Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (সপ্তম পর্ব)


১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:১৮

অদ্ভুত প্রস্তাব

বৃদ্ধের অনুরোধেই বৃদ্ধের বিশাল বাড়ির একটা সুসজ্জিত গেষ্টরুম দখল করে কবিতা লিখতে শুরু করেছে সামিউল। বৃদ্ধ বলেছিলেন, সামিউলের মেসের ডেরা ছেড়ে দিতে। কিন্তু বৃদ্ধের এখানকার চাকরি চলে গেলে আবার মেস খুজতে যাওয়ার ঝামেলার কথা চিন্তা করে সামিউল মেসের বোর্ডার হিসাবে এখনও আছে। এমনকি মাঝে মধ্যে গিয়ে জহিরের সাথেও থেকে আসে। জহির অবশ্য টিটকারী দিতে ভোলে না, ‘বুড়ো শকুনের কোন বিবাহযুগ্যি মেয়েটেয়ে আছে নাকি? তোকে ঘরজামাই করে রাখার কারণ কি?’
সামিউল দুকাধ উচিয়ে বিদেশী কায়দায় শ্রাগ করে, ‘জানি না, নেই যতদূর জানি। ছেলেমেয়েরা সব বয়সী, বিবাহিত এবং প্রবাসি, এইটুকুই জানি।
‘তাহলে বুড়োর তোর এতো তোয়াজখাতির করার কারণ কি? কারোশি অফিস থেকে মাস শেষে বেতন পাচ্ছিস, বৃদ্ধ তোকে ওভারটাইম দিচ্ছে, আবার থাকা খাওয়া, এ যে দেখছি সোনার ডিম পাড়া হাস!’
‘সোনার ডিম পাড়া হাস কতদিন বাচে কে জানে!’ সামিউল তরল গলায় বলল, তারপর দ্বিধান্তিত স্বরে বলল, ‘কিন্তু বুড়ো একটা অদ্ভুত আবদার করেছে তার কি করব বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা শুধু অফিসিয়াল হলে সহজে এড়িয়ে যেতে পারতাম কিন্তু বৃড়োর বাড়িতে বসে অন্ন ধ্বংস করায় অন্নরিনে পড়ে গেছি। জগতের সবচেয়ে বড়ো রিন হলো অন্ন রিন।
‘কি আবদার খুলে বল তো?’
‘খুলে বলার কিছু নেই। ব্যাপারটা আমিও খোলাখুলি জানি না। বুড়ো আমাকে তার ছেলের মতোই ট্রিট করছে, আমারও কাজ তাকে বাবার মতো সেবা করা। সেটাই মেইনলি আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাজ। তার মধ্যে বুড়ো বন্ধ’ত্বের আবদা জুড়েছে, তাও না হয় মানলাম, কিন্তু এখন বলে তার সাথে জীবন বদলাবদলি করে নিতে।
‘মানে? বুড়োর জায়গায় বুড়োর বিছানায় তুই শুয়ে থাকবি আর বুড়ো তোর মতো ড্যাং ড্যাং করে সম্পাদকদের সাথে দেখা করে কবিতা ছাপবে?’
জহিরের কথা বলার ধরণে সামিউল হেসে ফেলল, ‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। তাছাড়া বৃদ্ধের যে কন্ডিশন তাতে সম্ভবও নয়। কামাক্ষিপ্রসাদ বাবুর গিন্নী গল্পের মতো অতিপ্রাকৃত ব্যাপারস্যাপার হলেও না হয় কথা ছিল, কিন্তু ঘাপলাটা হলো বুড়ো বলে কিনা এক জীবনে যেসব অপূর্ণতা রেখে গেছে সেগুলো মরার আগে পূর্ণ করেই মরতে চায় আর আমাকে বুড়োর হয়ে সেই ইচ্ছেপূরণ করতে হবে। আর তা রবি ঠাকুরের ইচ্ছেপূরণ গল্পের মতো নয়।’
‘গল্পটল্পের কথা রাখ। ব্যাপরটা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তোকে কি করতে হবে?’
‘আমিও এখনও ঠিক বুঝি না, তবে বুড়োর সাথে আরো দুএকটা কনভারসেশন হলে হয়তো বুঝে যাব। একটা উদাহরণ বুড়ো দিয়েছে তাতে কিছুটা হয়তো বুঝেছি, তুই শুনে দেখ তো, ব্যাপারটা ধরতে পারিস কিনা? বুড়ো বলেছে ছোট বেলায় বুড়োর খুব লাটিম খেলার শখ ছিল, কিন্তু সেভাবে পারতো না বলে বুড়োর সমবয়সীরা ওকে সেই খেলায় নিতো না, এখন বুড়োর ইচ্ছে বুড়োর সেই জন্মগ্রামে গিয়ে সহপাঠিদের মধ্যে যারা এখনও বেচে আছে তাদের ডেকে নিয়ে একত্রিত করে বুড়োর হয়ে আমাকে লাটিম খেলতে হবে, বুঝতে পারছিস?’
জহির হো হো করে হেসে উঠল যেন এরকম মজার কথা আর কখনও শোনেনি, ‘বুড়ো যে একটা পাগল একটু বুঝতে পারছি এবং তুই ভালই পাগলের পাল্লায় পড়েছিস। আমার পরামর্শ হলো পাগলের পাগলামী আরো বাড়ার আগে তুই ওখান থেকে বেরিয়ে আয়। তোর লাইফে মনে হয় পাগল পিছছাড়া করছে না, মায়ের পাগলামীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আবার বুড়োর পাগলামী ভর করেছে।’ বলেই জহির বুঝতে পারল মায়ের প্রসঙ্গ তোলাটা ঠিক হয়নি। সে তাড়াতাড়ি সরিটরি বলে মাফ চেয়ে নিল।
সামিউল মুখে কিছু মনে করিনি বললেও মায়ের খোচাটা তার বুকে খচখচ করে বিধতে লাগল।

বিজ্ঞাপন

সামিউলের মনমরা ভাব বৃদ্ধের নজর এড়ালো না। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘তুমি যদি আমার ব্যাপারটা নিয়ে মনমরা হয়ে থাকো, তাহলে ভুল হবে। আমি জোর করে তোমার উপর কিছু চাপাচ্ছি না। আমি শুধু তোমাকে প্রস্তাবটা দিয়েছি, বিবেচনা করে দেখার অধিকার তোমার আছে। তাছাড়া এখানে তো তোমার খরচাপাতির কোন ব্যাপার নেই, সব খরচখরচা আমার, পাশাপাশি তুমি তোমার সালারি অভারটাইম তো পাবেই আর আমি আমার এসব ইচ্ছেপূরণ বাবদ তোমাকে এক একেটা ইনটেনসিভ দিব, তাতে তোমার পুষিয়ে যাবে, ভবিষ্যতে মাথা তুলে দাড়াতে সাহায্য করবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, তোমার একটা আউটিং হবে, একটা এ্যাডভেঞ্চার হবে, তোমার অভিজ্ঞতার মুকুটে নতুন পালক যুক্ত হবে, তোমার লেখালেখির ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঝতা যুক্ত হবে। আমাদের দেশের লেখকের অভিজ্ঞতার খাতা এতো ম্যাড়মেড়ে যে লেখাগুলোও কেমন যেন অন্তসারশুণ্য মনে হয়। মার্ক টোয়েন জাহাজের খালাসী, হেমিংওয়ে রণক্ষেত্রের সৈনিক ছিলেন, আর আমাদের দেশের লেখকরা সম্পাদকের চামচা হয়ে থাকে।’ বৃদ্ধ না জেনেবুঝেই সামিউলকে মোক্ষম খোচা দিলেন।
সামিউল ইতস্তত করে বলল, ‘সেজন্য নয়, মাকে নিয়ে বন্ধুর কথায় একটু আহত হয়েছি। আমার মৃত মাকে নিয়ে ক্উে কিছু বললে আমি সহ্য করতে পারি না। মায়ের দেখভালেই বলতে গেলে এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছি…’
বৃদ্ধ নরোম স্বরে বললেন, ‘আমি জানি তোমার কথা, তোমার মায়ের কথা, তোমার আত্মত্যাগের কথা। কারোশি কেয়ার থেকে যখন তোমার ডিটেলস আমাকে জানাল হলো, তখন শুধু তোমার মায়ের কথা শুনেই কিন্তু আমি জোর দিয়ে জানিয়েছিলাম এই ছেলেকেই আমার এখানে চাই। সে যাই হোক, বন্ধুর কথায় কিছু মনে করো না। আহত করে কথা বলা বন্ধু থাকাও কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার, দৃুুভার্গ্য কি জানো, আমার তেমন কোন বন্ধু কখনই ছিল না। আমি বেড়ে উঠেছি একা একা নিসঙ্গ।’
সামিউলও জহিরের ব্যাপারটা মাথা থেকে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ওর কথাতে আমি কিছু মনে করিনি। ও সত্যি কথাই বলেছে, তবে সত্যি জিনিসটা হজম করা খুব কঠিন। যেমন, চাচা, এখন আমি আপনাকে সত্যি কথাটাই বলতে চাইছি, আপনার এই অদ্ভুত প্রস্তাবটা নিয়ে আমি ভেবেছি, ভেবে কোন কুলকিনারা করতে পারিনি। সেজন্যই বুঝতে পারছি আমার মন চাইছে না, এসব ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে। আমি যেরকমভাবে আপনার সাথে কাজ করছি সেভাবেই কাজ করতে চাই। এর বেশি কিছু নয়। চাইলে আপনার বাসা ছেড়ে দিয়ে আমি আবার আমার মেসে গিয়ে উঠতে পারি।’
বৃদ্ধ শীর্ণকায় হাতের মুঠোয় সামিউলের হাত ধরে রেখেছিলেন, সেটাতেই মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, ‘তুমি ব্যাপারটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছো বলেই তোমার এরকমটি মনে হচ্ছে। আমি শুধু আমার একটা দৃষ্টিভঙ্গি তোমার সাথে শেয়ার করেছিলাম। তুমি ইচ্ছুক না হলে এই ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই। তাতে আমাদের দুজনের মধ্যে বন্ধ’ত্বে কোন ভাটা পড়বে না। আর এই ব্যাপারটা নিয়ে তুমি আমার বাসা থেকে চলে যাও বা আমার কাজটা ছেড়ে দাও তা আমি কোনমতেই চাইব না। আমি যে এই প্রস্তাব তোমাকে দিয়েছিলাম তুমি তা পুরোপুরি ভুলে যাও। আমাদের সম্পর্কটা আগের মতোই থাকুক।’
এতো সহজে যে বৃদ্ধের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে সামিউল তা ভাবেনি। কথাটা বৃদ্ধকে কিভাবে বলবে এই ভেবেই রাতে তার ভাল ঘুম হয়নি। এখন কেন জানি মনে হচ্ছে, বৃদ্ধের কথামতো একটু এ্যাডভেঞ্চার করে এলেও কি এর এমন ক্ষতি হতো!
বৃদ্ধ তখনও হাতটা ধরে রেখেছেন। ‘আসলে আমি ভেবেছিলাম কি, তোমারে দিয়ে মনের কিছু খায়েশ পূরণ করব। জানি, ব্যাপারটা অদ্ভুত, কিন্তু তুমি ছাড়া মন খুলে এই কথাগুলো বলার আমার আর কেউ নেই। ছেলেরা তো অনেক আগেই বিদেশের ব্যস্ত জীবনে অতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ছেলেদের সাথে আমার কখনও সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমার সেরকম কোন বন্ধু নেই। মন্ডল আমার সময়বয়সী হলেও ও কর্মচারী, আমার কেয়ারটেকার। এরকম জি¦ হুজুর জি¦ হুজুর কারোর সাথে কখনও বন্ধুত্ব হতে পারে না। তোমাকে যে কাজের কথা বলেছিলাম তুমি আমার বন্ধু বলেই কিন্তু সরাসরি মুখের উপর না করে দিতে পারলে, কিন্তু মন্ডলকে বললে ও আগুন ঝাপিয়ে হলেও রাজি হয়ে যেতো, পার্থক্যাটা এখানেই।’
সামিউল আমতা আমতা করে বলল, ‘আসলে ব্যাপারটা আমার কাছে এতোটাই গোলমেলে যে আমি এই প্রস্তাবে রাজি হব কিভাবে এটাই বুঝতে পারিনি। সেজন্যই আমার মনে হয়েছে…’
‘তোমার বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। আমি শুধু চেয়েছিলাম আমার হয়ে কেউ আমার ইচ্ছেটুকু পূরণ করুক। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই ইচ্ছে পূরণ হওয়া দেখব। যেরকম তুমি আমার গ্রামে গেলে এই বৃদ্ধ বয়সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার গ্রামটাকে দেখতে পারতাম। আমার গ্রামের সেই খেলা তোমার মাধ্যমে খেলতে পারতাম। আমার গ্রামের সেই সহপাঠীদের খোঁজখবর জানতে পারতাম। আরেকটু সুপ্ত ইচ্ছে ছিল, ওদের খোঁজখবর পেয়ে কে কেমন আছে জানতে পারলে হয়তো ওদের কিছু সাহায্য টাহায্য তোমার হাত দিয়ে করতে পারতাম। এই ছাড়া আর তেমন কিছু না।’
সামিউল চিন্তিত স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে চাচা, আমি একটু ভেবে দেখি। আপনাকে এই মুহুর্তে কথা দিতে পারছি না। না-ই ধরে রাখেন, তারপরেও আমি দেখি যদি নিজের মন থেকে সায় পাই।

বিজ্ঞাপন

প্রায় মাসখানিক এই বাড়িতে অবস্থান করলেও সামিউলের নার্স শশী/শিপ্রার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। প্রথম কথা সামিউল যখন বৃদ্ধের সঙ্গ দেয় তখন খুব দরকার না পড়লে নার্স কখনও বৃদ্ধের ব্যক্তিগত রুমে ঢোকে না। সামিউলের মতো নার্সের ডিউটিও আট ঘন্টা, নার্স আট ঘন্টা শেষ করেই চলে যায়, সামিউলের মতো এই বাড়িতে থাকে না। তাছাড়া কোন মেয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলা সামিউলের ধাতে নেই, নার্সও তাকে এড়িয়ে চলে, সেই কারণে দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না।
বৃদ্ধের ঘুমের সময় হওয়ায় নার্সের দেওয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, টানা ঘন্টা তিনেক ঘুমাবেন তিনি। এই সময়টা সামিউলের তেমন কোন কাজ নেই। মন্ডল চাচাও নিজের মতো কোথায় জানি থাকে, বাড়ির সবকিছু তদারকি করে, সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার, সামিউলের মনে হয় নিসঙ্গ বৃদ্ধ মন্ডলের সাথে তার কোথায় জানি মিল আছে। মনে হয় এই বৃদ্ধের মতোই তার জীবনটাও নিসঙ্গতায় কারোর কেয়ারটেকারগিরি করেই কাটবে। এই সময়টুকুতে সামিউল নিজের রুমে এসে নিজের মতো করেই কাটায়, নিজের মতো করে কাটানো মানেই গল্প উপন্যাস কবিতা এসব লেখার চেষ্টা করে। এই যেমন এখন কেয়ারটেকার মন্ডলের সাথে তার জীবনের মিল নিয়ে একটা কবিতার লাইন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খোতে থাকে। ‘নিসঙ্গতাকে সতীন করে চলতে থাকি পথ/ জানি না কবে থামবে এই দ্বৈরথ…’ দ্বৈরথ শেষ করার আগেই আবজানো দরজায় মৃদু, প্রায় শোনা যায় না এরকম টোকার শব্দ।
সামিউল কান খাড়া করে দিল। মনের ভুল ভেবে আবার যখন কবিতা লেখায় মনোযোগ দিতে যাবে তখনই মিষ্টি মেয়েলী গলা ভেসে এলো দরজার ওপাশ থেকে, ‘ভেতরে আসতে পারি?’
এই বাড়িতে অশরীরি কোন কিছুর অস্তিত্ব না থাকলে একমাত্র মেয়েমানুষ ওই সুন্দরী নার্সই, আর কোন মেয়েমানুষের দেখা সামিউল কখনও পায়নি। রান্নাবান্নার দায়িত্বটাও মন্ডল চাচা নিজেই সারেন, কোন মহিলা রাধুনি নয়। সামিউল তাড়াতাড়ি কবিতার খাতা এক পাশে সরিয়ে লুঙ্গিটাকে ঠিকঠাক করে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘দরজা খোলাই আছে। আসেন, ভেতরে আসেন।’
নার্সের গায়ে আজ সাদা এপ্রণ না থাকায় তাকে অন্যরকম লাগছে, ঠিক ডাক্তার নার্সদের দেখলে যে সর্তকতার ব্যাপার থাকে তেমন মনে হয় না, অনেকটা জানি কাছের মানুষ মনে হতে থাকে। মেরুন রঙা সালোয়ার-কামিজে ফর্সা স্বাস্থ্যবতী নার্সকে শেষ বিকেলের আলো ও রুমের সাদা বৈদ্যুুতিক আলোয় অসম্ভব মোহময়ী লাগছে। নার্স ভেতরে ঢুকে দরজাটা হাট করে খুলে রাখল। হয়তো পরপরুষের রুমে একা আসায় এই বাড়তি সর্তকতাটুকু। ‘আপনার বিশ্রামের ডিস্টার্ব করলাম বোধ হয়।’ কিন্তু নার্সের মুখে চাপা হাসির ভাব দেখে মনে হলো না এই ব্যঘাত ঘটনায় সে দুঃখিত। বরং পায়ে পায়ে হেটে রিডিংটেবিলের সাথের চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে বিছানায় হতবুদ্ধর মতো বসে থাকা সামিউলের মুখোমুখি বসল। ‘এক বাসাতে দুজনেই ডিউটি করি, অথচ আমাদের তেমন আলাপ পরিচয়ই হয়নি।’ নার্স আগ বাড়িয়ে বলল।
সামিউল আমতা আমতা করে বলল, ‘না…মানে…আসলে… আপনি কি ভেবে বসেন তাই!’
‘হু,’ নার্স মুখ টিপে হাসল, ‘তাই তো মেয়ে হয়েও আমাকে নিজে থেকেই পরিচিত হতে আসতে হলো।’ নার্স লম্বা একটা কনভারসেশনের প্রস্ততির মতো করে বেশ জাকিয়ে বসল, সন্ধ্যে হতে এখনও অনেক দেরী। সন্ধ্যের পরেই তার ডিউটি টাইম শেষ হয়। ‘স্যার আপনাকে আমার কথা কখনও বলে কিনা আমি জানি না, তবে আপনার কথা আমার সাথে খুব বলে।’
সামিউল একটু অবাক হলো। বৃদ্ধ নার্সের সাথে তার কথা কি বলেন? সে কি কথা বলার মতো কোন ব্যক্তি? এক জীবনে সে একজন উপেক্ষিত মানুষ, বলতে গেলে কেউ না। ‘স্যার আমার কথা কি বলেন?’ সামিউল কৌতুহলী হয়ে উঠল।
‘কি যে বলেন না তাই বলেন। সর্বক্ষণ আপনার কথা, গুনগান উনার মুখে। নিজের ছেলের মেয়ের প্রসঙ্গেও উনি কখনও আমার সাথে এতো কথা বলেন না, যতটা আপনাকে নিয়ে বলেন। আমার তো মনে হয় উনি আপনাকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন।’
সামিউল স্বস্তিদায়ক মুখে বলল, ‘সেটা আমার স্বার্থকতা। আমাদের চাকরির ধরণটাই ওইরকম। যেসব বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের ছেলেমেয়েরা ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারে না, আমরা ছেলে মেয়ে সেজে তাদের সময় দেই।’
সামিউলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নার্স বলল, ‘হ্যা, এরকম অদ্ভুত ধরণের চাকরি এবং চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান যে বাংলাদেশে আছে তা আপনি এই বাসায় না এলে জানতেই পারতাম না।’ নার্স একটু দুষ্টমিভরা কণ্ঠে বলল, ‘কালে কালে আরো কত কি যে দেখব!’
সামিউলও দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘আমিও ঝানতাম না!’ নার্সের সাথে কথা বলতে তার ভাল লাগছে, শুধু যে ভাল লাগছে তাই্ই নয়, তার ইচ্ছে হচ্ছে নার্স তার এখানে আরো কিছুক্ষণ বসে তার সাথে কথা বলুক। ‘গ্রামদেশ থেকে ঢাকা শহরে এসে জানতে পারছি। শুধু জানতেই পারিনাই এখন সেই কাজও করছি। আর আপনার মুখ থেকে শুনে বুঝতে পারছি কাজ খুব একটা খারাপ করছি না।’
‘খারাপ করছি না মানে কি? আপনি অনেক ভাল করছেন। আমাদের নার্সিং প্রফেশনে কোন রোগী যদি আমাদের সেবায় সন্তুষ্টু হয় আমরা খুব খুশি হই। আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনার কাজে স্যার এতোই সন্তুষ্টু যে উনি কিন্তু আপনাকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। কই আমাকে তো দেন নাই?’
সামিউল ইতস্তত করে বলল, ‘হয়তো আপনি মেয়েমানুষ বলেই।’
‘হুম, সেটাও হতে পারে আবার আমার কাজে এখনও অতটা সন্তুষ্টু হন নাই বলেও হতে পারে।’ নার্স হঠাৎ গলা নামিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, স্যার যে আপনাকে কি একটা কাজের কথা বলছেন ওটা করে দিচ্ছেন না কেন?’
কোন কাজের কথা সামিউল প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি, জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই বুঝতে পারল, জীবন বদল করে নেওয়া। আর তখনই তার কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠল নার্স এতো ঘটা করে তার রুমে কেন এসেছে, বৃদ্ধ নিজেই নার্সকে প্ররোচিত করে এখানে পাঠিয়েছে যাতে নার্সের প্ররোচনায় সে রাজি হয়ে যায়। মেয়েমানুষ লেলিয়ে দিয়ে কাজ আদায় করে নেওয়া আদিমকাল থেকেই হয়ে আসছে, সবসময়ই হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। ধরণধারণ বদলালেও কাজ একই থাকবে। সামিউল একটু রসিকতার ঢঙে বলল, ‘আপনি বলছেন করতে?’
নার্সও একটু মদালসা হাসল, ‘এরকমভাবে বলছেন যেন আমি বললেই আপনি স্যারের কাজটা করে দেবেন?’
‘আপনি বললে আমি বিবেচনা করে দেখতে পারি, শুধু আপনার জন্যই।’
‘বেশ কথা ফুটেছে মুখে দেখি আপনার!’ নার্স মুখের হাসিটা ধরেই রাখল, ‘স্যারের কাজ করে দিলে আমার ফায়দা কি?’
‘সেটা আপনিই ভাল জানেন!’ সামিউলও মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, ‘তবে যদি কাজটা করেই দেই তাহলে আপনার জন্যই করব একটু জেনে রাখবেন।’
নার্স এবার একটু সাবধানী হলো, ‘আমার সমন্ধে আপনি কতটুকুই বা জানেন?’
‘হয়তো সবটা জানি না। কিছুটা তো জানি। এটুকু তো জানি, আপনি মায়ের সাথে থাকেন। একবার বিয়ের পিড়িতে বসেছিলেন, কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় সে পাট চুকেবুকে দিয়েছেন।’
‘বাব্বাহ, আসল জিনিসটাই তো জানেন দেখছি। আপনার আসল জিনিসটাও কিন্তু আমি জানি!’
সামিউল অবাক করা গলায় বলল, ‘আসল জিনিসটা কি?’
‘ওই যে মায়ের সেবা করতে গিয়ে আর বিয়ের পিড়িতে বসা হয়নি আপনার। যে মেয়েটাকে ভালবাসতেন তার বিয়ে হয়ে যায়, তারপর থেকেই আপাতত চিরকুমার ব্রত নিয়ে আছেন।’
সামিউল চমকে উঠল ‘আমার সমন্ধে এতো ভেতরের কথা আপনি জানলেন কিভাবে?’
‘আপনি যেভাবে আমার কথা জেনেছেন? স্যারের কাছ থেকে!’
সামিউলের অবাক ভাব তবুও কাটল না। কোথায় জানি একটা খটকা রয়ে গেছে। বৃদ্ধের সাথে সে মায়ের গল্প করেছে, কিন্তু কখনও শেলীর গল্প সেভাবে ভেঙে বলেনি। বৃদ্ধ জানতে চাইলে শুধু বলেছিল, মায়ের কারণে সংসার করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাহলে বৃদ্ধ এতো কথা জানল কিভাবে? তাহলে কি কারোশি প্রতিষ্ঠান থেকেই জানিয়েছে নাকি শেলী নিজেই বলেছে? সামিউলের ভেতর থেকে ধন্ধ যায় না।
এই সময় মন্ডল ট্রেতে করে এক গ্লাস শরবত এনে নার্সকে এখানে দেখে যেন একটু চমকে উঠল, ‘ওহ, আপনি এখানে। আগে জানলে আপনার শরবত এখানে নিয়ে আসতাম। আমি ভাবলাম স্যারের রুমেই আছেন। স্যারের তো মনে হয় ঘুম ভাঙার সময় হয়ে গেল।’
নার্স চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল, মন্ডলকে দেখে যেন সে কিছুটা বিব্রত। বিব্রত ভাব কাটাতেই তাড়াতাড়ি বলল, ‘যাই দেখে আসি স্যারের ঘুম ভাঙল কিনা। ঘুম ভাঙলেই রাতের ওষুধপত্র খাইয়ে আমার আবার যাবার সময় হয়ে যাবে।’ নার্স সাামিউলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসি, আবার দেখা হবে। আর আমার কথাটা একটু মাথায় রাখবেন।’
পদমর্যাদার কারণে কিনা মন্ডল কোন ব্যাপারেই কোন কৌতুহল দেখায় না। সে সামিউলের টেবিলে শরবত পিরিচ ঢাকা দিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘শরবতটা শেষ করেই স্যারের রুমে আসেন।’
সামিউল প্রায় এক চুমুকেই শরবত শেষ করল, পেস্তা বাদামের এই শরবতটার সে ভক্ত হয়ে উঠেছে। যেরকম সুস্বাদু তেমনি খেলে কেমন যেন নেশার মতো লাগে। আফিমটাঙিং মেশায় কিনা কে জানে, শরীর অবশ অবশ কেমন যেন মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। আজ মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠতেই একটা সন্দেহ ডেকে গেল মনে। শরবত খাওয়ার পরে কি তার সাথে এরকম কিছু করা হয় যাতে সে তার না বলা ভেতরের কথাগুলো উগরে দেয়?

চলবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই

আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (সপ্তম পর্ব) ঈদুল ফিতর ২০২৪ উপন্যাস প্রিন্স আশরাফ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর