Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিড়ম্বনা


১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:০১

যমুনার বুকে জেগে ওঠা বিস্তির্ণ চরাঞ্চল জুড়ে কাজিপুর উপজেলা। জেলা সদর সিরাজগঞ্জ থেকে ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরে সেই যমুনার তীরেই কাজিপুর উপজেলা কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সের ডান পাশে পাঁচতলা জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। বছর দুই হয় নির্মিত হয়েছে অথচ এখনও রঙের গন্ধ যায়নি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে তকতকে রুম। রুমের জানালায় ভারি পর্দা। নতুন এসির হিমহিম ঠান্ডা হাওয়া। সামনেই দুগ্ধফেননিভ বিছানা। কাজিপুর উপজেলার মতো প্রত্যান্ত অঞ্চলে এমন বিলাসবহুল রেস্টহাউজ পাবো, স্বপ্নেও ভাবিনি। শুনেছি, স্বাস্থমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাহেবের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এটি নির্মিত হয়েছে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নেমেছে। সারাদিনের দীর্ঘ জার্নিতে অবসন্ন শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। ভাবছিলাম, সব কাপড় খুলে ভাদ্র মাসের গরমে সেদ্ধ শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে এসির ঠাণ্ডা বাতাসে একটু শীতল করব, এমন সময় দরজায় শোনা গেল,
টুক, টুক, টুক…
কে এলো আবার? কিছুটা বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই দেখি, লিজা দাঁড়িয়ে। প্রায় উদোম শরীরে। শুধু একটা গামছা জড়ানো বুকে। আজ দুপুরেই পরিচয়। কিছুটা ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে। তাই বলে এভাবে সে আসবে আমার ঘরে, কল্পনাও করিনি। দু’চোখ কপালে তুলে বললাম, লিজা তুমি?
ভাইয়া গরম। খুব গরম। অঙ্গ জ্বলে যায়।
বলে এক অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে হাসল লিজা। দেখে এবার আমার অঙ্গ জ্বলে গেল। কণ্ঠে যথেষ্ট বিরক্তি এনে বললাম, তা আমার কাছে কেন? দরজা বন্ধ করে এসি চালিয়ে অঙ্গ ঠাণ্ডা করে নাও।
ভাইয়া, সেই জন্যই তো আপনার কাছে আসা।
মানে কী?
মানে আমার রুমের এসি চলতেছে না। সরেন। আমারে একটু ঘরে ঢুকতে দেন।
বলে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই আমাকে ঠেলে ঘরে ঢোকে লিজা। এসির সামনে বুক খুলে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে। আমার সামনের রুমটাই ওর। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই রেস্ট হাউজ কমপ্লেক্স। এখানে এক রাত আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব। এমন আধুনিক রেস্ট হাউজের এসি চলে না, বিশ্বাস হতে চায় না। বললাম, চলো, দেখছি। কেন চলে না তোমার এসি।
কোনও লাভ নাই ভাইয়া। আমি সব রকম চেষ্টা করছি। দ্যাখেন না, কেমন ঘেমে নেয়ে গেছি!
দেখি ঘামে ভেজা চুল লেপটে আছে কপালে। মুক্তোদানার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম লিজার ফর্সা মুখে, গলায়, বুকে। আমি চোখ নামিয়ে নামিয়ে নিয়ে বললাম, তা কেয়ারটেকারকে বলেছ?
এই গাও গেরামে কেয়ারটেকারের চৌদ্দ পুরুষেও এসি দেখে নাই ভাইয়া। সে এসির কিছু বুঝে না।
বলে ধপ করে আমার বেডে বসে পড়ল লিজা। দেখে আমার চোখ সরু হয়ে গেল। এ সবের মানে কী? ও কি এই বিছানায় ঘুমোবার চিন্তা করছে? বত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে বউ ছাড়া আর কারও সাথে বেড শেয়ার করিনি। আমি হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাই। ঘুমের মধ্যেই পাশের জনের গায়ে হাত পা তুলে দেই। সেই পাশের জন বউ না হয়ে লিজা? ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল!
ছয় জনের টিম আমরা। রুম খালি পেয়েছি চারটি। আমি আগেভাগেই বলে রেখেছিলাম, বেড শেয়ার করতে পারি না। তাই প্রথমেই ওরা আমাকে একটা রুম দিয়ে দিয়েছিল। দুটোতে দুজন করে আর বাকি একটাতে অবশ্যই লিজা। সেই লিজার এসিই খারাপ হতে হলো? আমার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। রাতের বেলা উপজেলা শহরে এসির মেকানিক কোথায় পাব?

বিজ্ঞাপন

মাটির টানে সুযোগ পেলেই লন্ডন থেকে উড়াল দিয়ে খুলনা চলে আসি। আর শেকড়ের টানে যাই খালিশপুরে। যেখানে কেটেছে আমার শৈশব আর কৈশোরের নানা রঙের দিনগুলি। বায়তুল ফালাহ মোড়ে, কচি ভাইয়ের দোকানে সন্ধ্যার পরে একে একে জড় হয় অনেকে। আসে ইঞ্জিনিয়ার ফরহাদ। ছোট ভাইয়ের ক্লাসমেট। আমার চেয়ে এগারো বছরের ছোট। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও খুলনা ছাড়েনি কখনও। ঘুরেফিরে খুলনার আশেপাশেই চাকরি করে। পড়ে থাকে খালিশপুরের মাটি কামড়ে। আসে লতিফ ভাই। আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। এক বছর হয় বিটিসিএল থেকে রিটায়ার করেছেন। আসে জুয়েল, জাকির, বাবু, আরও অনেকে। কেউ ব্যবসা করে, কেউ মাস্টারি, কেউ জুট মিলে চাকরি। সবাই প্লাটিনাম স্কুলের ছাত্র। আড্ডা জমে ওঠে। সময় পেলেই আমি ওদের কাছে যাই। ভাঙ্গা চেয়ারে বসে কাঁচের গ্লাসে লাল চা খাই। সাথে গরম গরম ডালপুরি কিংবা পিয়াজু। ওরা আমাকে চটের কথা মনে করিয়ে দেয়, মাটির কথা মনে করিয়ে দেয়, আমার শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বলা হয়, দানের জন্য ধন নয়, মন থাকা চাই। ওখানে জড় হওয়া মানুষগুলো ধনে বড় না হলেও মনের দিক দিয়ে অনেক বড়। প্রকৃতির লীলাভূমি এই ব-দ্বীপের মানুষগুলোর জীবন নিয়ে প্রতি বছরই প্রকৃতি নানা খেলায় মেতে ওঠে। কখনও পানিতে ডুবিয়ে দেয়, কখনও জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয়, আবার কখনও বা শীতে ঠাণ্ডায় জমিয়ে মারে। ওদের মন তখন কেঁদে ওঠে। ওরা তখন নিজের সামর্থ্য মত যা পারে, তাই নিয়ে প্রকৃতির কাছে অসহায় ঐ মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে চায়। আমাকে খবর পাঠায়। দূর প্রবাসে থাকি বলে সব সময় ওদের সাথে যেতে পারি না। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। তবে সাধ্যমত সাহায্য করি।

বিজ্ঞাপন

এবার এসে ব্যস্ততার কারণে ওদের কাছে যেতে পারিনি। খবরের কাগজে দেখলাম, বন্যার পানি বাড়ছে। তলিয়ে যাচ্ছে মাঠ, ঘাট, প্রান্তর। তলিয়ে যাচ্ছে ফসলের জমি, সব্জির খেত, বসত বাড়ি, পশুদের খোয়ার। এমন সময় একদিন ফরহাদের মেসেজ এলো, ভাই, যাওয়া দরকার। তলিয়ে যাচ্ছে সব। সাথে সিরাজগঞ্জের যমুনার চরাঞ্চলের কিছু ছবি। শুধু পানি আর পানি। তারই মাঝে নাকে জাগিয়ে কোনমতে বেঁচে আছে গাছপালা, ঘর বাড়ির চুড়া। লিখলাম, বস তোরা, আসছি আমি।

যথারীতি জড় হয়েছে সবাই কচি ভাইয়ের দোকানে। শুনলাম, লতিফ ভাইদের গ্রামের বাড়ি কান্তপুর তলিয়ে গেছে বানের জলে। বলা হয়, চ্যারিটি স্টার্টস ফ্রম হোম। যেতে হলে ওখানেই প্রথম যাওয়া উচিৎ। বললাম, এবার আমিও যেতে চাই তোদের সাথে। সবাই চমকে ওঠে। ভাবতে পারেনি আমিও যাব ওদের সাথে। ফরহাদ আমতা আমতা করে বলল, ভাই, আপনি পারবেন?
তোরা পারলে আমি পারব না কেন?
না, মানে এত বছর ধরে ইংল্যান্ডে আছেন। সাঁতার টাতার হয়তো ভুলে গেছেন!
শুনেই প্রমাদ গুনলাম। ভুলব কী? আমি তো সাঁতারই জানি না! খাল নদীর দেশ বরিশাল। সেই বরিশালের ছেলে হয়ে সাঁতার জানিনা, কথাটা ছোট ভাইদের বলতে মন চাইল না। তাছাড়া সাঁতার জেনেও তো কত মানুষ ডুবে যায়। আমি নাহয় সাঁতার না জেনেই ডুবলাম। পরাজয়ে ডরে না বীর। বললাম, চিন্তা করিস না। আমাকে একটা লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে রাখিস।

যেই বলা, সেই কাজ। দ্রুত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হল। শুকনা খাবার দেব। সাথে চাল, ডাল, তেল, যা আমাদের সাধ্যে কুলায়। ছয় জনের টিমও তৈরি হয়ে গেল। আমি, লতিফ ভাই, ফরহাদ, জুয়েল, আসাদ ও লিজা। আসাদকে চিনি না। সম্ভবত ওদের কোনও বন্ধু হবে। তবে লিজার নাম শুনেই চমকে উঠলাম। বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ টিমে মেয়ে? বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, লিজা কে?
আমার এক বন্ধু।
কিছুটা কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিল ফরহাদ। অবাক হয়ে ফরহাদের দিকে তাকালাম। বাহ, বাংলাদেশের ভালই তরক্কি হচ্ছে তাহলে? মেয়েদেরকে বান্ধবী না বলে বন্ধু বলা হচ্ছে? বলুক, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। বিশ বছর ধরে ইংল্যান্ডে আছি। সেখানে ছেলে হোক, মেয়ে হোক, সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হলে ফ্রেন্ডই বলে। আর ফ্রেন্ড শব্দটির কোনও স্ত্রীলিঙ্গ নেই। শুধু প্রেমিকা কিংবা ফিয়ান্সে হলে গার্ল-ফ্রেন্ড বলে। সেখানে ছেলে মেয়েতে কোনও ভেদাভেদ নাই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আলাদা। এখানকার মানুষগুলো এখনও তেমন উদারমনা হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলো। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও সামাজিক ও ধর্মীও সংস্কারে সীমাবদ্ধ। এতগুলো ছেলের সাথে একটা মেয়েকে কি তারা ভাল ভাবে নেবে? নাকি পশ্চিমা বিশ্বের মতো এরাও আধুনিক হয়ে উঠেছে? তবুও কিছুটা অস্বস্তিত নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আগে গেছে কখনও?

হ্যাঁ ভাই। ও তো প্রায়ই যায় আমাদের সাথে। কাশ্মীরেও তো গিয়েছিল আমার সাথে। ফরহাদ মিটিমিটি হেসে জবাব দিলো। শুনে আমার বিষম লাগার জোগাড়। ফরহাদকে আমি ভাল ছেলে বলেই জানি। একসময় দুষ্টের শিরোমণি থাকলেও এখন ধার্মিক হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। বউকে কঠোর পর্দা করায়। শুনেছি, ফরহাদ মাঝে মাঝেই ইন্ডিয়া ট্যুরে যায়। বাচ্চারা ছোট বলে বউকে সাথে নেয় না। তাহলে এই ব্যাপার? আমি চোখ সরু করে ফরহাদকে দেখি। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না ফরহাদ তাহলে তলে তলে মেয়ে বন্ধু নিয়ে ট্যুরে যায়? বুঝলাম, মানুষ চিনতে এখনও অনেক বাকি। তবে, মানুষের ব্যক্তি জীবনে নাক গলানো স্বভাব নয় আমার। অস্বস্তি হলেও ছোট ভাইয়ের বন্ধুর এই অস্বাভাবিক স্বভাব নিয়ে অহেতুক কৌতুহুল দেখানো সমীচীন মনে করি না। অন্যারা কেউ এ ব্যাপারে কোনও আপত্তিও করল না। অগত্যা আমি চুপ করে রইলাম।

ঠিক হল, পরের বৃহস্পতিবার যাওয়া হবে। ট্রেনে। আমরা চারজন খুলনা থেকে উঠবো। আসাদ ও লিজা যশোর থেকে উঠবে। ওরা নড়াইলে থাকে। ত্রাণ সামগ্রী আমাদের চাহিদা মোতাবেক সিরাজগঞ্জেই প্যাক হবে। তৈরি থাকবে ট্রলারে কাজিপুর যমুনা ঘাটে। বৃহস্পতিবার রাতে আমরা কাজি পুররেস্ট হাউজে থেকে শুক্রবার সকালে স্পীড বোটে যমুনা পাড়ি দিয়ে যাব কান্তপুর গ্রামে। ওখানকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান লতিফ ভাইয়ের আত্মীয়। সে ত্রাণ বিতরণে সার্বিক সহযোগিতা করবেন।
সব ঠিকঠাক মতই এগুচ্ছে। সময় এগিয়ে আসে যাত্রার। জীবনে এই প্রথম বানভাসি মানুষের কাছে যাচ্ছি। অথচ আমার ভেতর উৎসাহের চেয়ে অস্বস্তি হচ্ছে বেশী। লিজা নামের কাঁটা বিঁধে আছে বিবেকের ভেতর। ছোট ভাই সমতুল্য বন্ধুদের কাছে লিজার ব্যাপারে বেশী কিছু জানতে চাওয়াও অশোভন দেখায়। আবার নিজের নাম উইথড্র করব, সে উপায়ও নাই। আবার ভাবি, মন্দ কী? ইংল্যান্ডের রাস্তায় দেখেছি, ছেলে মেয়ে পুলিশ জোড়ায় জোড়ায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়ায়। গল্প করতে করতে, হাসি ঠাট্টায় ওদের সময়টা বেশ কেটে যায়। মেয়েরা এখন পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে, প্লেন চালায়, নভোচারী হয়ে রকেটে চড়ে পুরুষের সাথে চাঁদে যায়। সেখানে একটি মেয়ে আমাদের সাথে বন্যা দুর্গত এলাকায় গেলে ক্ষতি কী? নিজের সংকীর্ণ মানসিকতার জন্য নিজেই লজ্জা পেলাম। বরং লিজার এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য তার প্রতি এক ধরণের সমীহ ভাব চলে এলো।

বৃহস্পতিবার সকালে আমরা চারজন খুলনা ঢাকা চিত্রা এক্সপ্রেসে উঠলাম। বাথে শুধু আমরা চারজন। চিত্রা এক্সপ্রেস বাংলাদেশ রেলওয়ের ঐতিহ্য বজায় রেখে যথারীতি প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ল। চিত্রাকে আন্তঃনগর এক্সপ্রেস কেন বলে কে জানে? সে তো সব টার্মিনালেই থামে! যেন এক কম্যুটার ট্রেনে চড়েছি। খুলনা থেকে যশোরের ট্রেন দূরত্ব বড়জোর চল্লিশ কিলোমিটার। মৈত্রীর পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। এর চেয়ে সাইকেলেও তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। অথচ একটুখানি দেশ তাইওয়ানে তিনশ কিলোমিটার বুলেট ট্রেনে পাড়ি দিয়েছি দুই ঘণ্টায়। একটা দেশের উন্নতি তার যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। আমরা দেশকে ডিজিটাল বানাচ্ছি। হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক তুলে দিচ্ছি। সাথে সাথে দিচ্ছি রাস্তায় অফুরন্ত অলস সময়, যাতে যাত্রীরা ফেসবুকে, ইন্টারনেটে সময় কাটাতে পারে। আক্ষরিক অর্থেই ডিজিটাল বাংলাদেশ। অথচ প্রতিদিন কত লক্ষ কর্ম ঘণ্টা যে রাস্তায় অপচয় হয়, তার হিসাব কি কেউ রাখে?

চিত্রা যশোরে পৌঁছাতেই ফরহাদ বলল, ভাই, যাই, লিজাকে নিয়ে আসি। ফরহাদের এই অতি উৎসাহ দেখে আমার গা জ্বলে গেল। লিজা যেন মহারানী যোধাবাই। সম্রাট আকবর নিজেই যাচ্ছেন তাকে বরণ করে আনতে। তবে অস্বীকার করব না, লিজাকে দেখার জন্য আমার ভেতরেও এক ধরণের গোপন আগ্রহ তৈরি হয়ে আছে। শত হলেও পুরুষ মানুষ তো! হলাম না হয় ষাটের বুড়ো!

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফরহাদ ফিরে এলো। মুখে যুদ্ধজয়ী হাসি। পিছে পিছে দুজন ছেলে ঢোকে। ছেলে না বলে দুজন মধ্যবয়সী পুরুষ বলাই ভাল। চল্লিশের উপরে বয়স। দুজনেরই মেদহীন সুঠাম শরীর। আমার চোখ লিজার অপেক্ষায়। ইতিমধ্যে চিত্রা আড়মোড়া ভেঙ্গে চলতে শুরু করেছে। তাহলে কী লিজা ট্রেন মিস করল? আমার বুকের এক কোণে কিছুটা আশাভঙ্গের মেঘ জমতে শুরু করে। হতাশ চোখে তাকিয়ে দেখি, ছেলে দুটো বাকি সবার পরিচিত। ফরহাদই আমার পরিচয় দিলো ওদেরকে। প্রথম জন হাত মিলিয়ে বলল, আমি আসাদ। আর দ্বিতীয় জন হাত মিলিয়ে যেই বলল, আমি লিজা, অমনি আমার কয়েকটা হার্ট বিট মিস হয়ে গেল। এমন চমক বহুদিন পাইনি। অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, মানে?

হোহো করে হেসে উঠল সবাই। বুঝলাম, সবাই আমাকে ইচ্ছে করেই অন্ধকারে রেখেছে। এমন বেকুব হইনি জীবনে। রেগেমেগে বললাম, তোরা আমাকে আগে বলিসনি কেন? ফরহাদ ক্যাবলাকান্ত হাসি দিয়ে বলল, ভাই, আপনে তো জানতে চাননি, ও ছেলে না মেয়ে? যা জানতে চাইছেন, সবই তো বলছি। আমার রাগ তখনও পড়ে না। লিজাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ছেলে, তোমার নাম লিজা রাখছে কে? ভাইয়া, আব্বা। আমার বড় বোনের নাম লিপি, আর আমার নাম লিজা। লিজার জবাব শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কেউ তার ছেলের নাম লিজা রাখে, বাপের জন্মে শুনিনি। ফরহাদ বলল, ভাই, ওর ভাল নাম নাজমুল হাসান। তবে ও নিজেকে লিজা বা লিজা হাসান বলে পরিচয় দেয়। আমি লিজার দিকে তাকালাম, দারুণ হ্যান্ডসাম। চওড়া বুকের পাটা। বোধহয় ব্যায়াম ট্যায়াম করে। মুখটায় সারাক্ষণ হাসি ঝুলিয়ে রাখে। আমার ভাল লেগে গেল। বললাম, নিজেকে মেয়েদের নামে পরিচয় দিতে তোমার খারাপ লাগে না?

এক গাল অমায়িক হেসে বলল লিজা, না ভাইয়া। বরং ভালই লাগে। জীবনের জটিলতায় মানুষ হাসতে ভুলে গেছে, অবাক হতে ভুলে গেছে। আমার নাম শুনে সবাই যখন অবাক হয়, সে অবাক মুখ দেখতে খুব ভাল লাগে আমার। ছেলেটা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর তার বাচনভঙ্গি। আরও সুন্দর তার জীবন বোধ। ছেলেটাকে আমার মনে ধরে গেল। হঠাৎ খেয়াল করি, লিজার কাঁধে ঢাউস এক ক্যামেরা ঝোলানো। জানতে চাইলাম, তুমি ফটোগ্রাফিও করো নাকি?
শুধু ফটোগ্রাফি না ভাই, ও সকল কাজের কাজি। যে কোনও কাজে ও সবার আগে হাজির।
লিজার হয়ে জবাব দিলো ফরহাদ। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, কেন লিজা সব ট্যুরে অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটু পরেই তার প্রমাণও পেয়ে গেলাম। লিজা চলন্ত ব্যাকগ্রাউন্ডে আমাদের ছবি তোল, লিজা চায়ের অর্ডার দিয়ে আয়, লিজা ব্যাগটা নামিয়ে দে। কোনও কাজেই না নেই লিজার। দারুণ উৎসাহে হাসি মুখে করে যায় সব। পথে যেতে যেতে বয়সের ব্যবধান ভুলে আমরা খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে গেলাম। গল্পে, আড্ডায়, হাসি, ঠাট্টায়, আমরা পথের ক্লান্তি ভুলে গেলাম।

বিকেল চারটায় চিত্রা আমাদের সিরাজগঞ্জ মনসুর আলী টার্মিনালে নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে সিএনজিতে ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরে কাজিসপুর উপজেলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। ইউএনও সাহেব আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে কেয়ারটেকার দিয়ে রেস্ট হাউজে পাঠিয়ে দিলেন। রুম বরাদ্দ হবার পর যেই কাপড় চোপড় খুলে ফ্রেস হতে যাব, অমনি লিজার এই এসি বিভ্রাট। এমন একটা ছেলে ভাদ্র মাসের এই ভ্যাপসা গরমে কষ্ট পাবে, মানতে পারছিলাম না। আবার লিজার সাথে বেড শেয়ার করব, তাও ভাবতে পারি না। এমন বিড়ম্বনায় পড়িনি জীবনে। বললাম, তারপরও চলো, দেখি তোমার এসির কিছু করা যায় কিনা।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিজা আমাকে তার রুমে নিয়ে গেল। রিমোট হাতে নিয়ে দেখি, কাজ করছে না। ডিসপ্লে অন্ধকার হয়ে আছে। খুলে দেখি ব্যাটারি নাই। ব্যাটারি কই পাই? নাসিম সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত রেস্ট হাউজ। প্রতি রুমে ফ্লাট স্ক্রিন টিবি। অবাক কাণ্ড হলো, এসির রিমোটে ব্যাটারি না থাকলেও টিভির রিমোটে আছে। সেই ব্যাটারি খুলে এসির রিমোটে লাগাতেই এসি চালু হয়ে গেল। আর আমিও বেড শেয়ার করার বিড়ম্বনার হাত থেকে বেঁচে গেলাম।

সারাবাংলা/এসবিডিই

আফতাব হোসেন ঈদুল ফিতর ২০২৪ গল্প বিড়ম্বনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর