Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জয় বাংলা: বাঙালি জাতির দৃপ্ত রক্তশপথ

রাআদ রহমান
৬ মার্চ ২০২৪ ২১:৩৪

পহেলা মার্চ, ১৯৭১। দুপুর ১টা। ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) ২৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক একাদশের বিপক্ষে পাকিস্তানের বেসরকারি টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ দিনের খেলা চলছে। ব্যাট করতে নামছে পাকিস্তান। ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের ডিজাইনটা তরবারির মতো। ঠিক যেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্বাচনী প্রতীক। জুয়েল বলে ওঠে, ‘দেখ দেখ মাউড়াগুলান তরবারি মার্কা ব্যাট নিয়া নামছে।’

বিজ্ঞাপন

সবাই কৌতূহল মেশানো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছে কখন রকিবুল হাসান নামবে। একসময় রকিবুল নামলো, পাকিস্তান টেস্ট দলে প্রথম বাঙালি টাইগার, মাঠে নামার মুহূর্তেই সৃষ্টি হল এক অনবদ্য ইতিহাস। বন্ধু শেখ কামাল ব্যাটে লাগিয়ে দিয়েছিল ‘জয় বাঙলা’ স্টিকার, সেই ব্যাট হাতে মাঠে নামছে রকিবুল হাসান।

সবার আগে চোখে পড়ল আজাদের, জুয়েলকে ধাক্কা দিয়ে দেখানো মাত্র সবার সাথে জুয়েলও গলার সব কটা রগ ফুলিয়ে গর্জন করে উঠলো, ‘জয় বাঙলা…’ রকিবুলের ব্যাটের উপর জ্বলজ্বল করছে কথাটা… ‘জয় বাঙলা!’ খেলার দেখতে বসা দর্শকগুলোর অখণ্ড মনোযোগ কিন্তু খেলাতে নয়, পাকিস্তান রেডিওতে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নাকি জরুরি ভাষণ দেবে। বেলা ১টায় ইয়াহিয়ার ভাষণ প্রচারিত হল, ইয়াহিয়া না, অন্য একজনের কণ্ঠে। ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসার কথা ছিল, যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা ছিল শেখ মুজিবের হাতে, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

প্রথমে বোধহয় কাজী কামাল চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা, মানি না, মানব না।’ তাতে গলা মেলায় জুয়েল, ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ পুরো গ্যালারীতে যেন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার লাভা স্রোতে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। যার কাছে যা ছিল, তাতেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে দর্শক, লাভা স্রোত ছড়িয়ে যাচ্ছে যদ্দুর চোখ যায়।

আজাদ, জুয়েল, রুমী, জামী, কামাল, হিউবার্ট রোজারিয়ো— বারুদগুলোতে কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা…’ স্টেডিয়াম থেকে অসংখ্য দর্শক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে বের হয়ে আসলো রাজপথে। ঢাকার সর্বত্র গণবিক্ষোভে একাকার হয়ে গেল। বায়তুল মোকাররম-স্টেডিয়ামের সব দোকান পাট বন্ধ করে দিলো দোকান মালিকেরা।

বিজ্ঞাপন

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশংকা করা হলে ইয়াহিয়া খান তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবজাদা ইয়াকুব আলি খানকে কিছু শর্ত দিয়ে পাঠালেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনরকম শর্ত মেনে নিতে রাজী না হওয়াতে ইয়াকুব আলী খান হুমকি দিয়ে বলেন, ‘দরকার পড়লে পূর্ব পাকিস্তানে কামান দাগানো হবে।’

বঙ্গবন্ধু টেবিলে থাবা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আমার উপর কোন আঘাত এলে আমি হয়তো সহ্য করব, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আর বাঙালীদের উপর কামান দাগালে আমি তার বদলা নেব।’ ডন পত্রিকাকে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তা সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, ‘We will die but will never surrender।’

সাক্ষাৎকারে জয় বাংলা স্লোগান সম্পর্কে বলেন, ‘জয় বাংলা কোন সাধারণ পলিটিকেল স্লোগান নয়। জয় বাংলা হলো বাংলার মানুষের আদর্শিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তির স্লোগান। এটা বেঁচে থাকবার অধিকার আর নিজস্ব সংস্কৃতি পালনের অধিকার আদায়ের স্লোগান।’

এই যে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যটা- যে শব্দগুলো তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, এই শব্দগুলোই বলে দিচ্ছে কেন জয় বাংলা শব্দটা বাঙালী জাতির জন্য অত্যাবশকীয় ছিল। কেন এখনও আছে, কেন সবসময়ের জন্যই থাকবে। এই স্লোগান বাঙালী জাতিকে দিয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো সময়টা জুড়ে, একাত্তরে নয় মাসের চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা ছিল আমাদের অসামান্য প্রেরণা, পাকিস্তানি জেনোসাইডারদের অকল্পনীয় বর্বরতা ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ার রক্তশপথ, দৃপ্ত দুঃসাহসী উচ্চারণ। এই জয় বাংলার পথ ধরে এসেছে আমাদের সুলিখিত দুর্দান্ত এক সংবিধান। এসেছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো মূলনীতি সংবলিত শাসনতন্ত্র ।

“বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্যে আমাদের আজকের এই সংগ্রাম। অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। বুলেট বন্দুক বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আর স্তব্ধ করা যাবে না। কেননা জনতা আজ ঐক্যবদ্ধ।
লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের দুর্গ। আমাদের দাবী ন্যায় সংগত তাই সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।

জয় বাংলা
শেখ মুজিবুর রহমান, ১৭.৩.৭১”

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আগত অতিথিদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা এই বার্তা কিংবা ৭ মার্চের অনলবর্ষী সেই ভাষণ কিংবা ২৫ মার্চ গ্রেফতার হবার আগে দেওয়া স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা- সর্বক্ষেত্রেই জাতির মুক্তির কান্ডারি হিসেবে তিনি জয় বাংলা উচ্চারণে তার অসমসাহস আর দুর্জয় আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তার অত্যাচারিত ও নিপীড়িত জনগণের মধ্যে। স্বাধীনতা সংগ্রামের যে দুর্লঙ্ঘ বিপদসংকুল পথ আর মুক্তির অসম্ভব যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা, সেখানে বাস্তবতার হিসেবে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সুপ্রশিক্ষিত দখলদার জেনোসাইডার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে হারাবে সেটা একপ্রকার অসম্ভব কল্পনাই ছিল।

কিন্তু আমাদের অকুতোভয় সর্বাধিনায়ক চির অনুপ্রেরণাদায়ী এক স্লোগান জয় বাঙলায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালী জাতি যখন মরতে শিখেছে, তখন কেউ আর তাকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাঙালী জাতি রক্ত যখন দিয়েছে, রক্ত আরো দেবে, তবু এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বে। প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনী অস্ত্রে-প্রশিক্ষণে যতই এগিয়ে থাকুক আর পৈশাচিক বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ুক, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে বাঙ্গালী জাতি শত্রুর মোকাবিলা করবে। আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব এই প্রত্যেকটা অভূতপূর্ব উচ্চারণ রক্তে আগুন ধরিয়ে দিত যখন সেগুলো শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ চূড়ান্ত স্লোগানে! পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন স্লোগান এভাবে একটা জাতিকে এতোটা দুঃসাহসী লড়াকু করে তুলতে পেরেছিল কিনা বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র, তার নাগরিক বা বিশ্বের যেকোন প্রান্তের বাঙ্গালীর স্লোগান সবসময়ের জন্যই জয় বাংলা। সর্বযুগে, সকল সময়ে প্রাসঙ্গিক, প্রয়োজনীয়, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটার শেকড়ের পরিচয় লুকিয়ে আছে এই দুইটা শব্দে, এই স্লোগানটায়। এই স্লোগানের বদলে স্রেফ একবার ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বললেই প্রাণে বেঁচে যেত কত হাজার মানুষ, কিন্তু পাকিস্তানি জেনোসাইডারদের এই শর্তের সামনে গলার রগ ফুলিয়ে মাথাটা উঁচু করে ‘জয় বাংলা’ চিৎকার দিয়ে তৎক্ষণাৎ বুকে একঝাঁক বুলেটে ঝাঁঝরায় শহীদ হয়েছে তারা। কারণ এই স্লোগানটা স্রেফ একটা স্লোগান না, এটা প্রাণের গভীরতম গভীর থেকে উঠে আসা স্বাধীনতার আকুতি, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, জন্মভূমির প্রতি নিঃশর্ত লয়্যালিটির প্রতীক।

এই স্লোগান শুনে যতই অপছন্দ হোক, আপনার সুশীলতায় আঘাত লাগুক, রাষ্ট্রের আবার স্লোগান কিসের, রাষ্ট্র কেন স্লোগান চাপায়ে দেবে, ব্যাক্তিস্বাধীনতা লঙ্ঘন বলে হাস্যকর দ্বিচারিতা আর বেইমানির পরিচয় দেন না কেন, তাতে ইতিহাস একবিন্দু মিথ্যে হয়ে যাবে না, বাস্তবতা একবিন্দু বদলাবে না। নিজেকে বাংলদেশের নাগরিক পরিচয় দিতে চাইলে তাই আগে আমাদের এই স্লোগানটা চেনা উচিত, জানা উচিত, বোঝার চেষ্টা করা উচিত, উপলব্ধির চেষ্টা করা উচিত। গৌরবোজ্জ্বল জন্ম ইতিহাসের মূলমন্ত্র ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে ধারণ করতে পারলেই কেবল এই জমিনের গর্বিত উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারব আমরা, নচেৎ নয়।

লেখক: অ্যাকটিভিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

জয় বাংলা রা'আদ রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর