বিভূতিভূষণ হল্ট
৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৩৬
১.
“চা নাও গো কাকুরা। ওমা! কী হয়েছে তোমাদের? সক্কলের মুখে দেখছি ভূষাকালির ছাপ! ভাবে মনে হচ্ছে আলুর গুদামে আগুন লেগেছে। গুদামটা কার গো? হাতে করে ক’টা আলু নিয়েই আসতে না হয়, পোড়া মিষ্টি আলু ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেতাম। মায়ের মুখে শুনেছি, তার বাপের বাড়িতে নাকি পোড়া আলু দিয়েই জলখাবার চলতো। আমাদের ঘরেও চলেছে কয়েক মাস, সেটা করোনাকালে। প্রতিদিন ঘুম ভাংগতো আলুপোড়ার গন্ধে। প্রথম প্রথম ভালই লাগতো, কদিন পরেই রুচি উল্টে তাল গাছে। গন্ধটা নাকে এলেই বালিশে মাথা ঢেকে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতাম, গুঁইসাপের মতো। উঠতাম না। হরদিন কতো ভাল্লাগে, বলো? কী আর করা, লকডাউন বলে কথা, তার উপরে বাপের কাম-কামাই নাই। এতদিন বাদে আবার মন চাইছে। ও সুদীপ কাকু, দেবেশ’দা বলো না গো কার গুদামটা পুড়েছে? সবই কি কয়লা হয়ে গেছে? দু-চারটাও রাখোনি! কেমনতরো মানুষ তোমরা! ভাল্লাগে না, নাও ধরো চা খাও। জুড়িয়ে গেলে তো আবার মালিকের কাছে নালিশ করবে।”
বারো-তেরো বছরের অভিমন্যু, হাত নাচিয়ে মুখ বেঁকিয়ে হরহর করে এতোগুলো কথা বলে দিল। থামার কোন লক্ষণ নেই তার! সুযোগ পেলেই লোকাল- ফোকালের ধার ধারে না, একেবারে সুপার ফাস্ট ট্রেনের মতো কথার তুবড়ি ছোটায়। বলতে বলতে ভাঁড়ে চা ঢেলে একে ওকে পরিবেশন করতে লাগল। আজ কারোর মুখে রা’ নেই। সবার যেন দাঁতকপাটি অবস্থা! অন্যদিন হলে কেউ বলতো সাথে একটা নোনতা দে তো, কেউ চাইতো কুকিজ কিংবা এক জোড়া ব্রিটানিয়া। আর বুড়ো সমরকাকু তো চা আসছে দেখেই গড়গড় করে এক জগ জল পেটে চালান দেওয়া শুরু করে দিতেন। এক ডেইলি প্যাসেঞ্জার নাকি তাকে এই পরামর্শ দিয়েছেন। উনি হোমিও ডাক্তার, দত্তপুকুরে দোকান। রোজ সকাল ৮টা ০৮ এর প্যাসেঞ্জার। ডাক্তারবাবু নাকি বলেছেন, গরম চা খেতে নেই, কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, নাড়িভুঁড়ি জ্বলে যায়, আগে জল ঢেলে নাড়িভুঁড়ি ঠাণ্ডা করে নিতে হয়। সেই থেকে সমরকাকুর কাছে এটাই গুরুবাক্য। সবচেয়ে ভাল লাগে অভীক’দাকে। পড়ালেখা জানা অভীক’দা। আচার-আচরণেও দাদা দাদা ভাব। খুব জমে তার সাথে। কে জানে নামের মিল বলে কিনা। সবাই দুজনকেই অভি বলে ডাকে।
‘ভদ্রজন বানিজ্যালয়’ প্রোপ্রাইটার- শ্রী নীতিশ নস্কর। টিনের বেড়া, টালির চালের একচালা ঘর। ঘরের সামনে দিয়ে চলা সরুপথটা নেমে এসেছে পাকা রাস্তা থেকে। আগে এই পথটা শুধুই পায়ে হাঁটার ছিল। পাড়ার নারী-পুরুষের দল সকালে কাজে যেতো, আর ফিরতো সন্ধ্যায়। এই দুইবেলা মানুষের জ্যাম লেগে যেত এখানে। বাকীটা সময় রাস্তাটা যেন ময়াল সাপ। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী তেমন একটা চোখে পড়তো না, হাতের কড়ে জনা কয়েক। পিচ ঢালাইয়ের পরে থেকে কিছু প্যাডেল রিক্সা চলে, মাঝেমধ্যে দুই একটা মাল টানা মেটাডোর আর কয়েকটা চার চাকার বাবুদের গাড়ি। ঢালাইয়ের কাজ উদ্ঘাটনের সময়ে ঘোষাল বাবু একটা শিরীষ গাছের চারা লাগিয়েছিলেন এখানে। গাছটা এখন বেশ বড়। এমনিতে জায়গাটার নাম মণ্ডলপাড়া। কিন্তু একে কেউ বলে শিরিষতলা, কেউবা বলে নীতিশতলা। মণ্ডলপাড়া নামটা মুখে কমই, সাইনবোর্ড আর দলিলে- কাগজেই চলে। নীতিশ নস্করের ঝাঁপি দরজার পাশেই কেশবের চায়ের দোকান- মা তারা টি স্টল। সন্ধ্যায় আর রাতের দিকে দশ-বারো কাপ করে আর দিনের মধ্যিখানে দুই-তিনবার দুই-চার কাপ চায়ের অর্ডার হয়। দিন শেষে হিসেব চুকে। এতে নীতিশ-কেশবের মধ্যে খুচরো আর নোটের আদান-প্রদানটা সুবিধের হয়। নীতিশের লাগে নোট আর কেশবের খুচরো পয়সা। চা বিলির কাজটা অভিমন্যুর।
মণ্ডলপাড়া কানেক্টিং থেকে অল্প দূরে রেল স্টেশন, বিভুতিভূষণ হল্ট। বাঙলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে নাম। তার একটার পরেই হোম স্টেশন বনগাঁ জংশন। ভোর থেকে মধ্যিরাত অব্দি ট্রেনের পেটের ভেতরে করে অসংখ্য যাত্রীর নিয়মিত চলাচল। অনেকটা-
“রোজ সকাল, ঘুম থেকে ওঠা;
একই রুটিন, সেই একই ছোটা।
ভিড় ঠেলে দৌড়নো দ্রুত;
বেঁচে থাকার টুকিটাকি ছুতো…” গানটির মতো।
ট্রেনের ১১ পদের সাইরেনের কোনটার কী অর্থ এখানকার মানুষের এতটাই মুখস্থ যে একে মুখস্থ বা কন্ঠস্থ না বলে মগজস্থও বলা যায়। সাইরেন শুনেই বলে দিতে পারে কোনটা ঢুকছে, কোনটা ছাড়ছে। কোনটা এই স্টেশনে হল্ট করবে না, কোনটায় পাবলিককে সতর্ক করছে কিংবা কোনটা ক্রসিং পার হচ্ছে। দুপুরে আর রাতের দিকে হল্লাটা কমে যায়, স্টেশনটাকে মনে হয় ভাতঘুম দিয়েছে। তখন কান পাতলে এই বাণিজ্যালয় থেকেই বিভুতিভূষণ হল্টের এনাউন্সমেন্ট শোনা যায়। বাঙলা, ইংরেজি আর হিন্দী তিন ভাষায় কিন্নরী কন্ঠ- অনুগ্রহ করে শুনবেন, গাড়ির সংখ্যা —— প্লাটফরম নং – আসছে। কৃপায়া ধ্যান দিজিয়ে—-, your kind attension please…
ভদ্রজন বানিজ্যালয়ের রাতের দিকের এই সময়টায় দৃশ্যটা প্রায় এমনই থাকে। সারাদিনের কাজ সেরে বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন পেশার হকাররা তাক থেকে, বস্তা থেকে যার যার পণ্য গুছিয়ে রেখে যায় পরেরদিন সকালের জন্য। যেহেতু স্টেশন ভেদে তাদের উঠা-নামার নিয়ম, তাই দূরের স্টেশনের হকাররা নিজেদের পণ্য সাথে করেও নিয়ে যায়। যাদের কাজ কাক ডাকের আগে থেকে শুরু, তাদের কেউ কেউ এখানেই ঘুমায়। কাজ সেরে সারাদিনের বেচাবিক্রি শেষে হিসেবপত্র চুকিয়ে-মিটিয়ে তবেই ছুটি। তার আগে এক পশলা হম্বিতম্বি চলে নীতিশ বাবুর মুখ থেকে। এই সময়ে নিতীশ নস্করের গলার আওয়াজ সপ্তম মাত্রা ছাড়িয়ে আট কিংবা ন’য়েও চড়ে। আজ মনে হয় নয়ও ছাড়িয়েছে, তাই সকলের মুখে তালা পড়েছে। চালা ঘরের পেছন থেকে নস্করের তিন নাম্বার বউয়ের গলা খাঁকারি না আসা অব্দি চলতেই থাকে এমন বজ্রস্বর। কিন্তু কাননদির বেলায় নস্কর মহাজনেরর গলায় লঘু তাল। আপনজনের মতো ব্যবহার করেন।
কানন’দির বেশ কদর এই লাইনে। মধ্যবয়সী অন্ধ কানন’দি নাম পাল্টে ছদ্মনাম কাননদেবী হয়েছেন। কিংবদন্তী নায়িকা-গায়িকা কানন দেবীর নামে নাম। এই নামেই বেশ নাম হয়েছে তার। আগে ছিলেন অন্য মহাজনের ঘরে, গেল মাসেই কড়া শর্তে আর চড়া দরে কাননকে নিজের ডেরায় ভিড়িয়েছেন নস্করবাবু। ভারী মিষ্টি কন্ঠ। ঘিয়ে রঙ্গের থানে, কপালে তিলক এঁকে, পিঠ ঢাকা কালো চুলে যখন খঞ্জরী বাজিয়ে গান গেয়ে বগি থেকে বগিতে হাঁটেন তখন সবাই মনে করে আসল কাননদেবী ফিরে এসেছেন মর্ত্যে! কিংবা লতা, সন্ধ্যা, ঊষাদের কেউ স্বয়ং গাইছেন। কাননের শর্ত ছিল সাউণ্ডবক্স বইয়ে চলা চ্যালাটা গানের হলে ভাল, নিজের মতো অন্ধ হলে আরো ভাল। না হলেও অসুবিধা নাই, তবে তাকে হতে হবে ভদ্র, বিশেষ করে সৎ। অন্ধ গায়িকার সুযোগে কালেকশনের টাকা হেরফের করা যাবে না। সবচেয়ে চড়া শর্ত ছিল কালেকশনের ভাগ আধাআধি, চ্যালার টাকা মহাজনের আর রবিবার ছুটি। নিতীশবাবু কাননদিকে একটু সমীহই করেন। তাছাড়া বাকিদের সাথে গলা চড়া থাকে।
“ও সমর দা’ বুড়ো ভাম। পড়ে পড়ে ভোস ভোস করে ঘুমাও! কতবার বলেছি ৫টা ১৫ বা ৬টা ৪০ না ধরো, দুপুরেরটা ধরলে কিছু হয়! বেলা গড়ালে কী মানুষের ভক্তি-ভুক্তি থাকে! কতদিন বলেছি, চাঁদিটা ভাল করে সেভ করো। টিকিতে সর্ষের তেল মেখে কাঠি দিয়ে রোল করো! কে শোনে কার কথা! ঘোড়ার লেজের মতো এক গাছি টিকি বানিয়ে রেখেছো! আরে বাপু, সাধুর বেশটা ভাল না হলে কারো ভক্তি আসে! পয়সা দেয়! নামাবলী তে দুর্গন্ধ, থালাটার দিকে তাকালে রুচি হয় কারো! আর ধুপ! গন্ধে মনে হয় চিতাশালে লাশ নিয়ে যাচ্ছে! নাহ, আমার দেখছি নতুন বুড়ো টানতেই হবে। “
“সুদীপ, তোকে কতদিন বলেছি, নখ কাটবি, নখে ময়লা আর আংগুলের ফাঁকে খোসপাঁচড়ার দাগ দেখলে এই হাতে ঝালমুড়ি, ঘুমনীমাখা (ঘুগনি) খাবে কোন মুচির পো! কেন? যাদব তো ঘায়ের মলম, পা ফাঁটার মলম, মাথাব্যাথার বাম বেচেই, তার কাছে থেকে একটা নিয়ে নে। নতুন ছেলেটা, কী যেন নাম! ও হ্যা, চৈতন্য। চৈতন্যকে না ছুরি- কেচি, মাথার ব্যাণ্ড, চুলের ক্লিপ, কপালের টিপ, আলতা, ফিতে, চিরুনি দিয়ে নতুন লাইন ধরিয়ে দিলাম! তার কাছ থেকে কি একটা নেইল কাটার নিয়ে নখ কাটতে পারিস না নাবাবের পো? সবাই খালি মহাজনের দিকে তাকিয়ে থাকিস! সব নচ্ছাড়েরা এসে দল বেঁধেছে আমার ঘরে! এভাবে লক্ষ্মী থাকে! মাগো… “কপালে জোড় হাত ঠেকায় নস্কর মহাজন।
“দেবেশ, তুই ঠিকই আছিস। তয় গলাটা একটু চড়াস। আদা চা বেচলেই হয়না, গলার জন্যও একটু আদা খাবি, বুঝলি? আরে তোদের জন্য তো আমার ঘরটা লক্ষ্মীর ভাঁড়। কী নেই এখানে! পল্টনের ভাঁড়ে হাত দে, ঢাউশ ঢাউশ আমলা আর জিঞ্জার এনে দিছি। আজকাল জিঞ্জারটা চলে ভাল। এক কৌটো জিঞ্জার পকেটে রাখবি, বুঝলি? আদা চা, দুধ চা, লেমন টি বেচবি, অথচ গলা খুলবে না, তা কী হয়! কেউ শুনে তোর গলা! যদি না পারিস, এবারে কিন্তু মিনারেলের বোতল ধরিয়ে দেব। ভারী বোঝা বইতে কেমন লাগে, তখন বুঝবি।”
“খাজা- গজার ভূপেন, হাঁকের সময় বলবি ‘গরম গজা’, তাইলে সে মানুষের নজর কাড়ে, আগ্রহ বাড়ে! সবই কী শিখিয়ে দিতে হবে! কেনরে অভি, শিক্ষিত দেখেই তো তোকে আনলাম। কথা তো ছিল সবাইকে শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি করে নিবি, এজন্যই তোর হাতে শুধুই বই তুলে দিলাম। আমার বাপু ব্যাবসা লাটে তুলো না। আমি টিকলে সবাই টিকবে, নইলে মাথায় মুটে, পায়ে প্যাডেল রিক্সা জুটবে, বলে রাখলুম”।
২.
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়, তারই কোলঘেসে বাঘমুন্ডি। বাঘমুন্ডির লাগোয়া একটা গ্রাম চড়িদা। পিছিয়ে পড়া এই গ্রামে দেড়-দুই’শ ঘরের বাসিন্দা। লোকে বলে শিল্পী গ্রাম। অনেকে আবার মুখোশ গ্রামও বলে। মুখ আর মুখোশের মেলবন্ধন তৈরি করাই এদের কাজ। গ্রামের শতভাগ নারী-পুরুষই শিল্পী, মুখোশ শিল্পী, এমনকি শিশুরাও। এদের সবার মাঝে পৌরণিক ভাবধারাটা আজও আছে। এরা ছৌ নাচের মুখোশ তৈরি করেন। ধ্যানের মতো কাজ। রামায়ণ- মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রের মুখোশ তৈরি করার সময় এতোটাই নিবিষ্ট থাকে, মনে হয় যেন এরা নিজেরাই কেউ রাম- কেউ অর্জুন, কেউ সীতা কেউবা আবার দ্রৌপদী হয়ে যান। পড়ালেখার ধার খুব একটা ধারে না এরা।
অভীক এসেছে সেই চড়িদা থেকে। ছোটবেলা থেকেই অভীক একটু ভিন্ন ধাচের। মাটির ঢেলা- ছেঁড়া কাপড়ের ছাঁচের কাজে তার মন বসেনা। পড়াশুনায় বড্ড টান। তার মন বলে, এই রামায়ন- মহাভারত নিয়ে পড়ে থকলে চলেবে না, কারণ এসবের শুরুটাই হয় ‘সে অনেকদিন আগের কথা’ দিয়ে। এই ‘আগের কথায়’ পরে থাকলে সামনে এগুবে কী করে! তার চাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বলা যায়, বাড়ির লোকেদের অমতেই পড়ায় মন দেওয়া, ইশকুলে যাওয়া ছেলে অভীক।
শিমুলপল্লীর নিমাই চণ্ডালের একটা ছাপড়া ঘরে ভাড়ায় থাকে অভি। নিমাই চণ্ডালের ছোট ছোট দুইটা ছেলে- মেয়েকে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ভাড়ার টাকা অর্ধেক দিতে হয়। ছোট্ট ঘর। কোনমতে চলে যায়। ঘরের জৌলুস তেমন কিছু না, তবে দখিনমুখী জানালাটা সব কমতিকে পুষিয়ে দেয়। এই জানালা দিয়েই ঝিরঝির বাতাস, চাঁদের আলো, বৃষ্টির ছাট, ঝিঁঝিঁর ডাক, জোনাকী দেখে দেখে ঘুমায় অভি। নিমাই চণ্ডালের সাথে নিতীষ নস্করের আড্ডার যোগসূত্র থেকেই চাকুরীটা পাওয়া। দলের সবার দেখভাল করা, ফাঁকিঝুকির তদারকি করা, আর নতুন নতুন বয়ান তৈরি করে ওদেরকে শিখিয়ে দেওয়াই তার কাজ। অন্য মহাজনের ঘর থেকে করিতকর্মা হকার ভাগিয়ে আনাও তার কাজের মধ্যে পড়ে। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের ছুটিছাটা থাকলেও অভির নেই, রোববার বাদে। প্রতিদিন ৬টা ৫০ এ দলেবলে বিভূতিভূষণ হল্টে হাজির থাকা তার নিত্যকর্মের মতোই।
সবাইকে উঠিয়ে দিয়ে অভি অপেক্ষায় থাকে ‘মাতৃভূমি’ এক্সপ্রেসের জন্য। তার কাছে একটা বিশেষ কারণে এইটি বিশেষ ট্রেন! ৭টা ১৫ তে ‘মাতৃভূমি’ ছাড়ে বনগাঁ থেকে, বিভূতিভূষণে আসতে সাড়ে সাত।
এসময়ে প্লাটফর্মটা লোকে গিজগিজ করে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা শত-শত মানুষ, যেন মানুষের মাথা মানুষে খায়! কতজনের কত কাজ! চণ্ডীপাঠ থেকে জুতা সেলাই, মহিষাসুরের গলা কাটা থেকে মানুষের পকেট কাটা, ঘর থেকে সমাজ, রাজ্য থেকে রাস্ট্রের সব কাজ যেন এদেরই মাথায়! অভি মনে মনে ভাবে, এরা আছে বলেই দেশটা আজও দাঁড়িয়ে আছে, এদের কাজের উপর ভর করেই পেট চলে, দেশ চলে। ভাবতে ভাবতে হুইশেলটা শুনতে পায়। লম্বা হুইশেল, এর মানে হচ্ছে ট্রেন আসছে। নির্দেশমতো এই ট্রেনে উঠবে দেবেশের চা গরম, ভূপেনের গজা- কুচুড়ি আর বামুন বেশের সমর’দা। অনেকেই সকালের প্রথম চা টা কুচুড়ির সাথে আয়েশ করে খায়, কেউ আবার সমর’দার ধূপ জ্বালানো কাঁসার থালায় মাথা ঠেকিয়ে তিলক পড়ে ঈশ্বরের নামে একটি পয়সা খরচা করে দিন শুরু করে।
“চা- চাই চা, চা চাই তো বলবেন। বেড টি চাইছেন? মহিষের দুধের চা। ভাঁড়ে হবে- গ্লাসে হবে। কার চাই বলুন। গরম গরম চায়ে চুমুক দিন। লাল চা চাই, লাল চা পাবেন, লেমন টি চাইছেন…? বউদির হাতে চা মিস করে এসেছেন? দেবেশে আয়েশ করুন। শুধু একটা আওয়াজ। ও মাসী, পানের কৌটো খোলার আগে এক কাপ চলবে নাকি?” দেবেশের গলায় এমনই আবেশ, যেন জলের অপন নাম জীবন বদলে আজ থেকেই লোকে বলবে চায়ের অপর নাম জীবন!
দেবেশের পেছন পেছন চলবে ভূপেন। “ চায়ের সাথে টা চাইতো আমাকে বলুন। মন চাইলে খাবেন, মনকে ভুখা রাখতে নেই। নরম মনের গরম রসনা। সিংগারা- কুচুড়ি। একদম গরম হবে, ফুঁ দিয়ে খাবেন, হিং এর কচুড়ি। অম্বল হবে না, গলা জ্বলবে না, উনুনে ভাজা গরম গরম সিংগারা- কুচুড়ি। একদম মনের জিনিস- মঞ্জিস। দু’টো পাঁচ, চারটে দশ। নুন-লঙ্কা- পেঁয়াজ ফ্রি“। এক হাতে সিঙ্গারা অন্য হাতে খাজা- গজা, কুচুড়ি নিয়ে তাল মিলিয়ে হাঁক দিতে থাকবে অভির ভাল ছাত্র ভূপেন।
আর সমরদা গাইবেন নগর কীর্ত্তনের সুর। ভীর ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার কায়দাটা বেশ ভালই জানেন। পুরুতমশাই ভেবে অনেকে জায়গা করে দেয়, পায়ে পা লাগলে কেউ কেউ আবার প্রণামও করে। হাতের তালুর বাতাসে ধূপের ধোঁয়া উড়িয়ে যাত্রীর কপালে থালা ঠেকান, কপালে তিলক পড়িয়ে দেন। অমনি একটা খুচরো পয়সা টং করে থালায় পড়বে সমরদা’র। মুখ দেখে মুগের ডাল দেওয়ার মতো পয়সার আওয়াজ অনুযায়ী আশীর্বাদের মাত্রাও কম-বেশি হয়!
বগি ভাগ করা থাকে আগে থেকেই। একদম শেষেরটায় দেবেশ- ভূপেন, শেষের তিন এ সমরদা আর শুরুর তিন এ অভীক। এই তিন নম্বর বগিটাই অভির জন্য ‘বিশেষ’!
জানালার ধারে বসে আছে সে। তাজ্জবের বিষয় হচ্ছে এতো ঠাসাঠাসির ট্রেনে যেখানে সিট নম্বরের বালাই নেই, প্রতিদিন একই সিটে একই কামড়ায় একই প্যাসেঞ্জার! কীভাবে! বিষয়টা ভাবায় অভিকে। ট্রেনের ভিতর শতেক আলাপ চলে প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, জী বাংলার সিরিয়াল থেকে এবিপি আনন্দের ‘ঘন্টাখানেক সুমন’, মূখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, ফুটবল থেকে ক্রিকেট, ফেসবুক থেকে বাঁধানো বুক, কিছুই বাদ যায় না। নিদেন পক্ষে মুঠোফোনে ধ্যানীর চোখ তো আছেই। হাসি-হুল্লোর- কাইজ্জাও চলে সমানতালে, কিন্তু সে নির্বাক, নিরাসক্ত! উদাস চোখে বাইরের ল্যাম্পপোস্ট, ধানের ক্ষেত, রাখাল, গরু সবই যেন সে চোখে গিলে! মাঝেমধ্যে বুনো বাতাসে উড়ে আসা এক গোছা চুলে হাত লাগায় আর নিস্পলক চোখে বগির যাত্রীদের উপর দৃষ্টি বুলায়। অভি ইচ্ছে করেই এই বগিতে আসে, একটু বেশি সময় দেয়। তার দৃষ্টি আকর্ষণের আশায় কয়েকবার গলা ঝাঁরে। একটু উঁচু স্বরেই শুরু করে,” সবাই সব দাদা-দিদিদের জন্য বিক্রি করে। আমি এসেছি শুধু বাংলাদেশের দাদাদের জন্য। কলকাতায় যাচ্ছেন। ভারতবর্ষ বেড়াবেন। কোন হোটেলে উঠবেন, হোটেলের ভাড়া কত, কোন ডাক্তার দেখাবেন, ডাক্তারবাবু কোথায় বসেন, ফি কত, কিভাবে এপোয়েন্টম্যান্ট করাবেন। কোন মন্দিরে মানত আছে, পূজো দিবেন, মন্দিরে যাবেন কিভাবে। কলকাতা থেকে বাইরে যাবেন, কোন ট্রেনে যাবেন, ক’টায় যাবেন, কোন ষ্টেশন থেকে ছাড়ে, ভাড়া কত, প্লেনের সময়সূচী, কলকাতার ম্যাপ সব পাবেন এক বইতে। বইটি বলা চলে ভারত বর্ষের প্রিন্টেড এনসাইক্লোপেডিয়া। আমার কাছে পাবেন, চাই তো বলুন। “ বয়ানটা সবার জন্য হলেও অভির চোখ আটকে থাকে জানালার ধারের সেই মেয়েটির দিকেই। এটিই যেন তার নৈমত্তিক কাজ।
৭টা ১৫ এর এই ‘মাতৃভূমি’ ট্রেনটি মূলত ‘লেডিস স্পেশাল ট্রেন। হলে হবে কী! অতি যাত্রীর চাপে পুরুষদের জন্য দু’টি বগি ছাড় দিলেও এখন আমে-দুধে একত্রে ক্ষীর হয়ে গেছে। ডিজিটাল বোর্ডটাই শুধু নারীপক্ষীয় তকমাটা গলায় ঝুলিয়ে ছোটে ‘মাতৃভূমি’! প্রতিদিন শুধু এই মেয়েটির জন্যই এই বগিতে আসে অভি। কালে-ভদ্রে চোখে চোখ মিলে কিন্তু সেই চোখে কোন ভাষা থাকে না, পড়া হয়না। তবুও অভি আসে। বাঁধাই খাতার সাদা পাতা পড়তে পড়তে নিজের মধ্যে কী যেন একটা অনুভূতির আবিস্কার করে অভি। মেয়ে মেয়ে সম্বোধনটা ভাল লাগে না তার, কেমন যেন অসম্মান ঠেকে। তাই, মেয়েটির একটা নাম দেয়। বানান-অর্থের ধার ধারেনা অভি, এই নামটাই তার মনে ধরেছে। রিক্তা।
দিনে দিনে রিক্তা এতটাই আপন হয়ে হয়ে গেছে যেন আপনার আপন! মনে মনে একপক্ষীয় কথা হয় রিক্তার সাথে। ছাপড়া ঘরের দখিনের জানালা খুলে কথা বলে, রাত কাটায় ওরা।
“তুমি রোববারে আসোনা কেন? ও সেদিন তো মাতৃভূমি বন্ধ। আমারও ছুটি। কিন্তু দিনটা যেন কাটে না।
সেদিন যে কপালে টিপটা দিয়েছে এটা যে এক পাশে সরে গিয়ে ছোট্ট খুকীর নজরকাটা কাজলের ফোঁটা হয়ে গেছে, দেখোও নাই! হা হা হা, বোকা মেয়ে !
চুল কাটিয়েছো কেন! জানোনা? বড় চুল আমার ভাল লাগে! তোমাকে কুন্তলা দেখতে আমার বড় ভাল লাগে। আমাকে না বলে আর এমন করবে না, কেমন?
এতো সুন্দর একটা শাড়ি পড়েছো, অথচ পায়ে একজোড়া চটি! খুব রাগ করেছি, হেসেছিও। হাঁসের পায়ের মতো পায়ে একটা সু হলে কী যে লাগতো! সামনের মাসের বেতন পেয়ে একটা সু কিনে দেব।
এই রিক্তা, দিন দিন কিন্তু সুন্দর হয়ে যাচ্ছো, প্রেমে-ট্রেমে পড়োনি তো! ওদিকে যাবে না কিন্তু। আমি জানলে কিচ্ছু বলবো না, সোজা ট্রেনের চাকায় মাথা দিয়ে দেব।”
অভি একা একা হাসে, কাঁদে, কপট রাগ দেখায়, রিক্তাকে বুকে টানে এসব করতে করতেই রাত কাটে তার।
বেশ কদিন রিক্তার দেখা নেই! কী হলো তার! সে কী স্টুডেন্ট ছিল? পরীক্ষা শেষ? চাকুরী করতো? ছেড়ে দিছে না ছাড়িয়ে দিছে? শরীর খারাপ? নাকি ট্রেন বদল করেছে? অন্য ট্রেনে যায়? নাহ, অন্য ট্রেনে গেলে তো চোখে পড়তো। সব ট্রেনেই তো তার ডিউটি। কোনমতে আরেকবার দেখা হলে ফোন নম্বর চাইবেই, কথা বলবেই। নাহ! তা কী করে হয়! অভি যে হকার, ফেরিওয়ালা। ভাবতে ভাবতে প্রায় পাগলপারা অবস্থা তার।
একদিন। বনগাঁ থেকে ১০টা ২৮ এর ট্রেন। অভি তখন অশোকনগর স্টেশনে। তার দলের ওঠানামার শেষ স্টেশন। এখান থেকে শিয়ালদাহ অব্দি সবার টানা সার্ভিস। কেউ নামবে না- উঠবে না। এখানে থেকেই শুরু হয় অভির বাড়তি কাজ। সব হকার ঠিকমতো ডিউটি করছে কিনা, কাউকে পুলিশে ধরলো কিনা, কারোর কাছে খুচরোর কমতি আছে কিনা সব কিছুর তদারকি। শুরু থেকে শেষ বগিতে ছুটোছুটি চলে অভির।
সবেই বগিটাতে ঢুকেছে অভি। বগিটাতে আজ বেশ ভীড়। ভীড় হলেও কেন যেন মনে হচ্ছিল যাত্রীরা সবাই একই দলের। সবার মধ্যে একটু বাবু-বাবু সাজ। মেয়েরাও বেশ পরিপাটি। নিজেদের মধ্যে হাসছে, হেসে একের উপর একে গড়িয়ে পড়ছে, হুল্লোর করছে, কেউ আবার জানালার বাতাসে ঘুমের রাজ্যে ডুবে আছে। কয়েকজন দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়িও ফুঁকছে। বগির শেষ সিটটা। টানা বেঞ্চির মতো। তার সামনে দাঁড়িয়ে ছোটখাটো একটি নারী দল। ভিন্ন রকমের মুখ। কড়া সাজগোছ। ক্ষণে ক্ষণে হাততালীর বিকট আওয়াজ। কী যেন বলছে, আবার গাইছেও। গানের কথাগুলো বেশ অশ্রাব্য! কথাগুলোও তেমন। এসব শুনে অন্যরাও হাসছেও!
“এই হিরো, বিয়ে করছিস, নেমন্তন্ন দিলি না! এখন টাকা দে।
এই শাকচুন্নী, ভূষাকালীকে বিয়ে করলি কেন? আমাকে দেখিসনি?
ওকে আমাদের দিয়ে দে, আমাদের দলে দে। নাচাবো-গাওয়াবো…। “
আরো কত কী! অশ্লীল কথা, অশ্লীল দেহভঙ্গি! আসলে এই দলটা বৃহন্নলাদের। কৌতুহলে এগিয়ে যায় অভি। বুঝতে পারে এরা একটা বিয়ের দলকে পাকড়াও করেছে। মনে মনে রোমাঞ্চিতও হয়। রিক্তার মুখটা ভেসে আসে চোখের সামনে। নিজেকে এমন একটি দলের আসল পুরুষ ভাবে। ভীর ঠেলে এগোয় অভি। জানালার পাশে একটা নববধূ। লাল বেনারসিতে ঢাকা, লম্বা ঘোমটায় মুখটা ঢাকা। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসা শরীরটা এলিয়ে আছে বরের কাঁধে। দেখতে ভারী সুন্দর দৃশ্যটা। রিক্তার স্পর্শ পায় মনে মনে। একটা বাতাস। ঘোমটাটা উড়ে মুখটা বেড়িয়ে আসে। কপাল জুড়ে লাল টকটকে সিঁদুর, সিঁথিটাও টকটক করছে। কানে- গলায় গহনার বাড় বাড়ন্ত!
মাথাটা টলে যায় অভির! ট্রেনের কামড়ায় সন্ধ্যা নামে, আলো কমে। এক পা –দুই পা করে পিছিয়ে কোনমতে সরে আসে অভি। পায়ে শক্তি কমে আসছে অভির, গতি কমলো ট্রেনেরও। নেমে পড়ে সে। এলোমেলো পা টলতে টলতে এগোয় ঝকঝকে প্লাটফরমে। ঝাপসা চোখে জলে ধারা, যেন অযোধ্যা পাহাড়ের বামনি ফলস নামছে দু’চোখ দিয়ে।
সারাবাংলা/এসবিডিই