মোরেলা
৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:২২
মূল গল্প: এডগার অ্যালান পো
ভাষান্তর: রওনক আরা
আমার বন্ধু মোরেলাকে আমি এক বিশেষ অনুভূতি নিয়ে স্মরণ করতাম। বহু বছর আগে অনেকটা দৈবক্রমেই তার সাথে আমার জানাশোনা হয়। সে যে সমাজের অধিবাসী সেখানে আমার জড়িয়ে যাওয়ার কথা না। আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হয় সেদিন থেকেই আমার আত্মার ভেতরে যেন আগুন জ্বলছিল। এই অবস্থার সাথে আমার আগে কোনও পরিচয় ছিল না। আমার মনের ভেতরে ক্রমাগতই একটা দোষীভাব জন্ম নিচ্ছিল। বিষয়টা আমার বড়ই তিক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ঠেকছিল। স্বাভাবিকের বাইরে এই আবেগের আমি না দিতে পারছিলাম কোনও সংজ্ঞা না পারছিলাম তার দুর্বোধ্য তীব্রতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। তারপরও আমাদের দেখা হতে লাগল। ভাগ্য আমাদের জীবনের বেদিতে একসূত্রে গেঁথে ফেলল। আমি কখনও আমার আবেগের কথা বলিনি, কখনও ভালবাসার কথাও ভাবিনি। যা হোক, মোরেলা তার সমাজ পরিত্যাগ করে আমার জীবনের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করল। আমি সুখিই হলাম। এ এক আশ্চর্য সুখ। মানুষ যেমনটা স্বপ্নে আকাঙ্ক্ষা করে তেমন।
মোরেলার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। তার প্রতিভা কোন সাধারণ স্তরের নয়- আর সে ছিল বিশাল মানসিক শক্তির অধিকারী। আমি তা অনুভব করতাম আর বহু বিষয়েই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতাম। অল্প সময়ের মধ্যেই সে আমার কাছে বেশ কিছু অতীন্দ্রিয় রহস্যপূর্ণ বিষয় হাজির করল। ঐ বিষয়গুলোকে প্রাচীন জার্মান সাহিত্যের নিছক পরিত্যক্ত লেখা বলে মনে করা হত। সম্ভবতঃ এটা মোরেলার প্রেসবুর্গ শিক্ষাগ্রহণের ফলাফল হবে। আমি জানি না কেন, এগুলো তার খুবই প্রিয় এবং সুনির্দিষ্ট বিষয় ছিল। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সেগুলো আমার নিজেরও বিষয় হয়ে গেল। দৈনন্দিন অভ্যাসে আর বিভিন্ন উদাহরণ টানার সময় দেখলাম সেগুলো আমার উপরে খুবই প্রভাব ফেলছে।
আমার যদি ভুল না হয় তা হলে বলতে পারি, এসবের মধ্যে আমার যুক্তি দিয়ে কিছু করার ছিল না। আমি আসলে নিজেকে ভুলে ছিলাম। আমার বিশ্বাস আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয়নি মোটেও। এভাবেও বলা যেতে পারে, যদি আমার বড় কোনও ভুল না হয়, আমার চিন্তা ও কাজের মধ্যে নূন্যতম অতীন্দ্রিয়বাদী বা রহস্যময় ব্যাপার ছিল না। কেবল পড়তে গিয়েই আমি এসব আবিষ্কার করেছি। এসবের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে, নিজের থেকে দূরে সরে গিয়ে আমি আমার স্ত্রীর জগতে মত্ত হয়ে পড়ি। মোরেলার অনুসন্ধানের দুর্বোধ্য মারপ্যাঁচের জালে আমি অদম্য উৎসাহ নিয়ে আটকে পড়ি। যখন নিবিষ্ট চিত্তে নিষিদ্ধ পাতাগুলো পড়তাম তখন অনুভব করতাম আমার ভেতরে একটি অস্বাভাবিক আত্মার স্ফূরণ ঘটছে। আমার হাতের উপর মোরেলা তার শীতল হাতটা রাখত, আর চাপা পড়া মৃত অধ্যায়গুলো থেকে বেছে বেছে কিছু বিশেষ শব্দ সুর করে নিচু স্বরে আবৃত্তি করত।
তাদের অজানা অদ্ভুত অর্থ আমার স্মৃতিতে সারাক্ষণ জ্বলজ্বল করত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি মোরেলার পাশে বসে সময় কাটাতাম, তার সুরেলা কণ্ঠ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতাম। ভাবতেই থাকতাম, যতক্ষণ না সেই সুর আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত হত। তখন আমার আত্মার উপর কিসের ছায়া নেমে আসত, আমি ফ্যাকাশে হয়ে যেতাম আর অতিমাত্রার অপার্থিব সেই স্বরাঘাতে আমি ভেতরে ভেতরে থর থর করে কাঁপতে থাকতাম। এভাবেই সুখ আর আনন্দ পরিণত হল ভয়ে আর যা ছিল সবচাইতে সুন্দর, তাই হল ভয়ানক। যেভাবে প্রাচীন জেরুজালেমের হিন্নম উপত্যকা পরিণত হয়েছিল চির ধ্বংসের উপযুক্ত প্রতীক, অগ্নিময় নরককুণ্ড গিহেন্নায়।
বলাবাহুল্য, প্রাচীন শাস্ত্রের ঐসব বিশ্লেষণাত্মক তত্ত্বগুলোই দীর্ঘকাল ধরে আমার এবং মোরেলার মধ্যে একমাত্র কথা বলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে, বিদ্বানগণ এগুলোকে শাস্ত্রীয় নৈতিকতা বলে ভাববেন, আর বাকিদের কাছে এসব তেমন বোধগম্য হবে না। কল্পনাপ্রবণ মোরেলার উপস্থাপনার মধ্যে সবচে সুন্দর ছিল ফিখটির আদিম সর্বেশ্বরবাদ, পিথাগোরাসের পরিবর্তিত তত্ত্ব, সর্বোপরি শেলিভ এর পরিচিতি মতবাদ। মোরেলার উত্তেজনাকর আবেগই আমার মধ্যে তীব্র আগ্রহের সৃষ্টি করত। কিন্তু সেই সময় তো এলোই যখন আমার স্ত্রী’র রহস্যময় আচরণের ইন্দ্রজাল আমাকে নিপীড়ন করতে লাগল। আমি তার বিবর্ণ আঙুলের স্পর্শ সহ্য করতে পারছিলাম না, পারছিলাম না সহ্য করতে বিষণ্নতাঘেরা দৃষ্টির ছটা। মোরেলা সব বুঝতে পারছিল, কিন্তু আমাকে কোনও প্রকার ভৎর্সনা করেনি। সে আমার ত্রুটি বা মূঢ়তা সম্বন্ধে জানত। একটু হেসে সে বলত যে এটা নিয়তি। আরেকটি বিষয়ও সে জানত, তা হল আমার মনোযোগের ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্তি, যদিও এর কারণ আমার নিজেরই জানা ছিল না। কিন্তু সে যে জানত এটা কোনদিন আমার কাছে প্রকাশ করেনি। তবুও মোরেলা একজন নারী। প্রতিদিন সে একটু করে শীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। কখনও তার গালে রক্তিমাভা জন্ম নিত। ফ্যাকাশে কপালে নীল শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠত। আমার মনে বিগলিত করুণা জন্মলাভ করত। কিন্তু পরক্ষণেই আমি তার অর্থপূর্ণ চোখের ঝলক দেখতে পেতাম। তাতে করে আমার আত্মা পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে যেত। তার দৃষ্টি গহ্বরের অতল ক্লান্তি দেখে আমার সমস্ত সত্তা ঝিমিয়ে পড়ত।
তা হলে কি আমি প্রবলভাবে চাইতাম মোরেলার মৃত্যু হোক! হ্যাঁ, আমি তাই চাইতাম। কিন্তু তার ক্ষয়িষ্ণু প্রাণশক্তি যেন দীর্ঘকাল দেহকাঠামোকে আঁকড়ে ধরে ঝুলছিল। বহু সপ্তাহ, বহু বিরক্তিকর, যন্ত্রণাদগ্ধ মাস অতিবাহিত করার পর আমার অত্যাচারিত স্নায়ু আমার মনের উপর প্রভুত্ব অর্জন করল। মোরেলার মৃত্যুর দেরি দেখে আমি ক্রোধোন্মত্ত হয়ে গেলাম। শয়তান আমার আত্মাকে তাড়িত করছিল, আর আমি ঘণ্টা, দিন ও মুহূর্তগুলোকে অভিশাপ দিতে থাকি। তার স্থিরজীবন ক্ষয়ে আসার মুহূর্তগুলোও যেন দিনের শেষ ছায়ার মত প্রলম্বিত হচ্ছিল।
হ্যাঁ, আমি তাই চাইতাম। কিন্তু তার ক্ষয়িষ্ণু প্রাণশক্তি যেন দীর্ঘকাল দেহকাঠামোকে আঁকড়ে ধরে ঝুলছিল।
অবশেষে এক শরতের সন্ধ্যায় সমস্ত বাতাস নিশ্চুপ হয়ে গেল। মোরেলা আমাকে তার পাশে ডাকল। চারপাশে মাটির উপর হালকা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছিল, জলের উপর ছিল উষ্ণ আভা। আর অক্টোবরের বনে ঝলমলে পাতার ভেতরে আকাশের উপর থেকে রঙধনু প্রতিফলিত হচ্ছিল।
“আজ একটা বিশেষ দিন”, আমি এগিয়ে আসতেই মোরেলা বলে উঠল। “এই দিনটা হয় বেঁচে উঠবার অথবা মৃত্যুর। পৃথিবী ও জীবনের পুত্রদের জন্য দিনটি বিশেষ সুন্দর। আহ!
আরও বিশেষভাবে সুন্দর স্বর্গের ও মৃত্যুর কন্যাদের জন্য।” আমি মোরেলার কপাল চুম্বন করলাম। সে বলতে লাগল, “আমি মারা যাচ্ছি, তবুও আমি বেঁচে থাকব।”
“মোরেলা!” আর্তনাদ করে উঠলাম প্রায়।
“আমাকে ভালবাসতে পার তেমন দিন তোমার শেষ হয়ে গেছে। বেঁচে থাকতে যাকে তুমি ঘৃণা করেছ, মৃত্যুতে তাকে তুমি ভালবাসবে।”
“মোরেলা”
“আমি আবারও বলছি আমি মারা যাচ্ছি। কিন্তু আমার ভেতরে ভালবাসার একটি আমানত আছে—আহ, সে ভারি ছোট। তুমি আবার তেমনি অনুভব করবে, যেমন তুমি একসময় আমার জন্য অনুভব করতে। আমার আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যাবে, আর শিশুটি বেঁচে থাকবে। সে তোমার এবং মোরেলার সন্তান। কিন্তু তোমার জন্য আগামী দিনগুলোতে দুঃখ অপেক্ষা করে আছে। বৃক্ষরাজির মধ্যে যেমন সাইপ্রেসের জীবন দীর্ঘ, তেমনি তোমারও থাকবে গভীর দুঃখের ছায়া। তোমার সুখের দিন তো শেষ। একজীবনে আনন্দের কাল দুইবার আসে না। তোমার কাল আর হাসিখেলায় কাটবে না। সাফল্য আর উপভোগ চলে গ্যাছে। মর্ত্যের জীবনেই তোমাকে শবাচ্ছাদান পরতে হবে, যেমন মুসলিমরা মক্কায় গিয়ে পরজাগতিক পোশাক পরে।”
“মোরেলা!” আমি চিৎকার করে উঠলাম। “মোরেলা, তুমি কি করে এসব জানলে?” কিন্তু তখন বালিশের উপর তার মুখটা কাৎ হয়ে পড়ল আর অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল। মোরেলা মারা গেল। তার কণ্ঠ আমি আর শুনতে পাইনি।
তারপর, তার কথামত, মৃত্যুকালে তার সন্তান জন্ম নিল। তার মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত শিশুটি নিঃশ্বাস গ্রহণ করেনি, অবশেষে মোরেলার কন্যা বেঁচে উঠল। আশ্চর্য রকম বুদ্ধিমত্তা আর অবয়ব নিয়ে সে বেড়ে উঠতে লাগল। দেখতে সে অবিকল, যে চলে গেল, তার মত। শিশুটিকে আমি এত ভালবেসে ফেললাম যে মর্ত্যের আর কোনও বাসিন্দাকে আমি এমন করে ভালবাসিনি।
কিন্তু ভালবাসার নিখাদ স্বর্গে অচিরেই অন্ধকার নেমে এল। তার সাথে ধেয়ে এল বিষণ্নতা, আতঙ্ক আর দুঃখের মেঘ। আগেই বলেছি শিশুটি আশ্চর্য রকম দেহাবয়ব আর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বড় হচ্ছিল। তার দৈহিক আকৃতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু তার অস্বাভাবিক মানসিক বিকাশ দেখে আমার মনে যে বিক্ষুব্ধ চিন্তার ঢেউ ভীড় করে আসত তা রীতিমত আতঙ্কজনক হয়ে উঠছিল। আমার এই আতঙ্কিত অবস্থাকে কি অন্য কোনওভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? চিরায়ত ধারণার বাইরে প্রতিদিন একটি শিশুর ভেতরে নারী শক্তির পূর্ণ বিকাশ দেখছিলাম বলে এমন হচ্ছে? একটি শিশুর মুখ থেকে অভিজ্ঞতার পাঠ আসছিল বলে? পূর্ণতার আবেগ কিংবা প্রজ্ঞা ক্ষণে ক্ষণে তার সম্পূর্ণ এবং গভীর চিন্তাশীল চোখ থেকে প্রজ্জ্বলিত হচ্ছিল বলে? সবকিছু পরিস্ফুট হচ্ছিল আমার আতঙ্কগ্রস্ত বোধের সামনে। এমনকি আমার আত্মার অনেক ভেতর থেকেও এটা লুকোতে পারছিলাম না। আমার ভীত, কম্পিত ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধিগুলো ছুঁড়ে ফেলতেও পারছিলাম না। এইরকম অবস্থায় গা শিরশির করা, উত্তেজনাকর কিছু সন্দেহ চুপিসারে আমার মনে প্রবেশ করল। মোরেলা এখন কবরে শায়িত কিন্তু তার অতিপ্রাকৃতিক কাহিনী আর রোমাঞ্চকর তত্ত্বগুলো আমাকে তাড়া করছিল। আমার মনের দরজায় পুনরায় এলোমেলো, ভীতবিহ্বল ভাবনা আছড়ে পড়তে লাগল। জগতের যত জেরাদৃষ্টি থেকে আমি তাকে ছিনিয়ে আনলাম। নিয়তি তাকে আমার পূজার ধন বানিয়েছে। আমার গৃহের কঠোর নির্জনতায়, যন্ত্রণাক্লিষ্ট উদ্বেগের দৃষ্টিতে আমি নিবিড়ভাবে সেইসব জিনিসগুলো দেখতাম যা আমাকে বিচলিত করত।
বছর গড়াতে লাগল, দিনের পর দিন তার পবিত্র, কোমল ও বাঙ্ময় মুখের দিকে তাকিয়ে আর তার বর্ধিষ্ণু শরীরের দিকে বিস্ময় দৃষ্টি মেলে আমি তার মা’র সাথে সাদৃশ্যের নুতন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পেলাম। এই মুখ একই রকম বিষণ্ন ও মৃত। সাদৃশ্যের এই ছায়া প্রতি মুহূর্তে আরও ঘন হয়ে উঠছিল আর তা আরও পূর্ণ, আরও স্পষ্ট, আরও বিহ্বলকর এবং আরও ভয়ংকর বিকট রূপ নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল। ও’র হাসিটা যে মা’র মত এটুকু আমি মেনে নিতে পারতাম; কিন্তু এরপর আমি প্রকম্পিত হলাম যখন দেখলাম তার চোখগুলো অবিকল তার মা’র চিহ্ন বহন করছে- এ’টুকুও আমি সহ্য করতে পারতাম; কিন্তু এরপর, ওই হাসি আর ওই চোখ- মোরেলার তীব্র ও অপ্রস্তুতকর চাহনি হয়ে আমার আত্মার গভীরে গিয়ে বিঁধত। তার প্রশস্ত কপালের শেষ প্রান্তে, রেশমি চুলের গোছায়, তালুর মধ্যে গুটিয়ে থাকা বিবর্ণ আঙুলগুলোয় আর তার গভীর বিষাদময় সুরেলা কণ্ঠের ধ্বনিতে, সর্বোপরি— ওহ্, সবার উপরে, জীবন্ত এই প্রিয় মানুষটির ঠোঁটে সেই মৃত মানুষটির ভাষা ও অভিব্যক্তির প্রকাশে আমি গভীর ভাবনার ও আতংকের বিষয় খুঁজে পেলাম। এটা এমন একটা পোকার মত আমার মনে প্রবেশ করল যা সহজে বিদায় নেবার নয়। ওই হাসি আর ওই চোখ- মোরেলার তীব্র ও অপ্রস্তুতকর চাহনি হয়ে আমার আত্মার গভীরে গিয়ে বিঁধত।
দেখতে দেখতে দশটি বছর চলে গেল। আমার মেয়ের কোনও নাম দেওয়া হল না। ‘আমার মেয়ে’, ‘আমার ধন’- এ জাতীয় সম্বোধনই ছিল একমাত্র যোগাযোগ, এই অনুভব একান্তই পিতৃহৃদয়ের ভালবাসা থেকে উৎসারিত। কঠোর নির্জনতার বেড়াজাল অন্যসব মিথস্ক্রিয়াকে অসম্ভব করে তুলল। মৃত্যুর সাথেই মোরেলার নামটিও মুছে গিয়েছিল। আমি কখনও কন্যার কাছে তার মায়ের প্রসঙ্গ আনিনি। এ বিষয়ে কথা বলাই আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। আমার কন্যা তার সংক্ষিপ্ত জীবনে বাইরে থেকেও তার মায়ের কোনও আভাস পায়নি। তার নির্জনতার সংকীর্ণ সীমারেখার জন্যও এটা হয়ে উঠেনি। আমি অস্থির ও চরমভাবে বিচলিত হয়ে পড়লাম। অবশেষে আমার কন্যার ব্যাপটিজম আমাকে নিয়তি নির্ধারিত আতঙ্কের হাত থেকে পরিত্রাণের একটি তাৎক্ষণিক উপায় বাতলে দিল। একটি নাম বের করতেই আমি বারবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলাম। কত শত সুন্দর, প্রজ্ঞাপূর্ণ, অতীত ও বর্তমানের, দেশী-বিদেশী বিনম্র সাধু-সন্তদের নাম, উপাধি আমার মনে ভীড় করতে লাগল। কী যেন আমার স্মৃতিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল সেই সমাধিস্থ মৃতের দিকে। কোন অভিশপ্ত আত্মা আমাকে সেই শব্দটা উচ্চারণ করার তাগাদা দিল? শব্দটা মনে আসার সাথে সাথে আমার রক্তের মধ্যে প্রবল আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। দুষ্ট শয়তান তাড়া করে আমাকে আত্মার গহীন অন্ধকারে নিয়ে চলল। আমি সেই ঝাপসা গলিপথে দাঁড়িয়ে, রাত্রির নিস্তব্ধতায় পাদ্রীর কানে ফিসফিসিয়ে বললাম— “মোরেলা”। আর শয়তানের থেকেও বেশি শক্তিশালী কোনও অভিশপ্ত আত্মা যেন আমার সন্তানকে প্রবল ঝাঁকুনি দিল। অস্পষ্ট সে নামটি উচ্চারণ করার সাথে সাথে তার উপর মৃত্যুর রঙ ছড়িয়ে পড়ল। উজ্জ্বল চোখজোড়া তুলে সে মাটি থেকে স্বর্গের দিকে চাইল। আমার পিতৃপুরুষদের খিলানে কালো পাথরের উপর গড়িয়ে পড়তে পড়তে সে সাড়া দিলো, “আমি তো এখানেই।”
আমার কানের একেবারে ভেতরে আমি শান্ত, সুস্পষ্ট ও শীতল ঐ শব্দগুলো শুনতে পেলাম। গলিত সীসার মত সেগুলো গড়িয়ে চলল আমার মস্তিষ্কে। বছরের পর বছর গড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঐ দুঃসময়ের স্মৃতি আমার জীবন থেকে কখনও মুছতে পারে না। আনন্দ, উপভোগ যে বাদ হয়ে গিয়েছিল জীবন থেকে তাই নয়, বরং দুশ্চিন্তা ও কিসের কালো ছায়া যেন আমাকে দিন রাত্রি আচ্ছন্ন করে রাখত। আমি স্থান, কালের জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। আমার ভাগ্যাকাশের তারাগুলো মলিন হয়ে গেল। পৃথিবী জুড়ে অন্ধকার নেমে এল। চার পাশের সব বস্তু যেন অপসৃয়মান ছায়ার মত আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। সবকিছুর মাঝে আমি শুধু মোরেলাকেই দেখতে পেলাম। বায়ুর রাজ্যে কত শব্দের খেলা, কিন্তু আমার কানে শুধু একটিই শব্দ শুনতে পেলাম। সাগরের তরঙ্গে একটি শব্দের গুঞ্জনই বারবার আছাড় খায়-
‘মোরেলা’
কিন্তু সে মারাই গেল। নিজ হাতে আমি তাকে কবরে বহন করে নিয়ে গেলাম। সেই একই স্থানে শুইয়ে দিলাম যেখানে তার মা ঘুমিয়ে আছে। আশ্চর্য? প্রথম মোরেলার কোনও প্রকার চিহ্নও নেই! আমার মুখে এক দীর্ঘ, তিক্ত হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
লেখক পরিচিতি: মার্কিন সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান কবি ও গল্পকার এডগার অ্যালান পো ১৮০৯ সালে আমেরিকার বোস্টন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জীবদ্দশায় সুস্থির ও সংযমী জীবনযাপন করেননি তিনি। তবে গভীর আবেদনময় কবিতার পাশাপাশি বিশেষভাবে ব্যতিক্রমধর্মী বেশ কিছু ছোটগল্প তিনি লেখেন যেগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে রহস্যময়তা, অতি প্রাকৃতিক আবহ, মৃত্যু, নরনারীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, আতংক ইত্যাদি। ‘মোরেলা’ তেমনই একটি ছোটগল্প। শুধু মার্কিন সাহিত্যই নয়, বিশ্বসাহিত্যে স্থায়ী উচ্চ আসনধারী এই মেধাবী কবি ও কথাসাহিত্যিক ১৮৪৯ সালে মাত্র চল্লিশের কোঠায় পা দিয়েই এক জটিল ও অস্থির পরিস্থিতিতে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
অলংকরণের ছবি: The Crisis নামের চিত্রটি উনিশ শতকের ব্রিটিশ চিত্রকর Frank Dicksee এর আঁকা। ১৮৯১ সালে আঁকা বিখ্যাত এই ছবিটি মেলবোর্নের National Gallery of Victoria-তে সংরক্ষিত আছে।
সারাবাংলা/এসবিডিই