সংস্কৃতি ও অপরাধের নানা রূপ দর্শন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৪০
মানুষকে মানুষ হয়েই বেঁচে থাকতে হয়। এর বিকল্প খুঁজতে গেলে বা ভাবতে গেলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তা মনুষ্যত্ববিহীন বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করে। মানুষকে ‘মানুষ’ হতে গেলে সমাজ অভিজ্ঞতার মিশ্রণে শুদ্ধ আচরণের বাহক হতে হয়। এ শিক্ষা মোটেই সহজ নয়। একজন মানুষ বা সমগ্র জনগোষ্ঠীকে পরিপূর্ণ নাগরিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে একটি দেশের সামাজিক বেষ্টনী অন্যতম প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখে। সমাজে প্রচলিত ধারনা ও ভাবনা, অনুশীলিত মূল্যবোধ ও আদর্শিক সদ্ভাব সম্পর্কে সজাগ হওয়া এবং সম্প্রীতি ও সহনশীলতার শিক্ষা ও চর্চা অপরিহার্যভাবে অনুভূত হয়। এর বাইরে গিয়ে একজন মানুষের জীবন নানাবিধ অপরাধ বা বিচ্যুত আচরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়। জন্মগতভাবে মানুষ শৃঙ্খলার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, মানতে চায়। নৈরাজ্য পরিহার করে প্রচলিত আইনের প্রতি ভয় বা ভয়ের কারণে মেনে চলার প্রবণতা মানুষের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বা মনুষ্য সমাজের একটি সহজাত ভাবধারা। এই ভাবধারায় মানুষকে অভ্যস্থ করতে রাষ্ট্রের এতো আয়োজন, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মমুখর ব্যাপ্তি এবং মানুষের এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা।
অনেক প্রশ্নের সহজ উত্তর বা সমাধান অনেকসময় দিতে কষ্ট হয়। কারণ সহজ কোনো সমাধান নেই। তীর্যক বিতর্ক নিয়ে আলোচনা চলছে, মানুষ কেন অপরাধ করে? মানুষের মধ্যে কেনই বা সৃষ্টি হয় অপরাধ প্রবণতা। বিতর্কের একপক্ষ জোরালো যুক্তি আয়েশী ভঙ্গিতে চালিয়ে যাচ্ছে, ছড়াচ্ছে তর্কাতর্কির উর্বর উত্তাপ। যুক্তির মোদ্দাকথা হলো- মানুষ জন্মগতভাবে পূর্ব-পুরুষের কাছ থেকে দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মতো আচারণগত ধরণ বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। মানুষের অপরাধ প্রবণতার সাথে বংশগত সম্পর্ক নিয়ে সম্পাদিত কতিপয় গবেষণায় গবেষকরা জোর দিয়ে বলছেন, মানুষের কোনকিছুই জন্ম প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। বংশানুক্রমিক উপকরণের প্রভাবে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষ ভালো বা মন্দের সাথে সম্পৃক্ত হয়। যে যেভাবে প্রভাবিত হয়, তাকে সমাজ সেভাবে চেনে কিংবা মূল্যায়ন করে।
তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের নতুন পরিধি বাড়ছে, অনেক নিত্য-নতুন অজানা ঘটনা তথ্য সমেত মানুষের আলোচনার টেবিলে দাপটের সাথে জায়গা করে নিচ্ছে। কিংবা মানুষকে ভাবাচ্ছে কেন আমি এমন হলাম! মানুষ নীরবে হলেও জন্মের পরিধি বা নিজের সাথে পূর্ব-পুরুষের মিল খুঁজতে গিয়ে কখনো খুশি হয় আবার কখনো বেদনা বা হতাশার তালিমে ডুবে যায়, কখনো নিরাশার কুয়াশায়। এ এক অভিনব কায়দা, আজব ক্রিয়ার তরল সমীকরণে মানুষ সবসময় তটস্থ থেকেছে। নিজেকে নিয়ে, নিজের ভবিতব্য নির্মাণ নিয়ে কিংবা সমাজে বা মানুষের কাছে নিজের অর্জিত পরিচয় কিংবা অবস্থান নিয়ে। মানুষ ভাববে এবং ভাবতে গিয়েই আবেগ নিয়ন্ত্রণে আসবে। যখন মানুষ বুঝবে সঙ্গ দিয়েই সঙ্গী হয়। হয় পরস্পর জড়িয়ে ধরার এক কোমল পরশ। সমাজ সম্প্রীতি মানুষের জন্মগত বা জাতিগত পরিচয় থেকে আলাদা কিছু নয়।
এই পরিচয় যে জাতি ঠিক যেভাবে ব্যবহার করবে সেখানে সেই রংয়ের ফুল ফুটবে। ফুলের গন্ধ, প্রকৃতি বা সৌন্দর্যের বাহারি উপভোগ্য সেইভাবে হাজির হবে। মানুষের জীবনটাও ঠিক এরকম। যেমন বীজ তেমন ফসল বা জীবনের একান্ত উপহার, মানুষের জীবন।
তর্কের অন্যপক্ষের যুক্তিও খুব দুর্বল নয়। এ পক্ষের বোদ্ধারা বলছেন মানুষ জন্মগত প্রক্রিয়ার অনেককিছু সংশোধন করতে পারে। পারে মার্জিত হতে, পারে নিজেকে ঠিক জ্যামিতিক কাঁটার মতো সোজা রাখতে বা পেতে পারে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলার প্রয়োজনীয় পরামর্শ কিংবা প্রতিষেধক। এ পক্ষের বোদ্ধাদের মুল তর্কের জায়গা হলো- মানুষ পরিবেশ-পরিস্থিতি, সামাজিক অনুশাসন, সাংস্কৃতিক উপকরণের চর্চা ও আচরণে রপ্তকরণ, পরিবার থেকে পাওয়া সামাজিকীকরণ বা মানুষ হওয়ার দীক্ষা, সম্পর্কের প্রতিবেশ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাস ও সম্মানবোধের বৈশিষ্ট্য মানুষকে মার্জিত রাখে। কিংবা মানুষকে সঠিকভাবে মানবিক অবয়ব নিয়ে চলার পথে দরকারি শিখনে সহযোগিতা প্রদান করে। চারপাশের প্রভাব মানুষের জীবনে সর্বদা ক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখে। মানুষের সামাজিক বৈশিষ্ট্য অর্জনে মানুষের সাথে মানুষের কথন ও পরস্পর সাহচর্য গুরুত্বের দাবী রাখে। মানুষকে সকল জীর্ণতা পরিহার করে সঠিক পথে পরিচালনে মানুষের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মানুষ যেভাবে বেড়ে ওঠে অর্থাৎ মানুষের জীবন পরিচালনা পদ্ধতির সাথে অন্যায় আচরণ, অপরাধপ্রবণ মানসিকতা, নির্যাতন কিংবা নিপীড়ন প্রবণতা জড়িত। মানুষ এগিয়ে চলার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সকল শুভ বা অশুভ শক্তির সাথে পরিচয় ঘটে। মানুষ নৈতিক ভিত্তি বা শিক্ষার প্রভাবে নিজের দিকগুলো অন্বেষণ করে কিংবা সেই সমস্ত দিকের সাথে জড়িয়ে যায়। মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা সমাজ ও সংস্কৃতির বাইরের কোনো বস্তু নয়। বরং সমাজ ও সংস্কৃতির অপব্যবহার অর্থাৎ ক্রটিপূর্ণ দিকগুলো মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। আইন ভঙ্গ করতে উৎসাহ দেয়। অন্যের অধিকার হরণ করে আনন্দ পাওয়া বা গর্ব অনুভব করার দীপ্ত প্রলোভনে মানুষকে ঠেলে দেয়। মানুষও হাত মেলায়। তবে ব্যক্তিত্ব ও মানসিক পরিপক্কতা, সামাজিক দক্ষতা এবং নৈতিক মর্যাদায় বলিষ্ঠ হলে শুভ বৈশিষ্ট্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ জন্মায়।
অন্যথায় মানুষ দখল করে অথবা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। প্রতিষ্ঠিত করে আধিপত্যের দীর্ঘ মিছিল। যেখানে মানুষকে মূল্যায়ন করা হয় অনুগত বস্তুতে বা দাস সমতুল্য বিচার্যে। মানুষের এরূপ আচরণ অপরাধের উপযোগি ক্ষেত্র বা অপরাধ সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। তখন মানুষের প্রতি মানুষের দয়া, দায়বদ্ধতা কিংবা করণীয় সম্পর্কে এক ধরনের অনীহা পরিপুষ্ট হয়। মানুষকে পরিণত করে অমানুষে বা আইন ভঙ্গকারী অপরাধী হিসেবে।
একটি দেশের মানুষের মধ্যে সংস্কৃতিবোধ বা দেশের মানুষ সংস্কৃতিবান্ধব না হলে বিশৃঙ্খলার নৈরাশ্য মানুষের আচরণকে আঁকড়ে ধরে। নৃশংসতা বা নিষ্ঠুরতার সংস্কৃতি সমাজে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। মানুষকে মানবিক বৈশিষ্ট্য থেকে বের করে অপরাধের মতো বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করে এবং পরাজিত শক্তিতে পরিণত করে। সংস্কৃতি মানুষকে অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায় এবং মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো সামাজিক প্রেরণা দেয়। অপরাধীর প্রতি সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে সংশোধনের প্রতি গুরুত্ব দেয়। সংস্কৃতিবোধ সম্পন্ন মানুষের মধ্যে সাধারণত প্রতিশোধের সংস্কৃতি বা স্পৃহা জন্মায় না। অন্যের ক্রটি-বিচ্যুতির প্রতি মানবিক হতে শেখায়।
সমাজের মানুষকে সামাজিক প্রত্যাশা, সংস্কৃতির নিজস্ব ধরনের মধ্যে সমন্বয় করে নিজস্বতা নিয়ে চলতে হয়। উগ্র সংস্কৃতি ও এর উপকরণ পরিহার করা অপরিহার্য। নিজস্বতার প্রতি আগ্রহ ব্যতিরেকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব তবে তা ভারসাম্য বিনষ্ট করে। সমাজে সামাজিক বঞ্চনা বা বৈষম্য সৃষ্টি করে যা মানুষকে দায়িত্ব নেয়ার পরির্বতে অসহিষ্ণু ও স্বার্থপরতার কৌশলে আবদ্ধ করে। আইন বা সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শগত বলয়কে নিজের স্বার্থে বা সুবিধায় ব্যবহার করতে প্রণোদনা দেয়। ফলে সমাজ হয়ে যায় একপেশে বা দুষ্ট লোকের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। সমাজের মধ্যকার অনুশাসন বা দায়বদ্ধতার সংগীত সকলের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। এরূপ সমাজে অপরাধ হবেই এবং অনেকক্ষেত্রে অপরাধ-ই সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়। অপরাধের ক্ষেত্রে সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক ধারনা খুব স্পষ্ট এবং তা হলো-সমাজ কর্তৃক কোনো একটি আচরণ বা বিকৃতিপনা অগ্রহণযোগ্য হতে হবে এবং আইনের মাধ্যমে আইনি সমাধান খোঁজা হয়। প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ। তবে অপরাধ প্রবণতা মানুষের মনস্তত্ত্ব গঠনের সাথে সম্পৃক্ত।
কীভাবে একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে বা তৈরি করানো হয়েছে, এটি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা ধারনা একদিনে তৈরি হয় না। ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবং নির্দিষ্ট সময়ে বিচার না হওয়ার ঘটনা বা পরিস্থিতি অপরাধের জন্ম দেয়। এই দুই ঘটনা একত্রিত হলে সেই সমাজের মানুষকে অপরাধ থেকে মুক্ত করার সহজ কোনো রাস্তা থাকে না।
বাংলাদেশে চলমান অপরাধ জংশন বিচার করলে উপলদ্ধি করা যায় যে, এদেশের কিশোরদের মধ্যে একটি অংশ সংস্কৃতির সুস্থ ধারা অনুসরণ করছে না। উগ্রতাপূর্ণ সংস্কৃতি ও দাম্ভিক জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে। নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপকরণ পরিহার করে বা কম গুরুত্বের মনে করে পরদেশী বাহনে চড়ে বেশি দূর যাওয়া কষ্টের। বিশেষ করে সেই যাত্রা যদি জীবন সম্পৃক্ত হয়। সমাজ বা মানুষকে অপরাধমুক্ত রাখা বা অপরাধের সংখ্যা সহনশীল পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে সমাজস্থ মানুষকে ‘মানুষ হওয়ার’ শিক্ষা দেয়াটা জরুরি এবং সমাজে অপরাধের বিচার ও অপরাধীর সংশোধনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত তৈরি করা অপরিহার্য।
লেখক: কবি ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
তৌহিদুল হক প্রবন্ধ সংস্কৃতি ও অপরাধের নানা রূপ দর্শন সাহিত্য