পৃথিবীর পথে
৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২২
মা… ও মা …, মা গো …।
জিনু কাতরাচ্ছে। জ্বর বেড়েছে। তার চোখ বন্ধ। গলা শুকিয়ে আসছে। জ্বর তাকে কাহিল করে দিয়েছে। এরকম সময় মাকে তার খুব মনে পড়ে। ইস্ ! মা যদি এখন তার পাশে থাকত।
তোমাকে একটু আনারসের জুস করে দিই? নমি জিজ্ঞেস করল।
জিনু উত্তর দিল না।
‘কী দেব?’ নমি আবার বলল।
এবারও কোনও জবাব মিলল না।
‘কী হলো, কথা বলছ না কেন?’
‘ইচ্ছে করছে না। দয়া করে চুপ থাকো।’
‘জুস নিয়ে আসি? খাও, ভাল লাগবে।’
‘উফ্ ! এত কথা বল কেন? যা ইচ্ছে করো।’
নমি রুম থেকে বেরিয়ে এল। মানুষ বড়ো রহস্যময়। এদের সে ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। দশ বছরের ছেলেটা জ্বরে কষ্ট পাচ্ছে। সে জানে তার মা এ গ্রহে নেই। তারপরও মাকে ডাকছে।
একটু বাদে আবার হাজির হলো নমি। হাতে জুসের গ্লাস। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘জিনু ওঠো জুসটুকু খেয়ে নাও।’
‘তোমার মাথা কি মোটা? বলছি না চুপ থাকো।’
‘জুসটুকু খাও। তা হলে আর কথা বলব না।’
‘সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না?’
‘পারছি।’
‘না, পারছ না। পারবে কী করে? তোমাদের মাথায় তো ঘিলু বলতে কিছু নেই। আছে আর. ম্যাক্স১।’
‘রাগ করে না জিনু সোনা। খেয়ে নাও।’
‘তুমি ভুলে যাচ্ছ, তুমি আমার মা নও। তুমি যন্ত্রমানবী।’
‘ঠিক আছে, মাত্র একচুমুক।’
জিনু উঠে বসল। জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে তাকাল শীতলভাবে।
‘এই তো লক্ষ্মী ছেলে।’ নমি বলল।
চুমুক না-দিয়ে হাত থেকে গ্লাস ফেলে দিল জিনু। কঠিন গলায় বলল, ‘নাও এবার হলো তো, শান্তি …?’
নমি বিরক্তি প্রকাশ করল, তবে সেটাও মাপা। মেঝে থেকে পলিমারের গ্লাস তোলার ফাঁকে বলল, ‘এটা কি ঠিক হলো? এত অবুঝ হলে হবে। তুমি তো কোনও কথাই শুনছ না।’
‘আমি তো বলেছি কথা শুনতে ভাল লাগছে না। চুপ থাকো।’
‘তবে তুমিও শুনে রাখো, এরকম করলে তোমাকে হাসপাতালে নিতে হবে। তখন বেশ হবে।’
হাসপাতালে নেওয়ার কথায় জিনু একটু চুপসে যায়। কথা না-বাড়িয়ে পাশ ফেরে। মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। শীত শীত লাগছে। জ্বরটা কখন ছাড়বে? একটু ঘুমাতে পারলে বেশ হতো।
ঘরের মেঝটা পরিষ্কার করতে খুব বেশি সময় লাগল না। জিনু কী ঘুমিয়ে পড়েছে? নমি শিয়রে বসে তার কপালে হাত রাখল। এখনও বেশ জ্বর আছে। সে আলতো করে জিনুর মাথা টিপতে থাকল।
জিনু মুচকি হাসছে। তার চোখের পাতা দ্রুত ওঠা-নামা করছে। তবে কি সে স্বপ্ন দেখছে? নমি ভাল করে খেয়াল করল। জিনু বিড়বিড় করছে। স্বপ্ন দেখছে সে।
‘মা তুমি ভাল আছ?’ জিনু বলল। তার মাথা মায়ের কোলে।
‘হ্যাঁ, ভাল। তুমি তো দেখি জন্মদিনের আগে জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছ।’
জিনুর বলতে ইচ্ছে হলো : মা, তুমি আমার জন্মদিনের কথা জানো? পরে মনে হলো, ভাগ্যিশ বোকার মতো বলেনি। মা ছেলের জন্মদিনের কথা জানবে না তো কে জানবে? সে ফিক করে হেসে ফেলল।
মা বলল, ‘কী হলো, হঠাৎ হাসি?’
‘কাল আমার জন্মদিন। আমি হাসব না তো কে হাসবে?’
নাক টিপে দিয়ে মা বলল, ‘পাগল একটা।’
এই জ্বরের মধ্যেও জিনুর কী যে ভাল লাগছে ! মা তার মাথা টিপে দিচ্ছে। চোখ বুঁজে সেটা উপভোগ করতে থাকল সে।
দুই.
রাত বারোটা। চারদিকে নীরবতা। এই বাসায় সেটা আরও বেশি। নমি অলস বসেছিল। আপাতত করার মতো কিছু নেই। এরকম সময়ে মানুষের মন খারাপ হয়। নিজেকে খানিকটা অসহায় লাগে। নিঃসঙ্গতা জেঁকে বসে। নমির ভেতরে এ ধরনের কোনও বোধ কাজ করে না। তার কাছে বসে থাকা মানে স্রেফ বসে থাকা। সময় তার ওপর প্রভাব খাটাতে পারে না।
হলোগ্রাফিক ফোন২ হঠাৎ বেজে উঠল। নমি ফোনের কাছে গেল। সবুজ বোতাম টিপতেই সামনে ত্রিমাত্রিক ছবি। যেন জ্বলজ্যান্ত জিনুর বাবা মিজু দাঁড়িয়ে।
‘হ্যালো স্যার, কেমন আছেন?’ নমি বলল।
‘ভাল। জিনু কী করছে?’
‘ঘুমাচ্ছে।’
‘ওর কী জ্বর এসেছে?’
‘হ্যাঁ, স্যার।’
‘ঠিক আছে। তাহলে আর ডাকার দরকার নেই।’
‘সেটাই ভাল, স্যার।’
‘একটু পরেই আমি রওনা হবো। আশা করি সকালে পৌঁছে যাব। তুমি ওর দিকে খেয়াল রেখো।’
‘সেটা তো আমার কর্তব্য, স্যার।’
‘ঠিক আছে, শুভরাত্রি।’
‘শুভরাত্রি।’
হলোগ্রাফিক ফোনের সংযোগ কেটে গেল। নমি পা বাড়াল জিনুর রুমের দিকে।
তিন.
জিনুর ঘুম ভেঙেছে। রাত এখন দুইটা একচল্লিশ।
‘এখন কেমন লাগছে?’ নমি বলল।
‘ভাল। মাথা ব্যথাও কমে গেছে।’ জিনু উত্তর দিল।
‘খিদে পেয়েছে?’
‘হ্যাঁ, অনেক। কী রেঁধেছ?’
‘তোমার প্রিয় খাবার। ভুনা খিচুড়ি, খাসির মাংস, বেগুন ভাজা। আর কিছু লাগবে? ঝটপট তৈরি করে দিই।’
‘না, আর কিছু লাগবে না।’
‘তা হলে খেতে চলো।’
‘চলো।’
‘একা যেতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, পারব।’
মজা করে খাচ্ছে জিনু। বোঝা যাচ্ছে বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল। খাওয়ার গতিতে সেটা স্পষ্ট।
‘রান্না কেমন হয়েছে?’ নমি জানে প্রতিটি পদ সুস্বাদু হয়েছে। তারপরও জিজ্ঞেস করল। তার আর. ম্যাক্সে সেটাই প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে। এটা নাকি একধরনের সৌজন্যতা। যে খাচ্ছে তাকে এটা জিজ্ঞেস করতে হয়। তার দিকে তাকিয়ে জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
‘অনেক মজা হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘কেন?’
‘এত মজার খাবার রেঁধেছো সে কারণে।’
‘আর দু’টুকরো মাংস দিই।’
‘হ্যাঁ, দাও। বাবা ফোন দিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, দিয়েছিলেন। বারোটা বাজার পরপরই।’
জিনু মুচকি হাসল। বলল, ‘কী বলেছে?’
‘কাল সকালে আসছেন।’
জরুরি কাজে দুইদিন আগে বাবা নালখু নগরীতে গেছেন। জিনু জানে, বাবা কাল অবশ্যই ফিরবেন। তার জন্মদিনে বাবা কোনও কাজ করেন না। পুরোটা দিন তার সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেন।
‘তুমি কী আমার মাকে দেখেছ?’ জিনু বলল।
‘হ্যাঁ দেখেছি। উনি উচ্চমার্গের একজন মানবী। দেখতে সুন্দরী। ভীষণ বুদ্ধিমতী। একইসঙ্গে প্রচ- আবেগী। সবাইকে ভালবাসার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার মধ্যে।’
‘শুধু আমার জন্য তার ভালবাসা নেই।’ জিনুর গলায় অভিমান।
‘এভাবে বলো না। উনি তোমাকে পারতপক্ষে কোল থেকে নামাতে চাইতেন না। প্রায়ই দেখতাম তোমাকে বুকে চেপে ধরে কাঁদছেন। কী গভীর মমতার সেই কান্না ! কেউ না-দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না।’
‘তুমি কি জানো, মা কেন এ গ্রহ ছেড়ে চলে গেল?’
‘নিশ্চয়ই প্রয়োজন ছিল। নইলে যাবেন কেন?’
‘আমি বিস্তারিত জানতে চাই।’
‘আমি তো পুরোটা জানি না।’
‘জানো না, না কি বলতে চাও না।’
‘আসলেই জানি না। আমি যন্ত্রমানবী। কেবল গৃহকাজে পটু। সবকিছু জানার অধিকার আমাকে দেওয়া হয়নি।’
‘মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। তাকে যদি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারতাম !’ জিনু কান্না লুকাতে চেষ্টা করল। পারল না। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।
নমি মানুষকে ঠিক বুঝতে পারে না। রাগ-হাসি-কান্না-ভালবাসার ক্ষমতা তাদেরকে এই মহাবিশ্বের অন্য সবার চেয়ে আলাদা করেছে। অনন্য করেছে। এত মায়াময় জীব কি আর দ্বিতীয়টি আছে?
চার.
জায়গাটা সুন্দর। চারপাশে সবুজ। তাকালেই প্রশান্তি মেলে। সামনে দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী। শান্ত, স্নিগ্ধ। পানি টলটলে। পাড়ে বেঞ্চের সারি। একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব বেশ খানিকটা।
একটা বেঞ্চে বসে আছে জিনু ও তার বাবা মিজু। এই ইকোপার্কে জিনু আগে আসেনি। বিকেলের মোলায়েম আলোতে পায়ের নিচের ঘাসকে মনে হচ্ছে সবুজ কার্পেট।
‘জায়গাটা পছন্দ হয়েছে?’ মিজু বললেন।
‘খু-উ-ব। জন্মদিনে এরকম একটা জায়গায় নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ বাবা।’ জিনু বলল।
‘তোমার মায়েরও এ জায়গাটা অনেক পছন্দের।’
‘সত্যি বলছ?’
‘হ্যাঁ, তোমার মা এ জায়গায় এলে ফিরতেই চাইত না।’
‘বাবা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
‘করো। এর জন্য অনুমতি নেওয়ার কী আছে। আজ তুমি বার্থ ডে বয়। যা ইচ্ছে বলতে পারো।’
‘মা কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেল?’
মিজু এ প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলেন না। হঠাৎই একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। বললেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর অন্য একদিন দিই।’
‘না, আমি আজই এটা জানতে চাই।’
‘অনেক বড়ো কাহিনি। আজ থাক না।’
‘বাবা প্লিজ। আজই বলো।’
‘তুমি কেন জোর করছ?’
‘কারণ মায়ের সম্পর্কে সবকিছু জানার অধিকার আমার আছে।’
ছেলের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকালেন মিজু। বয়সের তুলনায় তাকে বেশি পরিণত মনে হচ্ছে। এখন কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছেন না।
‘চুপ করে আছ কেন?’ জিনু বলল।
‘ভাবছি।’
‘কী ভাবছ?’
‘ভাবছি, কোথা থেকে শুরু করব।’
‘এত ভাবার কী আছে। এক জায়গা থেকে শুরু করো তো।’
‘আমরা বেশ ছিলাম।’
‘আমরা মানে?’
‘আমরা মানে আমি আর তোমার মা। তখনও তুমি আমাদের মাঝে আসোনি।’
‘ঠিক আছে, বলো।’
‘বড়ো আনন্দে সময় কাটছিল। দুজনেই চাকরি করতাম। টাকা জমলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম। এই গ্রহের মানববসতির এমন কোনও জায়গা নেই যে আমরা যাইনি।’
‘তারপর কী হলো?’
‘এই ইকোপার্কে আমরা প্রায়ই আসতাম। বেঞ্চে বসে গল্প করতাম। নদীর পাড় ধরে হাঁটতাম। সবুজ ঘাসে শুয়ে আকাশের মেঘ ভেসে যাওয়া দেখতাম। পাশের কোথাও হয়ত পাখি ডেকে উঠত। তোমার মা বলত, বলো তো কোন পাখি? সময় যে কোথা দিয়ে পেরিয়ে যেত টেরই পেতাম না। সন্ধ্যা পার হলেই আমি তাড়া দিতাম। তোমার মা অনুরোধ করত- থাকি না আরও কিছুক্ষণ।’
‘তুমি মায়ের কথা রাখতে?’
‘না-রেখে উপায় কী। এমনভাবে বলত…।’
‘পরে কী হতো?’
‘অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তবেই বাসায় ফিরতাম।’
‘মা তো বেশ মজার ছিল।’
‘হ্যাঁ, তোমার মা সবসময় মজা করত। মজায় থাকতে ভালবাসত। কিন্তু এই মজার মানুষটাই হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল।’
‘কেন, কী হয়েছিল?’
‘একটা দুর্ঘটনা তার মনোজগতের সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়।’
‘দুর্ঘটনা ! কীভাবে?’
‘সেদিন রাতে আমরা এই ইকোপার্ক থেকে ফিরছিলাম। পথে আমাদের গাড়িকে একটা কাভার্ড ভ্যান ধাক্কা দেয়। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। তোমার মা গুরুতর আহত হয়। তারপর থেকেই ঘটনার শুরু।’
‘কী রকম?’
‘তার ধারণা সে মারা গিয়েছিল। পরে তাকে বাঁচানো হয়েছে।’
‘সেটা কী করে সম্ভব?’
‘এই মঙ্গলগ্রহে অনেক কিছুই সম্ভব।’
‘কীভাবে?’
‘এখানকার মানুষ অমরত্বকে প্রায় হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে।’
‘তাই নাকি!’
‘অনেকটা তাই।’
‘একটু বুঝিয়ে বলবে?’
‘ধরো এখানের কেউ দুর্ঘটনায় মারা গেল। কোনও অসুবিধা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে তার ক্লোন করা আছে। বেঁচে থাকার সময় তার প্রতিটি স্মৃতি গিয়ে মেমরি ব্যাংকে জমা হয়েছে। মেমরি ব্যাংক থেকে স্মৃতিগুলো ওই লোকের ক্লোনের মস্তিষ্কে স্থানান্তর করলেই কাজ শেষ। তখন মরে যাওয়া ওই লোক আর তার ক্লোনে তেমন কোনও তফাৎ নেই। বলতে গেলে একই মানুষ।’
‘মায়ের বেলায়ও কি এরকম করা হয়েছিল?’
‘না, এসবের প্রয়োজন পড়েনি। একটু সময় লাগলেও সে এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠেছিল।’
‘তা হলে ঝামেলাটা হলো কী কারণে?’
‘এ দুর্ঘটনা তোমার মায়ের বোধে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল।’
‘ঠিক বুঝলাম না।’
‘বোঝার মতো বয়স তো তোমার নয়।’
‘আমি তবুও শুনতে চাই।’
‘হাসপাতাল থেকে ফেরার পর তোমার মা চুপচাপ হয়ে গেল। এত হাসি-খুশি একজন এরকম চুপচাপ হয়ে গেলে সহ্য করা মুশকিল। বললাম, কী হয়েছে? বলল, কিছুই হয়নি। আমি সেটা মানতে নারাজ। শত চেষ্টা করেও তার হাসি ফিরিয়ে আনতে পারি না। কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে।’
‘আসলে মায়ের কী হয়েছিল?’
‘অনেক কষ্টের পর একদিন সে মুখ খুলল। বলল, এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ? এখানকার প্রায় সবকিছুই কৃত্রিম। এখানে মানুষের জীবন ছকে বাঁধা। কৃত্রিমতায় ভরা। আমি তো সাধারণ জীবন চাই। অতি সাধারণ।’
‘এরপর তুমি মাকে কী বললে?’
‘কী আর বলব। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী এমন অপূর্ণতা আছে, আমাকে বলবে? সে কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি মা হতে চাই। পারবে, এই ইচ্ছে পূরণ করতে? আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা !’
‘কেন?’
‘মঙ্গলের এই মানববসতিতে সবকিছু চলে হিসাব কষে। এখানে অক্সিজেন মাপা। কতটুকু কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমন হবে তাও মাপা। চাইলেই এখানে কোনও দম্পতি সন্তান নিতে পারে না। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। সেই অনুমতি মেলা সোনার হরিণ খুঁজে পাওয়ার চেয়েও কঠিন।’
‘কেন এত কঠিন?’
‘এই বসতিতে মানুষের সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাড়তি আর কারো সংকুলান বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব। জীবন-বিতৃষ্ণ কেউ যদি সজ্ঞানে মৃত্যুসনদে সই করে মারা যায় বা এই গ্রহের বসতি ছেড়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে তবেই শুধু কোনও দম্পতি সন্তান নেওয়ার অনুমতি পায়। এই অনুমতি পঞ্চাশ বছরে একটা মেলে কিনা সন্দেহ।’
‘এরপর মা কী করল?’
‘সে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল।’
‘কী সিদ্ধান্ত?’
‘নিজে এই গ্রহ ছেড়ে দেবে, তবুও সে মা হতে চায়। আবেদন করা হলো। অনুমতি মিলল। তবে শর্ত সাপেক্ষে।’
‘কী শর্ত?’
‘সন্তান হওয়ার পর সর্বোচ্চ ছয় মাস সে এই মানববসতিতে থাকতে পারবে। প্রতিটি শিশু মায়ের দুধ পাওয়ার অধিকার রাখে- এটাও সেই বিবেচনায়। কে জানে তোমার মা এখন কী করছে? হয়ত একা তোমার জন্মদিনের আয়োজন করেছে। ইস ! আজ যদি সে আমাদের সঙ্গে থাকত।’
মিজুর গলা ধরে আসে। তার চোখ হঠাৎ একটু লাল দেখাচ্ছে।
‘বাবা, একটা কথা বলি।’ জিনু বলল।
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘আমার কারণেই মা আজ তোমার সাথে নেই। আমাকে তোমার অসহ্য লাগে না?’
‘নারে বোকা ছেলে। হঠাৎ তোমার একথা মনে হলো কেন?’ মিজু এগিয়ে এসে জিনুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন।
বাবার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে জিনু। সে বুঝতে পারছে তার চোখের জলে বাবার জামা ভিজে যাচ্ছে।
পাঁচ.
জিনু আর তার বাবা বাসায় ফিরছে। ইকোপার্ক থেকে বের হতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। এখন রাত পৌনে আটটা।
গাড়িতে বাবার গাঘেঁষে বসেছে জিনু। একটা হাতও ধরে রেখেছে।
‘কী হয়েছে?’ মিজু জিজ্ঞেস করলেন।
‘ভয় করছে বাবা।’
‘কেন, ভয় কীসের?’
‘যদি আবার দুর্ঘটনা ঘটে …।’
‘ঘটবে না। আর ঘটলেও কোনও অসুবিধা নেই।’
‘কেন, আমারও কি ক্লোন করা আছে !’
‘এই মানববসতির সবারই ক্লোন করা আছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ খুবই সতর্ক।’
‘আমার স্মৃতিও কি মেমরি ব্যাংকে জমা হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ হচ্ছে।’
‘কীভাবে?’
‘তোমার মাথার পেছনে হাত দাও।’
‘দিলাম।’
‘একটা কাটা দাগ অনুভূত হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, এই তো।’
‘জন্মের পরই তোমার মাথায় একটি বায়ো-সেন্সর লাগানো হয়েছে। ওটা হলো সেই দাগ।’
‘এই বায়ো-সেন্সরের মাধ্যমেই স্মৃতি জমা হয়?’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলছ।’
‘তোমার মাথায়ও কি এরকম কাটা দাগ আছে?’
‘আছে, না-হলে স্মৃতি জমা হবে কী করে।’
‘তোমারও কী জন্মের সময় বায়ো-সেন্সর লাগানো হয়েছে?’
‘না আমার আর তোমার মায়ের বায়ো-সেন্সর লাগানো হয়েছে পরে।’
‘কেন?’
‘কারণ আমাদের জন্ম এখানে নয়। আমরা পৃথিবী থেকে এখানে এসেছি।’
‘মা কি আবার পৃথিবীতে ফিরে গেছে?’
‘হ্যাঁ, পৃথিবীতে ফিরে গেছে।’
‘পৃথিবী নামের ওই গ্রহটা কি অনেক সুন্দর?’
‘হুম, অনেক সুন্দর। মানুষের শেকড় তো ওখানেই। আর তাই গ্রহটা ভীষণ টানে। সব ফেলে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে।’
বাবার গলাটা কী একটু ধরে এলো? জিনুর তো তাই মনে হলো। গাড়ি চলছে। গন্তব্যের দিকে ছুটছে। বাবার হাতটা আরও শক্ত করে আকড়ে ধরল সে।
ছয়.
‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ জিনু বলল।
নমি পড়ার টেবিল গুছিয়ে দিতে এসেছিল। সে বলল, ‘ কী সিদ্ধান্ত?’
‘আমি পৃথিবীতে যাব।’
‘বলো কী !’
‘চোখ এত বড়ো করার কী আছে?’
‘তুমি বুঝতে পারছ, কী বলছ?’
‘হ্যাঁ, পারছি। গতকাল রাতে আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘তোমার বাবাকে বলেছ?’
‘না, এখনও বলিনি। সময় হলে বলব।’
‘সময় হতে তোমাকে অনেক দেরি করতে হবে।’
‘কেন আর মাত্র আট বছর। আঠার হলেই আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারব।’
‘এক্ষেত্রে আঠার বছর যথেষ্ট নয়।’
‘তার মানে?’
‘একবার এ মানববসতি ছাড়লে আর ফেরা যায় না। এটা অনেক কঠিন একটা সিদ্ধান্ত। সে-কারণেই পঁয়ত্রিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কারো এ সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে না। কারণ তারা মনে করে, পঁয়ত্রিশ হওয়ার আগে যেকোনও সিদ্ধান্তে আবেগের প্রাধান্য থাকে। ওই বয়সের পরে মানুষ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়।’
‘তা হলে আমাকে আরও পঁচিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে?’
‘হিসাব তো তাই বলে।’
‘আমার মা কত বছরে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?’
‘বিয়াল্লিশ বছরে।’
‘ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করব। পৃথিবীতে আমি যাবই।’
‘তোমার জন্মদিন কেমন কাটল?’ নমি প্রসঙ্গ ঘুরাতে চায়।
‘গতকাল ছিল আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা দিন। সারাজীবনে আমি এ দিনটির কথা ভুলব না। ভুলতে পারব না।’
নমি অনুমান করতে পারল জিনুর মনোজগতে বড় ওলট-পালট হয়ে গেছে। মায়ের জন্য ছেলের কী এমনই টান হয়? এতটাই কী মন কাঁদে? কী জানি। এটার হিসাব তার মাথায় ঠিক আসে না। তার ভাবনার অনেক বাইরে এসব। মানুষ আসলেই রহস্যময়। এদেরকে বুঝতে পারা এত সহজ নয়। তবে নমি এটুকু বুঝতে পারল, ছেলেটার সঙ্গে এখন আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না।
সাত.
পঁচিশ বছর পরের কথা।
ইকোপার্কের বেঞ্চে পাশাপাশি দুজন। জিনু আর তার স্ত্রী নিসা। তারা পরস্পরের হাত ধরে আছে। অন্য দিনের তুলনায় আজ এ-দম্পতি কিছুটা গম্ভীর।
‘ছেলেবেলায় প্রতি জন্মদিনে নাকি তোমার জ্বর হতো?’ নিসা পরিবেশকে হাল্কা করার চেষ্টা করল।
‘হ্যাঁ, দু-তিনবার সত্যিই জ্বর এসেছিল।’ জিনু বলল।
‘আর বাকি বছরগুলোতে?’
‘আমি ইচ্ছে করে জ্বর বাধাতাম।’
‘কেন?’
‘যাতে বাবা আমার পাশে থাকে।’
‘বাবারও তাই ধারণা। কিন্তু উনি তো তোমার জন্মদিনে পাশেই থাকেন।’
‘থাকে। তারপরও বেশি করে নিশ্চিত করতে চাইতাম। মানব মন বড়োই জটিল।’
‘আজ আমরা তাড়াতাড়ি ফিরব।’
‘অন্যদিন তো ফিরতেই চাও না। আজ হঠাৎ কী হলো?’
‘বাবা বাসায় অপেক্ষা করছেন।’
‘তাকে তো বললাম আমাদের সঙ্গে আসতে। এল না কেন?’
‘আমি কী করে বলব। তবে উনি গতকাল একটা কথা বলেছেন।’
‘কী কথা বলো তো?’
‘আমরা সন্তান নিতে চাই কিনা? উনি তা হলে পৃথিবীতে যেতে রাজি।’
‘কেন, বাবা যাবে কেন? আমার সন্তান আসবে, আমি এ গ্রহ ছেড়ে যাব। এটা নিয়ে এত কথা বলার কী আছে।’ জিনু খানিকটা উত্তেজিত।
‘উনি বলেছেন, তোমাকে জানালাম। এত রেগে যাওয়ার কী আছে।’
‘এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমার আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।’
‘আমি তোমাকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বলছি না।’
নিসা এবার গম্ভীর হয়ে গেল।
‘কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কা-টা দেখেছ?’
নিসা কোনও জবাব দিল না। জিনু তার মন ভাল করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারটা সে বরাবরই উপভোগ করে। এই মানুষটাই কিছুদিন বাদে চলে যাবে- ভাবতেই তার মনটা আরো বেশি খারাপ হলো।
‘ভাবো তো কতকাল আগে কঠিন সত্যটা লিখে গেছেন। এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান …।’ জিনু দেখল নিসার কোনও ভাবান্তর নেই। অন্য সময় হলে সে অবশ্যই হেসে ফেলত।
‘আচ্ছা, হাতির লেজে পিঁপড়া আছে, জানো?’ জিনু আবার বলল।
নিসা এবারও কিছু বলল না।
‘পারলে না তো। এলিফ্যান্টের (ঊষবঢ়যধহঃ) শেষে দ্যাখো অ্যান্ট (ধহঃ) আছে। হাতির লেজে পিঁপড়া কুটকুট করে কামড়ায়।’
জিনুর বলার ভঙ্গিতে নিসা এবার আর না হেসে পারল না। তবে তার চোখ ছলছল।
আট.
মহাকাশ যানে জিনু। গন্তব্য পৃথিবী। যাত্রী তিন শতাধিক। এত মানুষ পৃথিবীতে ফিরছে !
জিনু চোখ বন্ধ করে আছে। বিচ্ছিন্নভাবে তার মনে পড়ছে টুকরো টুকরো সব স্মৃতি।
মঙ্গলে মানববসতির আয়তন প্রায় একানব্বই হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রতিটি জায়গা ঘুরে দেখেছে জিনু। প্রতিটি জিনিসই কৃত্রিম, তবুও তো পৃথিবীর আদলে তৈরি।
ভালই কেটেছে সময়। শুধু মায়ের কথা মনে পড়লেই সে অস্থির হয়ে যেত। এই অস্থিরতাই কি তাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়?
এই কবিতা লেখার বদৌলতে নিসার সঙ্গে তার পরিচয়। তখন দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। একই বর্ষে, পাশাপাশি বিভাগে। নিসা তখন নেত্রী। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের কাতারে থাকে। ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ।
নিসার সঙ্গে পরিচয়ের স্মৃতিও বেশ মজার। কবিতা লিখে একটু সুনাম কুড়িয়েছে জিনু। ক্যাম্পাসে তাকে কম বেশি সবাই চেনে। শীতের এক দুপুরে ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে শুয়ে আছে, নিসা হাজির।
‘তোমার কি শরীর খারাপ?’
‘না, শরীর খারাপ হবে কেন?’
‘তা হলে এভাবে শুয়ে আছো যে।’
‘রোদ পোহাচ্ছি। আকাশ দেখছি। কোনও অসুবিধা?’
‘না, অসুবিধার কী আছে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমিই অসুবিধায় আছো।’
‘ভাবার জন্য ধন্যবাদ। আজকাল তো কেউ কারো জন্য ভাবতেই চায় না।’
নিসা হেসে বলেছিল, ‘খুব সস্তা দরের কথা।’
জিনুও দমবার পাত্র নয়। বলেছিল, ‘সস্তা মানেই কিন্তু ফ্যালনা নয়।’
‘কী রকম?’
‘তুমি কখনও ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশে মেঘের ওড়াউড়ি দেখেছ?’
‘না, দেখিনি।’
‘একেবারে বিনে পয়সার জিনিস, কিন্তু ভীষণ দামি। একদিন দেখো, মন ভাল হয়ে যাবে। চাও তো এখনই চেষ্টা করে দেখতে পারো।’
‘পাগল আর কাকে বলে।’ নিসা দ্রুত পা চালিয়ে সটকে পড়েছিল।
এরপর আবার দেখা টিএসসির সামনে। নিসা অনেকের সঙ্গে প্লাকার্ড হাতে বসে। তাতে লেখা : সন্তান নেওয়ার স্বাভাবিক অধিকার চাই। জিনু সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলেছিল, ‘তোমার এই প্লাকার্ড লেখার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি।’
‘তা হলে পাশে বসে পড়।’ নিসা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল।
‘পাশেই যদি বসতে চাও, তবে ক্যাফেটেরিয়ায় এসো। তোমাকে কফির নিমন্ত্রণ।’
জিনু এরপর আর অপেক্ষা করেনি। চলে এসেছিল ক্যাফেটেরিয়ায়। ভেবেছিল নিসা আসবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সে হাজির। কোনও ভনিতা না করে বলেছিল, ‘কই কফির অর্ডার দাও। সামুচাও খাব কিন্তু।’
জিনু নিজে গিয়ে সামুচা আর কফি নিয়ে এল। সামুচায় কামড় দিয়ে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে নিসা বলেছিল, ‘এবার বলো, তুমি কী বলতে চাও।’
‘আমি তোমাকে সন্তান নেওয়ার অধিকার দিতে পারি।’ জিনু চোখে চোখ রেখে বলেছিল।
অন্য সময় হলে নিসা সপাটে চড় বসাত বক্তার গালে। কিন্তু জিনুর বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল।
‘কীভাবে এ অধিকার দেবে?’ নিসার হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। জিনু খুলে বলেছিল তার পরিকল্পনার কথা। গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিল প্রতিটি শব্দ। যা ছুঁয়ে যায় নিসাকে।
‘তুমি আসলেই একটা পাগল।’ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে বলেছিল নিসা।
তারপর? যা হওয়ার তাই হল। এক তেজী নেত্রী ধীরে ধীরে এক উঠতি কবির বশে চলে এল। প্রথমে হাতে হাত। কিছুদিন প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ানো। পাল্লা দিয়ে বকবক। বাক বাকুম। বাক বাকুম পায়রা…। অতঃপর? স্বাভাবিকভাবে যা হয় তাই। সানাই বাজল। চার হাত এক হল।
সানুর কথা খুব মনে পড়ছে জিনুর। ছেলের সঙ্গে তার মাত্র দুই মাসের স্মৃতি। ছোট্ট একটা মুখ, নিষ্পাপ হাসি। অথচ জগৎ-সংসারকে টলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
মঙ্গলের মানববসতির কর্তৃপক্ষের ওপর জিনু বেজায় খ্যাপা। মায়ের বেলায় সময় ছয় মাস। অথচ বাবা থাকতে পারবেন মাত্র দুই মাস। এই বৈষম্য কেন? এটা কি মেনে নেওয়া যায়?
সানু তার ছোট্ট হাত দিয়ে বাড়ানো আঙুলটা ধরতে চেষ্টা করত। ধরতে পারলে সে কি হাসি ! জিনু নিসাকে ডেকে বলত, ‘দ্যাখো, এ ছেলে বড্ড বান্দর হবে।’
‘খবরদার তুমি আমার ছেলেকে বান্দর বলবে না।’ নিসা কপট রাগ করত।
মঙ্গল ছাড়ার অনুমতি পাওয়ার পর বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হয়েছে। চাকরিতে ইস্তফা দিতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ক্লোন কর্তৃপক্ষ ভবনে যেতে হয়েছে মাথার বায়ো-সেন্সর অপসারণের জন্য। শারীরিক পরীক্ষা করাতে হয়েছে, মহাকাশ ভ্রমণ বলে কথা।
বাবা অনেকদিন রাগ করে কথা বলেননি জিনুর সঙ্গে। আড়ালে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন। বাস্তবতা বড়ো কঠিন। জিনুর তেমন কিছু করার ছিল কী? চলে আসার দিন বাবা বাসা ছেড়ে আগেই চলে গিয়েছিল। ছেলে চলে যাচ্ছে এ দৃশ্য তার পক্ষে সহ্য করা মুশকিল।
নিসা নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত পারেনি।
‘বান্দরের কাছে কিন্তু চাবি আছে। তুমি কি জানো?’
‘না, জানি না।’ নিসার গলা ভারি।
‘আরে, মানকি (গড়হশবু) শব্দটায় কি (কবু) আছে না।’
‘আছে।’ নিসা হাসতে চেষ্টা করে।
‘নিসা ম্যাডাম আমাদের বান্দরটাকে তুমি দেখে রেখো।’
‘রাখব।’
দুজনের হাতে হাত। মুখে হাসি। চোখে জল।
জিনুর তখন মনে পড়েছিল কয়েকটি লাইন। কবিতারও নিজস্ব একটা শক্তি আছে। সময় মতো ঠিক হাজির হয়ে যায়। নইলে এখন এ লাইনগুলো মনে আসবে কেন?
‘হাসি মুখে নিতেছি বিদায়
ফিরে আসিব না আর।
শান্তির অভয় বাণী
শুনাই বারে বার।’
নয়.
শহর থেকে দূরে ছোট্ট একটা গ্রাম। শোভায় ভরা। যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। দক্ষিণ পাশে নদী। একেবারে কবিতার মতো। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে।’ নদীর পাড় ঘেষে রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে গাছ। গাছের শীতল ছায়া রাস্তায়। ঢালে ঘাস, লতা, গুল্ম। তারপর ফসলি জমি। ফসলের ক্ষেত। ক্ষেত ভরা ফসল। বাতাস ঢেউ খেলে যায় ক্ষেতের ফসলে। আহ্া ! একেই বলে ভরা ক্ষেতের মধুর হাসি। একেবারে মন জুড়িয়ে যায়।
রবি ঠাকুরের একটা লাইন মনে এলো জিনুর। ‘কি শোভা, কি ছায়া গো, কি স্নেহ, কি মায়া গো…।’ উফ! লিখেছেন বটে। বিশ্বকবির জাদুকরি কলমে লেখা সোনার পঙ্ক্তি।
মাকে দেখার জন্য জিনুর মনটা ছটফট করছে। কোন বাড়িতে থাকে মা? নিজের মনে হাসল সে। ছেলে মায়ের বাড়ি চেনে না। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে?
স্কুলমাঠে একদল ছেলে গোল্লাছুট খেলছে। তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই লম্বা মতো একটি ছেলে বাড়ি দেখিয়ে দিল। অপরিচিত লোক। অনেকেই ভাল করে দেখল। কেউ কেউ আড়চোখে তাকাল। অন্য সময় হলে হয়ত জিজ্ঞেস করত: কে আপনি? কিন্তু এখন তাদের সেই সময় কোথায়? এখন কথা বলা মানেই বোকামি। কথা বাড়ালেই খেলার ক্ষতি। খেলা রেখে গল্প করার ফুরসত কোথায়? তারা সবাই খেলায় মন দিলো।
জিনুও হনহন করে ছুটল। যত দ্রুত ওই বাড়িতে যাওয়া যায়। আর এক মুহূর্ত নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না। মাকে দেখতে আকুল হয়ে আছে সে।
কী সুন্দর উঠান ! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একদিকে ফুলের বাগান। কত দীর্ঘ সময় জিনু এ দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছে। সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে সে ডাকল, মা, ও মা …।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়। জিনুর চোখে পলক পড়ে না। এই কি তার মা !
‘তুমি কি জিনু?’ প্রৌঢ় বললেন।
‘হ্যাঁ, আমার নাম জিনু।’
‘ভেতরে এসো বাবা।’
‘আপনি কে?
‘আমি তোমার খালা।’
জিনু ভাল করে তাকায়। মুখের আদল মায়ের কাছাকাছি। মায়ের ডান গালে একটা বড়ো তিল আছে। খালার সেটা নেই।
‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ঘরে চলো।’
‘মা কোথায়?’
‘ঘরে এসো, বলছি।’
অজানা আশঙ্কায় জিনুর বুক কেঁপে ওঠে। মা ঠিক আছে তো? দ্রুত পায়ে সে বারান্দায় উঠে আসে।
‘খালা, মা কোথায়?’
‘আগে জামা-কাপড় ছেড়ে কিছু মুখে দাও। তারপর তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব।’
‘খালা, মা বেঁচে আছে তো?’
‘আছে। আমাদের মাঝে বেঁচে আছে, তোমার মাঝে আছে।’
‘তার মানে কী? মা আর নেই।’
‘বললাম তো আছে। কেবল শরীরটা নেই।’
জিনুর গোটা পৃথিবী যেন নড়ে উঠল। কত আশা করে এসেছে মায়ের মুখ কাছ থেকে দেখবে। মায়ের হাত ধরে বসে থাকবে। কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকবে, গল্প করবে। অনেক গল্প। কত কথা জমে আছে। মা চুলে বিলি কেটে দেবে। আরামে তার চোখ বুজে আসবে। আনন্দে চোখ ভিজে ওঠবে। চেয়েছিল একসাথে পৃথিবীর বাতাস থেকে দুজনে নিঃশ্বাস নেবে। হলো না। একেবারেই হলো না। শেষ পর্যন্ত পারল না সে। বিফলে গেল সব।
‘কবে মারা গেছে?’ জিনুর দুচোখ জলে উপচে পড়ছে।
‘এই তো আজ একমাস সাতদিন।’
‘ইস ! মাত্র ৩৭ দিন আগে এলে দেখা হত। কী হয়েছিল মায়ের?’
শরীর ভেঙে গিয়েছিল। ঠিক মতো খেতে পারত না। ঘুমাতে পারত না, ওষুধ খাওয়ার পরও তার ঘুম আসত না শেষদিকে। তোমার কথা খুব ভাবত। খেতে বসলে বলত: আমার ছেলেটা খেয়েছে কিনা কে জানে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ত। ঘুমাতে গেলেও সেই একই কথা: আমার ছেলেটা কী এখন ঘুমাচ্ছে? তবে একটা কথা সে খুব জোর দিয়ে বলত : ‘দেখিস, আমার জিনু একদিন পৃথিবীতে আসবেই।’
জোছনা রাত। আকাশে ঝিকমিক করছে তারা। উঠানে মাদুর পেতে শুয়ে আছে জিনু। পাশে মোড়ায় খালা। কত সব গল্প। তার বেশিরভাগটা জুড়েই মা।
মা আর খালা মিলে এই গ্রামে একটা স্কুল বানিয়েছে। স্কুলের বয়স ৩৩ বছর। খালা বিয়ে করেননি। নিজের মা-বাবাকে তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আগলে রেখেছেন। শিক্ষার আলো বিলানোকেই জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
জিনুও গ্রামের স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছে। ছোটদের পড়ানোর কাজটা এত আনন্দের তা তার জানা ছিল না। সানুর কথা তার খুব মনে পড়ে। নিসা ও বাবার কথাও মাঝে-মধ্যে মনে পড়ে। তবে তাদের নিয়ে দুঃচিন্তা হয় না। মঙ্গল গ্রহে তারা ভাল আছে। ভাল থাকবে। যদিও একটা প্রশ্ন প্রায়ই মনের মধ্যে খচখচ করে। পৃথিবীর মায়া কী তাদের টানে না? হয়ত টানে। গভীরভাবেই টানে। বাবাকে তো পৃথিবীর স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায়। নিসারও যথেষ্ট টান আছে শেকড়ের প্রতি। তাহলে? সভ্যতার দাবি মেটাতে অনেকে মতো তারাও হয়ত বুকে পাথর চাপা দিয়ে পড়ে আছে ওখানে। বোধের জানালায় পর্দা টেনে দিয়ে। নাকি অন্যকিছু? দীর্ঘ আয়ুর লোভ? অমরত্বের লোভেই কী মানুষ মহাবিশ্বে ছুটছে?
বাড়ির পেছন দিকে মায়ের কবর। নামফলকে লেখা : বোধি। পৃথিবীর মায়ায় হেলায় ছেড়েছিল মঙ্গল। তার নিচে জন্ম আর মৃত্যু তারিখ, সাল।
জিনু ভাবে, মায়ের বাবা কি আগেই বুঝতে পেরেছিল তার মেয়েটির বোধ অনেক প্রখর হবে। নইলে কেন মেয়ের নাম রাখবেন বোধি?
জিনু প্রায়ই মায়ের কবরের পাশে গিয়ে শুয়ে থাকে। কখনও হাতে থাকে কবিতার বই। তার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। এত ভাল সব কবিতা একজন লেখেন কী করে? কী অদ্ভুত একেকটি লাইন। ‘আবার আসিব ফিরে, ধান সিঁড়িটির তীরে…।’ কিংবা ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে …।’
প্রকৃত কবি মাত্রই সত্যদ্রষ্টা। বড় নিঃসঙ্গ তার জীবন। সবাই পাশে আছে। কিন্তু থেকেও যেন তারা নেই। জিনু কবি হতে চায়। কবি হওয়ার স্বপ্ন বুকের গভীরে লালন করে সে। সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখতে চায়। অদ্ভুত সুন্দর একটা লাইন অন্তত লিখতে চায়। মা, মাটি আর কবিতা- কেবল এই তিনটি জিনিস আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। বুকে সারাক্ষণ ভালবাসা পুষে রাখে মানুষের জন্য। সবার ভাল চায় সে। সুন্দর এই পৃথিবীতে সবাই সুখী হোক। মহাবিশ্বের সবাই সুখী হোক। নিজের মতো করে সুখী হোক। পৃথিবীর পথে, ধুলোময় ধরনীর পথে আমৃত্যু হাঁটতে চায় সে।
কী যে মায়া! কী গভীর এক বোধ! আহা রে মানব সন্তান। মায়াময় পৃথিবীর পথে হাজার-হাজার বছর ধরে হেঁটে চলেছে। হেঁটে চলেছে…।
মহাবিশ্বের পথে অবিরাম পথ হেঁটে চলেছে…। অক্লান্ত পথিক বলে কথা। অমৃতের সন্তানরা তো থামতে জানে না। কেবল সামনে এগিয়ে যায়। হেঁটে চলে…। হেঁটে চলে…।
১. আর.ম্যাক্স : যন্ত্রমানব বা রোবটের মস্তিষ্ক
২. হলোগ্রাফিক ফোন : হলোগ্রাফি হলো ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরির বিশেষ প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়ার সাহায্যে যোগাযোগের একটি মাধ্যম হলো হলোগ্রাফিক ফোন।
সারাবাংলা/এসবিডিই