Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সম্পর্কের অন্তরালে


১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:২৯

টিচার্সরুমে বসে ক্লাস লেকচারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কী কী পয়েন্টে বিষয় উপস্থাপন করবো, আমার লেকচারের শিখনফল কী হবে, কী কী উদাহরণ তুলে ধরবো-এসব ভাবছিলাম, আর নোট করছিলাম। আজ বাসা থেকে সকালের নাস্তাটা সেরে আসতে পারিনি। ঘুম থেকে উঠতেই দেরি হয়ে গেছে। তাই তাড়াহুড়া করে কলেজে এসে পৌঁছেছি। মনে শঙ্কা ছিল, হয়ত ক্লাসের আগে কলেজে পৌঁছাতেই পারব না। প্রতিদিন রাস্তায় জ্যাম থাকলেও আজ কাকতালীয় ভাবে জ্যাম পড়েনি। হুরহুর করে কলেজে এসে পৌঁছে গেছি। এটা সৌভাগ্যের বিষয়। অতএব কিছু সময় হাতে পাওয়া গেছে। তাই লেকচারের পয়েন্টগুলো আরেকটুু ঠিক ঠাক করে নিচ্ছি। টিচার্স রুমের আশে পাশে বুয়া-খালাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। খালাদের পেলে হয়ত একটু চা খাওয়া যেতো। এখনও মিনিট দশেক সময় আছে ক্লাস শুরু হবার। অপেক্ষা আর প্রস্তুতি চলছে। এমন সময় হঠাৎ করে একটি মেয়ে শিক্ষার্থী টিচার্সরুমে প্রবেশ করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি হকচকিয়ে গেলাম। মেয়েটি আমার পূর্ব পরিচিত। তাই হাত দিয়ে ইশারা করলাম সামনের চেয়ারে বসার জন্য। মেয়েটি বসলো। বসে মেয়েটি মাথা নিচু করে রইল। আমি বললাম- কিছু বলবে? কিছু বললো না। মাথা নিচু করেই রইল। আমি বললাম কী হয়েছে? তবুও কোনও কথা বললো না। হঠাৎ করে ফুঁপিয়ে উঠে কান্না শুরু করে দিলো। আমি মেয়েটিকে অনেক দিন ধরেই চিনি। সে ই-সেকশনে পড়ে। আমি সে সেকশনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়াই। এ মেয়েটি প্রায়ই ক্লাসে আনমনা থাকে। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলে না। কিন্তু মেয়েটি যে আমার সাহিত্য পাঠের ভক্ত তা তার কিছু প্রশ্ন শুনেই বুঝেছিলাম। তবে আমি কখনও বিশেষ কিছু বলিনি। আর এসব নিয়ে কথাবলা আমার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না। আমার লক্ষ্য থাকে শিক্ষার্থীকে মানসিক ভাবে উদ্বোধন করা, জীবন গঠনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমি চাই প্রতিটি শিক্ষার্থী জীবনে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হোক। আমি সাহিত্যের শিক্ষক। সাহিত্যের মধ্যদিয়ে তার নিজের মুখই দেখাতে চাই। সমাজকে দেখাই, সমাজের রীতি-নীতি, সমাজের মানুষকে দেখাই সাহিত্য পাঠের মধ্যদিয়ে। মানবিকবোধে আত্মার উদ্বোধন ঘটাতে চেষ্টা করি। পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট, এমনকি সফল জীবনের দিকে উদ্বুদ্ধ করি। সেসব ভিন্ন কথা। কিন্তু মেয়েটি হঠাৎ এমনভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিলো আমি খুব বিব্রত বোধ করতে শুরু করলাম। এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হতে লাগল। আমি কী কোনও কটু কথা বলেছি তাকে! না তো। মেয়েটি যেন থামছেই না। বেড়েই চলছে তার কান্না। কী এক গভীর বেদনা তার। গভীর কষ্ট আর আবেগ দগ্ধ হয়ে উঠেছে। তাছ্ড়াা আমার সামনে কান্নার মানে কী! হ্যাঁ আমি একজন শিক্ষক হিসেবে কিছু দায়িত্ব রাখি বটে। তবে সেটা খুব ব্যক্তিক পর্যায়ে নয়। ক্লাসে সহপাঠীদের সঙ্গে ঝগড়া হলে কিংবা শিক্ষাসংক্রান্ত কোনও কারণে কোনও সমস্যা হলে তার দেখার দায়িত্ব আমার থাকে। কিন্তু মেয়েটির এসব কোনও বিষয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। যা হোক, আমি অনেকক্ষণ ধরে নানা সান্ত¦না দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম। ‘কী হয়েছে?’ ‘কী হয়েছে’ বলে নানাভাবে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মেয়েটি কেঁদেই যাচ্ছে, কোনও কথাই বলছে না। অঝরে মাথা নিচু করে কেঁদেই চলেছে। আমি বোকা সেজে গেলাম। এমন অভিজ্ঞতা আমার ইতোপূর্বে কখনও হয়নি। কী হয়েছে তা বলবে তো। কিন্তু মেয়েটি কোনও কথা বললো না। সারাক্ষণ কাঁদতেই থাকলো। হয়ত কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। এসব নিয়ে বাড়াবাড়িতে তরুণ শিক্ষকদের নানা সমস্যা থাকে।

বিজ্ঞাপন

ততক্ষণে প্রায় আট মিনিট পার হয়ে গেছে। আমি নোটখাতা হাতে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে ক্লাসে যেতে হবে। মেয়েটিও কাঁদতে কাঁদতে আর চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো। তবু কিছুই বললো না। কী এক গভীর অভিমান! কী এক গভীর বেদনায় কাঁদছে। কিন্তু সমস্যাটা কী। আমার আর সময় নেই তাই ক্লাসের দিকে চলে গেলাম। ক্লাসে রোল কল করে আলোচনা শুরু করবো কিন্তু কিছুইতে স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। আমার ভাবনা আড়ষ্ট হয়ে রইল। মেয়েটি আমার সামনে এসে কাঁদলো কেন? কিছু বললো না কেন? মেয়েটি কী কোনও প্রতারণার শিকার? তার কান্নাটা সাধারণ কোনও বিষয় বলে আমার মনে হচ্ছিল না। সে কী আমার কাছে কিছু চায়? কিংবা আমাকে কোনও কিছু জানাতে চায়? তরুণ শিক্ষকদের নানা প্রতিকূলতা থাকে সত্য। কিন্তু সারাক্ষণ নানা উদ্ভট ভাবনা আমাকে আড়ষ্ট করে রাখলো। আমি ক্লাসটিও ভালভাবে নিতে পারলাম না। কোনও রকমভাবে ক্লাসটা শেষ করে আমার বসার ডেস্কে ফিরে এলাম। ততক্ষণে বুয়া খালারা এসে গেছে। তাদের একজনকে ডেকে বললাম চা দিতে। আর কাগজে মেয়েটির নাম, রুল নাম্বার লিখে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে আসতে বললাম।

বিজ্ঞাপন

এই মেয়েটিকে আমি প্রায় বছর খানেক ধরে চিনি। খুব সহজ সরল ভদ্র মেয়ে। কখনও অতি চতুরতা দেখিনি। শিক্ষার্থী হিসেবে সে মনোযোগী, শান্তশিষ্ট ও বুদ্ধিমতী। দেখতে উঁচু লম্বা। একটা সপ্রতিভ ভাব আছে। গায়ের রঙ খুব উজ্জ্বল না হলেও একধরনের শুভ্রতা তাকে ঘিরে রাখে। মেয়েটি আবেগী বটে। সহজেই মায়া কাড়ে। সে মাঝে মধ্যেই আমাকে নানা প্রশ্ন করে। এটা-ওটা জানতে চায়। আমিও আন্তরিকভাবে তাকে সাহায্য করি। তার প্রশ্ন করার মধ্যে দেখানো কোনও প্রবণতা নেই। মনে হয় সে সত্যি জানতে চায়। বুঝতে পারি- মেয়েটি জীবন বড় কিছু হতে প্রচ- আগ্রহী। ভবিষ্যতে সে উঁচু ক্যারিয়ার গড়তে চায়। ঠিক এ কারণটার জন্যই আমি তার সঙ্গে কথা বলি। সে যখন যা জিজ্ঞেস করে তার উত্তর দেই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা কী আনন্দের আর সার্থক জীবনের ছবি দেখাই। তবে আজ মেয়েটির এমন আচরণ সত্যি ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে খালা ফিরে এসে জানাল মেয়েটি চলে গেছে। কলেজের দুটো ক্লাস পর্যন্ত করলো না। ভাবনা আরো জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠতে থাকলো। কী সমস্যা মেয়েটির? ভাবতে ভাবতে আমিই কেমন জানি অস্থির হয়ে উঠছিলাম। আর মেয়েটি যখন কাঁদছিল এত অসহায় লাগছিল যে, দেখে আমার কেমন মায়া হচ্ছিল। আমার আরো তিনটে ক্লাস আছে। অতএব বসে বসে কান্নার মায়ায় পড়ে থাকা চলবে না। আমার কাজ করতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের সেই মন্ত্রটা বারবার আওড়াতে লাগলাম ‘একবার ইচ্ছা হইল, ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি’ … নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।’ নিজের আবেগকে অবদমিত করে কিছুক্ষণ পর আবার ক্লাসে গেলাম। কিন্তু সত্যি বলতে কী। সেদিন কোনও ক্লাসেই ঠিক মতো মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। মেয়েটির কান্নাভেজা মুখের ছবি জানি ভাসছিল মনে। শেষ পর্যন্ত মেয়েটির ক্লাস টিচারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফোন নাম্বার সংগ্রহ করলাম।

আমার মন আর মানছিল না। অদম্য কৌতূহল, উৎকণ্ঠা আর স্নেহ মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। দুপুরের দিকে মেয়েটিকে ফোন দিলাম। প্রথম বার ফোন বেজে বেজে কেটে গেল। কেউ ফোনটা ধরলো না। পরের আবার রিডায়াল করলাম। হঠাৎ করে এক পুরুষকণ্ঠ ফোন ধরলো-
– হ্যালো।
– হ্যালো। এটা কী অমুকের বাসা। ওকি বাসায় আছে?
– কোনও বেশ্যা এ বাসায় থাকে না। আপনি কে?
– কে বলছেন আপনি! কে বলছেন?
– আমি ওর বাবা।
তৎক্ষণাৎ যেন আমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাবে যাবে এমন অবস্থা হলো। বাবা কখনও মেয়ে সম্পর্কে এমন নোংরা কথা বলে, তা জানা ছিল না। আমি আর কথা বলতে পারলাম না। ফোনটা কেটে দিলাম। ও একটা নিষ্পাপ মেয়ে। পৃথিবী সম্পর্কে কিছু জানে বলে মনে হয় না। নিজের বাবা হয়ে মেয়েকে এমন অসভ্য কথা বললো। ফোনটা রেখে আমি বসে রইলাম। আমি যেন পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলাম। নিজেকে সংবরণ করলেও নোংরা কথা মেনে নিতে পারছিলাম না। নিজের মেয়ে সম্পর্কে এমন ভাষা পৃথিবীতে কোনও কালে কোনও বাবা উচ্চারণ করেছে বলে মনে হয় না। অথচ মেয়েটিকে দেখে খুব ভদ্র পরিবার বলেই মনে হয়েছে। গত এক বছরে কখনও মেয়েটিকে বাজে কথা বলতে শুনিনি। বরং অন্যান্য শিক্ষার্থীর মধ্যে তাকেই সবচেয়ে বেশি রুচিশীল ভদ্র মনে হয়েছে। একে তো মেয়েটির আবেগ আমাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল এখন আবার তার বাবার নোংরা শব্দ নতুন করে ঘৃণায় ফেলে দিলো। কিছুক্ষণ মনে মনে গালিগালাজ করতে থাকলাম। মেয়েটি সত্যি সত্যি খারাপ হলে লোকজন আমাকেও খারাপ বলতে পারে। তাকে এড়িয়ে চলাই উচিত। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তো একটা দায়িত্ব থাকেই। মেয়েটির প্রকৃত সমস্যাটা কী। সে কী বলতে চেয়েছিল এটা আমার সমস্ত ভাবনাকে গ্রাস করেই চললো।

বাসায় এসে বিষয়টি আমার স্ত্রীর সাথে শেয়ার করলাম। আমার স্ত্রী উল্টো আমাকেই অপরাধী সাজিয়ে ফেললো। বললো তোমরা যারা সাহিত্য করো তারা তিলকে তাল বানিয়ে ফেল। কেউ একজন তাকালো আর তোমরা মনে করো তার মধ্যে না জানি কত অর্থ আছে। কেউ একজন কাশি দিলো আর মনে করো সারারাত কত পড়াই না পড়েছে। পড়তে পড়তে ঠাণ্ডা লেগে গেছে। ঐ মেয়ের সঙ্গে কথা বলা থেকে সাবধান থাকো। তোমাকে সহজ সরল পেয়েছে। দেখ ঐ মেয়েকে এতো ছোট করে দেখো না। আমার স্ত্রীকে বুঝালাম, মেয়েটি আমার সামনে বসে কথা না বলে এমনভাবে কাঁদছিলো যে আমি ভুলতে পারছি না। এত অভিমান কীসের। আবার আমার সামনেই কেন অভিমান দেখাবে। আর তার বাবা এমন অশ্লীল কথা বললো যে, বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে কীভাবে বলে এমন কথা। যা হোক, তারপর নানা কারণেই আমি ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম। প্রায় ভুলেই গেলাম।

ইতোমধ্যে দশ-বারো দিন পেরিয়ে গেছে। সেদিন দিন বাংলা কুইজ পরীক্ষা। হঠাৎ মনে হলো মেয়েটিকে অনেক দিন দেখি না। তাই খোঁজ নিলাম। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম সে কুইজ পরীক্ষা দিতে আসেনি। পরে আরো জানলাম তারপর থেকে সে আর কলেজে আসে না। ক্লাস টিচারের কাছ থেকে খবর নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম মেয়েটি সর্ম্পকে। কিন্তু ক্লাস টিচারও খুব কিছু জানে না। ভাবনাটা আবার নতুন করে জেগে উঠলো। ফোন নাম্বার আমার কাছেই ছিল। দেরি না করে তৎক্ষণাৎ ফোন দিয়ে দিলাম।
– হ্যালো- এটা কী অমুকের ফোন নাম্বার?
অপরপ্রান্ত থেকে পুরুষকণ্ঠ ভেসে আসলো
– হ্যাঁ, বলেন
– আপনি কে বলছেন?
– আমি ওর বাবা
– আমি অমুকের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম
– ও কারো সাথে কথা বলবে না
– আমি ওর শিক্ষক। একটু জরুরি প্রয়োজন আছে।
– কী প্রয়োজন আমার কাছে বলুন
আমি কী বলবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। মেয়েটির বাবা কোনওভাবেই মেয়েকে ফোন দিতে চাচ্ছিল না। পরে হঠাৎ বুদ্ধি করে বললাম সে কুইজ পরীক্ষা দিতে আসেনি কেন? অভিভাবকসহ কলেজে এসে দেখা করতে হবে। ফোনটা রাখার পরেই মনে হলো বিষয়টি আমার স্বার্থে বললাম কী না। কিংবা অনধিকার চর্চা করে ফেললাম কী না। কিন্তু না, কুইজ পরীক্ষায় উপস্থিত না থাকলে কলেজে অভিভাবকসহ আসাটাই নিয়ম। যা হোক, আর কথা বলে ফোনটা রেখে দিলাম। তারপর মাথা থেকে মেয়েটির ভাবনাটা একদম ঝেড়ে ফেলে আমি কাজে মন দিলাম।

পরদিন সকালে কলেজে পৌঁছে দেখি, সত্যি সত্যি অভিভাবকসহ মেয়েটি এসে বসে আছে। আমি ভাবতেই পারি নাই সে সত্যি চলে আসবে। অকস্মাৎ তাদের দেখে আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। মেয়েটি বিনয়ের সুরে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। ও বুঝিয়ে দিলো লোকটি তার বাবা। লোকটিও আমাকে বুঝিয়ে দিলো মেয়েটি শিক্ষক হিসেবে আমাকে খুব পছন্দ করে। মেয়েটি আমার কথা মানে। মেয়েটিকে সেদিনের মতো অস্বাভাবিক মনে হলো না। আমি মেয়েটিকে ক্লাসে চলে যেতে বললাম। উদ্দেশ্য বাবার সাথে কিছু কথা বলবো। আমি তার বাবা চা খাবে কি না জিজ্ঞেস করে প্রশ্ন শুরু করলাম-
– এত রাগ কেন মেয়ের প্রতি? মেয়ে কলেজে আসে না কেন?
– স্যার, ওর পড়াশুনার দরকার নাই
– কেন? মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে সমাজে ভালভাবে টিকে থাকতে পারবে?
– স্যার, আমি পড়াইতে চাই না।
– কেন? বিশেষ কিছু হয়েছে নাকি? খুলে বলুন। কোনও সমস্যা নাই, ও আমাদেরই মেয়ে। ওর ভালটা আমরা সবাই চাই
– স্যার, ও খারাপ হয়ে গেছে। বিভিন্ন ছেলের সাথে আজে-বাজে সম্পর্ক করে। কলেজের নাম করে বিভিন্ন জায়গায় যায়। তাই আর পড়াশুনা করাইতে চাই না।
– তাই নাকি! এটা তো ঠিক নয়। যা হোক, আপনি কীভাবে বুঝলেন?
– স্যার, ওর ফেসবুকের আইডিতে কয়েকটা ছেলের সাথে খুব নোংরা ছবি দেখছিলাম সেদিন…

বলতে বলতে মেয়েটির বাবা কেঁদে উঠলো। আমি সান্ত¦না দেবার চেষ্টা করলাম। এবার দেখি বাবা কাঁদছে। একি বিপদে পড়লাম। কোনও ভাবেই সে আমার কথা শুনছিল না। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। ক্রমশ কাঁন্না বেড়ে চললো। হুহু শব্দ করে কান্না শুরু করলো। আমি বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেলাম। আশে-পাশে সহকর্মীরা কী ভাববে। সেদিন মেয়ে কেঁদেছিল আর আজ বাবা। কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বারবার অনুনয় করতে থাকলাম। একসময় চোখ-মুখ মুছে কান্না থামালো। এত বয়স্ক লোককে এমনভাবে কান্না করতে আমি কখনও দেখিনি। আমি মাথা ঠাণ্ডা করে পরামর্শের সুরে বললাম-
– মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন। মেয়ে যেহেতু এই বয়স্ইে এতটা পেকে গেছে তাই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন।

এই কথা বলার পর মেয়েটির বাবা রেগে উঠলো। কান্না তখন ক্ষোভ দৃষ্টির পরতে। রূঢ়দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বুঝলাম মেয়েটির প্রতি তার কোনও চাপা কষ্ট আছে, ক্ষোভ আছে। অনুভব করলাম লোকটি রেগে যাচ্ছে। লোকটি তখন ঘৃণা-কান্না ও রাগ-ক্ষোভের অভিব্যক্তিকে বলে উঠলো-
– আমি সারা জীবন একা কাটিয়েছি ওরজন্য। ওর জন্মের পর পরই আমার স্ত্রী মারা গেছে। শুধু এই মেয়েকে মানুষ করার জন্য নিজে বিয়ে করি নাই। আমি ওকে খাইয়েছি। ওকে জামা-কাপড় পড়িয়েছি। ওর কাপড় চোপড় ধূয়ে দিয়েছি। ওর যতো মেয়েলি বিষয় সব আমিই সামলিয়েছি। এমন কী এখনও ওর যত গোপন কাপড় সেসব আমাকে ধূয়ে দিতে হয়…

বলতে বলতে লোকটির কান্না বেড়ে গেল। কিন্তু কান্নার মধ্যেও তার চোখ যেন চকচক করে উঠলো। আমি তার চোখে লোভাতুর একটা ছবি দেখতে পেলাম। আবারও কাঁদলো। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না ঘটনার মূল তবে কী। অনেকের কাছে নানা গল্প শুনেছি কিন্তু কখনও বাস্তবে দেখিনি। মেয়ের যৌবনের প্রতি বাবার বাজে দৃষ্টি তা বলবো না। আমরা পৃথিবীতে যা দেখি তা সবই সত্য নয়। আর যা সত্য তা হয়ত দেখি না। ভিন্ন কিছু দেখি। পৃথিবীর আকার-রূপ দেখা একটা বড় রহস্য। আমাদের উপলব্ধিতে নানা বিভ্রম থাকে। মেয়ে যদি একটা ছেলের সঙ্গে ছবি তুলে বাবা কষ্ট পাবে সত্য। কিন্তু তাতে এমন ক্ষোভ তো কখনও দেখি নাই। বরং অনেক ক্ষেত্রে বাবারাই সন্তানের পছন্দকে, সম্পর্ককে মেনে নেয়। ঘটা করে বিয়ের আয়োজন করে। কিন্তু এখন দেখছি বাবা নিজের জীবনের সঙ্গে তুলনা করছে। বাবা অপ্রাপ্তির একটা খতিয়ান টানছে। সত্যিই কী সত্য বুঝতে পারছি। নাকি বোধে বিভ্রম ঘটছে। লোকটির কষ্টে আমারও কষ্ট লাগল। বাবার বঞ্চিত জীবন নিয়ে সমবেদনা জানালাম। কিন্ত বাবার বয়স এত বেশি মনে হলো, তাই নতুন বিয়ে করার পরামর্শ দিতে পারলাম না। যা হোক, চা খাইয়ে বিদায় দিলাম। বিদায় দেবার সময় বললাম- আমি পরে আরেকদিন আপনার সাথে কথা বলবো। এ বিষয়টি আজ এখানেই থাক। মেয়েকে নিয়মিত কলেজে আসতে দিন। মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়তে দিন। বাবা চলে গেলেন। আমি আমার ভাবনার জাল থেকে বের হতে পারছিলাম না। পরক্ষণেই আমার ক্লাস। ক্লাস শেষ করে এসে এবার মেয়েটিকে ডাকলাম। বাবা চলে গেলেও মেয়েটি ক্লাস করছিল। সাথে সাথেই মেয়েটি এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। মেয়েটি যেন প্রস্তুতই ছিল আমার সামনে আসার। মেয়েটিকে আমি প্রশ্ন করলাম।
– তুমি কোনও এক ছেলের সঙ্গে খুব ঘণিষ্ঠভাবে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছো?
– স্যার, বাবা এ কথা বললো?
– হ্যাঁ, এখন কী তোমার প্রেমের সময়। এইচএসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আগে জীবন গঠন করো। তারপর জীবন সাজাবে, বিয়ে সাদি করবে। প্রেম-ভালবাসা, বিয়ে সাদি সবারই দরকার আছে। কিন্তু তা অসময়ে নয়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রথম প্রয়োজন নিরাপদ জীবন।
– স্যার, ও ছবিগুলো আমি ইচ্ছে করেই তুলেছি। বাবাকে দেখানো জন্য।
– আশ্চর্য! বাবাকে দেখানোর জন্য তুমি এমন কাজ করেছো কেন?
– জী স্যার, অনেক কথা, যা আপনাকে বুঝানো যাবে না। বাবা সারাক্ষণ আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, গায়ে ধরে। কেমন যেন আদর করতে চায়।
– বাসায় আর কে কে থাকে?
– আমি আর বাবা। মাঝে মাঝে এক আন্টি আসে।
– রান্না-বান্না কে করে?
– বাবাই বেশি করে। আমিও করি। আন্টি এসে বিভিন্ন কাজ করে দিয়ে চলে যায়।
– তুমি কী বলতে চাইছো তোমার বাবার কুদৃষ্টি?
– তা জানি না। বাবা আমাকে অধিক আদর করতে আসে। তা আমার কাছে ভাল লাগে না। তাই অন্য এক ছেলের সাথে ছবি তুলে দেখিয়েছি।
– তুমি কী চাও তোমার তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাক।
– তা আমি জানি না। তবে আমি চাই তাড়াতাড়ি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে।

আমি আর কোনও কথা বলতে পারছিলাম না। আমি এখন সাধারণ সাহিত্যের শিক্ষক। এসব সমস্যার আমি কী পরামর্শ দিবো। মেয়েটির জন্য কী করতে পারব! কৌতূহল জন্মে ছিল তাই বুঝতে চেয়েছিলাম। ওকে বললাম আমার এখন মাথা ধরেছে। তোমার সঙ্গে পরে কথা বলবো, পরে এসো। মেয়েরা কত গোপন কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়ায় কিন্তু কাউকে বলতে পারে না। হয়ত এমন কত ঘটনাই চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। আমরা যার দৃশ্যরূপ দেখি না। অস্তিত্বের সংকট কত ভয়াবহ। নারী কী শুধুই দেহসত্তা। একজন পুরুষের দৃষ্টিতে নারী কী কেবলই ভোগ্যবস্তু। তা স্বামীপুরুষ হোক কিংবা অন্যকোনও সম্পর্কের হোক। বাবাকেও আমি খারাপ ভাবে দেখছি না। যে মানুষ নিজে বঞ্চিত হয়েছেন, অন্যজনের উপভোগ দেখে কষ্ট কিংবা ঈর্ষা লাগতেই পারে। তবে এ ঘটনায় তিনি যে পিতা। পৃথিবীর প্রতিটি সম্পর্কের ভেতরে হ্রদ বয়ে বেড়ায়। তা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবে বাধা নয়। যুগে যুগে মানুষ তার বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে সম্পর্ক দাঁড় করিয়েছে। মানুষের নীতিবোধ-সৌন্দর্যচিন্তা কিংবা ধর্মের শ্বাশত শিক্ষাগুলোয় সম্পর্কের রূপরেখা নির্মাণ করেছে। তবু সম্পর্কের অন্তরালে অস্তিত্বের ধারায় বয়ে চলে নানা সম্পর্ক। মানুষের যেমন আছে নিজ অস্তিত্ব; তেমনি আছে সামাজিক অস্তিত্ব। বইয়ের মৃত অক্ষরগুলো আজ স্বার্থের পিষ্ঠে ঘোরে। প্রাণ আর জীবনের স্পন্দে সেখানে ফুটে ওঠে জীবনের প্রকৃত রূপ। সম্পর্ক একটি রহস্যময় শব্দ। যার আড়ালে বাস্তবের নানা ব্যাখ্যা লুকিয়ে থাকে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

আবু সাঈদ তুলু ঈদুল ফিতর ২০২৪ গল্প সম্পর্কের অন্তরালে

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর