Tuesday 03 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অন্য এক আঁধার (চতুর্থ পর্ব)


১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:১৫ | আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৫৮

। সাত।

মাসুম সুমির ফুপাত ভাই।
আপন না; দূর-সম্পর্কের।
তবে মাসুমের মাকে সে নিজের ফুপুই ভাবতো।

স্কুলে যাওয়া আসার পথে প্রায় প্রতিদিন দেখা করতো তার সঙ্গে। অদ্ভুত এক মায়া মাখানো ছিল মানুষটার মুখে। কেমন করে যেন কথা বলতেন। প্রাণটা জুড়িয়ে যেত। মনে হতো রূপকথার গল্প বলছেন। আর পরম মমতায় কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য এক জগতে। মানুষটার বয়স তখন সবে পঞ্চাশের এদিক ওদিক। কিন্তু দেখে মনে হতো সত্তরের কাছাকাছি। এর কারণ ছিল অনেকগুলো। রোগ, শোক, অশান্তি, দুশ্চিন্তা, অভাব-অনটন ইত্যদি।
মাসুমের মায়ের বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে। কিন্তু সুখ হয়নি। কারণ, স্বামীকে তিনি কোনও সন্তান দিতে পারছিলেন না। কত চেষ্টা! কত চিকিৎসা! কিন্তু কিছুতেই সুফল মিলছিলো না। এরপর অনেকটা অলৌকিকভাবে যখন তিনি মা হতে পারলেন, জানা গেল তার স্বামী প্রেমে পড়েছেন অন্য এক মহিলার। তবে তখনও জানতে পারেননি সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে আছে। যে পর্যায়েই থাকুক, স্ত্রীর পেটে সন্তান আসার খবরে তিনি সব পিছুটান ভুলে সংসারে মনোযোগ দেবেন- এমন বিশ্বাস ছিল সবার।

একদিন সেই মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে ওঠেন মাসুমের বাবা। জানা যায়, তারা বিয়ে করে ফেলেছেন। মাসুমের মা তখন বজ্রাহতের মতো বসে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর এক কাপড়ে চলে আসেন বাবার বাড়ি। যদিও বাড়িটা তখন বাবার নেই। হয়ে গেছে ভাইদের। আর ভাইদের বাড়িতে শ্বশুরবাড়ি-ফেরত বোনরা কতটা মানসিক নির্যাতন ভোগ করে, তা ভুক্তভোগী প্রতিটা বোনের জানা। মাসুমের মাও জানলেন, মানলেন এবং মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন।
সময় গড়ালো।
মাসুমের জন্ম হলো।
আর মা লিপ্ত হলেন নতুন সংগ্রামে।
যে সংগ্রাম অস্তিত্ব রক্ষার।
এরপর সময় আরও গড়ালো। মাসুমের প্রেমে পড়ল সুমি। আড়ালে-আবডালে এই প্রেম চললো প্রায় সাত বছর। মাসুম ভার্সিটিতে চান্স পেলো। আর সুমি উঠলো কলেজে। তারপর একদিন মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল তাদের প্রেমের কথা। পাড়া-প্রতিবেশীরা পরামর্শ দিলো দুজনকে যেন এক করে দেওয়া হয় বিয়ের মাধ্যমে। কিন্তু সুমির বাবা সাফ জানিয়ে দিলেন- যে ছেলে তালাকপ্রাপ্তা মাকে নিয়ে মামার বাড়িতে থাকে, তার কাছে তিনি মেয়ে বিয়ে দেবেন না।

বিজ্ঞাপন

এর কিছুদিন পরেই আচমকা মারা যান মাসুমের মা। তার দাফন-কাফন হয়। মাসুমের উপস্থিতিতেই হয়। প্রতিটা কাজে সে মামাদের সঙ্গে থাকে, তাদের সহায়তা করে। কথাবার্তাও স্বাভাবিকই বলে। কিন্তু গুনেগুনে এর চারদিন পর লাপাত্তা হয়ে যায় সে। মামারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। কিন্তু নিশ্বাসটা তারা জোরে ফেলেন না। যদি লোকজন শুনে ফেলে! শত হলেও আপন ভাগ্নে। আপন ভাগ্নের নিখোঁজ হওয়ার খবরে সজোরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে লোকে কী বলবে?

লোকের বলাবলির ভয়ে বিভিন্ন জায়গায় মাসুমকে খোঁজাখুঁজিও করেন মামারা। বিশেষ করে তার ইউনিভার্সিটিতে, আবাসিক হলে। কিন্তু কোথাও পান না। সেই না পাওয়ার বয়স এখন হয়ে গেছে ছয় বছর। আর সুমির বিয়ের বয়স দুই বছর হয় হয়। মাসুম এখন তার কাছে কেবলই বিবর্ণ অতীত। সে চেষ্টা করে সেই অতীতের দিকে ফিরে না তাকাতে। তবু কীভাবে কীভাবে যেন তাকানো হয়ে যায়। তবে তার ভাগ্য ভাল- রনি এব্যাপারে কিছুই জানে না।
গতরাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি সুমি। কারণ, সেই বিবর্ণ অতীত বেদনার নীল রঙে সজ্জিত হয়ে বারবার ভেসে উঠেছে তার চোখে। পুরোটা রাত অস্থির রেখেছে তাকে। অথচ তার পাশে শুয়েই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে রনি। জানতে পারেনি কতটা যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সে। সুমি একবার ভেবেছিল বারান্দায় যাবে। আকাশ দেখবে। অথবা বসে থাকবে অকারণ। কিন্তু রনির ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে যেতে পারেনি। যেতে পারেনি এমনসব প্রশ্নের ভয়ে- ঘুমাচ্ছো না যে? কোনও সমস্যা?

এখন সকাল সাড়ে দশটা। রনি অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় আগে। যাওয়ার সময় বলে গেছে- রাস্তার দিকে খেয়াল রাখবে। আর আমি দারোয়ানকেও বলবো যাতে খেয়াল রাখে। ছেলেটাকে দেখামাত্র যাতে আমাকে ফোন দেয়। তুমিও একই কাজ করবে। যদি দেখো রিসিভ করছি না, আবার ফোন দেবে। আজ কিন্তু তাকে ছাড়া যাবে না। এলাকার লোকজন দিয়ে হোক আর পুলিশ দিয়েই হোক; ধরাতেই হবে। তারপর বোঝাবো কত ধানে কত চাল।
সুমি সাধারণত রনি বের হয়ে যাওয়ার পরপরই নাশতা করতে বসে যায়। কিন্তু আজ বসেনি। কারণ, তার খেতে ইচ্ছে করছে না। আর ইচ্ছে না করার কারণ- দোটানা। যে দোটানায় সে ভুগছে রনি বের হয়ে যাওয়ার পর থেকে। তার মন একবার বলছে আরিফকে ফোন দিতে, আবার নিষেধ করছে। তাই সে একবার মোবাইল হাতে নিচ্ছে, আবার রেখে দিচ্ছে। কোনও কোনওবার তো এত জোরে রাখছে, যেন ভেঙে ফেলবে।

বিজ্ঞাপন

আরিফ সুমির পাড়ার ছেলে। সমবয়সী। সম্পর্কে চাচাত ভাই। সুমি তাকে ফোন দিতে চাচ্ছিল মাসুমের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। যেহেতু দুজন একই ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ব্যবধান শুধু বয়সের, শিক্ষাবর্ষের। সুমি আগেও একদিন ফোন দিয়েছিল আরিফকে। জিজ্ঞেস করেছিল মাসুমের কথা। সে বলছিল- আমার কাছে কোনও খবর নেই। যদি কোনওদিন কোনও খবর পাই, আমি নিজ থেকেই তোকে দেবো। তোর ফোন করতে হবে না।

সুমি জানে, আরিফের কাছে আজও কোনও খবর নেই। তাই তাকে ফোন দিতে তার এত দ্বিধা, এত দোটানা। কিন্তু মনকে যে শান্ত করবে, সেই উপায়ও তো নেই। তাহলে? সুমি কিছুক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তা করে। তারপর ফোন দিয়ে বসে আরিফকে। রিসিভও হয়। আরিফ জানতে চায় সে কেমন আছে। ভাল আছে কি না। সুমি নীরব থাকে। এরপর আরিফও নীরব হলে সে বলে- তোর মাসুম ভাইয়ের কি কোনও খবর আছে?
: তোকে কিন্তু আমি বলেছিলাম, খবর পেলে আমিই ফোন করবো।
: যা বলেছিলি, সব মনে আছে। কোনওটাই ভুলিনি। তবু জানতে চাচ্ছি…
: সুমি, তোকে কিন্তু আমি আগেও বলেছি, ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর মাসুম ভাইয়ের সাথে আমার মাত্র একবার দেখা হয়েছে। সেটাও উনি নিখোঁজ হওয়ার আগে।
: তোর কি ধারণা সে বিদেশ-টিদেশ চলে গেছে?
: কোনও ধারণা নেই। আচ্ছা সুমি, যে চ্যাপ্টারটা আরও অনেক আগেই ক্লোজ হয়ে গেছে, কেন তুই সেটা আবার খুলতে চাচ্ছিস? জানিস এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে?
: আমি খুলতে চাচ্ছি না। খুলতে চাচ্ছে সে-ই।
: কী আবোল-তাবোল বকছিস? এইমাত্র জানতে চাইলি উনি বিদেশে চলে গেছেন কি না, এখন আবার বলছিস…ধ্যৎ, এই প্রসঙ্গ বাদ দে তো! অন্যকোনও কথা থাকলে বল।
সুমি অন্যকোনও প্রসঙ্গে যায় না। মাসুমের কথাই বলতে থাকে। আর বলে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। সেই সঙ্গে সন্দেহ প্রকাশ করে, তার পেছনে লাগা ছেলেটা মাসুমের পক্ষেরই কেউ। এবার আরিফ গালি দেয় সুমিকে। বলে- মাসুম ভাই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর তুই অন্য কারো সঙ্গে লাইন মেরেছিলি কিনা মনে করে দেখ। অবশ্যই মেরেছিলি। আর এই ছেলে ওই পক্ষেরই কেউ হবে। আবার সে নিজেও হতে পারে। তুই বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখেছিস তো! এই জন্য চিনতে পারিসনি। কাছ থেকে দেখলে চিনে যাবি।

আরিফের গালি এবং আপত্তিকর কথা শুনেও কিছু মনে করে না সুমি। সে মোবাইলটা ডান কান থেকে বাম কানে নিয়ে বলে- আমি জানি, যেসব ঘটনা ঘটছে, এগুলোর সঙ্গে মাসুমের কোনও সম্পর্ক নেই। থাকতে পারে না। হয়তো এমনও হতে পারে, সে দুনিয়াতেই নেই। আত্মহত্যা করেছে। তবু কেন তার নামটাই বারবার মাথায় আসছে, বলতে পারিস?
ইন্টারকম বেজে ওঠে। সুমির মনে হয়, ফোনটা দারোয়ান দিয়েছে। অবশ্যই বিশেষ কোনও খবর দেওয়ার জন্য। তাই সে মোবাইলটা রেখে দৌড় দেয় ইন্টারকমের দিকে।

। আট।

সুমি রিসিভার কানে তোলে।
তবে ‘হ্যালো’ বলার সুযোগ পায় না।
কারণ, এর আগেই দারোয়ান বলে ওঠে- সব্বনাশ হইয়া গেছে ম্যাডাম।

সুমি ভয়ার্ত গলায় জানতে চায় কী হয়েছে। দারোয়ান তাকে নিচে নামতে বলে। আর বলে, নামলেই জানা যাবে। সুমি এবার রেগে যায়। বলে, নামা না-নামা পরের ব্যাপার। আগে তাকে যেন জানানো হয় কী হয়েছে। দারোয়ান ফিসফিসিয়ে বলে- ম্যাডাম, ওই পোলাডারে কুত্তার মতন পিডানি হইছে। বাঁচবো বইলা মনে হয় না। যদি না বাঁচে ম্যাডাম, তাইলে কিন্তু আপনেরাও বাঁচবেন না। আমার খুব ভয় করতাছে ম্যাডাম। আপনের একটু নামতেই হইবো।

সুমি কোনওমতে রাখে রিসিভারটা। তারপর দরজা খোলে যন্ত্রের মতো। আর একদৌড়ে চলে যায় দারোয়ানের কাছে। জানতে চায় ছেলেটা কোথায়। দারোয়ান বলে- হাসপাতালে নিয়া গেছে। তবে বাঁচার সম্ভাবনা কম ম্যাডাম। নাক-মুখ দিয়া যেইভাবে রক্ত বাইর হইতেছিল, কী আর বলমু। আমার তো ম্যাডাম সাহস কম না। সাহস কম হইলে কি আর দারোয়ানের চাকরি করতে পারতাম? তারপরেও রক্ত দেইখা ভয় পাইয়া গেছি। বোঝেন তাইলে কী পরিমাণ রক্ত পড়তেছিল!
: কীভাবে কী হয়েছে, আমি বিস্তারিত শুনতে চাই। তাড়াতাড়ি বলেন।
: আমি এই টুলে বইসা মোবাইল টিপাটিপি করতেছিলাম। এমন সময় একটা হইচইয়ের শব্দ কানে আসলো। আমি পকেটগেইট খুইলা দেখি একটা লোক ওই পোলাডারে দৌড়াইতাছে। তার পিছনে আরও কিছু লোক। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই হাওয়া হইয়া গেল।
: মানে?
: ছিল রোডের উপ্রে, ঢুইকা গেল গলির ভিত্রে। তবে কাউরে তখন দেখা না গেলেও হাঙ্গামা শোনা যাইতেছিল। চিল্লাপাল্লা শোনা যাইতেছিল। এর মধ্যে বহু লোক জমা হইয়া গেল। সবাই চিল্লাপাল্লার আওয়াজ শুইনা-ই আসছিল। কিন্তু আপনে ক্যান শোনেন নাই, সেইটাই তো বুঝতে পারতেছি না। নাকি শুনছিলেন?
: না। আমি ফোনে কথা বলছিলাম।
: ও আইচ্ছা। তবে ম্যাডাম, চিল্লাপাল্লা শুইনা যারা আসছিল, তারা সবাই কিন্তু এখন নাই। বাসায় চইলা গেছে, যার যার কাজে চইলা গেছে। কারণ, তারা চিন্তা করছে, যদি পোলাডা মারা যায় আর পুলিশ আইসা জেরা করে, তাইলে ঝামেলায় পড়া লাগতে পারে। বোঝেন না, গণধোলাইয়ের বিষয়। আর গণধোলাইয়ে কেডা কেডা অংশ নিছে, তার তো কোনও ঠিক-ঠিকানা নাই। এই জন্য পুলিশ যারে সামনে পাইবো, তারেই মামলায় ঢোকায়া দিতে পারে।
: কোন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে?
: সবচে কাছে যেইটা, এইটাতেই।

সুমি হাসপাতালের নাম জিজ্ঞেস করে। এমন সময় রিকশাসহ গেটের সামনে হাজির হয় সেই রিকশাওয়ালা। সুমি তাকে দেখে এগিয়ে যায়। আর সেও এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে। জানায়, জরুরি কথা আছে। সুমি রিকশাওয়ালাকে নিয়ে ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়ায়। তারপর তার দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাতেই সে বলে- আফা, ঘটনা কী ঘটছে, তা তো মনে হয় শুনছেন। এখন আপনে আমারে বাঁচান আফা। রাগের মাথায় কাজটা কইরা ফালাইছি।
সুমি কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে অনড় চোখে। রিকশাওয়ালা বলে- আমি যাইতেছিলাম এইদিক দিয়াই। আৎকা দেখি ওই পোলাডা। আমি ‘ধর’ ‘ধর’ কইয়া তাড়া দিলাম। তখন পাবলিকে ঠিকই ধইরা ফেললো। তারপরে মাইর আর মাইর। আমি থামানির চেষ্টা করছি আফা। পারি নাই। তয় এখনও সেইভাবে কেউ জানে না পয়লা তাড়াটা যে আমি দিছিলাম। কিন্তু জানতে কতক্ষণ? আর যখন জানবো, তখন তো আমারে ফাঁসিতে ঝোলাইবো আফা।
: আপনি কি জানেন তাকে কোন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে?
: কেয়ার হাসপাতালে।
: জেনে বলছেন তো?
: আফা, আমিই নিছি। আমার রিকশার দিকে তাকাইলেই বুঝবেন। রক্তের দাগ লাইগা আছে।
: চলেন, আমি যাবো।
: কই যাইবেন? হাসপাতালে?
: জি।
: আপনের কি মাথা খারাপ হইছে আফা? ওইখানে গেলে কী অবস্থা হইবো চিন্তা করতে পারতেছেন? আমি যে কত কায়দা কইরা বাইর হইয়া আইছি! ধরা পড়লে খবর আছিল। আর আপনে গেলে ধরা পড়বেনই। ওই পোলাডায়ই আপনেরে ধরায়া দিবো। বোঝেন না কী জন্য, এখন তার সব রাগ তো গিয়া পড়বো আপনের উপরে।

সুমি সতর্ক হয়ে যায়। আর ফোন করে রনিকে। জানায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা। শুনে নির্বাক হয়ে যায় সে। সুমি ব্যাকুল হয়ে জানতে চায় এখন কী হবে। রনি কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকার পর বলে- দেখো, তুমি যতটা টেনশন করছো, ব্যাপারটা কিন্তু তত টেনশন করার মতো না। কারণ, এই ছেলে যে আমাদের বাসার উদ্দেশ্যেই আসতো, এটা এলাকার লোকজন জানে না। তুমি আমি হয়তো জানি। কিন্তু এই জানার মধ্যে ভুলও থাকতে পারে। তুমি যাও তো, বাসায় যাও।
সুমির তড়পানো কমে না। সে বাসায় যেতেও রাজি হয় না। কিন্তু হাসপাতালে যে যাবে, সেই সাহসও পায় না। সে রনিকে বলে তাড়াতাড়ি যেন বাসায় ফেরে। কারণ, তার ভাল লাগছে না। ভয় করছে। এবার রনির গলার স্বর বদলে যায়। সে বলে- তোমার গতিবিধি কিন্তু খুবই সন্দেহজনক। রাস্তা-ঘাটে এই ধরনের ঘটনা রোজ ঘটে। কতজন গণধোলাই খেয়ে মারা যায়! কই, ওইসব ঘটনা শুনে তুমি তো কোনওদিন ভয় পাও না! আজকে ভয় পাওয়ার কারণ কী, খারাপ লাগারই বা কারণ কী?
: তুমি কি তাহলে আমাকে সন্দেহ করছো?
: আমি করতে চাইনি। কিন্তু তোমার কা–কারখানা দেখে না করে পারছি না।
: বিয়ের এতদিন পরে এসে এই কথা?
: এমনভাবে বলছো, যেন আমরা কয়েক যুগ আগে বিয়ে করেছি। শোনো, একসঙ্গে ত্রিশ-চল্লিশ বছর সংসার করলেও সন্দেহ করার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
: বুঝতে পেরেছি। আমার উপরে কোনও কারণে তুমি রেগে আছো।
: জি, আমি রেগে আছি। কারণ, তুমি রাস্তায় নেমে এসেছো। তুমি যদি এই মুহূর্তে বাসায় ফিরে না যাও, তাহলে আরও রেগে যাবো। আর শোনো, প্ল্যান ছিল খালার কাছে যাবো। কিন্তু এখন আর যাচ্ছি না। বাসায়ই চলে আসবো। আসার পথে ছেলেটাকে দেখে আসবো।
এবার স্বস্তি পায় সুমি। সে রিকশাওয়ালাকে আত্মগোপনের পরামর্শ দিয়ে এবং দারোয়ানকে সহজে গেট না খোলার হুকুম দিয়ে উঠে যায় উপরে। আর রনি একটু আগে আগেই বের হয় অফিস থেকে। তারপর সোজা চলে আসে হাসপাতালে। তবে ছেলেটার কাছে যেতে পারে না। কারণ, নার্স জানায় তার অবস্থা আশংকাজনক। এখন কাউকে দেখা করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। কখন এই সুযোগ মিলবে, তাও বলা মুশকিল।

ডাক্তার ছেলেটার স্বজনদের খোঁজেন। কিন্তু পান না। আর তার কাছে এমন কোনও কাগজ-পত্রও পাওয়া যায় না, যার ভিত্তিতে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। রনি একজন ডাক্তারের সঙ্গে একান্তে কথা বলে। জানায় সে মানবিক কারণে ছেলেটাকে দেখতে এসেছে। যেহেতু দুর্ঘটনা তার বাসার পাশেই ঘটেছে। আর বলে- আপনারা কোনও চিন্তা করবেন না। ছেলেটার জ্ঞান ফিরে আসলে দেখবেন সে-ই নিজের নাম, পরিচয়, ঠিকানা জানিয়ে দেবে।
রনি জানতে চায় পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে কি না। ডাক্তার জানান, দেওয়া হয়েছে। এর একটু পরেই পুলিশ আসে। তবে তারাও ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায় না। তাই তাদের চলে যেতে হয়। কিন্তু রনি বসে থাকে। অপেক্ষা করে ছেলেটাকে দেখার জন্য, কথা বলার জন্য। এরমধ্যে কিছু ওষুধও কিনে দেয় সে। ডাক্তারকে বলে- যা লাগে, আমাকে বলবেন। যতক্ষণ তার স্বজনের খোঁজ পাওয়া না যাবে, ততক্ষণ মনে করবেন আমিই স্বজন।
রাত বারোটার দিকে একটা খবর নিয়ে বাসায় ফেরে রনি। ছেলেটার মৃত্যুর খবর।

চলবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই

অন্য এক আঁধার (চতুর্থ পর্ব) ইকবাল খন্দকার ঈদুল ফিতর ২০২৪ উপন্যাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর