়াকে টুকটাক রান্না শিখতে বলায় সে উত্তর দিয়েছিল, “পেটে বিদ্যে থাকলে রান্না শিখতে হয় না! আমারও চাকুরির বেতন আছে আর দেশে ও হোমডেলিভারি আছে।” কী বলবে ভেবে না পেয়ে রাণি সেদিন নিরুত্তর ছিল। তার কিছুদিন পরে কী যেন এক প্রসংগে ছেলের কাছে “তোদের জন্য কত কষ্ট করেছি সারাজীবন” এই বলে আক্ষেপ করতেই শমিত সাফ জবাব দিলো, “একটু রান্নাইতো করেছো! এত কষ্ট হলে রাঁধতে কেন? পয়সা দিলে কী রাঁধুনি মেলেনা?”

ভোরে রঞ্জিত এর বেড টি দিয়ে দিন শুরু করে, স্কুলে যাবার আগে শমিত রিয়ার নাস্তা, টিফিনের জন্য একেকদিন একেক রকম বায়না, পাশেই রঞ্জিত এর অফিসের ভাত তরকারি, রিয়ার ডায়েটের স্যুপ বা ওটস, শমিত রাত জেগে পড়বে বলে ঘন্টায় ঘন্টায় কফি আর স্ন্যাকস এর জোগান, তাদের বন্ধু বান্ধবী আর কলিগ দের সাপ্তাহিক গেট টুগেদার এর বিরিয়ানি, রিয়ার ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বলে নানাকায়দায় দুধ এর বিকল্প তৈরি করা- এক লহমায় পরিশ্রম এর দিনরাত্রি গুলো তুচ্ছ হয়ে গেল৷ সবাই যখন শীতাতপ ঘরে আরাম করেছে বা পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখেছে,পেপার এর পাতা উলটেছে, তখন ঘামে ভিজে নেয়ে সারাটা জীবন রাণী রান্নাঘরটাতেই কাটিয়েছে৷ ভেবেছে সংসারে এই তার অবদান, এই তার দায়িত্ব, এতেই সবার মঙ্গল,এতেই সবার সেবা, এর মাঝেই তার মায়া ভালোবাসা স্নেহ ছড়িয়ে দেয়া। কখনো বুঝেনি এ দায় অতি সামান্য, কখনো বুঝেনি পেটে বিদ্যে নেই বলে ওর জায়গা হয়েছিল রান্নাঘরে, আর কোথাও নয়৷ বুঝতে বুঝতে কী না তিন যুগ কেটে গেলো তার?

তারপর থেকে রান্নাঘরে আর যেতে মন চায়না। মন এর আপত্তি শরীরও যেন বুঝলো৷ হাই প্রেশার,ব্লাড সুগার, ইউটেরাস এর টিউমার, আর্থ্রাইটিস সব একসাথে আসন পেতে বসলো শরীরে৷ সেই প্রথম বিশ্রাম পেলো রাণী, শরীর খারাপ উপলক্ষে মিললো ছুটি। কিন্তু তার বিকল্প পাওয়া গেলো না। পয়সা দিয়ে ভাত ডাল নামানোর লোক পাওয়া গেলেও রাণীর হাতের আলু ভাজা বা বৃষ্টির দিনের খিচুড়ি ইলিশ পাওয়া গেলনা। হোম ডেলিভারিতে সকালের বেড টি মিললোনা। সবাই যেন রাণীর উপরেই রেগে গেলো অসুখ বাঁধানোর জন্য। অগত্যা, সেই যে দাম না পাওয়া দায়িত্ব আর নাম না পাওয়া স্নেহ ভালোবাসা উঠিয়ে দিলো তাকে। এলবো ক্রাচে ভর করে রান্নাঘরে রাখলো আবার পা। সকালের নাস্তা বানাবার জন্য হালিমা বহাল হলো। শুধু রাণীর রাঁধতে ভালো লাগার মন টা আর ফিরলোনা ঘরে৷

আজকাল যদিও তেমন কিছুই রাঁধার থাকেনা। বাষট্টির রঞ্জিত এর জন্য বেশির ভাগ দিনই পেপে সেদ্ধ, সবজি আর কাঁচাকলা দিয়ে মাছের ট্যালটেলে ঝোল বরাদ্দ। আর তার নিজের জন্য তো চিরকালই একটা ডিমভাজাই যথেষ্ট ছিল। তাই ইদানিং সকালের চা নাস্তা খেয়ে,রহিমা কে বিদায় দিয়ে এক দফা ঘুমিয়ে নেয় সে। দুপুরের আজানের শব্দে উঠে একটু একটু করে রান্নাঘরে যায়, সিরিয়াল এর ব্রেকে একটু একটু চামচ নাড়ে, এই করতে করতে বেলা হয়ে যায়। রঞ্জিত বিরক্ত হয়। লন্ডনে থাকা রিয়া আর কানাডায় থাকা শমিতের সাপ্তাহিক ফোন এলে নালিশ করে রাণী আলসে হয়ে গেছে বলে৷

কিন্ত রাণীর যে শুধু আলসেমি করতে ইচ্ছে করে তাই না, মন চায় আবার সেই বছর কুড়িতে ফিরে যেতে। তার ভাইয়েরা সবাই ভিন্ন হয়েছে। বহুকাল সে বাপের বাড়ি যায়নি, বহুকাল তাকে কেউ নিমন্ত্রণ করে পাত পেড়ে খাওয়ায়নি, বহুকাল কেউ তাকে শুধায়নি দুপুরে তার কী খেতে মন চায়? ইলিশ পাতুরি খাবে কী না? গোকুল পিঠে খাবে? চায়ে চিনি ক চামচ? দুটো টোস্ট বিস্কিট নিবে?

এ সংসারের বাইরে কোথাও গিয়ে জিরোতে মন চায় তার। বউ পুকুরের ঘাটে আম গাছের ছায়ায় আবার তেতুল ভর্তার বাটিটা কোলে নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে চুপিচুপি৷ ঠাকুমার দুধ ভাতের থালায় গাল পেতে দিতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলার ব্যস্ত সকালে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে খুব। সেই যে তিনমুখো জোড়া চুলোর পাড়ে বসে মেজ কাকী ভাত বেড়ে দিতো তাদের সব ভাই বোন কে। গরম ফেনা ভাতের উপর গাছ থেকে পেড়ে আনা কাঁচামরিচ দিয়ে যেত আলোর মা, মাথাপিছু একটা করে। আর মা দিয়ে যেত এক খাবলা করে আলুসেদ্ধ। মাঝে মাঝে জুটতো হাঁসের ডিম নয়তো চুনো মাছ এর শুখা ঝাল। রাণীর খুব ইচ্ছে করে সেই গরম ভাত আর ঝাল মাছের ঘ্রাণ নিতে। পেট ভরে ভাত খেয়ে, তেল দিয়ে পাট করে চুল আঁচড়ে আবার সেই স্কুলের পথ ধরে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। আরেকবার স্কুলে যেতে পারলে স্বীকৃতিহীন,বিনা বেতনের ভাত রান্নার কাজে আর ফিরবেনা রাণী। রঞ্জিত কে আর বলার সুযোগ দেবেনা- “ছত্রিশ বছর ধরে তো আমার ঘরে থাকলে, আমার ভাত খেলে!”

রাণীর রান্নাঘরের জানালার কার্নিশে বাসা বেঁধেছে এক জোড়া চড়ুই আর তাদের ছানা। রোজ সকালে তারা বেরিয়ে যায় খাবারের খোঁজে। আর বাসায় ফিরে আসে সন্ধ্যে নামার মুখে। আজকাল সেই চড়ুইদের সাথে উড়ে যেতে মন চায় রাণীর। ফিরতে ইচ্ছে করে নিজের ঘরে৷ নিজের একটা ডালভাতের থালা খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর