ক্রাইম রিপোর্টারের দুঃখ-সুখ
১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৫৭
২৭ মার্চ ২০২৩; ঘুমের মধ্যে টের পাচ্ছিলাম বাঁ পায়ের হাঁটুতে একটু একটু ব্যথা হয়তো। ঘুম ভাঙ্গার পর বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে বুঝলাম অবস্থা সুবিধার নয়। মনের মধ্যে উঁকি দিলো- বয়স কি তাড়া করছে? ফ্রেশ হওয়ার পর মোবাইল অনলাইন করতেই একজন শ্রদ্ধেয় সহকর্মীর ক্ষুদে বার্তা ভেসে উঠল। তিনি জানালেন আরেকজন সহকর্মী চরম বিপদে পড়েছেন। আমি যেন তার ফোন ধরি, তাকে সহযোগিতা করি। কিছুক্ষণ পর সেই সহকর্মীর ফোন আসলো। ও প্রান্ত থেকে শুরু হলো দীর্ঘ পারিবারিক বিরোধের হৃদয় ফুটো করা ইতিহাস।
সবিনয়ে জানতে চাইলাম- আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন? তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন। জানালেন তার ছোটভাই রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন। তার শরীরে বিষক্রিয়ার লক্ষ্মণ পাওয়া গেছে। পরে আস্তে করে বললেন, তার ভাই মাদকাসক্ত ছিলেন। পারিবারিক অশান্তি থেকে তারা আলাদা ছিলেন। ছোট ভাইয়ের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বড় ভাই এবং অভিভাবক হিসেবে আমার এই সহকর্মীকে ফোন দিয়েছে পুলিশ। এখন তিনি কি করবেন, পুলিশকে কি বলবেন, তার যাওয়া উচিত কি না এসব বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কথা বলে আমার সহকর্মীকে অভয় দিয়ে হাসপাতালে ছোট ভাইয়ের লাশের কাছে পাঠালাম। এরপর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ, ম্যাসেজ আদানপ্রদান।
সহকর্মীর বিপদে নিজের পায়ের ব্যথার কথা ভুলে গেলাম। ঈদ ঘনিয়ে আসছে, পায়ে ব্যথার কারণে মেয়ে আর তার মাকে পাঠালাম কাপড়ের দোকানে। ছেলে আর আমি বাসায় থাকলাম। সন্ধ্যা নাগাদ আমার ভাইহারা সেই সহকর্মীর আবার আবদার- ময়না তদন্ত ছাড়া ভাইয়ের লাশ চান তিনি। আবার যোগাযোগ করলাম পুলিশে। আরেকটু উপরে, তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনারকেও রাজি করালাম। ধন্যবাদের শেষ নেই আমার সহকর্মীর। লিখলাম ধন্যবাদ জানাতে হবে না, শোক পালন করুন আর ভাইকে শেষ বিদায়ের কাজে মনোযোগ দিন।
একটু পর আবারও আমার সেই সহকর্মীর ম্যাসেজ, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তার ভাইয়ের সন্ধানে কয়েকদিন আগে খুলনায় তাকে জড়িয়ে জিডি করেছে ছোট ভাইয়ের এক বন্ধু। লাশ হস্তান্তরের ঠিক আগমুহূর্তে এমন তথ্য এসেছে পুলিশের কাছে। এখন আর বিনা ময়নাতদন্তে লাশ দিতে চাইছে না। কি বলবো বুঝতে পারছি না। কতক্ষণ চুপ করে থাকলাম। আমার সহকর্মী কথা বলেই যাচ্ছেন। তিনি একচোখে দেখতে পান না। তার ব্রেনে সমস্যা। মা প্যারালাইজড হাসপাতালে ভর্তি, একটা সন্তান বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। নীরবতা ভেঙে এবার বললাম মর্গে থাকুন। দেখছি কি করা যায়। আবারও পুলিশের সাথে কথা বললাম। কিছুক্ষণ পর আবারও আমার সেই সহকর্মীর ম্যাসেজ- অসংখ্য ধন্যবাদ! মনে মনে বিড় বিড় করে বললাম- এই ধন্যবাদই যেনো শেষ ধন্যবাদ হয়।
কারণ করোনার সময় আমার এই সহকর্মী আমাকে যে পরিমাণ সুখ দিয়েছেন, করোনা আক্রান্ত হয়েও হয়তো এতো দুখ পাইনি। আমার এই সহকর্মী যে বাসায় থাকেন তার পাশেই নাকি নতুন ভবন হচ্ছে। রাত বিরাতে বিকট শব্দে আমার সহকর্মীর অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। তিনি, তার সন্তান ও বৃদ্ধ মা ঘুমাতে পারেন না। পুলিশকে জানালাম, চক্ষুলজ্জায় হলেও তারা গেল। ভবন মালিককে শাসানোর পর কয়েকদিন সকাল সন্ধ্যা কাজ করিয়েছে। রাতে বন্ধ রেখেছে। ভাবলাম এবার বুঝি মুক্তি। কিন্তু না, আমার ভুল ভাংল ওই সহকর্মীর ফোনে, নতুন ভবনের কর্মীরা যখনই শব্দ করে কাজ শুরু করে তখনই আমার ওই সহকর্মী আমাকে ফোন দেয়। বলে এ কেমন অসভ্যতা, মানুষের কোনও সিভিক সেন্স নাই। এতো বিকট শব্দে বাঁচা যায় বলুন। আমি শান্তনা দেই। আশ্বাস দেই কিছু একটা করার। তবে আমি নিজেও জানি কিছুই করতে পারব না আসলে।
তবে আমার সহকর্মীর আচরন আর আবদারে মনে হচ্ছিলো বিল্ডিং আমি বানাচ্ছি। আমি শব্দ উৎপন্ন করে ওনাকে জ্বালাতন করছি। এভাবে চললো বছরখানেক। সময় যত যাচ্ছে তত শব্দদূষণের মাত্রা নাকি আরও বাড়ছে, কারণ নতুন ভবন উঁচু উঁচু হতে হতে আমার সহকর্মীর তলা পর্যন্ত চলে এসেছে। বিরক্ত হয়ে একদিন বললাম, এতোই যখন যন্ত্রণা ভোগ করছেন তো বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন না কেনো? এবার শব্দ দূষণের শাস্তি, নাগরিক অধিকার বিষয়ে গুটিকয়েক আইন পাঠালেন আমাকে। তারপর আমাকে ফোন দেয়, ম্যাসেজ দেয়, আমি আর ধরি না। এমন করতে করতে করোনা কাল পার হলো। এবার আমার ওই সহকর্মী আমাকে দেখলে আড়ালে আবডালে টিপ্পনী কাটেন। আমার খুব ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করেন। আমি ওনাকে দেখলে অস্বস্তি বোধ করি। তো ডে অফের দিন আমার শ্রদ্ধেয় সহকর্মীর পক্ষ থেকে এই সহকর্মীকে সহযোগিতার বার্তা পেয়ে ধরেই নিয়েছি আজকে আমার পুরো দিন ওনার।
ইফতারির পর যখন চা খাচ্ছি তখন ঢাকার বাইরের আমার এক সহকর্মীর ফোন। জানতে চাইলেন কুষ্টিয়ার সজীব নামের কাউকে চিনি কিনা। হঠাৎই আমার পরিচিত কাছাকাছি নামের একজনের কথা মনে পড়ল। বললাম নামে মনে হয় একটু তফাৎ আছে। তিনি জানালেন ওই লোক আমার রেফারেন্স দিয়ে অন্য একটি টিভি চ্যানেলে স্থানীয় এক সাংবাদিককে ফাঁফর মেরেছে। এক লোকের ভেজালের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে যাওয়ার পর আমার কথা বলছে। এসব শোনার পর আমার সহকর্মীকে বলেছি- কুষ্টিয়ার খলিসাকুন্ডির যাকে আমি চিনি তার সাথে আমার কোনও কথা হয়নি। সুতরাং নিউজ হওয়ার মতো আইটেম এবং অভিযোগ থাকলে অন্য চ্যানেলের ওই সহকর্মী যেন রিপোর্ট করে দেয়। একদিনে মাত্র এরকম দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম।
আমরা যারা ক্রাইম রিপোর্টার পেশাগত কারণে তাদের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সাথে পরিচয়-জানাশোনা হয়। তাই কেউ বিপদে পড়লে সবার আগে ক্রাইম রিপোর্টারের সহযোগিতা চায়। শুধু নিজের বিপদে হলেও না হয় সহযোগিতা করা যায়। কিন্তু এমনও মাঝে মধ্যে আবদার যা শুনে অবাক হয়। কেউ একজন প্রথমেই বলা শুরু করে তার খুব কাছের লোক বিপদে পড়েছে। পরে আলাপচারিতায় বের হয়ে আসে ওই কাছের লোকটি তার খালাতো ভাইয়ের বন্ধুর বন্ধু! নিজেতে সহযোগিতা নেবেই লতায়লেঙ্গুরে জড়িয়ে সহযোগিতা নিতে চায়। কোনও কারনে যদি সহযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারি তখনই শুরু হয় ফিসফাস।
একজন ক্রাইম রিপোর্টারকে চব্বিশ ঘণ্টা সতর্ক থাকতে হয়। ফায়ারম্যানের মতো। সবচেয়ে বাজে খবরটি আসে তার মাধ্যমেই। সবার ছুটি আছে, পরিবারিক সময় আছে। কিন্ত একজন ক্রাইম রিপোর্টারের এসব কিছু নেই। এমনকি ঈদ পূজাপার্বণেও তাকে খবর ফেরি করে ফিরতে হয়। ক্রাইম রিপোর্টিং হলো সাংবাদিকতার মূল। এখানে যেমন থাকে অপরাধের খবর, আইন আদালতের খবর তেমনি মানুষের আবেগ অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার মতো নরম খবরও থাকে অনেক। একজন ক্রাইম রিপোর্টারকে একসাথে দ্রুত খবর ছেড়ে দিতে হয়, আবার সেই খবরের সত্যতাও নিশ্চিত করতে হয় অতি দ্রুত। তাকে আইন জানতে হয়, জানাতে হয়। একজন ক্রাইম রিপোর্টার যেমন অপরাধীর আতংক, তার প্রতিবেদনের কারনে দুষ্টচক্র আইনের আওতায় আসে, তেমনি নিরপরাধ মানুষও অপবাদ থেকে মুক্তি পায়। তাকে যেমন চলতে হয় চোর বাটপার দাগী অপরাধীর সাথে তেমনি যোগাযোগ রাখতে হয় সমাজের অন্দরমহলেও। সাধুর সাথেও সৌজন্যতা দেখাতে হয়। সোর্স মেইনটেইন করতে হয় সময় দিয়ে; কৌশলে। এতকিছুর পরও উন থেকে চুন খসলে সবার আগে কালিমা যায় ক্রাইম রিপোর্টারের গায়ে। কারণ অপবাদ দেওয়া খুবই সহজ। একজন ক্রাইম রিপোর্টার যাকে সহযোগিতা করেছে সময় সুযোগ পেলে ওই ব্যক্তিও অপবাদ দিয়ে বসে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে কেউ কেউ বিশ্বাসও করে বসে। কারণ নামের সাথে ক্রাইম কথাটা লেপ্টে আছে যে!
ক্রাইম রিপোর্টিং করা আর ক্রাইম করা যে এক বিষয় নয় অনেক সময় একথাও ভুলে যায় আমাদের কোনও কোনও দুষ্ট সহকর্মী। তাদের দু’একজনের অপেশাদার আচরণের কারণে অল্পতেই দুষ্টচক্র এই কঠিন ঝুকিপূর্ণ পেশার সততা নিয়ে আঙ্গুল তুলতে সাহস পায়। তবে একজন ক্রাইম রিপোর্টারের সুখ হলো, যখন কেউ কাছে এসে বলে আপনার রিপোর্টের কারণে আমার আমাদের জীবন এখন শান্তিময় তখন। যখন নির্যাতিত মানুষের মুক্তির আনন্দে চোখে অশ্রু টলটল করে তখন একজন ক্রাইম রিপোর্টার মনের সুখে হাওয়ায় ভাসে।
লেখক: স্পেশাল করেসপনডেন্ট, এনটিভি
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর ২০২৪ ক্রাইম রিপোর্টারের দুঃখ-সুখ সফিক শাহীন সাংবাদিকতা