‘পুরানো সেই দিনের কথা’
১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৩৬
ছোটবেলায় খুব মনে হতো, উকিল হব। যুক্তিতর্ক দিয়ে ফাটিয়ে দেবো। সব মামলাতেই আমি জিতব। প্রতিদিন পকেট ভরে টাকা কামাই করব।
একটু বড় হবার পর মনে হলো— ধুর, কীসের উকিল, কীসের ওকালতি! আমি পুলিশ হব। চোর-বাটপার ধরব। মানুষরে ভয় দেখাব। মেলা টাকা কামাই হবে। আসলে ওই সময় টাকাটাই আমার কাছে মুখ্য ছিল। আর সবকিছু ছিল গৌণ।
বয়স বাড়লো, খানিকটা হয়তো বুদ্ধি-শুদ্ধিও। আস্তে আস্তে বুঝে গেলাম, জীবনে টাকাটাই সব নয়। স্বাধীনতাটাই হচ্ছে আসল কথা। একটা বাউন্ডুলে ব্যাপার-স্যাপার না থাকলে কিসের জীবন। কীসের কী?
স্বপ্ন দেখতাম, নিজের একটা মোটরসাইকেল থাকবে। সারাদিন সেটায় চড়ে ঘুরে বেড়াব দেশের এ মাথা থেকে সে মাথা। সে আশা অবশ্য আমার পরে পূরণ হয়েছে। মোটরসাইকেলে না হলেও সারা দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানোর দুর্লভ সুযোগ হয়েছে।
আমার চরিত্রের মধ্যে যাযাবর একটা ব্যাপার সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল, আছে। বেশিদিন ঘরে মন টেকে না। আবার ঘরের বাইরে বেশিদিন থাকতে পারি না। তাহলে আবার ঘরের জন্য, ঘরের মানুষদের জন্য মন পোড়ে। কী আজব সাইকোলজি! তারপরও কয়দিন পর পর বাইরে বেরিয়ে পড়লেই যেন জীবনের ফুয়েল সংগ্রহ হয়। পূর্ণোদ্যমে পরবর্তী দিনগুলো পার করতে পারি।
বাবার সঙ্গে কখনো সখ্য গড়ে ওঠেনি। যা কিছু ছিল, সবই মায়ের সঙ্গে। চাওয়া- পাওয়া, আদর-ভালোবাসা, অভিমান-শাসন সব। বাবার ইচ্ছা ছিল, তার মতো প্রজাতন্ত্রের চাকর হই। অল্প পয়সার এই কষ্টের জীবনে বাবা যে কী মজা পেয়েছেন, জানি না! মা চেয়েছিলেন, আমাদের ছয় ভাই-বোনের কেউ একজন অন্তত ডাক্তার হোক। মায়ের সে চাওয়াটাও পূরণ করতে পারিনি আমরা কেউ।
সারাটা জীবন আমাদের আট জনের সংসারে কত অভাব আর অনটন দেখেছি। পয়সার অভাবে কোনোদিন প্রাইভেট মাস্টার রেখে পড়া হয়নি আমাদের ছয় ভাই-বোনের। তিন রুমের সরকারি বাসায় আমাদের ছিল দুইটা পড়ার টেবিল। চেয়ার ছিল মোটে চারখান। সেই চেয়ার আর খাটে বসে আমরা পড়াশোনা করতাম।
পড়ালেখার সময় সেকালে শব্দ করে পড়ার প্রচলন ছিল। একজনের পড়ার শব্দে অন্যজনের বিস্তর অসুবিধা হতো। অথচ কিছুই করার ছিল না আমাদের। আলাদা রুম বা টেবিলে পড়ার অবস্থা বা সামর্থ্য ছিল না। সাধ আর সাধ্যের মাঝে ছিল বিস্তর ফাঁরাক।
আমি বেশ ছোটবেলাতেই মানে স্কুলজীবনেই পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করি। সেটা বড় ভাইকে দেখে। বিভিন্ন পত্রিকায় নিজের নামে লেখা ছাপা হওয়ার পর একসময় মনে হলো সাংবাদিক হব। সাংবাদিকরা অনেক ক্ষমতাধর, সমাজের সব পেশার মানুষ তাদের সমঝে চলে! এমনকি যে পুলিশকে সাধারণ মানুষ ভয় পায়, এড়িয়ে চলে, সে পুলিশও তাদের হিসাব করে, ভয় পায়।
বড় ভাই মাহবুব কিসলু। তাকে দেখে, তার কথা শুনে, তার কাছে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা শিখেছি। একসময় মনে হলো, টেলিভিশনে খবর পড়ব। সে উদ্দেশ্যে উচ্চারণ আর কণ্ঠশীলনের ওপর কোর্সও করেছিলাম। কী কপাল, চেহারা-সুরত ভালো না হওয়ায় সাহসের অভাবে ক্যামেরার সামনে কোনোদিন খবর আর পড়া হয়নি! সব গুড়ে বালি।
লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে জীবনের প্রথম চাকরি নিলাম সেলসে। সে পেশায় মেলা দিন কাটিয়ে দিলাম। ১৩-১৪ বছর কম সময় না। তবে খুব বেশিদিন এক কোম্পানিতে থাকা আমার ধাতে ছিল না। চরম অস্থিরতা, স্পষ্ট কথা বলা, বসদের তেল না মারাসহ নানাবিধ কারণে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে তিন-চারটা কোম্পানি বদল করলাম।
সেলসে কাজ করার সময় কোম্পানি থেকে পাওয়া মোটরসাইকেল ছিল আমার। সেটা নিয়ে প্রায়ই এ জেলা, সে জেলায় যেতাম। যতটা কোম্পানির কাজে, তার চেয়ে বেশি অকাজে, মানে ঘুরতে। হাইওয়েতে তখন মোটরসাইকেল চালাতাম। তখন একটা ইচ্ছা মাথার মধ্যে কিটকিট করে কামড়াত— চলন্ত কোনো ট্রাকের সঙ্গে সামনাসামনি মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ লাগিয়ে দেখা, কী হয়!
মন থেকে কেউ কিছু চাইলে না কি সেটা পূরণ হয়! আমারও সে আশা পূরণ হয়েছিল, সেটা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক। একবার ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে দাউদকান্দি ব্রিজের ওপর ট্রাকের সঙ্গে আমার মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তারপর? ‘তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা…’! মাসখানেক হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে বিছানায় শুয়েছিলাম। এটা বিবাহের অল্প দিন পরের ঘটনা। ঘরে তখন নতুন বউ…!
বিভিন্ন পারিবারিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময়, মানে পরিবারের কারও বিয়ে বা ঈদের সময় মনে হতো, সব খরচ আমি একাই করব। পরিবারের অন্য কাউকে করতে দেবো না। দু-চারবার করেছিলামও। এতে যে কী পরিমাণ আত্মতৃপ্তি পেতাম, আহা! বন্ধুরা মিলে খাব, বিলটা কিন্তু আমিই দেবো। স্রেফ মানসিক তৃপ্তির জন্যই এসব করতাম। আবার আমার কাছে টাকা নাই, সেটাও বলে দিতাম। এ রকম ছোটখাটো অনেক ইচ্ছাই আমার পূরণ হয়েছে জীবনে। সত্যি বলতে কী, পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা আমার কাছে কোনো কালেই ছিল না। আজকাল মনে হয়, একটু বৈষয়িক হলে বা কিছু টাকা-পয়সা থাকলে মন্দ হতো না। তেমন আর হলো কই!
তারপরও পরিবারের, চারপাশের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই আমি। কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। যদিও কম্বল আমায় ছাড়ে না। না চাইলেও ঝামেলা নিত্য সহচর। কিছু টাকা-পয়সা হাতে এলেই ঘুরতে মন চায়। যদিও সবসময় তা পারি না। সংসার আমায় পিছু টেনে ধরে। তারপরও আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করি, সংসারের মানুষগুলো আমাকে ছাড় না দিলে আমার জীবনের অনেক ইচ্ছাই পূরণ হতো না। বিশেষ করে দেশ-বিদেশে, কারণে বা অকারণে ঘোরাঘুরিটা। তাদের সেসব আস্কারার কথা ভুলি কী করে!
এত কিছুর পরও নিজেকে কখনো দায়িত্বহীন মানুষ মনে হয়নি। সেটা পিতা হিসেবে হোক বা স্বামী হিসেবে। দায়িত্বের শতভাগ হয়তো পালন করতে পারিনি, তবে অনেকটাই পালন করেছি জীবনে। চেনা অনেকের চেয়েও বেশি দায়িত্ববান হিসেবে নিজেকে দাবি করি আমি। বাবার সঙ্গে আমার যে সম্পর্কের দূরত্ব ছিল, বাবা হিসাবে আমার সন্তানদের সঙ্গে সে দূরত্ব হোক, এটা চাই না। তাই সাধ্যমতো তাদের সব আবদার বা প্রয়োজন পূরণ করার চেষ্টা করি।
বন্ধুত্বকে আমি বেশ বড় করে দেখি। আমার বন্ধুদের আমি ভালোবাসি, সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। ওদের যেকোনো সমস্যায় ছুটে যাই। ওদের পাশে দাঁড়াই। সেটা সকাল, দুপুর বা মধ্যরাত যখনই হোক। আমি আমাকে ঈর্ষা করি। আমার এত্ত এত্ত বন্ধু। জীবনে কতজন মানুষের এমন বন্ধুভাগ্য হয়, জানি না! আমার খারাপ সময়ে বন্ধুরাও আমার পাশে দাঁড়ায়। কিছুই বলে না ওরা। পাশে এসে দাঁড়ালে ওদের উপস্থিতিই আমার জন্য অনেক কিছু বয়ে আনে। এই জীবনে আমি আর তেমন কিছু চাই না আসলে।
বাকি জীবনে যদি ভুল করে আমার হাতে অনেক টাকা এসে পড়ে, তবে সে টাকা, ব্যাকপ্যাক আর পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। একটা একটা দেশ ঘুরব। বিশেষ করে ইউরোপের সবকটি দেশে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। হয়তো এ আশা কোনোদিন পূরণ হবে না। তাতেও কোনো আক্ষেপ নেই। জীবনের সব আশা পূর্ণ হতে নেই। তাহলে জীবনে আর কোনো আনন্দ থাকে না।
আমাদের একটাই তো জীবন। সেটাও অনেক ছোট। এই ছোট জীবনের যেখানে যা পাই, তা থেকে আনন্দগুলো নিতে ভুলি না। দুঃখটা থাক না দূরে, অন্য কোথাও! নিজেকে সুখি ভাবতে পারে কজন মানুষ! আসুন নিজেকে সুখি ভাবি। সুখ তো জটিল কোনো বস্তু নয়। অল্প পাওয়াতে তুষ্ট থাকাই সুখ। সবকিছু থেকে আনন্দ নিংড়ে নেওয়াই সুখ। সুখ আপনার-আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে সবসময়। তাকে দেখতে হয়। বুঝতে হয়। নিজের করে নিতে হয়। তাহলেই কেবল আপনি-আমি-আমরা সুখি হবো। আমাদের সঙ্গী হবে রাষ্ট্র, পৃথিবী।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/টিআর/এসবিডিই
‘পুরানো সেই দিনের কথা’ আত্মকথা ঈদুল ফিতর ২০২৪ মুক্তগদ্য মেসবাহ য়াযাদ