উৎসব হোক সামাজিক সম্প্রীতি আর বন্ধনের শিক্ষার
২০ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:৩০
বাঙালী উৎসবপ্রবণ জাতি। আনন্দ করতে কেবল একটি উসিলা লাগে আমাদের। ক্ষুধা, দারিদ্র, হতাশা, বেকারত্ব কোনকিছুই বিরত রাখতে পারে না উৎসবকে বরণ করে নিতে। বাঙালী এই উৎসব কিন্তু কখনই একা করতে শিখেনি। কোন এক পার্বণ মানেই সেটাকে সবাই মিলে রঙিন করে তোলায় যেন কোন আলস্য কাজ করে না।
গোটা বিশ্ব এখন নানারকম দিবস পালন মেতে উঠছে। ৩৬৫ দিনের মধ্যে খোঁজ করলে অন্তত হাজারের উপর দিবস পাওয়া যাবে। এসব দিবস কারা সৃষ্টি করল? কেন করল? কোনোদিন কি ভেবেছি আমরা? আর এইসব দিবস আজকাল ইন্টারনেটের কল্যাণে আমাদের মত দেশেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অথচ আমাদের এ অঞ্চলের লোকদের কোনোদিন ধার করা উৎসবের প্রয়োজন পড়েনি। বিদেশীদের কাছ থেকে শিখতে হয়নি জীবনের উদযাপন।
‘উৎসব’ এ বঙ্গে পালিত হতো উৎসবের মতোই। সেটার আর কোনও পরিচয় বা নাম ছিল না কোনোদিন। বাঙালীর চিরায়ত উৎসবের নাম পহেলা বৈশাখ। সর্বজনীন না হলেও ধর্মীয় আচারকে কেন্দ্র করে যেসব আয়োজন আসে সেগুলোও পরিচিত সর্বজনের অংশগ্রহণের জন্যই। আমি বড় হয়েছি হিন্দুপ্রধান এলাকায়। আমাদের বাসার চারপাশে হিন্দুদের মন্দির, অনাথ আশ্রম, শ্মশান ছিলো। পাড়া-প্রতিবেশীদের বেশীরভাগই ছিলো হিন্দু ধর্মের। সকালে ঘুম ভাঙতো মন্দিরের প্রার্থনার সুরে। পাশের বাসার পূজার ঘন্টার শব্দে। দুর্গাপূজা মানেই গোটা পাড়া সেজে উঠত উৎসবের লাল নীল বাতিতে। সঙ্গীতের সুর চিনতে শুরু করেছি মন্দিরের প্রার্থনার সঙ্গীত শুনে।
পাশের বাসার মাসীমা শীত আসে আসে সময়ে ভোরবেলা স্নান সেরে শিউলী, জবাসহ নানারকম ফুলের ডালি নিয়ে পূজায় বসতো। পাশেই ছিলো মুসলমানদের মসজিদ। এই যে একটি মিশ্র সংস্কৃতির মাঝে বেড়ে উঠা জীবন আমাদের; সে জীবনে কখনও শিখিনি কে হিন্দু আর কে মুসলিম। ঈদ পার্বনে আম্মাকে দেখেছি প্রতিবেশী হিন্দুদের নিয়ে খাবার ভাগ করে খেতেন। আবার পূজা মানেই আমাদের বাসাতেও প্রসাদ চলে আসা।
ছোটবেলায় দুর্গাপূজা মানেই পাড়ায় গানবাজনা আর হৈ-হুল্লোড়। বিশাল বড় মন্ডপে গোটা শহর থেকে মানুষজন আসতো দুর্গাকে প্রণাম করতে। মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে বেড়ানো হয়তো হিন্দুদের জন্য ধর্মীয় বিষয় ছিলো, কিন্তু আমাদের জন্য ছিলো মানুষ দর্শনের আয়োজন। এই যে নানা সাজে ছোট বড় সবাই ঘুরে বেড়াতো সেই সাজ বা আয়োজনের সাথে ঈদের সময় আমাদের সাজ বা ঘুরে বেড়ানোর যে আয়োজন কোনোটারই কোনো বিশেষ পার্থক্য খুঁজতে যাইনি আমরা। আমরা সেটাই শিখেছি যা আমাদের বড়রা শিখিয়েছে।
আমার মা শিখাত সবার ভালোটা নিজের মধ্যে নিতে হয় আর খারাপ সেটা নিজের হলেও বর্জন করতে হয়। কখনও শিখাতেননা যে আমরা মুসলিম তাই হিন্দুদের বাসায় যাওয়া যাবে না বা তাদের বাড়ির খাবার খাওয়া যাবেনা। যে খাবার আমার ধর্মের নিষেধ আছে সেটাতো আমি এমনিতেই শিখেছি কিন্তু কেবল ধর্মের পার্থক্যের কারণে কাউকে বর্জন করতে হবে তেমন শিক্ষা দেওয়া হয়নি। উৎসব মানেই উৎসব। সেখানে কেবলই আনন্দ আছে। আছে সবাই মিলে বাঁচতে শেখার শিক্ষা। প্রতিবেশীর আনন্দ বা কষ্টে সবাইকে এগিয়ে যেতে হয়।
আজ কোথায় যেন সেই সব শিক্ষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হতে হতে এমন এক জীবনের দিকে চলে যাচ্ছি যেখানে পাশের বাসায় কারা থাকে সেটাও জানি না। পাশের বাসার কেউ মারা গেলেও জানা হয় না। এই বিচ্ছিন্নতা কিন্তু ধর্মের নয়। এই বিচ্ছিন্নতা সামাজিক শিক্ষার অভাবের। সবাই মিলে বাঁচতে শিখার শিক্ষার অভাবের। যদি কেবল ধর্মের মাধ্যমেই মানুষকে মানুষের কাছে আনা যেত তাহলে মুসলিম বা হিন্দুরা নিজে নিজেদের হত্যা করতে পারত না। শহরের রাস্তায় একজন খুন হচ্ছে দেখেও আজকাল আমরা এগিয়ে যাই না। বন্ধনটুকু কারা যেন কেটে দিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনুষ্যত্বের একটা আলাদা সৌন্দর্য থাকে সেখানে বিবেচনা থাকে কেবলই মানুষের। পরিচয় হয় মানুষের সাথে মানুষ। বংশ পরিচয় বা ধর্মীয় পরিচয়ে নয়। রহিমের সাথে সনাতনের কোনদিন বন্ধুত্ব হতে পারে না এই শিক্ষা যারা দিতে চায় তারাই সেই বন্ধনের সূতাটা নিয়ে খেলছে। আর এই খেলার বলী হচ্ছে গোটা দেশ, সংস্কৃতি আর জাতিসত্ত্বা। বাঙালীয়ানার কোন ধর্ম হয় না। বাঙালীয়ানায় বিভাজন থাকে না। যিনি বাঙালী তার জীবনের কোন উৎসবই হারিয়ে যায় না ধর্মের দোহাই দিয়ে।
হিন্দুদের পূজা, মুসলমানদের ঈদ, খৃষ্টান, বৌদ্ধদের বার্ষিক উৎসব কোনটারই সীমাবদ্ধ কোনও রূপ থাকা উচিত না। যে যার ধর্ম পালন করবে কিন্তু উৎসবের যে আয়োজন সেটি হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। সেমাই খাওয়ার জন্য যেমন নামের পরিচয় কাজ করা উচিত নয় আবার খিচুড়ি বা লুচি খাওয়ার জন্যও ধর্মীয় প্রতীক থাকা অযৌক্তিক।
প্রতিটা ধর্মেরই সামাজিক একটা শিক্ষা থাকে। সেই শিক্ষাই যুগ যুগ ধরে মানুষকে বেঁধে রেখেছে। যদি ধর্মের কারণেই বিভাজন করতে হতো তাহলে তো পৃথিবীতে দেশের সংখ্যা হওয়ার কথা ছিলো অগণিত। কই সেটাতো হয়নি। দেশের পরিচয় হয় ভৌগলিক সীমারেখা দিয়ে। সেই সীমায় কারা বসবাস করবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার দায় কেবলই যিনি বাস করবেন তার আর দেশের আইনের। শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই হবে মানুষের মনুষ্যত্বের শিক্ষায়। নিজেকে শ্রেষ্ঠ তখনই বলা যাবে যখন কেউ সর্বজনীন হতে শিখবে। সংকীর্ণ পরিচয়ে কেউ সবার হয়ে উঠতে পারে না।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস