নজরুল আজো কেন স্মরণীয় ও শরণীয়
২৫ মে ২০১৮ ০৯:১৯
।। সৌমিত্র শেখর ।।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় লিখেছেন: তিনি ভবিষ্যতের ‘নবি’ নন, বর্তমানেরই ‘কবি’। ‘নবি’ শব্দটি তিনি কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন? অভিধানে দেখলাম, এর তিন প্রকার অর্থ আছে। ‘নবি’র একটি অর্থ হলো ‘সংবাদদাতা’। তাহলে নজরুল হয়তো একথাই বলেছেন, তিনি বর্তমান নিয়ে কবিতা লেখায় আগ্রহ পান, ভবিষ্যৎ তাঁর লক্ষ্য নয়। যখন ক্ষুধাতুর শিশু একটু নুনভাতের জন্য কাঁদে, তখন তিনি কবিতা লিখে শুধু ভবিষ্যতের মানুষের জন্য সংবাদদাতা সাজতে চান না, হতে চান সেই ক্ষুধাতুর মানবসন্তানদের মুক্তিদূত! সে মুক্তিদূততো তিনি হয়েই ছিলেন।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকালে তিনি ডাক দিয়েছিলেন: ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন, / কাণ্ডারী বল ডুবিয়ে মানুষ সন্তান মোর মার’; রাজনৈতিক নেতাদের আপসকামী মনোভাব দেখে ডাক দিয়েছিলেন: ‘ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়’; শাস্ত্রধারীদের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদে লিখেছিলেন: ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ / গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’ নজরুল-সমকালে এসবইতো ছিল মুক্তির ডাক! যে ডাক দিতে সমাজসংস্কারকগণ ছিলেন দ্বিধান্বিত, রাজনৈতিক নেতাগণ ছিলেন বিচলিত, ধর্মীয় নেতাগণ ছিলেন পশ্চাৎপদ, অগ্রগতির সেই সমকালীন আহ্বানতো নজরুল দিয়েছিলেন। তাঁর সময়টা ছিল বিশের শতকের প্রথম ভাগ। এরপর আমরা আরো একশ বছর পেরিয়েছি। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এসে আবার কি নজরুলকে শরণ করবো আমরা, যেখানে নজরুল নিজেই হতে চাননি ভবিষ্যতের সংবাদদাতা? বিষয়টি নজরুলের চাওয়া না-চাওয়ার ওপর নির্ভর করে নেই, নির্ভর করে আছে তাঁর জীবনযাপন আর সৃজনের উপযোগিতার ওপর। সামন্তযুগের লেখক লেভ তলস্তয়কে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা ভ. ই. লেনিন অভিহিত করেছিলেন ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’ বলে। কারণ, নিজে ধনী হলেও এবং সামন্তসমাজে বসে লিখলেও তলস্তয়ের লেখায় লেনিন পেয়েছিলেন সমাজ-অগ্রগতির চাবি, যে চাবি দিয়ে রুশ জনতা মুক্তির দরজা উন্মোচন করতে পেরেছিল। তেমনি, বিশের শতকে লিখলেও উপযোগিতার বিচারে নজরুলের জীবন ও রচনা আজকের একুশ শতকের বাঙালিজীবনেও সমানভাবে আদরণীয়। কারণ, সময় এগোলেও সমাজ থেকে বিশ শতকের আবিলতা একুশ শতকেও তিরোহিত হয়নি।
নজরুলকে শুধু ‘বিদ্রোহী’ বলে মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দেবার শংকা নজরুল নিজেই করেছিলেন। বলেছিলেন: ‘‘আমাকে ‘বিদ্রোহী’ বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ।’’ আসলে ‘ভয়’ নয়, ‘বিদ্রোহী’ বলে নজরুলকে নিয়ে বাঙালি গর্বই করে। কিন্তু সেখানেই আটকে রাখা হয়েছে নজরুলকে- সমস্যার সূত্রপাত ওখান থেকে। তাঁকে শক্তিশালী পুরুষ-প্রতিমা হিসেবে গ্রহণ করেছেন বাঙালি। বাঙালি কি শুধু যুদ্ধই করে নাকি প্রেমও করে? নজরুলের লেখা কিন্তু শুধু একপথে বা সরল পথে অগ্রসর হয়নি। যে সংগ্রাম করে সে প্রেমও করে। লেনিন কবিতা পাঠ করতেন, মার্কস্ কবিতা রচনা করেছেন, মাও সেতুং নিজেও কবিতাপ্রেমী ছিলেন। নজরুলও তেমনি যুদ্ধের কথা বলেও প্রেমের কথা বলেছেন। নজরুলের সাহিত্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি ‘পলিটিক্যাল এসথেটিক্স’ তৈরি করা যেতে পারে- এটি তৈরি হয়নি, হলে খুব বড় কাজ হতো। সেই ‘পলিটিক্যাল এসথেটিক্স’-এর সঙ্গে তাঁর পুরো জীবনকে যুক্ত করে যদি আমরা ভাবি, তা হলে একটি নতুন পথের দিশা মেলে এবং সেটি এই একুশ শতকেও দিব্যি প্রয়োজন।
নজরুল আধুনিক কবি কি না- এই প্রশ্নটি সেকাল যেমন উঠেছে, একালেও মাঝে মাঝেই ওঠে। কারণ নজরুলের পরই জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব-অমিয়-বিষ্ণু দে’রা যে অত্যুঙ্গ আধুনিকতাবাদী আন্দোলন করে বাংলার কাব্যমুক্তির পথ দেখান, নজরুল তাঁদের থেকে পেছনে কিনা, আর পেছনে থাকলে তা কতোটুকু সে নিয়ে তর্ক-প্রতর্কের অভাব নেই। নির্দ্বিধ হওয়া প্রয়োজন, নজরুলের আধুনিকতা এই পঞ্চকবির আধুনিকতা নয়। নজরুল আধুনিকতার মধ্যে বাস্তবতা ও প্রত্যক্ষতার সম্মিলন ঘটানো কবি। এটি তাঁর আগে আর কেউ করেননি, এমন কি রবীন্দ্রনাথও নন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘উর্বশী’ কবিতায় যেখানে বলেন: ‘স্বর্গের উদয়াচলে মূর্তিমতী তুমি হে উষসী, / হে ভুবনমোহিনী উর্বশী! / জগতের অশ্রুধারে ধৌত তব তনুর তনিমা, / ত্রিলোকের হৃদিরক্তে আঁকা তব চরণশোণিমা- / মুক্তবেণী বিবসনে, বিকশিত বিশ্ববাসনার / অরবিন্দ-মাঝখানে পাদপদ্ম রেখেছ তোমার / অতি লঘুভার।’
সেখানে নজরুল তাঁর নায়িকা সম্পর্কে বলেন: ‘‘আজ কপট কোপের তূণ ধরি’ / ঐ আসল যতো সুন্দরী, / কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউবা আগুন, / কেউ মানিনি চোখের জলে বুক ভাসে!’’ এখানে ‘আসল’ শব্দের ব্যবহার আছে ‘এলো’ অর্থে। ‘এলো’ অর্থে ‘আসল’ কথাটি একেবারেই কথ্য। এই কথ্য শব্দের সাবলীল ব্যবহারতো হয়েইছে, উপরুন্তু ব্যবহার হয়েছে ‘খুন’ শব্দ। ‘খুন’ শব্দ নিয়েও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাহিত্যিক তর্ক হয়েছিল, যে বাংলা কবিতা, বিশেষত প্রেমের কবিতায় খুন শব্দ ব্যবহার করা যাবে কিনা! ‘সাহিত্যে খুনের মামলা’ এ বিষয়ে খুবই পরিচিত একটি অধ্যায়, যেখানে রবীন্দ্র-নজরুলের এতদ্বিষয়ক মত পাওয়া যাবে। অন্যত্রতো বটেই, নজরুল প্রেমের কবিতায়ও অনায়াসে ‘খুন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই ধারাতেই কিন্তু আধুনিক পঞ্চকবি শব্দ-স্বাধীনতা গ্রহণ করেছিলেন এবং পরে রবীন্দ্রনাথও নিজের কবিতায় লিখেছিলেন: ‘গলিটার কোনে কোনে / জমে ওঠে পঁচে ওঠে / আমের খোসা ও আঁটি, কাঁঠালের ভূতি, / মাছের কান্কা / মরা বেড়ালের ছানা- / ছাইপাঁশ আরো কত কী যে!’ আর সে-সূত্রেই কিন্তু বাংলা কবিতায় শব্দমুক্তি ঘটে।
এযুগের কবিকুল, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর কবিরা শব্দ নিয়ে যে জাদুকরী খেলায় মত্ত, নজরুলের চেতনা এখানে যে কার্যকর, সেটা ভাবাই যায়। আধুনিক পঞ্চকবিদের আগেই যিনি সূচনাটা করলেন এবং যাঁকে অনুসরণ করছেন উত্তর-আধুনিক কবিকুল, তাঁর ‘আধুনিকতা’ নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলা অবান্তর। নজরুল দুঃখকে জয় করা এক প্রবল পুরুষ। তবে তিনি দুঃখের সাগরে সাম্পান নিয়ে সাফল্যের মুক্তো খুঁজেছেন। আর এক্ষেত্রে তিনি সাথে নিয়েছেন রক্তমাংসের প্রেমিকাকে। রবীন্দ্রনাথ যেখানে দেহহীন নারীকে সাথী করে চলেছেন, যে নারী হলো এক বিমূর্ত সৌন্দর্য, যে দেখা যায়, দেখা যায় না- ধরা যায়, ধরা যায় না- চিরকাল ছলনাময়ী বা করুণাময়ী; নজরুল সেখানে রক্তমাংসের নারীকে নিয়েছেন সাথে, ঐসব ভাবাবেগের ধার ধারেননি। তিনি সরাসরি একটি রক্তমাংসের দেহী নারীকে চেয়েছেন। এই দেহী নারীর কথাই কি আমরা গত শতকের পঞ্চাশের, ষাটের, সত্তরের দশকে দেখি না? এরও আগে ছিল।
জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে পরের কবিকুলেও। শামসুর রাহমানের মধ্যেতো দেহহীন নারী একেবারেই নেই- তিনি বরং নারীদেহকে ‘অবজেকটিভলি’ দেখেছেন। যেন, নারীদেহ হলো একটি ‘অবজেক্ট’- এই নারীদেহে কী কী দেখা যাচ্ছে না যাচ্ছে- সেটাই মুখ্য বিষয়। এই যে দেহকে ফিরিয়ে এনে মানুষকে সত্যিকার অর্থেই মূল্য দেয়া, এটা নজরুল করতে পেরেছিলেন। ভারতে ইংরেজশাসনের আগে আমাদের শিল্প, সাহিত্য, দর্শন সব কিছুই কিন্তু ছিল দেহনির্ভর। আমরা যে চিত্রকলা দেখি বা স্থাপত্য দেখি বা গুহাচিত্র দেখি অথবা মন্দিরগাত্র পর্যবেক্ষণ করি- সর্বত্রই কিন্তু দেহের সৌন্দর্য ও উর্বরাশক্তিকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীতে কতো কিছুইতো সুন্দর আছে- কিন্তু মানুষের চেয়ে সুন্দর পৃথিবীতে আর কি কিছু আছে? ইংরেজ আমলে ভিক্টোরীয় নীতিচর্চা করে বাংলাবাসী তথা ভারতবাসীদের দেহচর্চা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দেহ ভিন্ন আর সৌন্দর্য অন্য কিছু। তারা মানব-মানবীর সম্পর্কের মধ্যে একটি আবিলতা, জটিলতা দেখেছে আর এতেই মানুষ কম মর্যাদা পেয়েছে। মানুষের আত্মশক্তি কমে যায় এতেই। কিন্তু এই চেতনা ভেতরে ভেতরে ধারণ করে থাকে লোকদার্শনিকগণ বা বাউলমতের মানুষেরা। তবে এই লোকদার্শনিক বা বাউলরা তথাকথিত সভ্যসমাজে আদৃত নন। এখনো আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক একটি কাদাছিটানো-সম্পর্ক হিসেবে চলছে।
নারীর শরীরে পুরুষের স্পর্শ লাগলে নারীর দেহের সে অংশ যেন অপবিত্র হয়ে যায়, আবার পুরুষ নারীর শরীর স্পর্শ করতে পারলে যেন মহামৃতসুখ অনুভব করে- এদুটোই পরস্পরের দেহবিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ভূত। ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়ের মধ্যে দুস্তর ফারাক রক্ষার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। একটু বড় হলেই ছেলে আর মেয়ের জগৎ যেন সর্ব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নজরুল তাঁর লেখাতে কিন্তু এই ভিক্টোরীয় চেতনাবিরোধী। নির্মল জল আর চাঁদের খেলা যেন নারী আর পুরুষের। কিন্তু দুটো এক সঙ্গেই কি সুন্দর নয়? এই সৃষ্টিজগতে বিরাজিত আছে এক অনিঃশেষ কামভাবনা। এটা যৌনতা নয়, সৃষ্টির এষণা। সৃষ্টির এষণা আছে বলেই পৃথিবী সুন্দর এবং চলমান। এটি বন্ধ হয়ে গেলে পৃথিবী থমকে যাবে। দার্শনিক এই গূঢ়সত্য নজরুল ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং তাই তিনি তাঁর লেখায় বারবার নারীপুরুষের সম্মিলিত সত্তাকে ভারতীয় চিরায়ত অনুভাবনার আলোকে তুলে ধরেছেন এবং ইংরেজ ভিক্টোরীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করেছেন। এই নন্দনতত্ত্ব নতুনভাবে চর্চিত হচ্ছে উত্তর-আধুনিক লেখকদের মধ্যে। নজরুলে আছে এর আধার।
ভাবতে হবে, নজরুল সংবর্ধনা পাচ্ছেন একেবারে তরুণ বয়সে, ঊনত্রিশ বছর বয়সে। এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এতো কম বয়সে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বাঙালিজনের মন হরণ করেছিলেন, আর করেন নজরুল। এই বয়সে এতো বড় সংবর্ধনা পাবার কথা নয়; কিন্তু পেয়েছিলেন। তাহলে কী ছিল নজরুলে? তাঁর চেহারায়, চলাফেরায়, সমস্ত অবয়বে যে একটি দ্রোহীভাব প্রকাশ হয়েছিল- তা সত্যি অবাক করার মতো। শুধুই কি বিদ্রোহ ছিল? না। তাঁর ছিল রোমান্টিসিজম। এটি রোমান্টিসিজমের আধুনিকতা আছে, এই রোমান্টিসিজমের মধ্যে রেনেসাঁ আছে এবং এ রোমান্টিসিজম আমাদের স্বকীয় রোমান্টিসিজম, পাশ্চাত্যের রোমান্টিসিজম নয়।
যে রোমান্টিসিজম আমরা জন্মগত, সহজাতভাবে অর্জন করি জীবনধারা থেকে- একেই কি বলবো না- ‘এলিমেন্ট অব লাইফফোর্স’? নিশ্চয়। এটি নজরুলের মধ্যে ছিল এবং এটি নজরুল ইউরোপ থেকে পাননি- এটি তিনি শেলি, কিটস্, বায়রন থেকে পাননি- এটা তাঁর ভেতর থেকে এসেছে। এসেছে দুটো পথে: একটি হচ্ছে- তিনি যে পর্যায় থেকে উঠে এসেছেন, দরিদ্র কাজি পরিবারে তাঁর জন্ম- এই পরিবারের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য ছিল; তা ছাড়া তিনি যখন করাচিতে ছিলেন সে সময়ও তিনি ইরান, তুরান, আরবি সাহিত্যসমূহ পাঠ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের যে রোমান্টিসিজম, মানে সুফি ভাবধারার মাধ্যমে জীবনকে ভালোবাসা- তা নজরুলকে প্রভাবিত করেছে। আর একটি ধারা হচ্ছে, ভারতীয় লোকায়ত সমন্বয়বাদী ধর্ম। আমাদের লোকজীবনে এক সমন্বয়বাদী পথ আছে এবং সেখানে মাতৃকেন্দ্রিক নিবেদন আছে- মায়ের কাছে শরণ প্রার্থনা করা, স্নেহতল প্রার্থনা করা- সব সন্তান সেখানে অবনত হচ্ছে। নজরুলও সে পথ অনুসরণ করেন। ভারতীয় পুরাণে নারীরা যে ক্ষমতা ও মমতার আধার, এটি নজরুল মনে মনে ধারণ করেছেন এবং সমীহ করেছেন। তাই ‘কালো মায়ের পায়ের তলায় দেখে যা রে আলোর নাচন’- এই বলে তিনি, সেই বিদ্রোহী নজরুল, করুণাময়ী মায়ের পদতলে আশ্রয় নিয়েছেন, নত করেছেন নিজেকে। এই নত ভাব মানে পরাজয় নয়, আত্মসাঁকো বন্ধন। এই প্রণত ভাবটিই হলো রোমান্টিসিজম। আর এটি এসেছে লোকায়তধারা ঐতিহ্য থেকে। নারীর পায়ে নিজেকে সমর্পণ- হোক তিনি মা বা প্রিয়া- এই সমর্পণের ব্যাপারটি নজরুলের মধ্যে আছে ব্যাপকভাবে। তাই নজরুল পাশ্চাত্যের ঘরানায় নন, এদেশীয় ধারায় রোমান্টিক। অন্ধ পাশ্চাত্যানুসরণ নয়, স্বদেশিচেতনায় রোমান্টিক হবার প্রেরণার জন্যও এযুগে বারবার নজরুলকে শরণ করতে হয়।
নজরুলের কবিতা ‘বিদ্রোহী’- আমরা কে না জানি? সেখানে তিনি কী বলেছেন? আমিত্বের চাইতে কি অন্যকে উদ্বুদ্ধ করা নয়? মনেতো হয়। তিনি বলেছেন: ‘বল বীর-’। এই দিয়ে শুরু। তিনি নিজেকে বীর বলছেন না, বলছেন অন্যকে- বলছেন বাঙালিকে- বলছেন ভারতীয়দের- তোমরা বল: তোমরা ‘বীর’! ‘বল উন্নত মম শির।’ দুর্বল বাঙালি বা ভারতীয়দের জাগ্রত করতে চাইছেন তিনি: বলছেন- তোমরা দুর্বল নও- বল, তোমরা বীর এবং তোমাদের দেখে পর্বতও মাথা হেট্ করে আছে। এভাবেই কিন্তু বড় বড় লড়াইয়ে নেতা তার অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। যেমন পৌরাণিক-সাহিত্যিক, তেমনি ঐতিহাসিক লড়াই। শ্রীমদ্ভাগবত ‘গীতা’য় কৃষ্ণ অর্জুনের মধ্য দিয়ে পা-ব পক্ষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন; রাবণ তার অনুগত সৈন্যদের বলেছে: ‘জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে, যে ডরে ভীরু সে মূঢ়, শত ধিক তারে’। লেনিন বলশেভিক বিপ্লবের সময় রাশিয়ানদের উদ্দেশে ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণামূলক বাণী কিংবা অনুগতদের জন্য হিটলারের বচন- নজরুলের এই ডাক এহেন চেতনার সাথে তুলনা করা চলে। প্রাসঙ্গিকভাবে নজরুলের আর একটি বচন খুব করে মনে পড়ে, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন: ‘আমাদের এমন একটি ছেলে দাও, যে বলবে আমি ঘরের নই আমি পারের, আমি আমার নই আমি দেশের।’ কী অসাধারণ কামনা! আত্মোৎসর্গের এমন কামনা এর আগে কি বাঙালি পেয়েছে? এটাকে অনেকে মুসলিম কমিউনিটিকে জাগানো কথা হিসেবে বলেন। হ্যাঁ, প্রথম-জীবনে মুসলিমজাগরণের প্রতি নজরুলের আগ্রহ ছিল। কিন্তু অতি অল্প পরেই তিনি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়চিন্তার বাইরে চলে গেলেন। শুধু মুসলিম নয়, সব বাঙালি, সব ভারতবাসী তাঁর লক্ষ্য হলো। আর সারাজীবন এই বোধ তিনি লালন করতেন। ১৯২৬ সালে নজরুল যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে বক্তৃতা দিতে আসেন, তখন মুসলিম ছাত্রদের অনেকেই আশা করেছিলেন যে নজরুল মুসলিম উম্মাহকে জাগানোর আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেবেন। আবদুল কাদিরের লেখাতে এই আকাক্সক্ষাটি প্রকাশ পায়। নজরুল কিন্তু তা করেননি। বরং তিনি ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, যে কবিতা পরমভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী। ফলে বোঝাই যায়, পরিস্থিতির চাপের কাছেও নজরুল আদর্শিক পথ থেকে বিচ্যুত হননি, আজ অনেকের মধ্যেই যে বিচ্যুতি দেখা যায়।
নজরুলের আর একটি বড় গুণ হলো, তিনি সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন- ভারতীয় সংস্কৃতি, মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি, এমন কি গ্রিক সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়েছেন তাঁর লেখায়। এর প্রভাবটি কিন্তু পরে তিনি রেখে যেতে পেরেছিলেন। যেমন, গত শতকের নব্বই দশকের যে আন্তঃসাংস্কৃতিক বয়ান কবিরা করেছেন, তার সাথে কিন্তু নজরুলেরই সরাসরি মিল পাওয়া যায়- অন্য কারো নয়। ষাট বছর বা তারও একটু বেশি পরে এমন মিল পাওয়া সত্যি আশ্চর্যের। প্রভাবক শক্তি কতোটা শক্তিশালী হলে এটি সম্ভবপর! নজরুল এমনটি করতে পেরেছিলেন। নব্বইয়ের কবিতায় বুদ্ধিবাদে চেয়ে ইনট্যুইশন বা সজ্ঞাবাদের প্রতি আগ্রহ বেশি। আশির দশকেও এর সামান্য প্রভাব আছে। তারা বলেছেন, আধুনিকতাবাদ আমাদের কিছুই দেয়নি- মহাযুদ্ধ আর রক্তপাত ছাড়া। কারণ মানুষ অনেক বেশি বুদ্ধিবাদী হয়ে স্বার্থবাদী হয়ে পড়েছে। তাই এই স্বার্থবাদী বা বুদ্ধিবাদের চেয়ে আমাদের ফিরতে হবে সজ্ঞার কাছে। নজরুলের লেখাতে বিদ্রোহের পাশাপাশি হৃদয়ের উত্তাপ ভরা সজ্ঞায় ফিরে যাবার কথা আছে। আবেগের সমুদ্রে যুক্তি-বুদ্ধির দ্বীপ একমাত্র অবলম্বন হতে পারে না। নজরুল তা করেননি। তিনি জগৎকে সুন্দর করার জন্য আমাদের আবেগময় ও সজ্ঞাময় হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। আজো কিন্তু তাই প্রয়োজন। অতিবস্তুবাদী হয়ে পথ হারাচ্ছে যখন একুশ শতকের পথিকেরা, তখন নজরুল যেন সজ্ঞার বহর নিয়ে বলছেন: ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?’ আর একটি হচ্ছে সমন্বয়বাদ, যে সমন্বয়বাদ নজরুলের কবিতার, সাহিত্যের মূলমন্ত্র। বাঙালি যদি সংকর জাতি হয়, তবে এর সার্থক রূপায়ণ নজরুলের কবিতায় লক্ষ করা যাবে। এর কিছুটা মোহিতলাল মজুমদারের কবিতায় আছে, তার আগে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের মধ্যেও আছে- তবে সেটা অলঙ্কারগত প্রয়োগ। নজরুল কিন্তু বিশ্বাসের পাতাল থেকে সমন্বয়ের জীবন্ত রাজকন্যাকে উদ্ধার করে আমাদের সমানে এনেছেন এবং নিজের জীবনে সেটা প্রতিফলন করেছেন। আমাদের জীবনে যেমনটি প্রায়ই দেখা যায় না। শুধু অমুসলিম বিয়ের ব্যাপারটিই নয়, সন্তানের নামকরণে একটি মধ্যপ্রাচ্যীয় শব্দের সাথে একটি বাংলা শব্দ যুক্ত করার ব্যাপারটিও তিনি দেখালেন। অমুসলিম বিয়ে করে তাকে দিয়ে ধর্মান্তর গ্রহণ করানোর রীতিটি পুরোনো। নজরুল অমুসলিম বিয়ে করেছিলেন এবং স্ত্রীর ধর্মীয় স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করে সন্তানের নাম আরবি ও বাংলায় মিলিয়ে রেখেছিলেন। এটি একেবারেই নতুন এবং দৃষ্টান্তরহিত। এক্ষেত্রে তিনি বাঙালি মুসলিমদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। বাঙালি মুসলিমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জীবন দিতে পারে- সবই সত্য। কিন্তু নজরুলের এই চ্যালেঞ্জ আজো সবাই গ্রহণ করেত পারেনি। এখানেই নজরুল একুশ শতকের চেয়েও অগ্রবর্তী। এই যে সমন্বয়কামী চিন্তা- উত্তর-আধুনিকদের চেতনার সাথে এর মিল আছে। আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, যে যে ধর্ম বা মতই পোষণ করি না কেন, সব কিছুকেই সম্মান করার চেতনাই বিশ্বয়নের চেতনা, উত্তর-আধুনিকতার চেতনাও। আমেরিকায় দেখা যায়, এক নিউ ইয়র্কেই ১৫২টি দেশের মানুষ আছে। আমেরিকা যে ডাইভার্সিটি ইমিগ্রেশন ভিসা বা ডিভি ভিসা দিয়ে সারা বিশ্ব থেকে লোক নিয়ে গেল, সেতো মাল্টিকালচারাল সোসাইটি গড়বে বলে। এটাই বিশ্বায়নের ব্যাপার। নজরুল কি এটাই করে যাননি, তাঁর মতো করে? যদি তিনি এটাই করে যান এবং আজো স্বদেশ ও বিশ্বজুড়ে এই ভাব অনুসরণের চেষ্টা থাকে, তবে বলতে দ্বিধা নেই, এ শতাব্দীতেও ‘নজরুল’ হবেন বাঙালির স্মরণীয় ও শরণীয় আদর্শের নাম।
ড. সৌমিত্র শেখর, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।