Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (প্রথম পর্ব)


৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৩০

বিষন্নতার ভাইরাস

মায়ের মৃত্যুতে যেন অসুস্থতার এক যুগ নয়, একশ বছরের অবসান হলো, এরকমটি মনে হলো সামিউলের। বাবা মারা যাওয়ার পর মা সেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তা থেকে মুত্যুতেই মুক্তি মিলল। সামান্য বিষন্নতা দিয়ে যে অসুখের শুরু হয়েছিল জটিল নিউরোসিসে সেই অসুখ আরো জটিলতর অবস্থা ধারণ করল। ডাক্তার কবিরাজ ওঝা বৈদ্য কোন কিছুতেই উনিশ বিশ হলো না। মা কেমন জানি পাগলের মতো হয়ে গেলেন। মায়ের পাগলামীর সাথে সাথে সামিউলের নিজের স্বপ্নগুলোও পাগলামীতে রুপান্তরিত হতে লাগল।
ক্লাস নাইনে স্কুল ম্যাগাজিনে গল্প কবিতা দেওয়ার চক্করে পড়ে সেই যে সাহিত্যের ভূত মাথায় চেপে বসেছিল, তা তো নামেইনি বরং সিন্দাবাদের ভূতের মতো শুধু ঘাড়ে চেপে বসে নেই, সেই ভূত দিন দিন আকারে প্রকারে বেড়ে প্রকান্ড রুপ ধারণ করছে। সাহিত্যের ভূত এবং ছিটগ্রস্থ অসুস্থতা মায়ের সাথে বসবাস করতে করতে এক প্রকার হাঁপিয়ে উঠেছিল সামিউল।
মায়ের মৃত্যুতে আক্ষরিক অর্থেই হাঁপ ছেড়ে বাচল সামিউল! তার আর কোন পিছুটান রইল না।
মা মারা গেলেন মাঝ রাতে। সামিউলের চোখের সামনে, তার হাতের উপরেই। তারপরেও সামিউল কোন উচ্চবাচ্য করল না। হাতের কাছে মোবাইল থাকতেও আত্মীয়পরিজন বন্ধুবান্ধব কাউকে ফোন দিল না। মাকে শুইয়ে রেখে বিছানা চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়ে নিজের রুমে গেল। হাত মুখ ধুয়ে অনেকদিন পর টেনে নিল কবিতার খাতা। লিখতে লাগল ‘আমি ঘোর ভেঙে ফিরে আসি বাস্তবে…’। লিখে ফেলল আস্ত একটা কবিতা। মৃতদেহকে সামনে রেখে লিখে ফেলল জীবনের কবিতা। কারণ এই মৃত্যুই যেন তাকে জীবনের পথে পাড়ি দেবে। এতোদিনের দেওয়াল ভেঙে সে বেরিয়ে পড়তে পারবে তার স্বপ্নের পথে, স্বপ্নের পৃথিবীতে।

বিজ্ঞাপন

একা মানুষ কিভাবে এই মৃত্যুকে সামাল দেবে সামিউল বুঝে উঠতে পারেনি। বাবার মৃত্যুর সময় তার চারপাশে অনেক মানুষ ছিল, মা ছিলেন। এখন কেউ নেই, সে একা।
মানুষ মৃত্যুর ভয়ে ভীত বলেই মনে হয় কেউ মাটির উপরে মৃতদেহ সহ্য করতে পারে না। মৃতদেহ যেন আপন মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। সেজন্যই সবাই তাড়াতাড়ি সৎকারের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে।
ইউনিয়নের চেয়্যারম্যান মজিদ গাজী, মসজিদের ইমাম আবুল হুজুর, পাড়ার মেম্বার নান্টু মিয়া, পাশের বাড়ির প্রতিবেশি মুরুব্বি হামিদ সানাসহ এসেই পুরো দায়িত্ব কাধে তুলে নিলেন। সামিউলকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য এক দঙ্গল প্রতিবেশি জুটে গেল। ‘বাবা-মা চিরদিন বেচে থাকে না।’ ‘মুত্যুর ডাকে সবাইকে সামিল হতে হয়।’ ‘মৃত্যুতে কান্না করতে নেই। তাতে মউতের আত্মা কষ্ট পায়।’’ এরকম প্রবোধ বাক্য ভেসে আসতে লাগল। যদিও সামিউল কান্না করছিল না, এই অবস্থাতেও তার মাথার মধ্যে জলের মতো ঘুরে ঘুরে কবিতার লাইন পাক খেয়ে যাচ্ছিল ‘আদিম মানুষের পিছু ছাড়ে না সভ্যতা…সভ্য মানুষের পিছু ছাড়ে না আদিমতা…’

বরই গাছের নিচে চেয়ার পেতে জবুথুবু হয়ে বসা সামিউলের কাধে স্বান্তনার হাত রাখলেন নান্টু মেম্বার। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাউকে কি আর খবর দিতে হবে? কেউ কি আসার বাকি আছে?’
সামিউল দুদিকে মাথা নেড়ে না জানাল। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘না। আমি মামুদের খবর দিয়েছি। ওরা আসছে। বেশিক্ষণ লাগবে না।’
‘তাহলে বাদ জোহরই গোর দেওয়ার ব্যবস্থা করি। লাশ যত তাড়াতাড়ি মাটির নিচে দেওয়া যায় ততই আজাব কম হয়। যতক্ষণ মাটির উপরে থাকে কষ্ট পেতে থাকে। তাছাড়া গরমের দিন। বরফ টরফের ব্যবস্থা করা নেই।’ নান্টু মেম্বার সম্মতি নেওয়ার জন্য দাড়িয়ে রইল।
সামিউল সম্মতি দিয়ে দিল, সে নিজেও চাইছে তাড়াতাড়ি এই ঝামেলা শেষ হোক, সে একটু নিরিবিলিতে বসে নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করুক। এমনকি মৃত্যুর পরে এখনও একবারও মায়ের মুখ দেখেনি সে। এক জীবনে অসুস্থ অবস্থায় এতোবার মায়ের মুখ দেখেছে তার চোখের সামনে সবসময় মায়ের মুখই ভাসে।

বিজ্ঞাপন

‘চাচীর কবর তো তোমার আব্বার কবরের পাশেই হবে?’ জানা বিষয়টাই আরেকবার জেনে নিল নান্টু মেম্বার। মানুষের মৃত্যুতে সেই সবসময় এরকমভাবে এগিয়ে এসে কাজ করে। এই কাজগুলো খুব চোখে লেগে থাকে মানুষের, মুখে মুখে ছড়ায়। আর তাতেই মেম্বারী ইলেকশনে তার ভোট বাক্স ফুলে ওঠে। এভাবে সেবার করার পাশাপাশি স্বপ্ন দেখে সে, বর্তমান বয়স্ক চেয়ারম্যান মারা গেলে সে চেয়ারম্যানী ইলেকশন করবে।

সামিউলের সম্মতি নিয়ে নান্টু মেম্বার কাজে লেগে পড়ল। আবুল হুজুরকে দিয়ে মসজিদের মাইকে জানাজার নামাজের সময়ের ঘোষণা দেওয়া, গোরখোদক ইব্রাহিমকে খবর দিয়ে আনানো, সামিউলের বাড়ির বাশ ঝাড় থেকে বাশ কেটে কবরের জন্য ব্যবস্থা করা এবং মাইয়াত মহিলা হওয়ায় দাফনকাফনের জন্য দাফনে এক্সপার্ট মহিলাদের খবর দেওয়া, দাফন কাফনের জন্য শাড়ি টাঙিয়ে আলাদা একটা জায়গার ব্যবস্থা করা, মাদ্রাসার তালেবুল এলেমদের দিয়ে কোরানখানির ব্যবস্থা, কাফনের কাপড় কেনাসহ বেশ কিছু খরচের কাজ আছে। টাকাটা ইচ্ছে করলে নান্টু মেম্বার নিজের তহবিল থেকে খরচ করতে পারে, কিন্তু এলাকায় কবি হিসাবে খ্যাত এই লোকের কাছ থেকে পরে টাকা বের করা যাবে কিনা সন্দেহ, চাইতেও লজ্জা লাগবে, যদিও মেম্বার হতে গেলে সেই লজ্জা থাকলে চলে না। যা চাওয়ার এখনই চেয়ে নেওয়াই ভাল।

নান্টু মেম্বার আবার এগিয়ে গেল সামিউলের দিকে। খুব কাছে গিয়ে বলল, ‘কবি, তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, কিন্তু আর কেউ নেই যে তাকে বলব। তোমার মামারাও তো এখনও আসেনি।’
‘আমাকেই বলেন ভাই।’ সামিউল মুখ তুলে দাড়ানো নান্টু মেম্বারের মুখের দিকে তাকাল, ‘বেচে থাকতে মায়ের আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না, এখন মরার পরেও নেই।’

‘দাফনকাফন কোরান খতম, ধুপআগরবাতি এসবের কিছু খরচাপাতি আছে।’ নান্টু মেম্বার একটু ইতস্তত ভাব দেখাল, ‘খবরটা শুনেই আমি দৌড়ে চলে এসেছি। ম্যানিব্যাগ আনতে ভুলে…’
‘ভাই, একটু দাড়ান। আমি টাকাটা এনে দিচ্ছি।’ সামিউল চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। মায়ের লাশটা মসজিদ থেকে আনা খাটিয়ার মধ্যে কাপড় পেচিয়ে বারান্দায় রাখা আছে। সে খাটিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে পাশ দিয়ে উঠে ঘরে গেল। বর্গা জমি আর বাজারের দোকানভাড়া থেকে তাদের মা-পুতের সংসার খরচ চলে যায়। তার একটা গচ্ছিত টাকা সবসময় সংসার খরচের জন্য আলমারির মধ্যে থাকে। সেখান থেকে একটা হাজার টাকার নোট বের করে নান্টু মেম্বারের হাতে দিয়ে বলল, ‘এতে হবে?’

নান্টু মেম্বার কিছু বলার আগেই জোরালো শব্দে তীক্ষè কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। মামুর পরিবার এসেছে, এবং এতোদিন কখনও খোঁজ না নিলেও এখন লোক দেখানো কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী করে তুলছে। সামিউলকে দেখতে পেয়ে সবাই এসে তার উপরে এরকমভাবে পড়ল যেন তার মা মারা যায়নি সেই মারা গেছে ওরা তার লাশই দেখছে।
সামিউল এরকম মাখামাখিতে সবসময়ই অস্বস্তিবোধ করে, কিন্তু এখন সে মুখফুটে কিছু বলতে পারল না। শুধু তার মনে হলো, একজন কবির একজন সৃষ্টিশীল লেখকের কোন পরিবার থাকতে নেই, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন থাকতে নেই, কারোর মৃত্যুর মতো অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে নেই, আসলে কোন মৃত্যু থাকতে নেই!

জানাজার নামাজ শেষে কবরে নামানোর আগে শেষবারের মতো মায়ের মুখের কাফনের কাপড় সরিয়ে দেওয়া হলো। মায়ের মুখটা বেশ শান্ত স্নিগ্ন পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। সামিউল তাকিয়ে আছে দেখে পেছন থেকে কে যেন বলল, ‘তুমি মুখটাতে একটু হাত বুলিয়ে দিতে পারো শেষবারের মতো।’ সামিউল মায়ের মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিয়ে গলার দিকে চোখ পড়ল তার। ডুকরে কেদে উঠল সে। পেছনের সেই কণ্ঠস্বরটা আবার বলে উঠল, ‘পৃথিবীতে মায়ের মতো আর কেউ নেই!’
কে একজন বিরক্ত স্বরে বলল, ‘কবিকে ওখানে অতো কাছে নিয়ে গেছো কেন? মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসো। মাকে কি কেউ ছেড়ে যেতে পারে?’ দুতিনজন সামিউলকে ধরে সরিয়ে নিয়ে এলো। তারপর লাশ নিয়ে নেমে পড়ল কবরে।

আবুল হুজুর সামিউলের হাতে কবরের মাটি তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘শেষবারের মতো মাটি দিয়ে দাও। আর পড়তে থাকো মিনহা খালাক নাকুম, ও মিনহা নুইয়ুদুমুকুম, ও মিনহা নকুরিযুকুম তা রা তান উখরা, এই মাটিতে থেকেই তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই মাটিতেই তোমাকে ফিরে যেতে হবে….

পশ্চাতে কবর রেখে বাড়িতে ফিরে এসে সামিউল দেখল সবাই ছোট ছোট জটলা পাকিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। টুকরোটাকরা যা কথাবার্তা ভেসে আসছে তাতে তার মায়ের মৃত্যুর সমবেদনার চেয়ে নিজেদের জীবনের কথাই বেশি। মৃত মানুষ কবরের আড়ালে চলে গেলেই অতীত হয়ে যায়। আর মানুষ অতীত নিয়ে পড়ে থাকে না। সামিউল কোন জটলার দিকে এগিয়ে যাবে বুঝতে পারছিল না। যদিও ওকে সঙ্গ দিচ্ছিল ওর চাচাতো মামাতো ভাইয়েরা। সামিউল আবার বরই তলায় এলো। গনগণে দুপুরে এখানে কিছুটা শীতল হাওয়া আছে। নান্টু মেম্বার ডেকারেটর ডাকিয়ে একটা সামিয়ানা টানিয়ে দিয়েছে উঠোন জুড়ে, তার নিচে লাল ও গাঢ় নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার।
সামিউলকে হাত ধরে সামিয়ানার নিচে নিয়ে এলো মামাত ভাই সুবর, যেন সামিউল নিজ বাড়ির বরই তলা থেকে উঠান পর্যন্ত একা যেতে পারে না। অথচ বাবার মৃত্যুর পরে দীর্ঘ এক যুগ একা একাই মাকে নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে এই বাড়ি, এই উঠান, এই বরইতলা, এই কবরখানা, এই পুকুর, এই বাশতলায়। লাল রঙের চেয়ারে বসতে বসতে সামিউল শুনতে পেল তাকে নিয়েই চর্চা চলছে উপস্থিত নারী পুরুষের মধ্যে। ‘কবিসাপ’ শব্দটা মানেই সেই জড়িত, এই গ্রামের সবাই তাকে কবি হিসাবেই চেনে যদিও সে যত না কবিতা লেখে তার চেয়ে ছোট গল্প এমনকি উপন্যাসও লেখার চেষ্টা করে। কিন্তু গাওগেরামের লোকেরা লেখালেখির সাথে জড়িত থাকা মানেই কবি বোঝে, তাই লোকটি যদি এক জীবনে একটাও কবিতা না লেখে, লোকটি যদি এক জীবন শুধু সায়েন্স ফিকশন লিখেই কাটিয়ে দেয়। তাছাড়া কবিলেখকদের নিয়ে অদ্ভুত একটা ধারণা আছে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণাটা কিছুটা অকমর্ণ্য বোঝাতেই ব্যবহার করা হয়। যেমন লোকটি কবিতা লেখে তার মানে সে আর কোন কাজের যোগ্য নয়, আর উল্টোটাও হয় যদি দেখা যায় যে লোকটি অন্য পেশার সাথে জড়িত তারপর কবিতা গল্প লেখে তখন ধারণা করা হয় সে ওই পেশার জন্য যোগ্য না। একজন ডাক্তার কবি মানেই সে ডাক্তার হিসাবে সুবিধের না, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, আইনজীবী সবার ক্ষেত্রেই এই কথাটা ভাবে তারা। একজন ভাল ডাক্তার কবিতা লিখবে কেন?

সামিউলকেও গ্রামের লোকেরা যেমন কবি বলে জানে, তেমনি অকমর্ণ্যই মনে করে। তবে সেই অকমণ্যতার মধ্যে এক ধরণের স্নেহ মিশে থাকে। কারণ তাদের জীবদ্দশায় তারা কখনও আর কাউকে এমনভাবে নিজের জীবন মায়ের জন্য উৎসর্গ করে দিতে দেখেনি। সামিউলের প্রসঙ্গ উঠলেই তারা বায়েজিদ বোস্তামীর প্রসঙ্গ টেনে আনে এবং উপসংহারে বলে, ‘তাও তো বায়েজীদ বোস্তামি মায়ের শিয়রে পানি হাতে একরাত দাড়িয়েছিল আর আমাদের কবি মায়ের জন্য এক জীবন দাড়িয়ে কাটিয়ে দিল।’ বাইরের একটা মেয়ে বিয়ে করে আনলে অসুস্থ মাকে দেখভাল করবে না বলেই এই তিরিশ পার হওয়া জীবনে কবি বিয়ে করেনি এরকম একটা মিথ গ্রামে প্রচলিত আছে, যেখানে এই গ্রামের ছেলেরা বিশ পেরুনোর আগেই বিয়ে সংসার পাতিয়ে জাকিয়ে বসে। সামিউলের ব্যবসায়ী বাবার কিছু জমিজিরাত আর বাজারে একটুখানি জায়গায় দুই তিনটে দোকান আছে বলেই কবি কবিতা লিখে সংসার চালাতে পারে। তাদের মতো খেটেখাওয়া মানুষ হলে আর কবিতা বের হতো না।

ঘরের দিক থেকে মহিলাদের নিচু লয়ের কান্নার গুণগুণ আওয়াজ ভেসে আসছিল। মায়ের মৃত্যুর জন্য সেই সকাল থেকেও দুপুর গড়িয়ে যাওয়া এখন পর্যন্ত কারা কাদতে পারে সামিউল বুঝতে পারছিল না। অসুস্থ হওয়ার আগে মায়ের সাথে গ্রামের মহিলাদের সখ্যতা থাকলেও অসুস্থতা হওয়ার পর থেকে এই বার বছর কারোর সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল না যে মায়ের মুত্যুতে কাদতে পারে। মা মামার বাড়ির পৈত্রিক সম্পত্তি নায্য দামে বিক্রি করে দিয়ে আসায় মায়ের সাথে ওদের সম্পর্কটা কখনও ভাল ছিল না। অসুস্থ হওয়ায় আপদ বিদেয় হয়েছে এরকমভাবে তারা হাত ধুয়ে ফেলেছিল, তারপরও আপন মানুষের মৃত্যুতে কান্নার উপলক্ষ থাকলেও তারা এখন চলে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করছে। মরা বাড়িতে কোন রান্না হয় না বলে বাড়িতে গিয়ে ওদের মহিলাদের রান্না চাপাতে হবে। তাহলে কি নান্টু মেম্বার কান্নার জন্য মেয়েমানুষ ভাড়া করে নিয়ে এসেছে?

কারা কান্না করছে ব্যাপারটা সামিউলের মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল, এমনকি এই খচখচানির মধ্যে একটা কবিতার লাইনও ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘কান্নার শব্দের মতো চোখের জলেরও কি শব্দ আছে?’

গ্রীষ্মের গণগণে দুপুরে বেলা বাড়তে থাকতে ক্ষুধার্ত আগতরা চলে যাওয়ার জন্য উসখুস করছিল। বয়স্ক চেয়ারম্যান জানাজার নামাজের পরপরই চলে গেছেন, কবর দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। আবুল হুজুর আরো কিছুক্ষণ ছিলেন, তারপর বেরিয়ে গেছেন। নান্টু মেম্বারও কোথায় জানি গেছে। প্রতিবেশী হামিদ সানা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মরা বাড়িতে তিনদিন আর আগুনের উনুন জ্বলবে না। কবির খাবার তার বাড়ি থেকেই আসবে।’ সামিউল বলতে চেয়েছিল সে উনুনের আগুনে রান্না করে না, বৈদ্যুতিক চুলায় এবং রাইস কুকারেই মা- ছেলের দুটো ভাতে ভাত ফুটিয়ে নেয়। কিন্তু সামিউল তা বলতে পারল না। এমনকি এতো বেলা বেড়ে যাওয়ার পরও তার কোন ক্ষুধা নেই। তবে শরীরটা ক্লান্ত বিষন্ন লাগছে। বাবা মারা যাওয়ার পর কি মায়েরও এমন লেগেছিল তারপর বিষন্নতার ভাইরাস ঢুকে গিয়েছিল মায়ের শরীরে। এখন মায়ের শরীরের সেই বিষন্নতার ভাইরাস কি তার শরীরে ঢুকে পড়তে পারে? সামিউল আতংকিত হয়ে উঠল। মায়ের অন্তোষ্টিক্রিয়ার সব ক্রিয়াকর্ম শেষ হলে এখন থেকে এই বিষন্নতার ভাইরাসের হাত থেকে পালাতে হবে, বাবা-মায়ের কবর, এই বরইতলা, কলতলা, এই বাড়িঘর, এই গ্রাম, এই সবকিছু ছেড়ে পালাতে হবে।

নান্টু মেম্বার যেন হন্তদন্ত হয়ে কোত্থেকে আবার এসে উদয় হলো এবং জানাজার আগে যেরকম আবুল হুজুর মায়ের পক্ষ থেকে আর কোন দেনাপাওনার কথা বলিয়ে নিয়েছিল তেমনি করে সামিউলকে দিয়ে আবার বলিয়ে নিল, মায়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চাইল, কষ্ট করে জানাজায় আসার জন্য, সাথে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলল এবং সবশেষ আজ থেকে ঠিক চল্লিশ দিন পর কুলখানির জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে সবাইকে বিদায় দিল।

চল্লিশার জন্য আজ বাদ দিলে আর মাত্র উনচল্লিশ দিন হাতে আছে। এর মধ্যে চল্লিশার জন্য যেমন জোগাড়যন্ত্র করতে হবে, তেমনি নিজেকেও গুছিয়ে নিতে হবে। গুছিয়ে নিতে হবে নিজেকে বহুর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আজন্ম লালিত স্বপ্ন সাহিত্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়ার জন্য। যে সাহিত্যের জন্য সে সবকিছু ছেড়েছে, সমাজ-সংসার, মাকে হারিয়েছে, প্রেমিকা ছেড়ে গেছে, সাহিত্যের রাজধানী ঢাকা, কবিতার রাজধানী শাহবাগে গিয়ে সে এই সাহিত্য জীবনের শেষ দেখেই ছাড়বে!

চলবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই

অতিপ্রাকৃত উপন্যাস আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (প্রথম পর্ব) ঈদুল ফিতর ২০২৪ প্রিন্স আশরাফ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর