Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যে ভাষণ স্বাধীনতা এনেছিল

মশিউর রহমান
৭ মার্চ ২০২৪ ১২:৫৭

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা ও একের পর এক ষড়যন্ত্র শুরু করে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে যখন সরকার গঠনে বাধা দেওয়া হলো তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝে গেলেন পূর্ব বাংলার অধিকার আদায়ের একমাত্র পথ স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় বললেন— “আর কোনও ৬ দফা নয়, এবার এক দফা আন্দোলন— তাহলো স্বাধীনতা।” ৭ই মার্চের ভাষণে পরিষ্কারভাবে বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ভাষণে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির আহ্বান। তার এই ঘোষণা স্পষ্টত সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির ডাক। চূড়ান্ত যুদ্ধের আগে প্রস্তুতি পর্বে যা যা বলার দরকার ছিল সবকিছুই ছিল বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণে। এই ভাষণের পর তার কথায় পূর্ব বাংলার সবকিছু অচল হয়ে পড়েছিল এবং চূড়ান্ত যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে থাকে বাঙালি জাতি।

বিজ্ঞাপন

এ কথা সত্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার চূড়ান্ত ডাক দিয়েছিলেন ২৬ মার্চ রাতে প্রথম প্রহরে। কিন্তু তার ১৯ দিন আগে ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উত্তাল জনসমুদ্রে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের এই ডাক দিয়েছিলেন তিনি। জাতিকে স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানানোর এই ভাষটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা ছিল এই ভাষণে। তাই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পাকিস্তানে কারাগারে যখন বঙ্গবন্ধু বন্দি ছিলেন তখন দিশাহীন হয়ে পড়েনি বাঙালি জাতি। বরং তার এই বজ্র ভাষণই পশ্চিমা শোষকদের বিরুদ্ধে রসদ জুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। উজ্জীবিত রেখেছে বাংলার মুক্তিকামী কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবকসহ সর্বস্তরের মানুষকে। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আমরা যদি ইতিহাসে ফিরে যাই দেখবো ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যে আন্দোলন, সংগ্রাম ও ত্যাগ তার চূড়ান্ত ফসল স্বাধীনতা। তাই বলতে হয় ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে কি সেই প্রেক্ষাপট। আমরা যদি স্বাধীনতা যুদ্ধকে তিনটি স্তরের দেখি তাহলে প্রথম স্তরটি ছিল স্বায়ত্তশাসনের স্তর যা ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলে। এ সময় ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর নির্বাচন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪ এর বেসিক ডেমোক্রেসি আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুস্থান এসব প্রত্যেকটি স্বাধিকার আন্দোলনে বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে শোষণ, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এগুলো আমাদের রক্ত ও ত্যাগের ইতিহাস। এগুলোর মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে দ্বিতীয় স্তর মুক্তিযুদ্ধ ও চূড়ান্ত স্তরে স্বাধীনতা এসেছে। এই তিন স্তরের মধ্যে একটি কার্যকর যোগসূত্র স্থাপন করেছে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরেও কোনও সাধারণ নির্বাচন হয়নি। সামরিক—বেসামরিক ও আমলাতন্ত্রের শাসনে সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছিল চরম উপেক্ষিত। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম সাধারণ নির্বাচনেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। আর পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৩ আসন পেয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। বিজয়ী হয়ে জনগণের ম্যান্ডেট পেলেও তখন আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি। সমগ্র পাকিস্তানে বৃহত্তর দলের নেতা হিসেবে বাঙালির নয়নমণি বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে পাকিস্তানি শাসকরা। নানা রকম শর্ত ও সমঝোতার চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু জনগণের নেতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। সেজন্য জনগণের অধিকারের প্রতি থেকেছেন আপসহীন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিয়েছেন, “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি এ দেশের মানুষের মুক্তি চাই।” পার্লামেন্ট অধিবেশন বন্ধ করে দেওয়া হলে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধু তার দলের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনগণের রায়ের প্রতি স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানানোর এই ভাষটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা ছিল এই ভাষণে। তাই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পাকিস্তানে কারাগারে যখন বঙ্গবন্ধু বন্দি ছিলেন তখন দিশাহীন হয়ে পড়েনি বাঙালি জাতি। বরং তার এই বজ্র ভাষণই পশ্চিমা শোষকদের বিরুদ্ধে রসদ জুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। উজ্জীবিত রেখেছে বাংলার মুক্তিকামী কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবকসহ সর্বস্তরের মানুষকে। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরেও কোনও থাকার শপথ নেন এবং ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার ঘোষণায় অটল অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। ভোটে যে ৬ দফার ভিত্তিতে জনগণের ম্যান্ডেট পায় আওয়ায়ী লীগ সেই ৬ দফাকে অস্বীকার করে ইয়াহিয়া—ভুটো চক্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন ৬ দফা হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট। সুতরাং তিনি ৬ দফার প্রশ্নে আপস করবেন না। এ অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণে টালবাহানা করতে থাকে। তখন বঙ্গবন্ধু বুঝে গেলেন পূর্ব বাংলার অধিকার আদায়ের একমাত্র পথ হলো যুদ্ধ করে স্বাধীনতা আদায় করে নেওয়া। সকল বৈষম্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ নামে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীনতার চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন। অন্যদিকে সামরিক শাসক ইয়াহিয়াও পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্র মোতায়েন করতে থাকে।

এর মধ্যেই ৩ মার্চ ছিল পার্লামেন্ট বসার পূর্বনির্ধারিত দিন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পার্লামেন্ট বন্ধ করা হলো। একপর্যায়ে অনিশ্চিত হয়ে গেল পার্লামেন্ট অধিবেশন। এভাবে একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে সরকার গঠনের দায়িত্ব থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্ছিত করার নীলনকশা যখন করা হলো তখন বঙ্গবন্ধু বললেন— “আর কোনও ৬ দফা নয়, এবার এক দফা আন্দোলন— তাহলো স্বাধীনতা।” ৭ই মার্চের ভাষণে স্পষ্ঠভাষায় বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু এতদিন পাকিস্তান ফ্রেমওয়ার্কের ভেতর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি—দাওয়া প্রতিষ্ঠিত ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এসেছেন। কিন্তু ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললেন। একটা রাষ্ট্র হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের যে অধিকার তা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে বঙ্গবন্ধু বললেন, “পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।”

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার এ ভাষণ সঞ্জীবনী সুধার মতো বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ রাখে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে। এই ভাষণ শোনার জন্য মুক্তিপাগল মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকতো। কারাগারে বন্দিজীবনে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই সর্বস্তরের মানুষকে উজ্জীবিত রাখে। আর ছিল কালজয়ী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। এই স্লোগান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রণধ্বনি। যা উচ্চারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে এগিয়ে গেছে অস্ত্রের মুখে। বুকের গভীরে ছিল ‘বঙ্গবন্ধু’ আর মুখে ‘জয় বাংলা।’ ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…’ এই উচ্চারণে বাঙালি পেয়েছে দিশা।

তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর একটি। যে ভাষণ নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে রাতারাতি সশস্ত্র যুদ্ধের সাহস জোগায়। এই ভাষণকে অবলম্বন করে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি জীবন উৎসর্গ করেন। কয়েক লাখ মা–বোন সম্ভ্রম বিসর্জন দেন। যে কারণে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেসকো এ ভাষণকে বিশ্ব–ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’এ অন্তর্ভুক্ত করে।

আমরা চলে যাই একাত্তরের মার্চে। কী উত্তাল ছিল দিনগুলো। পুরো বিশ্বের দৃষ্টিও ছিল ঢাকার দিকে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু কি বলছেন, কি ভাবছেন তা জানতে প্রচুর বিদেশি সাংবাদিক তখন ঢাকায়। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণে কি বলবেন তা ছিল সকলের আগ্রহের বিষয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য এ ভাষণটি লিখিত ছিল না। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি তার মনের কথা জনগণের সামনে স্ততস্ফূর্তভাবে বলে দিয়েছেন। চোখ থেকে চশমা খুলে জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জনতাকে আপনি সম্বোধন করে শুরু করেন ভাষণ। বলেন ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।’ একপর্যায়ে জনগণের কাতারে সামিল হয়ে সেই জনতাকে তুমিতে সম্বোধন করে বলেন, “তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।” তিনি যে জনগণের নেতা এরচেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি বড় উল্লেখযোগ্য দিক হলো— তিনি জনগণের অধিকার জন্য আন্দোলন করেছেন এবং ন্যায্য দাবির প্রতি আপসহীন থেকেছেন। যে কারণে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে তিনি কোনও সমঝোতায় যায়নি। নিজের রাজনৈতিক অবস্থানে থেকেছেন অটল।

বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলে ৭ মার্চের ভাষণ দেন। একদিকে ছিল মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা, তেমনি যুদ্ধের প্রস্তুতিরও নির্দেশনা ছিল। তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও ছিল সতর্ক দৃষ্টি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। এ কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শেখ মুজিবকে ‘চালাক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকতা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে চলে গেলেন কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না। তার এই কৌশলী দুরদর্শিতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক সমর্থন ও বৈধতা পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শব্দচয়নও ছিল মর্মস্পর্শী। ইয়াহিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কী করে আমার মায়ের বুক খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ এই কথাগুলো নাড়া দিয়েছিল মানুষের মনকে।

যে কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই একটি কথা বলে থাকেন তাহলো— বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে যুগসৃষ্টিকারী সেরা ভাষণগুলোর অন্যতম। বাঙালির মুক্তির পথ—নকশা নির্মাণে অনন্য—দূরদর্শী ভাষণ এটি। প্রতিটি বাক্যে উঠে এসেছে একটি জাতির ইতিহাস, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সংগ্রাম ও বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের কথা।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়— বাঙালির মুক্তির প্রেরণা, বিশ্বের বিস্ময় এই ভাষণ এক সময় আমাদের এই দেশে প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের গর্বের ইতিহাসকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করেই আক্রমণ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। নতুন প্রজন্মকে জানতে দেওয়া হয়নি বাঙালির ত্যাগ আর সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও অবদানকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে স্বাধীনতাবিরোধী ক্ষমতা দখলকারীরা।

গণমানুষের চাপের মুখে এই ভাষণ ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ রেডিওতে প্রচার করতে বাধ্য হয়েছিল পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কিন্তু জিয়াউর রহমান সেই ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ করে। পরবর্তীতে এ ভাষণ বাজানোর ওপর ২১ বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষদের ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো থেকে বিরত রাখতে পারেনি এই নিষেধাজ্ঞা। এই কারণে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছে। ৭৫ এর পরের সরকারগুলো শুধু ৭ মার্চের ভাষণই নিষিদ্ধ করেনি, জয় বাংলার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও নিষিদ্ধ করেছিল।

কিন্তু ইতিহাস চলে তার স্বাভাবিক নিয়মে। সাময়িকভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে একটা প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হলেও ইতিহাসে বঙ্গবন্ধ বাঙালির মহানায়ক ও জাতির পিতার আসনেই থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হয়তো বিশ্বের একমাত্র নেতা, যিনি দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রেখে একটি অসহযোগ আন্দোলনকে স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপান্তরিত করেছিলেন। এ কারণে ৭ মার্চের ভাষণ শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিই পায়নি। বিশ্ববরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক ও নামকরা বিদেশি গণমাধ্যমও এই ভাষণকে যথাযথ মূল্যায়ন করেছে। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছেন, “এই ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।”।

যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন “পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা। ”

বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে। গণমাধ্যমটি বলেছে, “বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয় একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।”

১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে ‘শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে ‘এই ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে এই ভাষণেরই আলোকে।’

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

সারাবাংলা/এসবিডিই

নিবন্ধ মশিউর রহমান যে ভাষণ স্বাধীনতা এনেছিল সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর