Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (চতুর্থ পর্ব)


৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:২৩

কারোশি কেয়ার

ঢাকায় এসে পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপানো যতটা সহজ হলো চাকরিবাকরি খুজে পাওয়া সহজ হলো না সামিউলের। শেলীর ওখান থেকে আসার পর থেকেই কবিতা গল্প লেখার পাশাপাশি সে চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। জহিরের সহায়তায় একটা সিভি বানিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের পরিচিতজনের কাছে দিয়ে রাখল। কিন্তু কোনখান থেকে কোন সাড়া মিলল না। সাংবাদিকতার চাকরিতে তারমতো ফ্রেশার কাউকে সহজে নেয় না। সাধারণত এক সাংবাদিকের মাধ্যমে আরেক সাংবাদিককে রেকমন্ডশনের কারণে যাচাইবাছাই করে নেয়। আর সেক্ষেত্রে তার সংবাদপত্র বা মিডিয়া জগতের অভিজ্ঞতাটাই আসলে যাচাইবাছাই করে। দুএকজন সাহিত্য সম্পাদক আশ্বাস দিলেও আদতে কোন কাজ হলো না। শুধু তাই নয়, তারা এখন ফোন রিসিভও করে না, দেখা করতেও চায় না। চাকরি চাইতে গিয়ে পত্রিকায় লেখা ছাপানোর সোর্স বন্ধ হয়ে যেতে পারে ভেবে সামিউল সম্পাদকদের কাছে চাকরির উমেদা দেওয়া বন্ধ করল।
অভিজ্ঞতা ছাড়া গণমাধ্যমে চাকরি হবে না বুঝতে পেরে সামিউল অন্য চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে উঠল। এই বয়সে এসে স্কুলের বাচ্চাদের ক্যাচোরম্যাচোর সহ্য হবে না ভেবেই সে স্কুল কলেজে দরখাস্ত করা থেকে বিরত থাকল। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু সার্কুলার দেখে সেখানে চেষ্টা করলেও ভাইভাতে গিয়ে অভিজ্ঞতার বলী হলো। তাছাড়া তার সার্টিফিকেটের পয়ত্রিশের কাছাকাছি বয়স অথচ কোন চাকুরির অভ্জ্ঞিতা নেই, ব্যাপারটা কেউ সহজভাবে নিল না। মাস্টার্স পাশ করে এতোবছর বেকার বসে থাকার অর্থই হচ্ছে হয় সে কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল না হলে চাকরি করার মতো কোন যোগ্যতাই তার নেই। আর এরকম অযোগ্য একজন প্রার্থীকে তারা চাকরির দিতে পারে না। অনেক প্রতিষ্ঠানে সে দরখাস্তই করতে পারল না বয়সের বাধায়। চাকরির সমাজ পয়ত্রিশ বছর বয়ষী যুবককে বাতিলের খাতায় ফেলে আরো তরুণ মুখ খুজতে চায়।
চাকরির চক্করে পড়ে কোনদিক যে মাস তিনেক সময় পার হয়ে গেছে খেয়াল করেনি সামিউল। এর মধ্যে লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে এই কমাসে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে তার ডজনখানেক কবিতা ছাপা হয়েছে, হালিখানিক গল্প ছাপা হয়েছে। কবিতার সমাজ তার নামকে চিনতে শুরু করেছে। এমনকি একজন মুরগী ধরা প্রকাশকও যোগাযোগ করে বলেছে কিছু বই বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে পারলে তারা তার একটা কবিতার বই ছাপতে পারে। অর্থাৎ প্রকারান্তারে টাকা দিয়ে বই করার কথা জানিয়েছে। টাকা দিয়ে কবিতার বই বের করা সামিউলের জন্য ওয়ানটুর ব্যাপার। ওরকম টাকা তার ব্যাংকে গচ্ছিত আছে। এমনকি জহিরের জোরাজুরিতে তার অলস পড়ে থাকা কিছু টাকা সে জহিরের ব্যবসায় লগ্নি করেছে। এখনও কোন লভ্যাংশ আসেনি। এবং তার মন বলছে জহিরের ব্যবসা থেকে তার শেয়ারে কোন লভ্যাংশ তো দূরে থাক, আসল টাকা উসুল করতে গিয়েই দুই বন্ধুর মধ্যে জন্মের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। তারপরেও সে জেনেবুঝে লাখ অধিক টাকা জহিরকে দিয়েছে। বই বের করতে হলে হাজার বিশ তিরিশ সে প্রকাশককে এক্ষুণি দিতে পারে। কিন্তু সে যে শুধু টাকা দিয়ে বই বের করবে না তাই নয়, প্রকাশক চাইলেও এখনই সে কোন বই বের করবে না। তার কেন জানি মনে হয়, বই বের করার মতো যোগ্যতা তার এখনও হয়নি।
মাঝে মধ্যে সামিউলের মনে হতে লাগল, যদি কোন বাসায় কেয়ারটেকারের চাকরিটাকরিও পেয়ে যায়, তাও সই। কেয়ারটেকারের চাকরিতে মোটামুটি লেখালেখি করার মতো ভালই অবসর পাওয়া যায়। তাই শুনে জহির হাসতে হাসতে বলল, ‘চাকরির দুনিয়াটা অতো সহজ নারে বন্ধু। সহজ হলে কি আর আামি চাকরির ধান্ধা বাদ দিয়ে ব্যবসার ধান্ধায় লাগতাম। পাস করে ঢাকায় এসে টিউশনির পাশাপাশি ভাল একটা চাকরির চেষ্টা কি কম করেছি? টুকটাক ছোটখাট চাকরি পেয়েছি, করেছি। কিন্তু ওই যে কথায় বলে না, ছোট চাকরিতে উঠতে লাথি, বসতে ঝাটা। কেয়ারটেকারের চাকরি করে দেখ লাথিঝাটা কাকে বলে। শেষমেষ সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়লাম। যদিও এখনও সেভাবে বলার মতো সফলতার মুখ দেখতে পারিনি, তবে স্ট্রাগল করে যাচ্ছি। এক সময় দাড় হয়ে যাচ্ছে। তুই যেমন স্ট্রাগলিং লেখক, আমিও তেমনি স্ট্রাগলিং ব্যবসায়ী। আমাদের জীবনটাই হচ্ছে স্ট্রাগলের জীবন।’
সামিউল মনে মনে বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না, ওর ব্যবসায় তার লাখ টাকা যে জলে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছিল। সে জহিরকে মনে করিয়ে দিল, ‘বসে খেতে খেতে আমার রাজার ভান্ডার কিন্তু ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ওদিকে কিছু রোজগার না করতে পারলে বন্ধকী জমিটমি কস্মিনকালেও ছাড়াতে পারব না। তখন কিন্তু আমাকে বসে বসে তোকেই খাওয়াতে হবে।’
‘তা খাওয়াতে পারব।’ জহির জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আমার দুমুঠো জুটলে তোরও জুটে যাবে। বিয়ে করিনি বলে বাচোয়া। আমি না হয় রুটিরোজগারের ধান্ধায় বিয়ে করতে পারলাম না। বাড়িতে এমন কেউ নেই যে আমাকে ধরে জোর করে বিয়ে করিয়ে দেয়। তুই করলি না কেন? শেলীর জন্য?’
সামিউল দুদিকে মাথা নাড়ল, ‘না, মায়ের জন্য!’ তারপর একটু কি ভেবে বলল, ‘শেলী চলে যাওয়ার পর শেলীর চিন্তা যে মাঝেমধ্যে মাথায় আসেনি তা নয়, কিন্তু সেটা ঠিক আবেগের মধ্যে ছিল না। মাঝে মধ্যে মনে পড়তো আর কি? কিন্তু ওইদিন দেখে করে এসে সেটুকুও উবে গেছে। যদিও এর মধ্যে দুচারবার ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু সেসব অন্তসারশূন্য কথাবার্তা।’
‘ও ভাল কথা, তুই না শেলীর সাথে দেখা করে এসে বলেছিলি, ও তোকে কি একটা চাকরির অফার করছিল, তুই তো সিভিও পাঠিয়েছিলি।’
‘হ্যা, বলেছিলি। ওই কেয়ারটেকার গোছেরই চাকরি নাকি? ধনাঢ্য বুড়োবুড়ির সাথে কিছুটা সময় কাটাতে হবে, এই টাইপের কিছু। আমি আগ্রহ দেখায়নি।’
‘কেন? এখন তো এমনিতেই কেয়ারটেকার থাকতে চাইছিস। আমার মনে হয়, তুই গিয়ে একবার দেখা করে আয়। না হলে যোগাযোগ কর। তুই যেরকম ভাবছিস তার চেয়ে অন্য কিছু তো হতে পারে।’
‘যাব, বলছিস!’
‘হ্যা, বসে না থেকে অন্তত দেখে আয় ব্যাপারটা কি! সারাদিন তো ঘরে বসে লেখালেখিই করিস। লেখালেখির জন্য হলেও তো একটু অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা দরকার!

বিজ্ঞাপন

লেখালেখির অভিজ্ঞতার জন্যই হোক, ঘরে বসে বিরক্তি ধরে যাওয়ার জন্যই হোক আর শেলীর সাথে দেখা হবে এই কারণেই হোক, সামিউল শেলীকে ফোন করে জানাল, ওই চাকরির ব্যাপারে সে আগ্রহী। কবে কখন কোথায় দেখা করতে হবে?
‘তুমি ফোন দিয়ে ভালই করেছো। আমিই তোমাকে ফোন দিতে চেয়েছিলাম। ওরা নতুন কিছু কর্মী রিক্রুট করবে। আমি তোমার সিভি দিয়ে রেখেছিলাম, ওটা গ্রান্ট হয়েছে। এখন তোমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক আসবে। তবে আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি, কবে তোমার ইন্টারভিউ। তোমাকে বলেছিলাম না ওখানে একজনের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। তার কাছেই খোঁজ নিতে হবে।’
বারবার ওই লোকটার প্রসঙ্গ ওঠায় ভাল লাগছিল না সামিউলের, প্রেমিকার বিয়ে হলে গেলে এক কথা, কিন্তু প্রেমিকাকে অন্য আরেকজনের সাথে প্রেম করলে আরেক কথা। তবে সামিউলের মনে হলো, একটা বয়সের পরে মানুষের প্রেমে হয়তো শরীরটাই বড়ো হয়ে ওঠে, শেলীর সাথে ওই লোকের সম্পর্ক কি শারীরিক?

ইন্টারভিউয়ের দিনে একাই যেতে হবে এরকমই প্রস্তুতি নিয়েছিল সামিউল। কিন্তু ওই দিন সকালেই ফোন দিয়ে শেলী বলল, ‘তুমি গুলশান-১ এর গোলচক্করের ওখানে থাকো। আমিও আসব। তোমার সাথে যাব। শুধু ভাইভাই তো হবে। আমি গিয়ে বাদল ভাইয়ের সাথে তোমার ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দেব। তাতে কাজটা সহজ হবে।’
গুলশান-১ এ সামিউলই ফর্মাল ড্রেস শাট ইন করে ঝা চকচকে পলিশওয়ালা জুতো পরে শেলীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। শেলী প্রায় নির্ধারিত সময়েই এলো। মেয়েদের জন্য মিনিট পনেরো লেট কোন ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।
শেলী পাশে এসে দাড়াল। সামিউলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে চাকরির ইন্টারভিউ নয়, নায়কের অডিশন দিতে যাচ্ছ। অনেক হ্যান্ডস্যাম লাগছে তোমাকে।’
‘থাঙ্কস।’ সামিউল ধন্যবাদ দিল, যদিও এক সময় শেলীর সাথে তার ধন্যবাদের সম্পর্ক ছিল না। শেলীকেও তোষামোদ করে সুন্দরী বিউটি কুইন লাগছে বলতে পারল না, কারণ শেলী সুন্দরী অসুন্দরী কিছুই লাগছিল না, কেমন যেন খালাম্মার মতোই লাগছিল।
‘ওদের অফিসটা নিকেতনে, আবাসিক এরিয়ার মধ্যে। রিকশা ছাড়া হেটে যেতে বেশ খানিকটা পথ। রোদও চড়ে গেছে। তোমাকে এখানে বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে।’ রিকশা নেওয়ার কথাটা বলতে শেলীর এতোগুলো কথা বলা লাগল। আগের সেই ঘোরানো-প্যাচানো স্বভাবটা এখনও যায়নি।
রিকশা নিতে গিয়ে সামিউল ভেতরে ভেতরে একটু বিব্রত হলো, রিকশা কি একটা নিবে নাকি দুজনের জন্য দুইটা? এক সময় শেলী তার এতো কাছে ছিল যে সামান্যতম দুরত্বও তাদের মধ্যে ছিল না, শরীরে শরীর মিশিয়ে শুয়েছে একদিন আর এখন?
রিকশা একটাই নিল এবং শেলী খুব ষ¦াচ্ছন্দ্যে তার বিশাল বপু নিয়ে সামিউলকে এক প্রকার চেপে কোণঠাসা করে রিকশায় বসল। কত কতদিন পরে সেই পুরানো শরীরের স্পর্শ শরীরের গন্ধ তাকে বিবশ করে তুলল।
শেলী সামিউলের হাত স্পর্শ করে বলল, ‘তোমার সিভির সাথে আমি বুদ্ধি করে তোমার ওকে মাকে নিয়ে গল্পটাও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তাছাড়া তুমি যে দশ-বছর ধরে প্রায় একা হাতে খালাম্মাকে সেবাশ্রুশষা করেছো, মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তা থেকে পিছপা হওনি এইগুলি আমি ফুলিয়ে ফাপিয়ে বলেছি। তোমাকে জিজ্ঞেস করলে লজ্জা পেয়ে এড়িয়ে যেও না। এই চাকরির জন্য এটাই তোমার সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট। সবচেয়ে বড়ো অভিজ্ঞতা।’
সামিউল একটু অবাক হলো। যে অভিজ্ঞতার জন্য সে হাঁপিত্যেশ করে মরছিল সেরকম কোন একটা অভিজ্ঝতা তাহলে এই জীবনে সে অর্জন করেছে। জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা!
রিকশা দ্রুতই অফিসের সামনে এসে থামল। অফিসের জন্য রিকশা নিলেও প্রায় হাটা দুরত্বেই বলা যায়। তাহলে কি শেলী তার শরীরের একটু ছোঁয়া পাওয়ার জন্য রিকশার এই ছলনাটুকু করল?
জাপানী প্রতিষ্ঠানের বেশ ঝা চকচকে অফিস। বাইরের নেমপ্লেটে বাংলা ইংরেজীর পাশাপাশি জাপানি হরফেও কিছু একটা লেখা আছে, সম্ভবত প্রতিষ্ঠানের নাম। তবে বাইরের ওই নামটুকু জাপানি থাকলেও ভেতরে সব বাংলাদেশী। রিসপশনে বসা রিসিপশনিষ্ট থেকে শুরু করে শেলীর সেই কর্মকর্তা বাদল ভাই পর্যন্ত।
শেলীর ফোনে শেলীর সেই বাদল ভাই কোন একটা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বাদল ভাইকে দেখে সামিউল একটু হতাশই হলো। প্রায় আফ্রিকার নিগ্রোদের মতো কালো, শুধু তাই নয় মাথায় একটা চুলও নেই, মাথা ভুরু টুরু সবই কামানো ক্লিন শেভড, সাইজেও ছোটখাট একটা হাতির মতো, ঘাড়ে গর্দানে এক সা। সাদা শার্টের উপর কটকটে হলদে রঙের টাইতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এই লোকের সাথে শেলী বিছানায় যেতে পারে কল্পনাও করতেই কেমন যেন হাসি পেল সামিউলের। অবশ্য কল্পনার চেয়ে অনেক অসম্ভব ঘটনা বাস্তবে ঘটে।
শেলীকে দেখে বাদল ভাই এক প্রকার হই হই করে উঠল। তাদের দুজনকে নিয়ে কাচ ঘেরা ছোট্ট গোল টেবিলের দুপাশে তিন চেয়ার রাখা মিটিং রুমে নিয়ে গেল। শেলী না না করলেও বাদল ভাই অন্যরকম হাসি দিয়ে বলল, ‘তুমি আমার অফিসে এসে শুধু মুখে ফিরে যাবে তা তো হয় না। এক কাপ কফি তো তোমাকে খেতেই হবে।’ ওদের দুজনের জন্য দুকাপ কফির অর্ডার দিয়ে বাদল ভাই বলল, ‘ইন্টারভিউয়ের মেম্বার হিসাবে আমিও থাকব। কাজেই এখানে বেশিক্ষণ বসে চাকরি প্রার্থীর সাথে কথা বলতে পারব না।’
‘বাদল ভাই, আপনাকে তো আগেই বলেছি। আপনি শুধু ওর দিকে খেয়াল রাখবেন, আর কিছু করা লাগবে না। আর শোনেন, আপনার কফি শেষ হলেই আমি বের হব। এখান থেকে সোজা অফিসে যেতে হবে। আপনি দয়া করে ওকে একটু ব্রিফিং দিয়ে দিয়েন।’
গ্লাস ভর্তি পানি, কফি আর টিসু পেপার চলে এলো। বাদল ভাই বললেন, ‘নেন, কফি নেন। আমাদের প্রতিষ্ঠান সমন্ধে আপনি কতটুকু জানেন আমি জানি না। আমি একটু জানিয়ে রাখলে ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনার জন্য সুবিধেই হবে। তার আগে বলে রাখি, শেলীর পাঠানো আপনার গল্পটা আমি পড়েছি। গল্প উপন্যাস কখনও সেভাবে পড়া হয় না, আসলে পড়ার সময়ই পাইনি। তবে অনেকদিন পরে একটা লেখা পড়ে আমি গল্পের মা এবং ছেলের সম্পর্কটা ফিল করতে পেরেছি, এবং এটুকু বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি গল্প খুবই ভাল লেখেন। আর এই গল্প যখন আপনার জীবনের গল্প তখন এই চাকরির জন্য আপনাকে সুপারিশ করা যায়।’
নানান রকম ধোয়াশায় সামিউল ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হচ্ছিল। কেন জানি টাকলা এই লোকটাকে দেখার পর তার বিরক্তি আরো বেড়েছে, সেটা কি শেলীর আর বাদলের মধ্যের গদগদ ভাব দেখে? সামিউল বিরক্ত চেপে স্বাভাবিক গলায় বলতে চাইল, এখানে চাকরি পেলে আমার কাজটা কি হবে? সে গলার উঞ্চতা এড়াতে পারল না, ‘চাকরির ধরণটা কি একটু জানতে পারলে ভাল হতো।’
শেলী কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির ভাব ‘আহা’ করে একটা শব্দ করল, ‘আমি নিজেও ভাল জানি না, সেজন্যই তো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে নিয়ে আসলাম।’
বাদল ভাইয়ের ভেতর থেকে একটা কল এসেছে, সে মোবাইল কানে ধরেই ‘জাস্ট এ মিনিট’ বলে বেরিয়ে গেল।
এক মিনিটের কথা বললেও দুজনের কফি শেষ হয়ে গেলেও বাদল ভাইয়ের দেখা নেই। উসখুস করতে থাকা শেলী বলল, ‘আমার অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বের হতে হবে। তুমি বসো। ইন্টারভিউ শেষ হলে সোজা আমার অফিসের সামনে চলে এসো। তাই যখনই হোক, এক সাথে লাঞ্চ করব।’ শেলী উঠতে উঠতে বলল, ‘এসো কিন্তু, তোমার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা আছে।’
শেলী বের হতেই বাদল ভাই ঢুকল, মুখে হাসি ধরে রেখে চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘ব্যস্ততার শেষ নেই ভাই। চাকরি মানেই ব্যস্ততা। আপনাদের ইন্টারভিউয়ের আয়োজন ধরতে গেলে আমাকেই করতে হচ্ছে। আশা করছি, এগারোটা থেকেই শুরু করব। তার আগে কিরোশি কেয়ার সমন্ধে একটু জানিয়ে রাখি। প্রতিষ্ঠানটা জাপান-বাংলাদেশ ফ্রাঞ্জাইজি টাইপের, জাপানের মূল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করার চেষ্টা করছি। জাপানে প্রতিষ্ঠানের মূল অফিস হলেও আমরা সারা পৃথিবীতে এটা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এটাকে আপনি ইচ্ছে করলে জাপানি একটা কনসেপ্ট বলতে পারেন। কারোশি- জাপানি ভাষায় এ শব্দের অর্থ, ‘অতিরিক্তি কাজ করতে করতে মরে যাওয়া।’ এই সিন্ড্রোমে প্রতিবছর জাপানে ৭৫-১০০ জনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, জাপানে প্রতি বছর ৮৭৬০ ঘন্টা কাজ করতে হয়। কারোশি ভিকটিমদের তাদের মৃত্যুর আগের বছর অতিরিক্ত ৩০০০ ঘন্টা কাজ করতে হয়েছে। আগে এক সময় এই সমস্যা বলতে গেলে শুধুমাত্র জাপানেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন দ্রুতগতির পৃথিবীর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে উন্নত এবং উন্নতের কাতারে থাকা দেশগুলোও এখন কারোশি সিনড্রোমে ভুগছে। তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাইলেজেশনের কারণে এখন মানুষের হাতে সময় খুবই কম। ভারত বাংলাদেশেও এই সমস্যা কম নয়। আর এখনকার প্রজন্মের এই সীমাহীন ব্যস্ততার কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েন বৃদ্ধ বাবা মা। সন্তানরা এখন আর বাবা মায়ের সাথে থাকেই তো না, গ্রামের বাড়িতে বা যেখানেই থাকুক বৃদ্ধ বাবা-মাকে চোখের দেখা দেখতে যাওয়ার, একটু কথা বলার, সঙ্গ দেওয়ার সময় পর্যন্ত তারা পায় না। আর বয়স্ক সন্তানের পিতা মাতাকে সঙ্গ দেওয়ার কাজটাই করে আমাদের কারোশি কেয়ার। বৃদ্ধ বাবা-মাকে সন্তানের হয়ে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমরা এখান থেকে সেই বাবা-মায়ের বাড়িতে আমাদের কর্মী পাঠিয়ে দেই, সেই কর্মী বা আমাদের ভাষায় স্বেচ্ছাসেবক ছেলে বা মেয়ের হয়ে বাবা-মাকে সঙ্গ দেয়, এই সঙ্গদানের জন্য সন্তানেরা আমাদের একটা পেমেন্ট করে। ব্যাপারটা কি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি?’
সামিউল উপর নিচ মাথা নাড়ল, চিন্তিত স্বরে বলল, ‘একজন বাবা মা আপনাদের এই কর্মীদের কেন তাদের সন্তানের মতো করে মেনে নেবে?’
‘সন্তানের মতো করে তো মানবে না। নিসঙ্গ অবস্থায় সন্তানের মতো একজন সঙ্গী পাবে যে বাবা মাকে একটু সঙ্গ দিয়ে নিসঙ্গতা ভরিয়ে দেবে।’
ব্যাপারটা তাও যেন সামিউলের মনোপুত হলো না, সে দ্বিধান্তিত স্বরে বলল, ‘আমার মা হলে তো কখনই মানতো না। আমাদের দেশে কি এরকম কোন ক্লায়েন্ট এখনও পাওয়া গেছে?’
বাদল ভাই হেসে ফেলল, ‘ক্লায়েন্ট পাওয়া গেছে মানে? আমরা কর্মী সাপ্লাই দিয়ে সারতে পারছি না। চাহিদা বেড়ে যাওয়য় ঢাকাতেই হয়তো আরেকটা শাখা অফিস খুলতে হবে। তাছাড়া এরই মধ্যে আমরা বড় বড় বিভাগীয় শহরগুলোতে বিশেষত সিলেট আর চট্রগ্রামে ব্রাঞ্চ বাড়ানোর কাজ চলছে, এই দুই অঞ্চলের মানুষ বিদেশে বেশি থাকে চাহিদাও বেশি। কর্মী হিসাবে শুধু আপনাদের মতো ছেলেরাই নয় কয়েকজন মেয়েও আছে আমাদের অফিসে। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম একা থাকা বৃদ্ধা মায়েদের জন্য মেয়ে কর্মীই হয়তো ভাল সঙ্গ দিতে পারবে না। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে বৃদ্ধা মহিলারা ছেলেদেরকেই পেতে চায়, হয়তো নিজ ছেলে সন্তানের মতো মনে করে বলে। তবে বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে…’ বাদল ভাইয়ের ফোন আবার বেজে উঠল, বাদল ভাই ফোন রিসিভ করে কানে ধরে রেখেই বলল, ‘আপনি এখানেই ওয়েট করেন, সময়মতো ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হবে।
সালারি টালারি এবং কাজের ধরণ অফিস টাইম ছুটি টুটি নিয়ে সামিউলের নিজস্ব কিছু ইনকোয়ারি ছিল, কিন্তু তার আগেই বাদল ভাই বেরিয়ে গেল। সামিউলেরও ইচ্ছে করছিল বাদল ভাইয়ের পিছু পিছু শুধু মিটিং রুম থেকেই নয়, এই ভবন থেকেই বেরিয়ে যায়। এই রকম উদ্ভট চাকরি তার পক্ষে করা সম্ভব নয়!

বিজ্ঞাপন

ওভাল শেপের টেবিলের এক ধারে বসে আছে সামিউল। সাধারণত যেরকম ভাব গম্ভীর ইন্টারভিউয়ের পরিবেশ হবে ভেবে ছিল দেখল ব্যাপারটা তার ঠিক উল্টো। হয়তো এটাই জাপানি কেতায় ইন্টারভিউ। কারণ কেউ ফর্মালি তেমন কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করল না। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ইয়ারদোস্তদের সাথে কথা বলার ভঙ্গিতেও কথাবার্তা চলতে লাগল বাদলের সাথে। ছয় সাত জনের একটা দল ইন্টারভিউ বোর্ডে, কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট নয়, এই উঠছে কথা বলছে, চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আবার আরেকজন এসে সেই চেয়ারে বসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামিউলের মধ্যে ইন্টারভিউ সংক্রান্ত জড়তা কেটে গেল, সেও স্বাচ্ছন্দ্যে ওদের কথার উত্তর দিতে লাগল। আর সেগুলো কোন প্রশ্ন ছিল না, ছিল আলোচনা।
‘আপনার সিভিতে কি লেখা আছে টাছে কি ডিগ্রীটিগ্রী সব ভুলে যান, শুধু আপনি একজন মানুষ হিসাবে মানুষের কাছে যাবেন এটাই মনে রাখবেন, আর কিছু নয়।’ সম্ভবত চল্লিশোর্ধ এই লোকটাই ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রধান. তবে এখানে কে যে প্রধান বোঝা মুশকিল।
সামিউলও সরলভাবেই বলল, ‘সিভির ব্যাপারটা কখনই আমার মাথায় ছিল না, শুধু ফর্মালিটিজির জন্যই পাঠিয়েছিলাম। আসলে আমি এখনও পর্যন্ত কোথাও কোন চাকুরি করিনি। পড়াশুনার মধ্যেই মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, কোনমতে পড়াশুনাটা শেষ করতে পারলেও চাকরি খোঁজার মতো সময় পাইনি, মায়ের শ্রশুষাতেই বয়স পার হয়ে গেচে।’
‘আপনাকে নিয়ে আমাদের আগ্রহের কারণও কিন্তু এটাই। অনেক সিভিই আমাদের কাছে আসে। সবাই কোথাও না কোথাও স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে, কোন বয়স্কদের প্রতিষ্ঠানে, কোন হাসপাতালে, কোন কেয়ার হাউজে, প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানে চাকরির অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি লিখে থাকে। একমাত্র আপনার সিভিতেই দেখলাম ওসবের কোন অভিজ্ঞতা নেই। শুধু একটাই অভিজ্ঞতাই আপনার। আপন অসুস্থ মাকে বারো বছর ধরে একটানা সেবা শ্রুশষা করার অভিজ্ঞতা। এখনকার এই যুগে পৃথিবীতে এর চেয়ে বড়ো অভিজ্ঞতা আর হয় না। পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের মতো আমাদের নিজস্ব কিছু ভ্যারিফিকশনের ব্যাপারস্যাপার থাকে। একজন ধনাঢ্য বয়স্ক মানুষের বাড়িতে আপনাদের পাঠাবো, একটু ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে হয়, সিকিউরিটির কিছু ব্যাপার স্যাপার থাকে তো! আপনার সিভি পাওয়ার পরে আমরা সেই ভ্যারিফিকশনের জন্য আপনার গ্রামে খোঁজখবর নিয়েছিলাম। এবং ওখান থেকে যে ফিডব্যাক আমরা পাই তাতে আমরা অভিভ’ত। আপনার গ্রামে আপনাকে তো দেবতাতুল্য মানুষ হিসাবেই মানা হয়, কবি হিসাবে সবাই খুব মান্য করে। আপনি ঢাকা শহরে এসে চাকরির খোঁজ না করে গ্রামে ইলেকশনে দাড়ালে এক চ্যান্সে পাশ করে যাবেন, এরকমই আপনার জনপ্রিয়তা।’ তিনি কথা শেষ করে অন্যদের দিকে তাকালেন। সবাই প্রশান্ত মুখে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
বাদল ভাই বাইরে গিয়েছিল, ভেতরে ঢুকে খালি চেয়ার দেখে বসে বলল, ‘এখনও বিয়েশাদি করেননি তাই না?’
সামিউল লজ্জিত হেসে বলল, ‘মায়ের জন্য সময় সুযোগ হয়নি। তারপর তো…’ মায়ের প্রসঙ্গটা ইচ্ছে করেই তুলল। এখানে ওই ব্যাপারটাকেই বড়ো করে দেখা হচ্ছে। এদের হাবভাবে মনে হচ্ছে তার চাকরিটা হয়েই যাবে, না হলে আর কষ্ট করে তার গ্রামের মানুষের কাছে খোঁজ নেওয়া কেন?
বোর্ডের আরেকজন মেম্বার বললেন, ‘আমাদের আলোচনা শুনে তো বুঝতেই পারছেন এখানকার চাকরির ধরণটাই অন্যরকম। অন্য অফিসের গৎবাধা নটা-পাচটা চাকরির মতো নয়। এইটাকে আসলে চাকরি ভাবলেই তখন মাথায় প্যারাটা অনেক বেশি থাকবে। আমরা এটাকে চাকরি বলি না, সেবাদান বলি, আর তাই এখানকার কর্মীরা একেকজনক স্বেচ্ছাসেবক। আর স্বেচ্ছাসেবার কোন টাইম টেবিল থাকে না। তারপরও আমরা একটা অফিস ডেকোরাম মেইনটেইন করার চেষ্টা করি। যাতে অন্তত সপ্তাহে একদিন ছুটি আর আট ঘন্টার বেশি ডিউটি না করতে হয়। তবে সবই নির্ভর করে পরস্পরের সম্পর্ক ও সমঝোতা ও সহযোগিতার উপর। আমাদের একজন স্বে”চ্ছাসেবক রাকিব তো এক ক্লায়েন্টের বাসায় বলতে গেলে চব্বিশ ঘন্টাই ডিউটি পালন করছে, সে ওখানেই এক রুমে থাকে খায় ঘুমায়, বৃদ্ধ তাকে ছেলের মতোই দেখে, বৃদ্ধের সন্তান আমাদের টাকা দেয় আর বৃদ্ধ নিজের গচ্ছিত টাকা থেকে রাকিবকে খুশি রাখে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।
সামিউল ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘সাধারণত একজন স্বেচ্ছাসেবীকে এক সাথে কতজন ক্লায়েন্টের
সাথে ডিল করতে হয়?’
‘ওর কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই।’ অন্য আরেক সদস্য বলল, ‘ক্লায়েন্টের সন্তানরা যদি বেশি পে করে সেক্ষেত্রে ওয়ান ইজটু ওয়ানও থাকে। আর কম পেয়ীদের ক্ষেত্রে দুই তিনজনও গড়াতে পারে। সবকিছুই নির্ভর করে ক্লায়েন্ট পার্টির উপর, স্বেচ্ছাসেবীর পারফর্মের উপর আর চাহিদার উপর। এ ব্যাপারে শুরুতেই আমরা ছোট্ট একটা তিনদিনের ক্রাশ কোর্স করাই। মাদার প্রতিষ্ঠান জাপানি বলেই জাপানি কিছু নিয়মকানুন এখানে কাগজকলমে দেওয়া আছে কিন্তু আমাদের দেশে আমরা নিজেদের মতো করেই ম্যানেজ করে নেই। আপাতত আমাদের প্রথম মটো হচ্ছে কোন ক্লায়েন্টকেই না ফেরানো তাই সে যত কম পেই করুক না, মূল জাপানি প্রতিষ্ঠান আমাদের কিছু ভতুর্কি দিয়ে থাকে যে কারণে স্বে”চ্ছাসেবীদের আমরা একটা হ্যান্ডস্যাম সালারি দিতে পারি।’
সালারির ব্যাপারটা সর্বক্ষণ মাথায় কাটার মতো খচখচ করছিল, হ্যান্ডস্যাম সালারি বলতে কতো, সেটা কি জীবন যাত্রার উপর নির্ভর করে? কারোর জীবনযাত্রায় দশ হাজার টাকাও হ্যান্ডসাম সালারি কারোর লাখেও হ্যান্ডসাম হয় না।
ইন্টারভিউ শেষ হতেই সালারির অংকটা জানতে পারল সামিউল, হ্যান্ডসাম সালারি তার জন্যই হ্যান্ডসামই। শুরুতেই টুয়েন্টটি প্লাস সালারি টাকা তার জন্য কম কথা নয়। সে এপয়নমেন্ট লেটার হাতে নিয়ে বাদল ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি করল। এখন আর ভুড়িওয়ালা টাকমাথার লোকটাকে তার খারাপ লাগছিল না। কারণ এই লোকটাই তার চাকরি প্রাপ্তি ক্ষেত্রের সব কলকাঠি নেড়েছে, তবে সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ প্রাপ্য শেলীর। এখন আর ফোনে শেলীকে জানাবে না। গিয়ে দেখা করেই জানাবে। আর শেলীর জরুরী কথাটা কি জেনে নেবে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে, ডিভোর্সী শেলী হয়তো তার সাথে পুরানো সম্পর্কটা আবার জোড়া লাগাতে চায়। সেটাই শেলীর জরুরী কথা!
বাদল ভাই শুধু কোলাকুলিতেই শেষ করল না। তার হাত ধরে রেখে তার সাথে লিফট দিয়ে নিচে নেমে এলো। তারপর ঠিক বিদায় দেওয়ার আগ মুহুর্তে হাত ধরে রেখেই বলল, ‘আমার সাধ্যমত আপনার জন্য চেষ্টা করেছি। চাকরির এই দুমুল্যের বাজারে এপয়নমেন্ট লেটার হাতে ধরিয়ে দিতে পেরেছি। চেষ্টা করেছি শুধু শেলী অনুরোধ করেছিল বলেই। শেলী যে আমার কাছে আমার জীবনে কি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। আপনারা একই এলাকার মানুষ, বন্ধু ক্লাসফ্রেন্ড, শেলীর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে আপনার জন্য কিছু করতে পারলে ওর খুব ভাল লাগবে। ওর ভাল লাগাই আমার ভাল লাগা। আমি কি বলতে চেয়েছি বুঝতে পেরেছেন। আমার কেন জানি মনে হয়েছে শেলী আপনাকে খুব পছন্দ করে, আপনার কথা শুনবে। আপনি বললে সে কথাটা ফেলবে না। ঘটনাচক্রে আমার একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার আগেই সেই বউ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আমাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপর অনেকদিন আর বিয়েশাদির নাম মুখে আনিনি। কিন্তু শেলীর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে আর যদি কখনও বিয়ের পিড়িতে বসি তাহলে শেলীর সাথেই বসব। ওর স্বামীর সাথে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, আমরা দুজনেই সিঙ্গেল আছি। একা থেকে যদি দোকা হয়ে যাই তাহলে কারোর তো ক্ষতি হচ্ছে না। শেলী শুধু ওর মেয়েকে নিয়েই দুশ্চিন্তা করে। আপনি ওকে বলে দেবেন, ওর মেয়েকে আমি আমার নিজের মেয়ের মতোই দেখব। নিজের মেয়ের মতো এতো ভালবাসা যা ওর বাবাও ওকে দিতে পারিনি। আপনি আমার এই উপকারটুকু করেন। বড়ভাই হয়ে ছোটভাইয়ের কাছে এই আবদারটুকু করছি। শেলীর আর আমার মধ্যে আপনি একটু ঘটকের ভ’মিকা নেন। এই অফিসে আপনি যাতে রাজার হালে থাকতে পারেন সেই দায়িত্ব আমার। আপনি শুধু আমার দিকটা একটু দেখবেন!’

চলবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই

আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (চতুর্থ পর্ব) ঈদুল ফিতর ২০২৪ উপন্যাস প্রিন্স আশরাফ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর