অন্য এক আঁধার (ষষ্ঠ পর্ব)
১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১৭
।এগারো।
নতুন বাসায় উঠেছে সুমিরা।
প্রথম দেখায় ভালো লেগে যাওয়ার মতো বাসা।
নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ পাকাপোক্ত।
রনি অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছে বাসা বদলের কথা বলে। আজ চলছে ছুটির তৃতীয় তথা শেষদিন। ইতোমধ্যে সাজানো-গোছানোর সব কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। তাই আজ চলবে শুধু গল্প-গুজব আর বিশ্রাম। একটু আগেই দুপুরের খাবার খেলো সুমিরা। এখন শুয়ে আছে পাশাপাশি। উদ্দেশ্য ঘুমানো না। তবু যদি চোখ লেগে আসে, ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেবে। তারপর সন্ধ্যার একটু আগে বা পরে ঘুরতে চলে যাবে বাইরে। ফিরবে রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের খাবার খেয়ে।
রনির চোখ লেগে আসতে শুরু করে। সে বড়সড় একটা হাই তুলে বলে- মানুষ ভাবে একটা, হয় আরেকটা। আমার চিন্তা-ভাবনা ছিল, পুরো বছরে একদিনও ছুটি নেবো না। একদিনও দেরি করে অফিসে ঢুকবো না, একদিনও আগে আগে অফিস থেকে বের হবো না। অথচ যত অনিয়ম আছে, সব করে ফেলেছি গত কয়েকদিনে। অফিস কামাই দেওয়া, দেরিতে যাওয়া, ছুটির কয়েক ঘণ্টা আগেই বের হয়ে যাওয়া; এককথায় সব।
: তুমি এইসব অনিয়ম কিন্তু ইচ্ছা করে করোনি। অতএব আফসোস করার কিছু নেই। তবু যদি মনে করো তোমার কারণে অফিসের ক্ষতি হয়েছে, পরে একসময় পুষিয়ে দিও।
: তা না হয় করা যাবে। কিন্তু ওই আফসোসটা থেকেই গেলো। তোমাকে কক্সবাজারের কথা বললাম, অথচ যেতে পারলাম না।
: বাদ দাও তো! এই এক আফসোস আর কত করবে?
: আচ্ছা, আপাতত আর করলাম না। এখন বলো বাসাটার নেগেটিভ সাইড কী কী। মানে এতক্ষণ তো প্রশংসা করলে, এবার একটু সমালোচনা করো।
: সমালোচনা করার তেমন কিছু নেই। সবই ভালো। তবে বাসাটা যে টপ ফ্লোরে, এই জিনিসটা আমার তেমন পছন্দ হয়নি।
রনি হেসে বলে- তোমার স্মরণশক্তি তো দেখছি একেবারে মাঠে মারা গেছে। কতবার বললাম টপ ফ্লোরে বাসা নিয়েছি নিরাপত্তার জন্য। একবার তো আমার এই ডিসিশনের প্রশংসাও করলে। অথচ এখন বলছো পছন্দ হয়নি। আচ্ছা, আগের কথা বাদ দিলাম। এখন আবার তোমাকে বিষয়টা বোঝাচ্ছি। মাটি থেকে তৃতীয়তলা কিন্তু খুব একটা উঁচুতে না। তার মানে আগের বাসায় চাইলেই কেউ পাইপ বেয়ে উঠে পড়তে পারতো। কিন্তু এই বাসাটা অষ্টম তলায়। পাইপ কেন, সিঁড়ি বেয়ে উঠলেও খবর হয়ে যাবে।
সুমি বলে- শুধু নিরাপত্তা না, টপ ফ্লোরে থাকার আরও অনেক সুবিধা। ধুলোবালি থাকে না বললেই চলে। মানুষের হইচই তো থাকেই না। নিজের মতো থাকা যায়। চাঁদ দেখা যায়। ফ্যান চালিয়ে কাপড় শুকাতে হয় না; রোদেই শুকানো যায়। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, মাথার উপরেই ছাদ। যখন খুশি তখন চলে যাও, বাসায় বসে চা না খেয়ে ছাদে বসে খাও। আড্ডা দাও, যা খুশি করো। কেউ কোনো বাধা দেবে না।
: এই তো আমার লক্ষ্মী বউ সব বুঝতে পেরেছে। অতএব টপ ফ্লোর নিয়ে ভাবনা, আর না, আর না।
: আপাতত আসলেই কোনো ভাবনা নেই। যেহেতু এখনও গরম সেভাবে পড়েনি। কিন্তু মার্চের পর যখন পুরোদমে গরম পড়বে, তখন কী হবে? বাসা ছেড়ে পালাতে হবে না?
: ও, তাহলে এই কারণে বাসাটা তোমার পছন্দ হয়নি?
: জি। আর কারণটা কিন্তু ফেলনা কোনো কারণ না। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
: কিন্তু আমি যদি সময়মতো ব্যবস্থা নিই?
: কী ব্যবস্থা?
: যাকে বলে কার্যকর ব্যবস্থা। সেটা সময়মতো দেখতে পাবে। অতএব নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।
সুমি সত্যিই টপ ফ্লোর নিয়ে আর কোনো চিন্তা করে না। এরপর সন্ধ্যার দিকে সে ঘুরতে বের হয়ে যায় স্বামীর সঙ্গে। এসময় তাদের মধ্যে কথা হয়, রাত দশটা বাজার আগেই বাসায় ফিরবে। কিন্তু ফিরতে পারে না। কারণ, সিএনজি উল্টে পড়ে তারা দুর্ঘটনার শিকার হয়। আর আহত অবস্থায় দুজনকেই যেতে হয় হাসপাতালে। রনির আঘাত অবশ্য তেমন গুরুতর না। শরীরের দু-এক জায়গার চামড়া ছিলে গেছে কেবল।
গুরুতর আঘাত সুমিরটা। তার বাম হাতের কনুইয়ের উপর লম্বা এবং গভীর ক্ষত হয়েছে। ডাক্তার তাই তাকে ছাড়েননি। রনিকে নির্দেশ দিয়েছেন ভর্তি করাতে। আর বলেছেন- এই মুহূর্তে পেশেন্ট আউট অফ ডেঞ্জার হলেও রিকশা বা সিএনজির ঝাঁকুনিতে আবার ব্লিডিং শুরু হয়ে যেতে পারে। অতএব কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না। রাতটা আমাদের অবজারভেশনে থাকুক। সকাল দশটার দিকে চলে যেতে পারবে।
কেবিনে ঢোকানোর পরপরই লম্বা একটা ঘুম দেয় সুমি। তার এই ঘুম যখন ভাঙে, তখন রাত প্রায় আড়াইটা। সে চোখ খুলে দেখে রনি মাথার কাছে বসে আছে। তার মুখে মমতার হাসি। সে জানতে চায় এখন কেমন লাগছে। সুমি আস্তে করে ‘ভালো’ বলে নিজে নিজেই উঠে বসে। আর খাটের নকশা করা অংশে বালিশ ঠেকায়। তারপর সেই বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বলে- একটা বিষয় তখনও আমি বুঝতে পারিনি, এখনও বুঝতে পারছি না।
: কোনটা?
: তুমি কি আমার হাতের কাটা জায়গাটা দেখেছো?
: দেখবো না কেন? এই তো আমার চোখের সামনেই আছে।
: আরে বাপুরে, এখনকার কথা বলিনি। ব্যান্ডেজ করার আগের কথা বলেছি।
: তুমি তো জানো, আমি রক্ত দেখতে পারি না।
: বুঝতে পেরেছি। দেখোনি। এছাড়া অ্যাক্সিডেন্টটা যেখানে হয়েছে, সেখানে তো আবছা অন্ধকার ছিল। না দেখারই কথা।
: হাসপাতালে পৌঁছানোর পর অন্তত দেখা উচিত ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, আমি রক্ত দেখতে পারি না। ভীতু মানুষ।
: আমি কিন্তু তোমার মতো এত ভীতু না। ব্যান্ডেজ করার আগে কাটা জায়গাটার দিকে বেশ কয়বারই তাকিয়েছি। তখনও আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরেছে, এখনও ঘুরছে।
রনি নড়েচড়ে বসে। জানতে চায় প্রশ্নটা কী। সুমি বলে- একটু মনে করার চেষ্টা করো। আমরা সিএনজি দিয়ে আসছিলাম, আসছিলাম, আসছিলাম। তারপর সিএনজিটা যখন অন্ধকারমতো একটা জায়গায় আসলো, পেছন থেকে কেউ ধাক্কা মারলো। ধাক্কাটা মোটরসাইকেলেরও হতে পারে, লেগুনারও হতে পারে। সিএনজি উল্টে গেলো। আমি মাথায় বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। তোমার তখন কী অবস্থা হয়েছিল জানি না।
রনি জানায়, সেও জোরে বাড়ি খেয়েছিল। তবে পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। শুধু চোখে ঘোলা ঘোলা দেখছিল। সুমি বলে- যেহেতু সিএনজি উল্টে গিয়েছিল, অতএব আমার হাত কাটাটা স্বাভাবিক। রাস্তায় পড়ে থাকা ধারালো কোনো জিনিস দিয়ে কাটতে পারে, সামনের গ্লাস ভেঙে কাটতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে কাটবে কেন? কাটার ধরন দেখেন মনে হয়েছে, ছুরি বা চাপাতি দিয়ে কেউ পোঁচ মেরেছে।
: বলো কী!
: জি। বিষয়টা সন্দেহজনক। আমরা ছিনতাইকারীর কবলে পড়িনি তো?
: কিন্তু আমাদের তো কিছু খোয়া যায়নি। অবশ্য আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসছিল। ছিনতাইকারীরা সুবিধা করতে পারার কথা না। আচ্ছা, আমি কি পুলিশের কাছে যাবো?
: এত রাতে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। আর পুলিশের কাছে গিয়ে লাভই বা কী? এর আগে যখন গিয়েছিলাম, কী বিহেভ করেছিল মনে নেই?
: এই এলাকাটা কিন্তু অন্য থানার অধীনে। আর সব পুলিশ একরকম না।
: তবু একটু চিন্তা করি। আসলে পুলিশের কাছে গেলে কনফার্ম হয়ে যাওয়া উচিত। নইলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নেয় সুমি। তবে রনির কাছে প্রকাশ করে না।
। বারো ।
পরদিন সকাল।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েই রিকশায় উঠে বসে সুমি।
আর চলে যায় দুর্ঘটনাস্থলে।
তার সঙ্গে যায় রনিও। তবে কোনো প্রশ্ন করে না। গভীর কৌতূহল নিয়ে শুধু তাকে দেখে। দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছেই রিকশা থেকে নেমে পড়ে সুমি। আর কী যেন খুঁজতে থাকে হন্যে হয়ে। এবার আর প্রশ্ন না করে পারে না রনি। সে জানতে চায়, কী খুঁজছে। সুমি খুঁজতে খুঁজতেই বলে- আমার তখন জ্ঞান ছিল, নাকি ছিল না, বলতে পারবো না। তবে এইটুকু বলতে পারবো, আমি একটা শব্দ শুনেছি। লোহার কোনো জিনিস ছুড়ে ফেললে যদি সেটা শক্ত কোনো জিনিসে বাড়ি খায়, তাহলে যে শব্দটা হয়, ওই ধরনের শব্দ।
রনি বুঝতে পারে না সুমি কিসের শব্দের কথা বলছে। তাই সেও তার সঙ্গে খোঁজা শুরু করে। আর এলাকার উৎসাহী লোকজন প্রথমে তাদের দূর থেকে দেখে। তারপর এগিয়ে এসে বুঝতে চেষ্টা করে কী খোঁজা হচ্ছে। হঠাৎ চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় সুমির। কারণ সে দেখতে পায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পরিত্যক্ত লোহার বৈদ্যুতিক খুঁটির গোড়ায় একটা রক্তাক্ত চাপাতি পড়ে আছে। যা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় রনিরও।
এরপর চাপাতিটা এলাকাবাসীর নজরে আসতেই হইচই বাধিয়ে দেয় তারা। তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন ফোনও করে ফেলে থানায়। পুলিশ আসে। তারা চাপাতিটা সতর্কতার সঙ্গে থানায় নিয়ে যায়। সসম্মানে নিয়ে যায় সুমিদেরও। ওসি সাহেব মনোযোগ দিয়ে ঘটনার বিবরণ শোনেন। তারপর রনিকে বলেন একটা জিডি যেন করে। আরও বলেন- কাউকে যদি সন্দেহ হয়, অবশ্যই নাম উল্লেখ করবেন। আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবো।
রনি জিডি করে। কিন্তু সন্দেহভাজন হিসেবে কারো নাম উল্লেখ করতে পারে না। সুমির মাথায়ও এমন কোনো ব্যক্তির নাম আসে না, যাকে সন্দেহ করা যায়। রনি তাকে নিয়ে থানা থেকে বের হতে হতে বলে- আমি এখন শিওর, এটা ছিনতাইকারীদেরই কাজ। আমাদের জিনিসপত্র বা টাকা-পয়সা নেয়নি বলে তাদেরকে সন্দেহের বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। যারা পাবলিকের ভয়ে নিজেদের অস্ত্র ফেলে রেখে চলে যেতে পারে, তারা মালামাল নেবে কীভাবে?
: তুমি কিন্তু একদম টেনশন করবে না। বাসায় ফিরেই সুমিকে কথাটা বলে রনি।
: জি?
: বললাম, কোনোরকম টেনশন করা যাবে না, ভয় পাওয়া যাবে না। পুলিশকে খুবই আন্তরিক মনে হয়েছে। অতএব তোমার শরীর থেকে যে রক্ত ঝরিয়েছে, তাকে ধরা পড়তেই হবে। আর সেটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে।
: আচ্ছা, আমরা তো সন্দেহ করার মতো কাউকে পেলাম না। কিন্তু রিকশাওয়ালাকে কি সন্দেহের বাইরে রাখা ঠিক হচ্ছে?
: ধুর! শুধু শুধু গরিব মানুষটাকে সন্দেহ করো না। তোমার উপরে চাপাতি চালিয়ে তার কী লাভ? বলো, কোনো লাভ আছে?
সুমি সত্যিই কোনো লাভ দেখে না। তাই সে নীরব থাকে। এরপর ক্ষতস্থানে ব্যথা শুরু হলে কোঁকাতে কোঁকাতে শুয়ে পড়ে। তবে এর আগে ওষুধ খেয়ে নিতে ভোলে না। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে সুমি। আর রনি ফোন করে দারোয়ানকে। বলে ভালো দেখে একটা কাজের মেয়ে যেন দেয়। আগের বাসারটা কী পরিমাণ ফাঁকিবাজ ছিল; একদিন কাজ করতে আসলে কতদিন আসতো না; তাও বলে। আর বলে- ওইরকম ফাঁকিবাজ যেন না হয়।
দারোয়ানের সঙ্গে কথা শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে আসে রনির। সন্ধ্যার পর তার এই ঘুম ভাঙে মোবাইলের শব্দে। সে ঝাপসা চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফোনদাতার নামটা পড়তেই একটা ঝাঁকুনি খায়। ঝাঁকুনিটা বিস্ময়ের, ভয়ের, কৌতূহলের। রনি সুমির দিকে তাকায়। দেখে তার চোখ ডুবে আছে ঘুমে। সে আশংকা করে, রুমে বসে কথা বললে গভীর এই ঘুমটা ভেঙে যেতে পারে।
রনি তাই মোবাইল নিয়ে চলে যায় বারান্দায়।
আগামীপর্বে সমাপ্য…
সারাবাংলা/এসবিডিই
অন্য এক আঁধার (ষষ্ঠ পর্ব) ইকবাল খন্দকার ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা উপন্যাস