Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘হাওরের ইতিহাস-ঐতিহ্য’: তথ্যভিত্তিক প্রামাণ্য দলিল

রফিকুল ইসলাম
২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:০০

‘হাওরের ইতিহাস-ঐতিহ্য’ একটি আঞ্চলিক গবেষণাধর্মী গ্রন্থ বা বই। এটি হাওরকেন্দ্রিক গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে সাজানো। এছাড়া তা একটি আঞ্চলিক ইতিহাস, যা তথ্যভিত্তিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য করা চলে।

এ বইয়ের লেখক বশির আহমেদ কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। শিক্ষকতা ও গবেষণা কাজে অনেক অবদান রেখে চলেছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

এর আগে তিনি দীর্ঘদিন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে হাওরের উন্নয়নমূলক প্রকল্প ‘সুনামগঞ্জ কমিউনিটি ভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ (সিবিআরএমপি) এবং ‘হাওর অঞ্চলের অবকাঠামো ও জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ (হিলিপ) এর মাধ্যমে হাওরের অধিকাংশ উপজেলায় মাঠে কাজ করে কুড়িয়েছেন বাস্তব অভিজ্ঞতা। যার প্রতিফলন ঘটেছে বইটিতে। সেসব তথ্য দিতে গিয়ে অসংখ্য রেফারেন্সও টেনেছেন লেখক।

কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর অধ্যুষিত মিঠামইন উপজেলার সদর ইউনিয়নের মহিষারকান্দি গ্রামে ১৯৮৫ সালের ২০ ডিসেম্বর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে লেখক বশির আহমেদের জন্ম।

রোলাঁ বার্তার মতে, ‘পড়া আসলে একধরনের বিশিষ্ট কাজ।’ সেই হিসেবে আমি বইটির দুর্বল পাঠক। বই যদি পড়ার মতো করে পড়া যায় তাহলে ভাবতে হয় খুব। তেমন ভাবুকও যে নয় আমি। আসলে পড়া একটি আনন্দদায়ক উপলব্ধি। বই পড়ার কাজটা আরও আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে, যদি সেই বইটি অন্য কাউকে পড়ানো যায়।

পাঠক হিসেবে মনোজগতে যে আলোড়ন তুলেছে, এতে মনুষ্যত্ব থেকে আরও মানবিক হয়ে উঠতে শেখাবে। গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করবে সুখপ্রদ, আনন্দময় জীবন, জনপদ ও সমাজ। বইয়ের মূল বিষয়বস্তু উপলব্ধি, লেখকের রচনাশৈলী ও উদ্দেশ্য, আলোচ্য বইয়ের তথ্য-উপাত্ত ও সাহিত্যিক উপাদান অনুধাবন প্রক্রিয়া ইত্যাদি পাঠক মনোভঙ্গি নিয়ে আলোকপাতের প্রয়াস পেয়েছি।

বিজ্ঞাপন

‘হাওরের ইতিহাস-ঐতিহ্য’ – নামকরণই হাওরের উৎপত্তি, জীবন-জীবিকা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনীতি, বৈশ্বিক দৃশ্যপট, জলবায়ু, শিক্ষা-সংস্কৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন অনুচ্চরূপে। এমন সুখপাঠ্য আঞ্চলিক ইতিহাস কে কবে লিখেছে! ঝরঝরে গদ্য এবং সহজ ও পরিচিত শব্দের চমৎকার প্রয়োগ, দুর্বোধ্যতা পরিহার, যথাশব্দে মজবুত গাঁথুনির কারণে বইটি সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। শব্দই নেবে টেনে পরবর্তী বাক্যে। এভাবেই চলবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত। বইটি পড়ে পাঠক লেখক হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করবেন – এমনটি বলে দেওয়া যায় অকপটে।

বইয়ের শুরুটা হয়েছে হাওরের নামকরণ দিয়ে। লেখক লিখেছেন, ‘হাওর হলো সাগর সদৃশ পানির বিস্তর প্রান্তর। হাওর শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘সাগর’ এর বিকৃত রুপ বলে ধারণা করা হয়। উচ্চারণ বিকৃতির ফলে যথাক্রমে সাগর>সায়র>হাওর শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। হাওর অঞ্চল পূর্বে সাগরের বিশাল জলরাশি ছিল। সাগর ক্রমে দক্ষিণে সরে গিয়ে কালের বিবর্তনে তা হাওরের রুপ লাভ করেছে।’

লেখক এখানে বাংলাদেশের সমস্ত হাওরের একটি তালিকা দিতে চেষ্টা করেছেন। উল্লেখযোগ্য কিছু হাওরের পাশাপাশি কিছু হাওর উপজেলা এবং সেখানকার মিথ নিয়েও বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করেছেন।

লেখক রীতিমতো চমকে দিয়েছেন হাওরের উৎপত্তির ইতিহাস দিয়ে। তিনি লিখেছেন, “বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় অংশ এককালে ‘কালীদহ সাগর’ নামক বিশাল জলরাশিতে নিমজ্জিত ছিল। যা কালের পরিক্রমায় পলি ভরাটের কারণে ও ভূ-প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তা পিরিচ আকৃতির নিম্ন সমতলভূমিতে পরিণত হয়। এই নিম্ন সমতলভূমিই হচ্ছে হাওর।”

এক রেফারেন্স থেকে দেখিয়েছেন, “প্রাচীনকালে এই অববাহিকাটি বঙ্গোপসাগরের অংশ ছিল। অনবরত পাহাড় ক্ষয়ের মাধ্যমে সমুদ্রবক্ষে পতিত ভূমির মাধ্যমে প্রাচীনকালে এই অঞ্চল বঙ্গোপসাগর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকায় সংকুচিত হয়ে সাগর সদৃশ্য নিম্নাঞ্চলে পরিণত হয়। যা ক্রমে হাওরে রুপ নেয়।”

বিখ্যাত চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পর্যটক হিউয়েন সাঙের লেখার রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন, “একসময় কালিদহ সাগর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। হিউয়েন সাঙ তখন জাহাজে করে সরাসরি সমুদ্র তীরবর্তী তাম্রলিপ্ত (কামরুপ) থেকে সিলেট পৌঁছান।”

ভাবা যায়! কামরুপ থেকে সিলেট পর্যন্ত একসময় সরাসরি জাহাজ চলাচল করতো? এছাড়াও ইবনে বতুতার নদীপথে শাহজালাল (রঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে সিলেট আসার ব্যাপারটা উপরোক্ত বক্তব্যকেই সমর্থন করে।

এভাবে ধীরে ধীরে হাওরের শুরু হলো। কিন্তু সেখানে কারা এসে প্রথমে বসবাস শুরু করেছিল? হাওরের জনবসতি স্থাপন ও নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনে লেখক অসংখ্য রেফারেন্স টেনে দেখিয়েছেন, “হাওরের শুরুর পর সিলেট জেলায় অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর লোক প্রথমে বসবাস করতে শুরু করে। তারা হাড় ও পাথর দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ করতো। তামা ও লোহার ব্যবহারও তাদের জানা ছিল। কৃষিকাজে ছিল তাদের বিশেষ দক্ষতা। মূলত তাদের হাত ধরেই এদেশে ধানের চাষ শুরু হয়। পাশাপাশি নারিকেল, কলা, পান, সুপারি, আদা ও হলুদ ইত্যাদি চাষ করতো তারা। এই জাতিগোষ্ঠী কুড়ির সাহায্যে বেচাকেনা করতো। আমরা এক কুড়ি, দুই কুড়ি ইত্যাদি গণনার নিয়ম এদের থেকে পেয়েছি। এরা মূলত গারো,খাসিয়া, কোচ, হাজং প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ছিল। পরে যারা ক্রমে পাহাড়ের দিকে চলে যায়।”

লেখক বশির আহমেদ এখানে দেখিয়েছেন কীভাবে এদের হাত থেকে হাওর একসময় বহিরাগতদের হাতে চলে যায়। অনেকেই হয়তো জানেন, সিলেটীরা অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের ‘আবাদি’ বলে থাকেন। কিন্তু এই শব্দ এলো কোথা থেকে? এর অর্থ কী?

এক্ষেত্রে লেখক লিখেছেন, “আনুমানিক ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে বৃহত্তর ঢাকা জেলা এবং বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা থেকে ধান কাটা মৌসুমে বৈশাখ মাসে দাওয়াল হিসেবে নৌকাসহ ধান কাটার জন্য লোকজন হাওর এলাকায় আসত এবং ধান কাটা শেষ হলেই তারা তাদের নিজ এলাকায় ফিরে যেতো।

এইভাবে কিছুকাল চলার পর তারা হাওরের বিস্তর জায়গাজমি, খালবিল ও নদীর মাছ ইত্যাদি দেখে তারাও হাওর এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তাভাবনা শুরু করে। তাঁর মতে, ১৭৫০ হতে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বৃহত্তর ঢাকা এবং বৃহত্তর কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাওরের বিভিন্ন এলাকায় বিরাট একটা জনবসতি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। যেহেতু তারা হাওরের দক্ষিণ থেকে এসেছে সেহেতু তাদেরকে দখাইল্ল্যা বলে সম্বোধন করা হতো। তুচ্ছার্থে দখাইল্ল্যা আবাদি বা আবাইদ্যা বলেও সম্বোধন করতো। আর ‘আবাদি’ শব্দের অর্থ মূলত হাওরে লতাগুল্ম ও বনজঙ্গল পরিষ্কার করে যারা আবাদ করে।

হাওরের শুরুর ইতিহাস, হাওরের বিবর্তনের পাশাপাশি বাদ যায়নি হাওরের মুক্তিযুদ্ধও। মুক্তিযুদ্ধে হাওর এলাকার মানুষের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। হাওরের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের পরিচয় সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদসহ ঈশা খাঁ, আনন্দমোহন বসু, হাসন রাজা, গুরুদয়াল সরকার, বৃন্দাবন চন্দ্র দাস, উকিল মুন্সী, আবদুল মোমেন খান, মাওলানা মতলেব উদ্দিন আনোয়ারী (রহ.), দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, শাহ আবদুল করিম, আবদুস সালাম আজাদ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

অন্যদিকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান নিয়েও সীমিত পরিসরে আলোচনা করেছেন লেখক।

হাওরের মানুষের জীবন ও জীবিকা অধ্যায়ে ওঠে এসেছে জিরাতি, দাওয়াইল্লা, মৎসজীবীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের মৌসুমি পেশার কথা৷ এগুলোর পাশাপাশি হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য, লোকশিল্প, সংস্কৃতি ও উৎসব নিয়ে অসংখ্য তথ্য পাওয়া যায়।

লেখক দেখিয়ে দিয়েছেন হাওরের সম্ভাবনার নানান দিক। প্রশ্ন তুলেছেন এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, হাওরে মাছের প্রাকৃতিক বংশবিস্তার অস্বাভাবিকভাবে কমছে। হারিয়ে গেছে দেশীয় প্রজাতির ধান। যেমন- রাতা, গচিশাইল, নাজিশাইল, লাকাইল, টেপি ইত্যাদি। বিলুপ্ত হয়ে গেছে দেশীয় প্রজাতির বাচা, ঘারুয়া, ছেপচালা, ঢেলা, রিটা, বাঁশপাতা, নাফতানি, নাপিত কই, তারা বাইম, নামা চান্দাসহ আরও অসংখ্য মাছ। এছাড়া কমছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যাও।

আক্ষেপ করে লেখক লিখেছেন, “একসময় দেশের প্রাণিজ আমিষের বড় অংশের চাহিদা মেটাতো হাওরের সুস্বাদু মাছ। কিন্তু এখন খোদ হাওরের বাজারেই রাজত্ব করছে চাষের পাঙ্গাশ।”

লেখক বশির আহমেদ হাওরের সমস্যা যেমন চিহ্নিত করেছেন, তেমনি সম্ভাবনা নিয়েও আলোকপাত করেছেন। হাওরকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। হাওরের শ্রমজীবী মানুষ, উর্বর মাটি, বিশাল জলরাশি, শস্য ভাণ্ডার, মৎস ভাণ্ডার ও অপার সম্ভাবনার পর্যটন শিল্প এসব উৎস হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তিশালী খাত। সেজন্য প্রয়োজন হাওরের জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার।

বইটিতে পরিবেশ সুরক্ষায়, কৃষি ও মৎস্য উন্নয়নে, জীবিকা নির্বাহে, শিক্ষা প্রসার ও মানোন্নয়নে এবং স্বাস্থ্য,পুষ্টি ও স্যানিটেশন নিশ্চিতকরনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশকিছু সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। সে সাথে বর্তমান সরকার হাওর মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নের বিবরণও তুলে ধরা হয়েছে।

কিন্তু লেখক হাওর অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানা নির্ণয় করতে পারেননি তথ্যের ঘাটতিতে। সরকারিভাবেও ঘোষণা নেই তাতে কয়টি উপজেলা রয়েছে। বইযে শুধু বলা হয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলা সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাম্ যে পঁচিশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বিস্তীর্ণ নিন্মভূমিই হাওর অঞ্চল।

ধ্রুপদী বিষয়বস্তুর উন্মত্ততা, প্রাঞ্জল সুখবোধ্য ভাষা প্রমিত শব্দচয়নে বলিষ্ঠতা, ছোট ছোট বাক্যে গতিশীলতা ‘হাওরের ইতিহাস-ঐতিহ্য’কে অনুপমেয় উচ্চতা দান করেছে। মেহেদী পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত ২২২ পৃষ্ঠার মলাটবদ্ধ এই অনন্য সৃজনের প্রচ্ছদ এঁকেছে প্রজাপতি প্রিন্টিং এন্ড ডিজাইন।

বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করবেন তথা আগামী দিনের গবেষকদের জন্য সহায়কগ্রন্থ হতে পারে ‘হাওরের ইতিহাস-ঐতিহ্য’ বইটি, যা ইতোমধ্যে বাজারে এসে পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে সাড়া ফেলেছে।

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

‘হাওরের ইতিহাস-ঐতিহ্য’: তথ্যভিত্তিক প্রামাণ্য দলিল বই রফিকুল ইসলাম সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর