কবিতার বরপুত্র
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৩২
সময় তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাড়াতে তাড়াতে নিয়ে যায় শব্দ ছন্দের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো সে নিবেদিত হতে থাকে কবিতার দেহ-মনে। জানে সে, কবিতা এক শব্দনির্ভর শিল্প। কেবলই শব্দ-চিত্র-কল্প-রূপসম। আর কোনো কলকবজা নেই। নেই আর কোনো উপাদান। কবিতার শরীরজুড়ে শুধুই শব্দ। কবিতা শব্দের শিল্প। এ শব্দ নিয়ে যত কারিকুরি চলে কবিতায়। যে হাত উত্থিত ছিল মিছিলে, সেই হাত শব্দ-ধ্বনির বিস্তৃতিতে তুলে আনে জীবনের চালচিত্র। মানুষের কাছে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জীবনকে দেখেন কখনো সমাজবদ্ধ, কখনো রাজনৈতিক প্রাণী, কখনো হৃদয় উৎসারিত আবেগের প্রতিষ্ঠান। যে জীবন তাকে নিয়ে গিয়েছিল মিছিলে, স্লোগানে স্লোগানে করেছিল আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত, সামরিক জান্তাশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথ, জনপদে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সেই একই জীবন তাকে নিয়ে গেছে শব্দের ভেতরে ভেতরে-তলায় গিয়ে কবিতাকে আবিষ্কার করা।
সবচেয়ে সরল দেখতে জিনিসটাকে বিশ্লেষণ করাই সবচেয়ে কঠিন বলেছেন কবি মালার্মে। এ কঠিন কাজটির মধ্যে কবি শেখ মাতিন মোসাব্বির নিজেকে এমনভাবে প্রথিত করেছেন যে, সুচতুর শিল্পীর মতো শব্দ কারিকরে নিজেকে উন্নীত করেছেন। বলেছেনও কবিতায়, ‘জীবন নক্ষত্রের ন্যায়’। আবার যান্ত্রিক জীবন কবিতায় লিখেছেন, ‘নক্ষত্রের পতন বুঝি আসন্ন/ ধরণীর পতন বুঝি আসন্ন’।
নব্বইয়ের দশকের রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা একুশ শতকে এসে কবিতার অনন্ত নক্ষত্রবীথির মধ্যে নিজেকে প্রাণিত করেছেন। উন্মাদনা বা দ্রোহের আগুন ঝলসে ওঠে। তার কবিতা হেঁটে যায় আত্মগত নিভৃতির বৃত্ত বেয়ে, কোথাও তাদের পৌঁছানোর তাগিদ যেন সেভাবে নেই। তার কবিতায় প্রেম, জীবন-মৃত্যুনেশা, সত্য-মিথ্যা, আঘাত-প্রত্যাঘাত এবং এমন একটা চক্রের ভেতরে নিজেকে ঢুকিয়ে নেওয়া, যা অস্থিত এবং যা থেকে ছাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তার কবিতায় এক সৌন্দর্যপ্রেমী স্রষ্টাকে দেখা যায়। যার হাতে নাটকীয়তা ও ভাবহীন ঘোষণার এক ঝলসে ওঠা অস্ত্র আছে। যে খুব সচেতনভাবে লুকিয়ে রাখে শোক ও বেদনার আন্দোলন। তিনি প্রেমের ওপর কাব্য যেমন লিখতে চান, তেমনই দ্রোহের ভাবও তার কবিতায় উঠে আসে। বলেনও তিনি, ‘সবাই যদি লোভ করে, ভালোবাসবে কে? সকলেই যদি স্বার্থ চিনে, বিপ্লবী হবে কে?’ (নষ্ট আমি)।
বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ তার প্রিয় বিষয়। তিনি তা ধারণও করেন আন্তরিকতার সঙ্গেই। স্লোগানেই রাজপথ কাঁপানো কবিতা স্লোগান হয়ে জীবন এবং শিল্পিত ইমেজকে বহাল রেখেছেন।
কবি সাব্বিরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনুভূতির অনুরণন’ একজন শক্তিশালী কবির সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে। প্রথম গ্রন্থের অনুসরণে দ্বিতীয় গ্রন্থের নামকরণ করেছেন ‘অনুভূতির অনুনাদ’। পূর্ববর্তী কাজের ধারাবাহিকতায় যেন প্রথম গ্রন্থ থেকে দ্বিতীয় গ্রন্থের উত্তরণকালে তার চিন্তাচেতনা, মেধা-মননের স্তর আরও শানিত হয়েছে।
কবি সাব্বির আমার চেনা জগতের প্রথিতযশা সাংবাদিকের পুত্র হিসেবে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করার কাজটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। কবির পিতা শেখ রকিবউদ্দিন আমার পূর্বপরিচিত, সজ্জন, ঘনিষ্ঠ-স্বজন একই পেশার কারণেই। সেই সুবাদে পুত্রকেও চেনা। আমি তার কবিতা পাঠ করি তার সময়কালকে সামনে রেখে। প্রত্যাশা-কবিতায় মাস্তুলের শীর্ষদেশে ওঠে যেন সে সোচ্চারে বলে উঠতে পারে, আমি এই বাংলার মাটি ও মানুষের কবি।
লেখক: মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি); একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, কবি
সারাবাংলা/আইই