Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কষ্ট


১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:২৬

অনিমেষ ও প্রণবেশ বাল্যবন্ধু। একই গাঁয়ের পাশাপাশি বাড়ি এবং একই স্কুলে পড়াশোনা করেছে। ছাত্র হিসেবে দুজনেই তুখোড়। স্কুলে এক বছর অনিমেষ প্রথম হলে, পরবর্তী বছরে প্রণবেশ। তবে স্কুল জীবনে ক্লাসের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান এই মানিকজোড়ের কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি। এমনকি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, থেকেছে একই ছাত্রাবাসে। তা-ও আবার একই কক্ষে। তবে অনিমেষ পড়েছে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আর প্রণবেশ ইংরেজি সাহিত্যে। শিক্ষাজীবন শেষে অনিমেষ ঢাকাস্থ একটি সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছে। প্রণবেশ হল সরকারি আমলা।

বিজ্ঞাপন

ছোট থেকেই অনিমেষ লেখালিখি করতো। বলতে গেলে লেখালিখি ওর প্রাণ। ছাত্রজীবনে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভিন্ন পত্রিকায় ওর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ ও গল্প লেখায় প্রশংসাও কুড়িয়েছে বেশ। তাই পত্রিকার সম্পাদক একরকম ডেকেই ওর কাছ থেকে লেখা এনে ছাপিয়ে দিতো। তবে সংসারক্ষেত্রের ভারে পেশাদার লেখক হয়ে উঠতে পারেনি। ধনী পরিবার থেকে আসা বউ—চাহিদাও থাকে বেশ। নিত্যদিনে বউয়ের বহুধা বাজার ও এটাসেটা বায়না মেটানো, ছেলের পড়াশোনার খরচ চালানো, তার উপর বাড়িতে থাকা গরিব বাবা-মায়ের কাছে কিছু হাতখরচ পাঠানো—এসব করতে করতেই মাসিক বেতন প্রায় শেষ হয়ে যায়। তবে দুটো ছাত্র পড়ানো এবং বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালিখি থেকে যৎসামান্য যে অর্থ আসে তা দিয়ে সংসার নামক বস্তুটিকে ধরে রাখতে পেরেছে বেশ। সংসারাশ্রমে থেকেও ওর বেশ ক’খানা গল্প ও উপন্যাসের বই বেরিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রণবেশ নিজে তেমন লেখালিখি না করলেও ভীষণ বইপোকা ও বইয়ের কড়া সমালোচক। তাই অনিমেষ যেকোনও লেখা প্রকাশ করার আগে ওকে দেখিয়ে নেয়। ছোটো থেকেই বই পড়া ও বই কেনা ওর ভীষণ নেশা। বউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় প্রণবেশ কোথায় রে? উত্তর আসে—
দ্যাখ-গে! হয় নীলক্ষেত বইয়ের দোকানে, না হয় শাহাবাগ জাতীয় গ্রন্থাগারে।
প্রণবেশের একটি অনন্যসাধারণ অভ্যাস— কোনও নতুন বই হাতে পেলে নাকের কাছে নিয়ে প্রথমে তার গন্ধ শোঁকে, পরে সূচিপত্র, বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা ও ভেতরের কয়েক পৃষ্ঠা ওলটায়ে দেখে নেয়। এ থেকেই মোটামুটি বলতে পারে বইটি কেমন হবে। বইপোকা না হলে এমন ধারণা বোধ করি অনেকেরই থাকে না।
প্রণবেশ লক্ষ করল, বেশ কিছুদিন হলো অনিমেষ কোনও লেখাই পাঠাচ্ছে না। তাই হঠাৎ একদিন বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠল। দেখল, মেঝেতে বইপত্র এদিক-সেদিক ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। জিজ্ঞেস করল, বইগুলো এমন অগোছালো অবস্থায় রেখেছিস কেন? দেখে তো মনে হয় মাইকেল মধুসূদন হয়ে গেছিস!
হুম্, কোথায় আগরতলা আর কোথায় চৌকিরতলা!
বাসার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে, কারও কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
হ্যাঁ-রে, প্রমিলা বৌদি কোথায়? দেখছি না যে! তোর ছেলে চট্টগ্রামে কেমন আছে? শুনেছি নাকি ওখানে সবাই আতব চালের ভাত খায়। ওর খাওয়া-দাওয়ায় কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো? —এভাবে প্রণবেশ প্রশ্নবান ও সংশয়াত্মক বাক্যালাপ করেই যাচ্ছে, কিন্তু অনিমেষ নিশ্চুপ।
কী হল, বল!
বউ চট্টগ্রাম চলে গেছে। এখন থেকে ছেলের কাছেই থাকবে। যাওয়ার সময় বলে গেছে আর ফিরবে না!
বিষাদী জবাব শুনে প্রণবেশের মন আঁতকে উঠল। বলল, ওমা! বলছিস কী? এত্তবড়ো বাসা, একা একা… পরক্ষণে ভাবলো, অনিমেষ বরাবরই একটু নিশ্চুপ, বন্ধুবৎসল ও শান্ত স্বভাবের। কম কথা বলে, তবে লেখায় ফুলঝুরি ফোটে। অবসরি মানুষ সারাদিন বাসায় শুধুই লেখালিখি বই অন্য কিচ্ছুটি করে না। নিশ্চয়ই বউয়ের সাথে কিছু একটা ঘটেছে! আবার এটাও সত্যি— অর্ন্তমুখ ও শান্ত স্বভাবের মানুষ একবার ক্ষেপে গেলে অনর্থ কিছু একটা ঘটনা ঘটিয়েও ফেলতে পারে। বলল,
বুড়ো বয়সে বউয়ের সাথে ঝগড়াঝাটি করেছিস বুঝি?
না।
একথা বলেই অনিমেষ রসুইঘরে চলে গেল। প্রণবেশ ড্রইংরুম থেকে দেখছে— একটি ছোট্ট ডেকচিতে এক গ্লাস পানি ঢেলে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে দিলো। পরে চারিদিকে কী-যেন খুঁজছে, আর বিড়বিড় করছে। অবশেষে দু-কাপ কফি বানিয়ে প্রণবেশের পাশে বসে বলল,
আজ তোকে তেমন কিছু খাওয়াতে পারলাম নারে— এটা দিয়েই সেরে নে।
কফিতে চুমুক দিয়ে প্রণবেশ জিজ্ঞেস করল,
তোর লেখালিখি কেমন চলছে?
না! আর লিখব না।
কেন?
এতদিনের প্রাণাধীশ সাধনা এভাবেই ধ্বংস করে দিবি!
নয়তো কী!
জানিস, ছেলে মোটা অঙ্কের চাকরি করে। প্রমিলা আজ ছেলের টাকায় গরীয়সী। তাই বিভিন্ন ফরমায়েশে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তা না হলে ওমন কথা বলতে পারত, ‘লেখা দিয়ে কী পেট ভরে?’ —এ কথা বলে অনিমেষ চোখের জল ছেড়ে দিলো আর কপোল বেয়ে ঝরছে কষ্টের জলধারা।
ভেঙে পড়িস না বন্ধু! ওই যে রবি ঠাকুর বলেছেন, “সংসারের কোনও কাজেই যে হতভাগ্যের বুদ্ধি খেলে না, সে নিশ্চয়ই ভাল বই লিখিবে”। তুইও ভাল বই লিখতে পারবি। মিলিয়ে নিস—আজকের অবজ্ঞা একদিন ভালবাসার চরম মূল্য নিয়ে তোর কাছে ধরা দেবে।
অনিমেষ বরাবরই গুরুদেবের ভক্ত। প্রণবেশের কথা মনে লেগেছে। আবার লিখতে শুরু করল। মানুষ কিছু কষ্ট চোখের জল দিয়ে ঝরায়, কিছু কষ্ট মেজাজ দিয়ে প্রকাশ করে, কিছু কষ্ট হৃদয়ের মাঝে শুকিয়ে মরে— এমনই সমাজে ছড়ানোছিটানো কিছু কষ্ট নিয়ে লিখে ফেলল কালজয়ী উপন্যাস-‘কষ্ট’।
প্রণবেশ উপন্যাসটির উপর ছবি-সহ একটি বুক-রিভিউ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিলো। শুধু এতেই থেমে থাকেনি বিটিভির ‘শিল্পবাড়ি’ সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানে অনিমেষের একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রচারেরও ব্যবস্থা করল।
প্রমিলার বরাবরের একটা অভ্যাস—সন্ধ্যার পর টিভি দেখা। টিভি অন করতেই চোখে পড়ল অনিমেষের ছবি। এটা দেখেই ছেলেকে ডাকল—
খোকা! তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। তোর বাবাকে টিভিতে দেখা যাচ্ছে।
অনিরুদ্ধ, ডাকনাম খোকা দৌড়ে ড্রইংরুমে এসে বাবার সাক্ষাৎকারটি মনোযোগ দিয়ে শুনলো। অনুষ্ঠান শেষে মাথা নিচু করে টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছতে মুছিতে বলল—এমন বাবার জন্য আমি আজ গর্বিত!
একথা শুনে প্রমিলা বলে উঠল- কী এমন করেছে শুনি! টিভিতে উঠেছে বলেই এমন কথা বলছিস?
মা, ও তুমি বুঝবে না। শিল্পবাড়ি অনুষ্ঠানে যাঁরা আসেন বা যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় তারা অত্যন্ত বিদগ্ধজন, গুণী ও অপরিমেয় সাহিত্যরসের অধিকারী। মা, তুমি যেমন আমার কাছে স্নেহময়ী, তেমনি বাবাও আমার কাছে আরাধ্য দেবতা। আজ তোমাকে একটি মনের কথা বলি- বাবার বাকি জীবনে তুমি একটু সময় দাও, সারথী হও।
ছেলে অমন কথা শুনে প্রমিলা নিঃসন্ধিগ্ধ চিত্তে ড্রইংরুম থেকে নিজের ঘরে চলে গেল। বিছানায় শুয়ে ভাবছে— সত্যিই তো! ওকে সারাটা জীবন কতই না কষ্ট দিয়েছি কেবল নিজের হাউস-আহ্লাদ মেটাতে। পারব না, কোনওদিন মুখফুটে একথা বলেনি। বিনিময়ে ওর প্রাণাধীশ সাধনায় কোনও সহযোগিতা করেছি? না, দেইনি কখনও! পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অনিরুদ্ধকে বলল—
চলতো খোকা, আমার সাথে বই মার্কেটে।
কেন? হঠাৎ এ প্রস্তাব!
না, তোর বাবার পছন্দের কিছু বই কিনব। আমি তো তেমন বুঝি না, তুই তো জানিস— তোর বাবার কোন কোন বই পছন্দ। কোন বই কিনলে খুব খুশি হবে।
আজ ছুটির দিন, চল যাই!
চট্টগ্রাম থেকে প্রণবেষের পছন্দের অনেকগুলো বই কিনে পরদিনই প্রমিলা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো; সাথে অনিরুদ্ধ। বিকেল পাঁচটার দিকে ঢাকায় পৌঁছে বাসার কলিংবেল টিপতে থাকল। কিন্তু দরজা খুলছে না। ভাবল, দুপুরের খাবারের পর ওর একটু ঘুমানোর অভ্যাস, তাই বোধ করি টের পাচ্ছে না। মুঠোফোনে কল করলে হয়তো ধরবে। কিন্তু তাও কোনও কাজ হচ্ছে না। কী করা যায়! অগত্যা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে— অনিমেষ বিছানায় বসে টেবিলে হাতের ওপর মাথা রেখে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। প্রমিলা অনিমেষের একেবারে কাছে গিয়ে বলল,
কী হলো! এতবার কলিংবেল দিলাম, ফোন করলাম তা-ও ধরছো না। তাছাড়া এভাবে কি কেউ ঘুমায়! বিছানায় শুয়ে ঘুমালেই তো পারতে।
এই বলে হাত ধরে নাড়া দিতেই নিথর দেহখানি বিছানায় ঢলে পড়ল। আত্মপীড়নে চিৎকার দিয়ে উঠল প্রমিলা!
একী সর্বনাশ হলো আমার! খোকা এদিকে আয়…

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর ২০২৪ কষ্ট গল্প তপন দেবনাথ

বিজ্ঞাপন

‘উইকড’ ও ‘রেড ওয়ান’ একই দিনে
২১ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর