Friday 29 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার পূজা ও বিবিধ প্রসঙ্গ

বিভুরঞ্জন সরকার
২০ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:২৩

দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার আরাধনার সময় সমাগত। চারদিনব্যাপী চলবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে পিতৃগৃহ ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে পাড়ি দেন দেবী। সেই কারণেই এই তিথিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনী মতে, মহিষাসুরের সঙ্গে নয় দিন নয় রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন মা দুর্গা। তাই এই দিনটিকে ‘বিজয়া’ বলা হয়। দেবীদুর্গা অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তার এই জয়ের মধ্য দিয়ে অন্যায় ও অশুভর বিরুদ্ধে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

দুর্গাপূজাকে বাঙালি হিন্দুর প্রধান উৎসববলা হলেও ত্রিপুরা, হাজং, বানাই, পাত্র, কোচ, মাহাতোসহ ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষও দুর্গা পূজা করে থাকেন। বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের আটপৌরে সংসারে হাজারো না পাওয়ার হতাশা, ব্যর্থতা এবং বিপর্যয়ের মধ্যেও অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে দেবীদুর্গার উপাসনা করে এই বিশ্বাস নিয়ে যে দেবী তাদের সব দুর্গতি মোচন করবেন, কারণ তিনি দুর্গতিনাশিনী।

বিজ্ঞাপন

এবছর দেবীর আগমন ও গমন দুটোই ঘোটকে– যা অশুভ ইঙ্গিত। শাস্ত্রমতে বলা হয় সপ্তমীতে দেবী দুর্গার আগমন এবং দশমীতে গমন হয়। সাধারণত প্রতি বছর সপ্তমী ও দশমী কী বার পড়ছে তার ওপর নির্ভর করে দেবীর কিসে আগমন এবং গমন সেটা বোঝা যায়। শাস্ত্রে আরও বলা আছে, কোনো বছর দেবীর আগমন ও গমন একই বাহনে হলে তা অত্যন্ত অশুভ। ২০২২ সালে দেবীর আগমন হয়েছিল গজে এবং গমন হয়েছিল নৌকায়।

কোন বাহন কিসের প্রতীক?

দোলা: দোলা অর্থাৎ পালকি হল মহামারী বা মড়কের প্রতীক।
নৌকা: নৌকা বন্যার প্রতীক। আবার অনেকে মনে করেন, নৌকায় দেবী দুর্গার আগমন হলে চারিদিকে ভাল ফসল হয় ।
গজ: গজ বা হাতি হল শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক। গজে আগমন বা গমন হলে বসুন্ধরা শস্য শ্যামলা হয়।
ঘোটক: ঘোটকের অর্থ ছত্রভঙ্গ। ঘোটক বা ঘোড়ার অর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির এলোমেলো অবস্থা। যুদ্ধ- বিগ্রহ, অশান্তি, বিপ্লব ইত্যাদির সংকেত।২০ অক্টোবর ভোরে কলাবউ স্নানের মধ্যে দিয়ে যাবতীয় মলিনতা, অন্ধকার দূরে সরিয়ে চারদিনের মহোৎসবের শুভ সূচনা হবে। বাঙালির

আটপৌরে সংসারে হাজারও না পাওয়ার হতাশা, ব্যর্থতা এবং বিপর্যয়কে অতিক্রম করে ২৪ অক্টোবর বিসর্জন পর্যন্ত আগামী একবছর নতুন করে চলার শক্তি ও অনুপ্রেরণা দুই-ই খুঁজে পাবে ধর্ম বিশ্বাসী হিন্দু সম্প্রদায়। সব ভুলে মানুষ সবাই মেতে উঠবে আনন্দ অবগাহনে কোনো উজ্জ্বল আলোর অপেক্ষায়। এখানে ধনি-দরিদ্র কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। এই আনন্দযজ্ঞে শামিল হয়ে তাই সবার উচিত অন্যের নিরানন্দের কারণ না হয়ে, অন্যকে দুঃখ না দিয়ে নিজের মতো করে শান্তিতে এই চারটি দিন অতিবাহিত করে।

বলা হয়ে থাকে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। বছরের পর বছর ধরে এই ভূখণ্ডে হিন্দু-মুসলমান যেমন পাশাপাশি বসবাস করে আসছে, তেমনি তারা একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিয়ে সামাজিক সম্প্রীতি আরও সুদৃঢ় করেছে। বাঙালি সংস্কৃতি যে অন্তর্নিহিতভাবে সর্বপ্রাণবাদী, নারী তথা মাতৃচরিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে, দুর্গাপূজার মধ্য দিয়ে তা ফুটে ওঠে। এই গুণাবলি যতটা ধর্মীয় বিশ্বাস, ততটাই সংস্কৃতির প্রাণরসে ঋদ্ধ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সম্প্রীতির পরিবেশ কিছুটা হলেও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত বছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে সারাদেশে এক রকম আনন্দ আয়োজন সম্ভব হয়নি নোয়াখালীসহ কয়েক স্থানে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে। নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপন নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও এবারও সারা দেশে হাজার হাজার মণ্ডপে পূজা উদযাপনের আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। দু’এক জায়গায় ছোটখাট কিছু সমস্যা হলেও পূজা মন্ডপগুলোতে আয়োজনের ঘাটতি নেই। মানুষ সাধ ও সামর্থের সমন্বয় করে নতুন জামাকাপড় কিনেছে।

সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির ব্যাখ্যা উইকিপিডিয়ায় দেওয়া হয়েছে এই ভাবে- সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষ এ ক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হলো সম্প্রদায়। ধর্মনিষ্ঠার সাথে সম্পর্ক আছে ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার বিচারের। সাম্প্রদায়িকতার যোগ আছে সম্প্রদায়ের সাথে। অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের আচরণ এবং ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব বেশি। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব বেশি। এ ছাড়া সত্যকার ধর্মনিষ্ঠা পরকালমুখী। পরকালেই তার সত্যকার পুরস্কারের আশা। সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা ইহলোকে। ধর্মনিষ্ঠার জন্য অন্যের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশে এই প্রবণতাই কি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে না? সম্প্রীতি আকাশ থেকে ঝরে পড়ে না। সম্প্রীতি গড়ে তোলে মানুষ আবার সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্টও করে মানুষ। মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর। কাজেই মানুষকেই সব সময়ের জন্য মানবিক ও সংবেদনশীল হয়ে উঠতে হবে।

গত কয়েক বছর ধরে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চলানো হয়। অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই না করে, একজনের কল্পিত অপরাধের দায়ে একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এমন হামলে পড়াটা কি স্বাভাবিক কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? কেউ কেউ হয়তো সেটা বলে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করতে চান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাকে আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এই ঘটনাগুলোকে যদি বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়নের একটি পরিকল্পিত উদ্যোগ বলা হয়, তাহলে কেউ কেউ নিশ্চয়ই তার প্রতিবাদ করবেন। বলবেন, না, বাংলাদেশ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ফসল। এই দেশের জন্য মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান সব ধর্মবিশ্বাসীদের আত্মদান ও ত্যাগ আছে।

এই কথাগুলো বলতে ভালো লাগে। এক সময় শুনতেও খারাপ লাগতো না। এখন এসব কথা সংখ্যালঘুদের মনে কোনো বিশেষ আবেগ তৈরি করে বলে মনে হয় না। শখ করে কেউ দেশত্যাগী হয় না। দেশত্যাগের, ভিটেমাটি ছাড়ার বেদনা অবশ্য ভুক্তভোগী ছাড়া কারো বোঝার কথা নয়। দেশে মুসলিম জনসংখ্যা যেখানে ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কেন কমছে সে প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা হতে চাই না। সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ যে নতুন করে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ার কারণেই ঘটেছে, সেটা আমরা মানতে চাই না। অথচ সত্য এটাই যে, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।
এ কথা ঠিক যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল। কিন্তু নানা ঘাত-প্রতিঘাত, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ক্ষমতার রাজনীতির জটিল সমীকরণ এখন আমাদের এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর কোনোভাবেই সংখ্যালঘুদের নিরাপদ বাসভূমি নেই। এক সময় হিন্দু প্রতিবেশীর প্রতি মুসলিম প্রতিবেশীর যে দরদ ও সহানুভূতি ছিল, এখন তাতে চিড় ধরেছে। আক্রান্ত হিন্দু প্রতিবেশীকে রক্ষার জন্য মুসলিম প্রতিবেশী কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। অনেকেই আবার এখন আর নিজেকে হিন্দু দরদি হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না। এক সময় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঐতিহ্যবহন করা আওয়ামী লীগও আর সে পরিচয় গায়ে সেঁটে রাখতে চায় না। বরং আওয়ামী লীগের কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক কথাবার্তায় মুসলিম লীগকেও ছাড়িয়ে যায়!

এই ধারণা যদি ভিত্তিহীন হতো তাহলে গুজব ছড়িয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে হাজারে হাজার জমায়েত হয়ে সংখ্যালঘুদের গ্রাম-পাড়া আক্রমণ করা সম্ভব হতো না। অসাম্প্রদায়িক চেতনার শুভবোধ সম্পন্ন মানুষই প্রতিরোধে শামিল হতো। প্রশাসনের ভূমিকা খুবই দুঃখজনক। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাসময়ে তৎপর হলে দেশের কেথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারতো না। আকস্মিকভাবে কোথাও কোনো হামলার ঘটনা ঘটে না। কিছু না কিছু প্রস্তুতি নিয়েই হামলা হয়। হঠাৎ করে কিছু হয় না। যখন হাওয়া গরম করা হয় তখন নাকে তেল দিয়ে সুখনিদ্রায় থেকে হামলার পর তৎপর হওয়ায় ক্ষতি হয় দুইদিক থেকে। হামলার শিকার হিন্দুরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। দেশত্যাগের পরিকল্পনা করে। আবার হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের নামে পুলিশ প্রশাসন নির্দোষ ব্যক্তিদের হয়রানি করে না, তা-ও নয়।
যা হোক, শেষ করি আশা নিয়েই। কারণ মা দূর্গা দুর্গতিনাশিনী। অকালবোধনে তিনি এসেছিলেন অসুরবধ করতে। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ অসুর যে আমরাই, আমাদের নির্লজ্জ স্বার্থপরতা, আমাদের সংকীর্ণ বিচারবোধ, আমাদের অন্ধ সহ্যক্ষমতা অথবা প্রাপ্তির লোভে পাছে কোনো কিছু হারানোর ভয়ের আসুরিক চিন্তা কি দেবী দুর্গা বধ করতে পারবেন? দেবীর বিদায়েও আমাদের দুর্গতি কি বিনাশ হবে?

লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক, কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার পূজা ও বিবিধ প্রসঙ্গ