Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সবুজ


৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৫

এই জায়গাটার নাম লাউয়াছড়া। এখানে আছে বন, পাহাড় আর বানর। শায়লা আর শামীম শ্রীমঙ্গলে এসেছে সেকেন্ড হানিমুনে। চমৎকার একটা রিসোর্টে উঠেছে তারা। গ্রাম্য পরিবেশ, মাটির ঘর, পানি তুলতে হলে যেতে হয় খানিকটা দূরে। ঝিঁঝিপোকা ডাকে, ফুলগাছের ওপর থোকথোক জোনাকি ফুটে থাকে, নিস্তব্ধতার মূর্ছনায় মুহূর্তগুলি হয়ে ওঠে হিরন্ময়। বাসে করে আসার পথটা অবশ্য ভাল ছিল না। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বেরুতেই অনেক সময় লেগে গিয়েছিল তাদের। বাসের আসনও ছিল অসুবিধাজনক। হেলে বসলে পিছনের জনের হাঁটুর ওপর সিট নেমে যায়। আবার অতটা না নামালে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতে হয় সোজা। আরাম পাওয়া যায় না। তবে ৫ ঘন্টা তো? এটা সয়ে নেয়া যাবে। তাই তারা গল্পনায় আর কল্পে মেতে থেকে সময়টা কাটিয়ে দিলো। এমন কী যখন ড্রাইভার বাস থামিয়ে কন্ডাক্টরকে দিয়ে রাস্তার ভ্রাম্যমাণ হাঁস বিক্রেতার সাথে দরদাম শুরু করেছিল, তখনও তারা অন্য যাত্রীদের মতো বিরক্ত হয় নি। পথে যখন নেমেছে, তখন তো একটা না একটা সময় পৌঁছেই যাবে! অত তাড়া কীসের? সামনে তিনদিন ছুটি। গত এক বছরে এত বড় ছুটি তারা পায় নি।

বিজ্ঞাপন

বাস থেকে নামতেই তারা পেয়ে গেল ব্যাটারিচালিত যান। বিনয়ী এবং আন্তরিক চালক তাদেরকে নিয়ে গেল রিসোর্টের রাস্তায়। এখান থেকে সামনে নেমে একটা ছোট্ট সেতু পার হতে হবে। ঝোলানো সেই সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। কুলকুল শব্দ হচ্ছে। কী প্রশান্তিময়! শায়লা শামীমকে বলল একটু দাঁড়াতে। সেতু পার হলেই তো ওরা চলে যাবে জল থেকে দূরে। হারিয়ে যাবে শব্দের অপার্থিব জগৎ থেকে।

-এত পানি কোথা থেকে আসছে? যদি পানি আসা থেমে যায়? যদি শব্দরা হারিয়ে যায়?
শায়লার কন্ঠে উদ্বিগ্নতা।
-হারাবে না। এই পানি তো আর ওয়াসার মহাসচিবের দপ্তর থেকে আসে না। এর চাবি অন্য কারো হাতে, যে আরো শক্তিশালী। তাই, ভয় নেই।
শামীমের কথায় আশ্বস্ত হলো শায়লা। তারা দুজন হাত ধরে এগুতে থাকল। বেশিদূর হাঁটতে হলো না। রিসোর্টের কর্মীরা তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। এই জায়গাটা তারা যেমন আশা করেছিল, ঠিক তেমনই। সবুজে ঘেরা, ছায়ায় মোড়ানো। বড় বড় গাছ আছে, গাছে ধরে আছে তাজা ফল আর সুখী ফুল। স্বাস্থ্যবান ছাগল আর কুকুরের সহাবস্থান দেখা যাচ্ছে এখানে। ছাগলদের জন্যে এখানে অনেক ঘাস আছে, কুকুরদের জন্যে আছে মাংস এবং হাড়।

…এবং শায়লা আর শামীমের জন্যে আছে অবারিত সবুজ।

দুইদিন ওরা খুব ঘুরেছে। দুই পাশে চা বাগান, মাঝখান দিয়ে চলেছে ওদের ব্যাটারিচালিত গাড়ি। দূষণ নেই, শব্দ নেই, সবুজের অভাব নেই। মন জুড়িয়ে যায়, প্রাণ ভরে যায়। ড্রাইভার ওদের এখানে-ওখানে, বাঁকে-ঝাকে নামিয়ে দেয়। ওরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, আর ওদেরকে জড়িয়ে ধরে প্রকৃতি মা। ওরা বিকেলে গেল হ্রদের ধারে। ওরা রাতের বেলা আগুনে পুড়িয়ে ঝলসানো মাংস খেলো। হাত দিয়ে ঘন কুয়াশা সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পৌঁছে গেল লেমুর আর হাতিদের আবাসস্থলের কাছাকাছি। এই সময়টায় ওদের গা ছমছম করল। তাই জ্বলজ্বলে চোখের হিংসুটে বিড়ালের দেখানো পথে ধরে ফিরে এল আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত নির্জন মাটির ঘরে। ওখানে কোলাহলরত ঝিঁঝিপোকাদের বকে দেয় আরণ্যক নিস্তব্ধতা। দূরের কটেজ থেকে ভেসে আসে গিটারের মেলোডি। এসবই তারা শুনতে পায় নরম বিছানায় শুয়ে। আর কী চাই এই অ্যানিভার্সারির রাতে?

বিজ্ঞাপন

সকালে ওরা গেল পাখি দেখতে। পাখিরা ওদের উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেও নানারকম জ্যামিতিক আকৃতির বিস্ময় দেখাতে ছাড়ল না। অবজারভেশন টাওয়ার থেকে মেমসাহেবের মতো হ্যাট পরে দূরবীন দিয়ে শায়লা এসব দেখল, আর মনে মনে হয়ে গেল একটা ফিঙে পাখি।
এখন ওরা লাউয়াছড়া অরণ্যে। দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় পাহাড়ের নিচে। এখান দিয়ে ওঠার পথটা সংকীর্ণ। কীভাবে উঠবে ভাবছে। বনের প্রবেশপথে তারা একটা গাইড পেয়েছিল। সে তাদেরকে দিক নির্দেশনা আর সাহস দিয়ে তরতর করে পাহাড়ে উঠে যায়। শায়লা আর শামীম তাল মেলাতে পারে না বলে তাকে বারবার থামতে হয়।

-হাঁটতে হাঁটতে যদি বন শেষ হয়ে যায়?
অনভ্যস্ত দেহ শারীরিক পরিশ্রমে কাবু হলেও সাধ মেটে না শায়লার।
-এই বন ছয়দিন ঘুরলেও শেষ হবে না।
গাইড ছেলেটার হাসি বিস্তৃত হয়।
-তবে একা একা কোথাও যেয়েন না। মনে হবে যে এইখান থেকে ওখানে যাচ্ছেন, কিন্তু এমন গোলকধাঁধায় পড়বেন, যে আর পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
শামীম ফোন বের করে ম্যাপের ম্যাপ টেকনোলজি সংক্রান্ত কিছু বলতে যাচ্ছিল।
-ঐসব জিপিএস ফিপিএস এখানে কাজ করবে না। সেইদিনই না দুইজন হারায় গেছিল। ২৪ ঘন্টা পর তাদের খুঁজে পাওয়া যায়।

শায়লা আর শামীম অরণ্যের বিশালত্ব অনুধাবন করে আশ্বস্ত হলো। এত সহজে পথ ফুরাবে না। আর এত দ্রুত কোথাও যেতেও হবে না তাদের। না হয় বাস মিস হয়ে গেল! না হয় অফিস কামাই হলো এক দিন! তারা বড় একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে থাকল, বসেই থাকল। এখান থেকে অনেকদূর দেখা যায়। হরতকি গাছ, আমলকি গাছ, সেগুন গাছ, কড়ই গাছ, নাম না জানা পাখি, কাঁচপোকা, বানর, একটা সাপও সামনে দিয়ে চলে গেল। তাদের ভয় করল না। গা শিরশির করে উঠল না।
-চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নাও শায়লা। আবার কবে এখানে আসা হবে জানি না।
শায়লা উত্তর দিলো না। সে গান গাইতে লাগল গুনগুন করে।
“সবুজের আল ধরে লাল নীলে শব্দেরা শুয়ে থাকে/ আমার জানালা থেকে কড়ি কড়ি দুটো চোখ তোমাদের ফুলবনে শুধুই হাঁটে…”

গোলাপি

…তারপরেও ফিরে যেতে হয়। সবুজকে বিদায় জানিয়ে ওরা ওঠে একটা মেটে লাল রঙের বাসে। পরের দিন অফিস ধরতে হবে। বাছবিছার করার সুযোগ নেই। সামনে যেটা পেয়েছে, তাতেই উঠে গেছে। এই রুটে ভাল বাস নেই। ওরা সিট পেল একদম পেছনে। ঝাঁকি সহ্য করে যেতে হবে। তাই হোক। এই বাসটা মিস করলে আবার বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা। ঢাকায় পৌঁছুতে তাহলে গভীর রাত হয়ে যেতে পারে।
বাসের অর্ধেক দখল করে রেখেছে একটা বিশেষ সওদাগরি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। তাদের সবার পরনে গোলাপি টি-শার্ট। তারা সম্ভবত কোম্পানির টার্গেট পূরণ করার পুরস্কার হিসেবে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। খুব মধুর স্মৃতি সঞ্চয় করে ফিরে গেছে এমন মনে হচ্ছে না। তারা গান গাইছে না, গল্প করছে না, কিছুটা বিরক্ত, অনেকটা ক্লান্ত, এবং খানিকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও যেন! জানা গেল, এদের কাউকে আবার রাতের বেলায় অফিসে ফিরে কী যেন একটা প্রেজেন্টেশন প্রস্তুত করতে হবে। গোলাপি টি শার্টে তাদের কোম্পানির স্টিল আর সিমেন্টের দৃঢ়তার কথা লেখা আছে। সিমেন্টের সাথে গোলাপি রঙের বদখত সংমিশ্রণের বুদ্ধিটা কার মাথা থেকে এসেছিল? এসব নিয়ে শায়লা আর শামীম খুব একচোট হেসে নিল। সবুজ বন থেকে তারা নীলকন্ঠ পাখির সুরের স্মৃতি নিয়েই ফিরবে। আফসোস, আক্ষেপ আর আশঙ্কার স্থান নেই এখানে।

-যাক, এইসব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট থেকে আমরা পুরো তিনটা দিন মুক্ত ছিলাম।
শায়লা বলল।
-হ্যাঁ, তোমার গালে যেন এখনও সবুজ রং লেগে আছে। হাত দিলেই উঠে আসবে!
-আর বেশিক্ষণ থাকবে না। একেকটা উপজিলা পার হব, আর রং হারাতে থাকব।
-থাক, মন খারাপ করো না। ভাল অনুভূতিটা ধরে রাখো। এই বেচারা লোকগুলির কথা ভাবো। এরা গোলাপি রংয়ের টিশার্ট পরে ফুটফুটে বার্বিডল সেজে বিরসবদনে বসে আছে বাসে। গিয়েই আবার অফিস ধরতে হবে। আচ্ছা, তারা টিশার্টের এই অদ্ভুত কালার কোথা থেকে পেল?

শামীম যখন এই প্রশ্ন করেছে, তখন তারা পেরিয়ে গেছে দুটো উপজিলা, মেহগনি গাছ আর রাবার বাগান দৃশ্যপট থেকে বহু দূরে। বাগানের ঠান্ডা ছায়া সরে গেছে। ইট, বালি আর ধূলোর জগতে প্রবেশ করছে তারা। এই সময়টা গোলাপি রঙের জামা পরা বিষণ্ণ দেখতে সেলস এক্সিকিউটিভদের নিয়ে ঠাট্টা- তামাশা করার জন্যে চমৎকার।
-তোমাকেও একটা এরকম গোলাপি শার্ট কিনে দিব। তখন বুঝবে কেমন লাগে!
প্রগলভ হেসে শায়লা হুমকি দিলো শামীমকে।
-দিলে পুরো সেটই দিও! গোলাপি রঙের টি-শার্ট, প্যান্ট, আর একটা আন্ডারওয়্যারও! আর তোমার গোলাপি ঠোঁটটাও!
– যাও তো! সরো।
শায়লা প্রশ্রয় মেশানো লাজুক কণ্ঠে উশকে দেয় শামীমকে। দুর্বলভাবে সরিয়ে দিতে চায়। শামীম সুযোগ পেয়ে আরেকটু কাছে ঘেঁসে বসে শায়লার। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কামনামদির কণ্ঠে একটা সস্তা গানের সুর ভাঁজতে থাকে।
তীব্রগতিতে চলতে থাকা বাসটা ততক্ষণে পেরিয়ে যায় আরেকটা উপজিলা। ওভারটেক করতে থাকে একের পর এক বাস, এবং ধাক্কা খায় দাহ্য বস্তু বহনকারী একটি ট্রাকের সাথে।

ধূসর

লাল, নীল, এবং হলুদ এই তিনটি হলো মৌলিক রং। এই তিনটি রংকে বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি করা যায় হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ রং। সবুজ আর গোলাপি বিভিন্ন মিশ্রণে মেশালে নানা রং এর শেড পাওয়া যেতে পারে। হতে পারে সেটা অলিভ গ্রিন, হতে পারে সেটা ধুসর, হতে পারে সেটা ছাই রং। দাহ্যবস্তু বহনকারী ট্রাকটির সাথে ঢাকাগামী বাসটি ধাক্কা লাগার পর যখন আগুন লেগে যায়, এবং যখন শামীমের শরীর পুড়তে থাকে, তখন শামীমের মনে হতে থাকে সে ছাইয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। তার মাংস, চামড়া আর হাড্ডি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সে সাবজেক্ট থেকে অবজেক্টে রূপান্তরিত হচ্ছে। সবুজ, গোলাপি, নীল, সব রং হারিয়ে গিয়ে হয়তো আর কিছুক্ষণ পর সে পড়ে থাকবে ধূসর রঙের ছাই হয়ে। এখন যদি মারা যায়, তাহলে সে জানবে মৃত্যু কোনও বর্ণিল স্বপ্নযাত্রা নয়।

আবার সবুজ (ভিন্ন শেড)

চল্লিশ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়ে শামীম শুয়ে আছে বার্ন ইউনিটের বিছানায়। ব্যান্ডেজে মোড়ানো শরীরটা নিশ্চল পড়ে থাকে। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রূ ঝরে তার। গভীরভাবে পুড়ে যাওয়া শরীরের চল্লিশ ভাগ অংশকে ভুলিয়ে রাখে ঘুমের ঔষধ আর পেইনকিলার। একদিন হয়তো সে ঘুমের মধ্যেই মরে যাবে। কত সইবে আর একটা শরীর? পোড়া শরীরটায় প্রতিদিনই ফুঁড়তে হচ্ছে সূঁচ দিয়ে। এই সূঁচ, সিরিঞ্জ আর ব্যান্ডেজের কারাগারে তার সাথে আছে শায়লা। তার শরীরে ক্ষত নেই, পোড়ার চিহ্ন নেই। কিন্তু তার চোখে ঘুমও নেই। মনের ভেতর জ্বলছে দোযখ। ঐ বাজে বাসটায় করে সবুজের কাছে না গিয়ে আরেকটু বেশি পয়সা খরচ করে সাগরের নীলে যেত যদি? শামীম তো সেটাই চেয়েছিল! কেন সে বিরোধীতা করল? কেন অযথা অ্যাডভেঞ্চারাস হতে গেল? এখন নীল নেই, সবুজ নেই, গোলাপি রংও নেই। এইচডিইউ এর বিছানা, বালিস, পর্দা, সব সাদা। সাদা কোনও রং নয়, সব রং এসে গোত্তা খেয়ে মরে যায় সাদায়। অদৃশ্য একটা রং এখনও আছে। সে রং কেউ দেখে নি। মৃত্যুর রঙে নিরাকার কালিতে এখানে প্রতিনিয়তই লেখা হচ্ছে সমাপ্তির গল্প। চিকিৎসকদের কাছে আশার বাণী শোনা যায় না কোনও। কখনও যদি শামীমের পায়ের ফোলা একটু কমে, বা কখনও যদি জ্বর জ্বর ভাবটা না থাকে, তাহলে শায়লার চোখ ঝিকমিক করে ওঠে। মনে হয় সে আরো হাজার রাত্রি না ঘুমিয়ে থেকে তার সেবা করে তাকে সুস্থ করে তবেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু ডাক্তার আর নার্সদের ভাবলেশহীন, কঠোর মুখ তাকে অতলে নিয়ে যায় আবারও। অবস্থার উন্নতি না অবনতি হচ্ছে এই ব্যাপারে তারা কোনও মন্তব্য করতে রাজী না। তারা শুধু জানায় কখন কোন ঔষধ লাগবে, কোন ইনজেকশন লাগবে। বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করা যায় না তাদের। তারপরেও শায়লার পীড়াপীড়িতে একজন দয়ালু চিকিৎসক একদিন মুখ খুললেন।

“৪০% ডিপ বার্ন আসলে খুব ক্রিটিকাল একটা ব্যাপার। এই সময় নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। এই একটু দেখবেন ভাল, আবার দেখবেন পরের মুহূর্তেই জীবন নিয়ে টানাটানি। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের প্রোবাবিলিটি সবসময়ই থাকে। আর একবার ইনফেকশন হলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে শরীরে। সেপটিসেমিয়া হয়ে ধীরে ধীরে শাটডাউন হতে থাকবে সব। এসব ক্ষেত্রে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত কোনওকিছুরই ভরসা নাই। আল্লাহ আল্লাহ করেন”।

প্রতিদিন শামীমের শরীর ড্রেসিং করা হয়। বুক আর পিঠের ব্যান্ডেজ খুলে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করে আবার ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক এক প্রক্রিয়া। যতবারই শামীমকে ড্রেসিংয়ের জন্যে নেয়া হয়, সে ভয়ে সিঁটকে থাকে। পুরো সময়টায় সে বন্য পশুর মতো চিৎকার করে। তাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিতে বলে। এই নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্যে মিনতি জানায়। ওটি থেকে নিয়ে আসা হলে শায়লার কাছে অভিযোগ করে সে। জানিয়ে দেয়, তার ওপর কী অকথ্য নির্যাতন হয়েছে। অভিযোগ করার পর বড় আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার চোখে। যেন শায়লা চাইলেই এসব বন্ধ করতে পারে। শায়লার চোখ ফেটে জল বের হয়। কিন্তু কিছু করার নেই তার। তাকে জানানো হয়েছে, প্রতিদিন ড্রেসিং হলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে। এই ক্ষত শুকানো, পোড়া চামড়া আর মাংস সরে গিয়ে নতুন, তাজা কোষ জন্ম নেয়ার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। হাসপাতালে থাকতে হতে পারে তিন মাস, ছয় মাস, কিংবা আরো বেশি সময়। শায়লা আর শামীম তিনদিনের ছুটি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। আর এখন? কত ছুটি তাদের! কত অবসর! জীবনের আয়রনি!

এই শোকার্ত, পাথর সময় অতিক্রম করা যাচ্ছে তবুও। সময় আর জীবন, কোনও না কোনওভাবে কেটেই যায়। যদি একটুখানি কোনও শুভ লক্ষণ দেখা যায়, ডোপামিনের প্রভাবে চঞ্চল রক্তপ্রবাহে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে শরীর। রক্ত, পুঁজ, মল-মূত্র অথবা র‍্যাশ; দেহের যাবতীয় বর্জ্য, অথবা দেহে গজিয়ে ওঠা নতুন অনুষঙ্গ নিবিড়ভাবে নিরীখ করে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যাচাই করে শায়লা। শামীমের অবস্থার অবনতি অন্তত হচ্ছে বলে মনে হয় না। ডাক্তাররাও এখন আর অতটা চাছাছোলা কথা বলছেন না।

তারপর একদিন…

ড্রেসিং শেষে যখন শামীমকে ফিরিয়ে আনা হলো এইচডিইউ এ, সাথে গম্ভীর মুখে এলেন চিকিৎসক। জানালেন তার আশঙ্কার কথা।
-লক্ষণ সুবিধার মনে হচ্ছে না। ক্ষতে সবুজ ছোপ পড়েছে। এই সবুজ রংটা খারাপ। গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ। ভেতরে কতটা ছড়িয়ে পড়েছে দেখতে হবে। ইন্টারনাল অর্গান ইনফেক্টেড হতে দেওয়া যাবে না।

সবুজ রংও এমন বিনাশের ক্ষমতা রাখে? এই কদিন আগেই না তারা দুজন মিলে উদযাপন করে এলো সবুজের সমারোহ! আর কি কখনও ফেরা হবে সেখানে? না কি বাকি জীবনটা কেটে যাবে এখানেই?

সেদিন শামীমের অবস্থার অবনতি হতে লাগল দ্রুতগতিতে। ক্ষতস্থানে সবুজ রঙের ছোপ বাড়তে লাগল। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেল। উচ্চচাপসম্পন্ন অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ না থাকলে তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন।

গোলাপি (ভিন্ন শেড)

সেদিন রাতেই আইসিইউতে একজন সংকটাপন্ন রোগী মারা যায়। একটা বাচ্চা মেয়ে। পাঁচ বছর বয়স ছিল তার। রান্নাবাটি খেলতে গিয়ে তার শরীরে আগুন ধরে গিয়েছিল। কেউ একজন মারা গেছে, এবং এখন শামীমকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে, এটা জেনে আশাবাদ এবং আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠলো শায়লার মন। আইসিইউতে নেয়া মানে রোগী আজরাইলের কাছে আধাআধি চলে গেছে। কিন্তু তার কাছে মনে হলো, এই এখন থেকেই শামীম সুস্থ হতে শুরু করবে। সার্বক্ষণিক নজর থাকবে, যখন যা লাগবে, পাবে। তাহলে আর চিন্তা কীসের? কিন্তু তাকে যখন আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলো, তখনও মৃত শিশুটির স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় নি। উশখুশ করতে লাগল শায়লা। অধৈর্য হয়ে বলল,”বাচ্চাটাকে একটু সাইড করে আমার পেশেন্টকে শোয়ায় দেন না!”।

আইসিইউতে মৃত্যু যেন পরিচিত মেহমানের মতো, যে যখন তখন ঘরে ঢুকে পড়ে কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। সে যখন ইচ্ছে আসে, যখন ইচ্ছে যাকে খুশি তাকে নিয়ে চলে যায়। প্রতিদিনই সে একবার করে এসে দেখে যায় সবাইকে। তারা চিৎকার করে ওঠে, ‘না, না” বলে! এত বাধা আর বিরোধীতা স্বত্তেও তার নিজেকে অনাহুত মনে হয় না। আন্তরিক চেষ্টা চলতে থাকে তার। এসে কুশলাদি নেয় সবার। “ কী, কবে যাবে আমার সাথে? আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখবে? আমি কি বারবার এসে ফিরে যাব?”
একদিন আর তার এই অনন্তের আহবান ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। দস্যু প্রেমিক যেমন লাজুক প্রেমিকার আবরণ খসাতে, তার ভেতর প্রবেশ করতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে একসময় সফল হয়েই যায়, তেমনই একদিন শামীম, শায়লা, কাতরাতে থাকা কেউ অথবা প্রাণচঞ্চল এবং সুস্থ কেউ একজন বলেই দেবে তাকে- এসো!

প্রতিদিনই একটা না একটা বিছানা খালি হয়। আইসিইউ এর পাশের বসার জায়গায় ওঠে কান্নার রোল। দুটো আলাদা বসার জায়গা এখানে। একটা নারীদের, একটা পুরুষদের। মৃত্যুসংবাদ শোনার পর স্বজনেরা দুই কক্ষ থেকে বের হয়ে করিডরে একত্রিত হয়ে আহাজারি করতে থাকে। অন্যেরা পাংশু মুখে অপেক্ষা করে কান্নাপর্ব থামার। কিছুক্ষণ পর নিরাপত্তারক্ষীরা এসে তাগাদা দেয় শোকপালন সংক্ষিপ্ত করার জন্যে। এর মধ্যে শামীমকে নিয়ে মৃত্যু আর জীবন, এই দুই জগতের দুই পাশে চলতে থাকে টানাহেঁচড়া। যেন এক চলমান সাইনওয়েভ! কখনও উঠছে, কখনও নামছে। কখনও তার শরীরে প্লাটিলেট কমে যায়। তাকে শ্বেত রক্তকনিকা দেওয়া হয়। তখন প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়লেও আবার দেখা দেয় ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা। লোহিত রক্ত কনিকা ঠিকঠাক রাখতে গেলে দেখা যায় নতুন জায়গায় সংক্রমণ ঘটেছে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলি পুরো শক্তিতে কাজ করতে পারছে না। রেজিস্টেন্ট। ঔষধের ডোজ বাড়ানো হয়, বদলানো হয়, প্রতিদিন প্রোটিন ইনজেকশন দেওয়া হয়। পাঁচ হাজার টাকা দাম একেকটা ইনজেকশনের। তাও আবার সবসময় কাছে পিঠে পাওয়া যায় না।

আইসিইউ এর প্রতিটি বিছানাতেই এমন নানা গল্প। ষোল দিন লাইফ সাপোর্টে থাকা একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের কিডনি বিকল হয়ে গেল এর মধ্যে। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থাতেই তার ডায়ালিসিস শুরু হলো। মারা গেলেও লাশ নিয়ে যাবার উপায় নেই শীঘ্রই। মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে। সুরতহাল করবেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। পুলিশী তদন্তে খতিয়ে দেখা হবে কী বৃত্তান্ত। কী কারণে এই মৃত্যু? কেউ ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলেছে, না নিছক দুর্ঘটনা? এসব দেখে এক কিশোরের মা ছেলের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তাকে আইসিইউ থেকে প্রত্যাহার করে নিল। “মরলে মায়ের কাছেই মরুক”। শামীমেরও কি এমন অবস্থা আসবে? শায়লাকেও কি এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে একদিন? তাকে কেউ কোনও আশার বাণী দেয় না। উল্টো প্রশ্ন শুনতে হয়, তার বয়স কত, বিয়ে কবে হয়েছে, সন্তানাদি কী, সে কাজ করে কি না। যেন যাচাই করে নেয়া হয় স্বামী মারা গেলে ঠিক কতটা গভীর জলে পড়তে যাচ্ছে সে।

এমন সময় শায়লা একটা সুখবর পেলো। শামীমের নতুন অ্যান্টিবায়োটিকগুলি কাজ করতে শুরু করেছে। সবুজ রঙের ছোপ সরে যাচ্ছে মাংসের ওপর থেকে। সেগুলি এখন গোলাপি বর্ণ ধারণ করছে।
-এই গোলাপি রংটা শুভলক্ষণ। এর মানে হলো ক্ষত শুকোচ্ছে।

এই প্রথম তাকে ডাক্তার একটা ভাল খবর জানাল।

শায়লা সেদিন প্রাণভরে দেখল সেই বিক্ষত মাংসের সুন্দর গোলাপি রং, যাতে করে প্রবাহিত হচ্ছে জীবনের আশাবাদ।

বর্ণালি

-তোমার হাসপাতালে যাবার দিন কবে যেন আবার?
-সামনের শুক্রবারে।

শামীম তার কৃত্রিম পা’টায় হাত দিয়ে ধরে দেখে। এখানে স্পর্শ করলে কোনও অনুভূতি হয় না। হবার কথাও না। তারপরেও, এটা তো আর তার শরীরের বাইরের কিছু না! এখনও এই প্রস্থেটিক পায়ের সাথে তার শরীর খাপ খাইয়ে নিতে পারে নি। এই কসরৎগুলি শিখতেই এখনও যেতে হয় হাসপাতালে।

বারান্দা সংলগ্ন গাছের ডালে একটা কাক এসে বসে। এই শহরে না কি আজকাল কাক কমে যাচ্ছে? ডিম পোচের মতো দেখতে সূর্যটা শেষ বিদায় নেবার জন্যে প্রস্তুত। শামীম আর শায়লা প্রতিটা ছুটির দিনে সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখে বারান্দায় বসে। তাদের বারান্দার সামনে এখনও বিশাল কোনও ইমারত ওঠে নি। আকাশ দেখা যায়। আকাশের রং পাল্টায়। তারা জেনে গেছে, আকাশ শুধু নীল রঙের হয় না। আকাশের অনেক রং। এমন কী নীলেরও অনেক রকম। তারা এও জেনে গেছে, সূর্যের আলো অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করে যদি একটা পানির পাত্রে পড়ে, এবং সেখানে যদি একটা আয়না রাখা হয় তাহলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। প্রতিসরিত হয়ে আবার প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যাবার সময় প্রতিসরিত হয়ে আলো বিভিন্ন রঙে ভাগ হয়ে যায়। তৈরি হয় রংধনু। রংধনু দেখতে এখন আর বৃষ্টির পরের মেঘমুক্ত আকাশ দরকার নেই তাদের। তারা শিখছে সাতরং তৈরির নতুন নতুন কৌশল। তারা জানছে রঙের নামতা, মিলিয়ন ঘর পর্যন্ত।

এই মুহূর্তে ঘুলঘুলি দিয়ে বিকেলের মরা রোদের আলো এসে পড়ছে। তৈরি হচ্ছে চৌকোনও নকশা। ওগুলিকে কী রং করা যায়?

সবুজ, বা গোলাপি, কোনওটাতেই আপত্তি নেই তাদের।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর ২০২৪ গল্প সবুজ হাসান মাহবুব