অন্য এক আঁধার (সপ্তম পর্ব)
১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৩২
। তেরো ।
রাত।
ওসি সাহেবের সামনে বসে আছে রিকশাওয়ালা।
তার মধ্যে বেপরোয়া এবং গা-ছাড়া ভাব।
একটু আগেই সে চা-বিস্কুট খেয়েছে। আর এখন পেট হাতাচ্ছে। বোঝাচ্ছে, ক্ষুধা মেটেনি। ভারী কিছু খাওয়া দরকার। এদিকে ওসি সাহেব হাবুডুবু খাচ্ছেন অতল বিস্ময়ে। তিনি না পারছেন তার বলা কথাগুলো বিশ্বাস করতে, না পারছেন অবিশ্বাস করতে। যদিও দীর্ঘ চাকরিজীবনে তাকে বিস্ময়কর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার। তবে এই ঘটনাটা অন্য যেকোনো ঘটনাকে হার মানানোর মতো। তাই তার বিস্ময় কাটছেই না।
রিকশাওয়ালার পেট হাতানো চলমান থাকলে ওসি সাহেব বিরিয়ানির অর্ডার দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসে গরম গরম বিরিয়ানি। রিকশাওয়ালা কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে পরনের লুঙ্গিতে হাত মুছে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবারের উপর। তারপর পেটের একাংশ ভরে গেলে বলে- আপনে হয়তো আমারে হাভাইত্যা মনে করতাছেন। কিন্তু আমি হাভাইত্যা না। অনেকদিন ধইরা পেট ভইরা খাওয়ার সুযোগ পাই না তো! এই জন্য এই অবস্থা। মনের মইধ্যে ভয় থাকলে আসলে খাওয়া যায় না। আজকা থেকে সব ভয় শেষ। এখন যতক্ষণ বাঁইচা আছি, খালি খামু আর খামু।
: কিসের ভয় ছিল?
: এতক্ষণ তাইলে কী বললাম স্যার?
: যা বলেছো, শুনেছি। এখন আবার বলো।
: ও, বুঝতে পারতেছি। আপনে মিলায়া দেখবেন। আগের কথার সাথে এখনকার কথার একটু গরমিল পাইলেই গজারির ডান্ডা চালায়া দিবেন। ঠিক কিনা স্যার?
: তোমাকে যা বলেছি, তা-ই করো। আর বাড়তি কথা কম বলো।
: স্যার, খাওনডা শেষ কইরা লই?
রিকশাওয়ালাকে খাবার শেষ করার সময় দেন ওসি সাহেব। সে আয়েশ করে খায়। আর তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। একবার সরাসরি, একবার চোরাচোখে। এরপর খাবার শেষ হলে রিকশাওয়ালা হাত ধুয়ে এসে আগের জায়গায় বসে বলে- কালামের সাথে আমার পরিচয় অল্পদিনের। প্রথম থেইকাই তার খিয়াল আছিল ধান্ধা, বাটপারির দিকে। আর আমার খিয়াল আছিল হালাল রুজির দিকে। কিন্তু বোঝেন তো, হালাল ইনকাম দিয়া জীবন চালানি কঠিন।
রিকশাওয়ালা বোতলের মুখ খুলে দুই ঢোক পানি খায়। তারপর বোতলটা নিঃশব্দে টেবিলের কোনায় রেখে বলে- আমি টাকার অভাব-অনটনে পড়লে নানানজনের কাছে হাত পাততাম। কালামের কাছেও। আর এই সুযোগে সে আমারে দিয়া খারাপ কাজ করাইতো। তবে আমি সব সময় চেষ্টা করতাম, যদি ওইগুলা না কইরা পারা যায়। যদি রিকশা চালায়া-ই খাওয়া যায়। কয়দিন আয়-রোজগার ভালোই হইছিল
: কালামের সঙ্গে ঝামেলাটা কীভাবে বাধলো, সেটা বলো।
: সে কাজটা পাওয়ার পরে বলছিল, আমি যাতে একটু সাথে-পাছে থাকি। সাহাইয্য-সহযোগিতা করি। আমি তারে কাজটা করতে নিষেধ করলাম। কিন্তু সে আমারে বোঝাইলো, সুমি আফার নাকি চরিত্র খারাপ। নানান লোকের সাথে লাইন। তারেও নাকি বিভিন্ন সময় ইঙ্গিত দিছে। আর যার চরিত্র খারাপ, তার শাস্তি হওয়া দরকার আছে। নাইলে সমাজ নষ্ট হইয়া যাইবো।
: ওরে আমার সমাজওয়ালা!
: আমি প্রথম মনে করলাম, যার চরিত্র খারাপ, তার শাস্তি হইলে ভালোই হয়। আমার বউয়ের চরিত্র খারাপ ছিল তো! এই জন্য মনের মইধ্যে একটা রাগও ছিল। কিন্তু সুমি আফার সাথে যখন কথা বললাম, মনে হইলো মহিলাডা খারাপ না। তারপরেও চিন্তা করলাম একটু যাচাই কইরা দেখি। বাজায়া দেখি। এই জন্য নানান কথা বললাম। নানান কথা জিগাইলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন বুঝলাম সুমি আফার চরিত্রে কোনো ঝামেলা নাই, তখন কালামরে বললাম তার ক্ষতি করার চিন্তা যাতে মাথা থেইকা সাবান দিয়া ধুইয়া পরিষ্কার কইরা ফালায়।
: কালাম তোমার কথা শুনলো না। সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো মহিলার উপর অ্যাটাক করার জন্য। আর তুমি চেষ্টা চালাচ্ছিলে তাকে যেকোনোভাবে থামানোর জন্য। এই তো কাহিনী?
: জি স্যার। জি।
: তারপর বলো।
: যেইদিন সে গণধোলাই খাইলো, এইদিনও তারে অনেক বোঝাইছিলাম। যখন বুঝতেছিল না, তখন গালিগালাজ করছিলাম। সে ক্ষেইপ্যা গেল। হুমকি দিলো, উল্টা আমারেই নাকি ফাঁসায়া দিবো। আমার উঠলো রাগ। দিলাম দৌড়ানি। এলাকার লোকজন আগায়া আসলো। তারপরে ক্যামনে জানি কী হইয়া গেল। তয় সে যে গণধোলাইয়ে মারা যায় নাই, তারে যে হাসপাতালে গলা টিপ্যা মারা হইছে, সেইটা তো বললামই।
: বলেছো, আমার মনেও আছে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। এখন বলো ওইদিন রাতের ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল। আর এর সঙ্গে তুমি কীভাবে জড়ালে।
: স্যার, একবার তো বললাম। আবার বলতে হইবো?
: আগেই কিন্তু বলেছি, আমি দ্বিতীয়বার শুনতে চাই। তাহলে এখন আবার প্রশ্ন কেন?
: এককথা দুইবার বলতে ভালো লাগতাছে না তো! যা-ই হোক, তারপরেও বলি। বিপদে পড়ছি, কী আর করা যাইবো!
রিকশাওয়ালা ঢেঁকুর তোলে। তারপর আস্তে করে একটা গলাখাঁকারি দিয়ে বলে- কালামরে গলা টিপ্যা মারা হইছিল ভয়ে। যদি সে মুখ খুইল্যা দেয়! তয় তারে মাইরাও কিন্তু উনি শান্তি পাইতেছিল না। কারণ, আমি যে পুরা ব্যাপারটা জানি, এইটা উনার জানা আছিল। উনি ভয় পাইতেছিল, যেকোনো সময় আমি পুলিশরে সব বইলা দিতে পারি। এই জন্য লোক লাগাইলো আমারে মাইরা ফেলার জন্য। কিন্তু আমিও তো কম চালাক না। আমি কোনো না কোনোভাবে জাইনা গেলাম, আমারে মারার দায়িত্ব দিছে খোরশেদের উপরে।
ওসি সাহেব জানতে চান রিকশাওয়ালা খোরশেদকে আগে থেকে চিনতো কি না। সে বলে- কালাম কিন্তু স্যার আমারে এই লাইনের অলিগলি সব চিনায়া ফেলছিল। এই জন্য আমি সবাইরেই কম বেশি চিনতাম। কেডা মানুষ মারার ‘কন্টাক’ নেয়, কেডা হাত-পাও কাটার কন্টাক নেয়, কেডা হাত-পাও ভাঙ্গার কন্টাক নেয়; সবাইরেই। যেই কারণে খোরশেদও আমার অপরিচিত আছিল না। আমি চেষ্টা করলাম তার সাথে খাতির করা যায় কি না। পরে জানলাম, সে এত বেশি টাকা পাইছে; খাতিরে-খুতিরে কাজ হইবো না। আমারে মাইরা-ই ছাড়বো।
: এর মধ্যে তুমি জানতে পারলে, কালাম যে কাজটা করতে পারেনি, সেই কাজটাও খোরশেদকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সুমির হাত কাটার কাজ। তারপর?
: আমি সুমি আফারে বিষয়টা জানানির চেষ্টা করলাম। প্রথমে চেষ্টা করছিলাম, সরাসরি যদি দেখা করা যায়। ফেইল মারলাম। তারপরে ফোনে চেষ্টা করলাম। কয়েকবারই চেষ্টা করলাম। একবার দেখি নাম্বার বন্ধ, আবার উনার জামাই রিসিভ করলো, আবার তো রিসিভই হইলো না।
: ওইদিন রাতে যখন খোরশেদ চাপাতি দিয়ে সুমির হাত কেটে ফেলার চেষ্টা করলো, তখন তুমি কোথায়? সত্যিই কি বাসায় ছিলে? নাকি আশপাশে ছিলে? আমার তো মনে হয় আশপাশেই ছিলে। কিন্তু এখন স্বীকার করছো না।
রিকশাওয়ালা বলে- মাইন্ড কইরেন না স্যার। পুলিশের মনের ভিত্রে খালি জিলাপির প্যাঁচ। যদি প্যাঁচ না থাকতো, তাইলে এতকিছুর পরে আপনে আমারে সন্দে করতেন না। কতগুলা সত্য কথা বললাম! তারপরেও যদি জিগান ঘটনার সময় আমি আশপাশে ছিলাম কি না, আবার যদি বলেন আমি মিথ্যা বলতেছি, অস্বীকার করতেছি; তাইলে কেমনডা লাগে? স্যার, আপনে বিশ্বাস করলে করেন, না করলে নাই। তবে এইটাই সত্য, ঘটনার সময় আমি আশেপাশে আছিলাম না। যা শুনছি, মামুনের কাছ থেইকা শুনছি।
ওসি সাহেব জানতে চান, মামুন কে। রিকশাওয়ালা বলে- মামুন কেডা, সেইটা আপনে জানেন। তারপরেও যখন জানতে চাইতাছেন, বলতেছি। যার দোকানের সিসি ক্যামেরায় ঘটনাটা ধরা পড়ছে, খোরশেদের চেহারা ধরা পড়ছে, সে হইলো মামুন। পুলিশ কিন্তু কয়েকবার ওইখানে গেছে। যারে কয় লোক দেখাইন্যা যাওয়া। যদি কাজের যাওয়া যাইতো, তাইলে তারাই খুঁইজা বাইর করতো আশেপাশে সিসি ক্যামেরা আছে কি না, সেই ক্যামেরায় কিছু ধরা পড়ছে কি না।
হঠাৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখায় ওসি সাহেবকে। রিকশাওয়ালা বুঝতে পারে না এই আকস্মিক দুশ্চিন্তার কারণ কী।
। চৌদ্দ।
ওসি সাহেব মোবাইল বের করেন পকেট থেকে।
কাউকে ফোন দিতে চান।
কিন্তু কী মনে করে যেন আবার রেখে দেন।
রিকশাওয়ালা এবার জানতে চায় কোনো সমস্যা কি না। ওসি সাহেব বলেন- আমরা বারো রকমের ঝামেলায় থাকি তো! যে কারণে জরুরি বিষয়ও অনেক সময় মাথায় থাকে না। এই যে মামুন লোকটা, সে কিন্তু রিস্কে আছে। খোরশেদ যেকোনো সময় তাকে মেরে ফেলতে পারে। আমাদের উচিত তাকে নিরাপত্তা দেওয়া। তার কিছু হয়ে গেলে আমরা সেই দায় এড়াতে পারবো না। তুমি একটু বসো, আমি একজনের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতে করতে বাইরে যান ওসি সাহেব। কার সঙ্গে যেন কথা বলেন। তারপর আবার এসে বসেন নিজের চেয়ারে। রিকশাওয়ালা বলে- মামুনের কলিজা বড় আছে স্যার। কেউ তার কিছু করতে পারবো না। তারে আমি ভালো কইরাই চিনি। এই রোডে অনেকদিন রিকশা চালাইছি তো! তবে আপনেরার পক্ষ থেকে তারে একটা পুরস্কার দেওয়া দরকার। অইন্য কেউ হইলে ভয়ে সিসি টিভির ফুটেজ ডিলিট কইরা ফেলতো। আর সে কী সুন্দর কইরা থানায় জমা দিয়া গেলো।
: আমরা নিষেধ না করলে হয়তো ফেসবুকেও দিয়ে দিতো।
: স্যার, ফেসবুকে না দিলেও ওই এলাকার সবাই জাইনা গেছে বিষয়টা। আমি তো জানছি তাদের কাছ থেইকাই।
: যা-ই হোক, আসল কথায় ফিরে যাই। তুমি তাহলে ধরেই নিয়েছো খোরশেদ তোমাকে মেরে ফেলবে?
: জি স্যার। কারণ, সে এখন পাগলা কুত্তা হইয়া গেছে। আমারে না মাইরা নিস্তার হইবো না। এই জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হইলো, বাকি জীবন জেলে থাকা। কারণ, জেল একটা নিরাপদ জায়গা। কিন্তু যারে তারে তো এইখানে থাকতে দিবো না। অপরাধী হইতে হইবো। এই জন্য আমি আমার সব অপরাধ স্বীকার করলাম। আশা করি আমারে জেলে ঢোকাইতে আপনেরা আর কোনো আপত্তি করবেন না। তয় এইখানে বইলা রাখি, অপরাধ কিন্তু আমি আরেকটা করছি। আর সেইটা জেলে ঢোকার জন্য করি নাই। করছি বিবেকের তাগিদে।
ওসি সাহেব জানতে চান অপরাধটা কী। রিকশাওয়ালা বলে না। জানায়, পরে বলবে। ওসি সাহেব আর চাপাচাপি করেন না। তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রথম টান দিয়ে বলেন- আমার কিন্তু সন্দেহ লাগছে। রনি আসছে না কেন? কতবার ফোন দিলাম। শেষ যখন কথা হলো, তখন তো বললো দশ মিনিটের মধ্যে নাকি চলে আসবে। অথচ কত সময় পার হয়ে গেলো! আর এখন তো ফোনটাও বন্ধ করে ফেলেছে। নাহ্, বিষয়টা সন্দেহজনক। সে কি তাহলে কোনোভাবে বুঝে গেলো আমরা যে সব জেনে গেছি?
: স্যার, আমি তারে সব বইলা দিছি।
: কী!
: জি স্যার। আর বলছি, আপনের জায়গা দোজখেও হইবো না। কারণ, আপনে মানুষ না। আপনে জংলী জানোয়ার। আপনের বউ বিয়ার আগে না হয় একটা প্রেম করলোই। ব্লেড দিয়া চামড়া কাইট্টা না হয় প্রেমিকের নাম লেখলোই। তাই বইলা আপনে পাষাণ সিমার হইয়া যাইবেন?
: আমি নিশ্চিত, সে মেন্টাল।
: আরে মেন্টাল মুন্টাল বইলেন না স্যার। সে জংলী জানোয়ার, এইটাই হইলো আসল কথা। স্যার, প্রথম প্রেম করার সময় মানুষ কিন্তু অনেককিছুই কইরা ফালায়। আবেগ বইলা কথা। তো সুমি আফা বাম হাতের কনুইয়ের উপরের চামড়া কাইটা যে ‘মাসুম’ নামটা লেখছিল, এইটা নিয়া কিন্তু উনি খুব ভয়ে থাকতো। কোন সময় জানি রনি দেইখা ফেলে। এই জন্য উনি সবসময় লম্বা হাতার ব্লাউজ পরতো। শাড়ির আঁচল দিয়া হাত ঢাইকা রাখতো। তারপরেও এই জানোয়ার ক্যামনে জানি একদিন এইটা দেইখা ফেলে। তয় কিছু বলে না। গোপনে শুধু খোঁজ নেয় মাসুম লোকটা কেডা।
: সে নাকি মাসুমকেও খুন করার পরিকল্পনা করেছিল।
: জি স্যার। কিন্তু পারে নাই। কারণ, মাসুম নিখোঁজ। এছাড়া মাসুম তো আর তার সাথে থাকতেছে না। তার সাথে থাকতেছে সুমি আফা। এই জন্য এই জানোয়ারের বাচ্চা সিদ্ধান্ত নিলো, উনার হাতটা কাইটা ফেলবো। যাতে উনার শইল্লে মাসুমের আর কোনো স্মৃতি না থাকে, চিহ্ন না থাকে।
: হাত কাটার দায়িত্ব প্রথমেই কালামকে দিয়েছিল নাকি অন্য কাউকেও দিয়েছিল, কে জানে?
: কালাম আমারে যেইটা বলছিল, এই জানোয়ারের বাচ্চা নাকি তার আগেও কাউরে কাউরে দায়িত্ব দিতে চাইছিল। দিছিলও। কিন্তু কাটাইতে পারে নাই। তয় যা-ই বলেন স্যার, এই শুয়োরের বাচ্চার মাথায় কিন্তু বহুত বুদ্ধি।
: এই ধরনের মেন্টালিটির লোকজনের ব্রেইন খুব পরিষ্কার থাকে।
: সে একটার পরে একটা পরিকল্পনা করছে, একটার পরে একটা মিছা কথা কইছে, কিন্তু কেউ বুঝতে পারে নাই। এই যে তার খালার অসুখের বিষয়টা। এইটা একটা ডাহা মিছা কথা। সে এই উসিলায় সেই উসিলায় সুমি আফারে বাসার বাইরে নিতে চাইছে, যাতে রাস্তায় কালাম বা খোরশেদ উনার হাত কাটতে পারে। আবার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিয়া পরেই আবার বদলায়া ফেলছে। যেমন কক্সবাজারে যাওয়ার বিষয়টা। কারণ সে চিন্তা কইরা দেখছে, দূরদূরান্তে গিয়া এইসব কাজ করলে ধরা খাওয়া লাগতে পারে।
: আচ্ছা, কালামের গলা কি রনি নিজে টিপেছিল, নাকি নার্স?
: নিজেই টিপছিল। তয় সুযোগ কইরা দিছিল নার্স। আপনে নার্সের সাথে কথা বললেই সত্য মিথ্যা জানতে পারবেন। আর আমার সাথে কালামের কী কথা হইছিল, রনির কী কথা হইছিল, এইগুলার কলরেকর্ড তো আপনেরে দিলামই। ভাইগ্য ভালো স্যার, বুদ্ধি কইরা রেকর্ড করছিলাম। নাইলে তো আমার কথা বিশ্বাসই করতেন না।
: দুশ্চিন্তা করার কিচ্ছু নেই, তোমার সব কথা আমি বিশ্বাস করেছি। তবে ফাইনাল বিশ্বাসটা করবো খোরশেদ আর রনির বক্তব্য নেওয়ার পর।
: স্যার, একটু আগে মামুনের নিরাপত্তার কথা বলছিলেন না? আমি তো বললাম, সে সাহসী মানুষ। তাছাড়া এলাকায় রাজনীতি করে। তার ভাইও পাঁচ-ছয়টা। সে নিজের নিরাপত্তা নিজেই দিতে পারবো। তয় সুমি আফা কিন্তু খুব ‘রিক্সে’ আছে। যেকোনো সময় যেকোনো বিপদ হইয়া যাইতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে উনার নিরাপত্তা দরকার।
: একটু ওয়েট করো। খোরশেদ ধরা পড়লেই সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মামুনের, তোমার, সুমির। তবে আমি একটা জিনিস ভয় পাচ্ছি।
: কী স্যার?
: কাউকে দিয়ে হাত কাটাতে না পেরে রনি নিজেই সুমির উপর চাপাতি বা দা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো?
: না স্যার, এইটা সম্ভব না।
: আরে সম্ভব। যারা মেন্টাল, তাদের পক্ষে সব সম্ভব। তুমি তাদের ব্যাপারে জানো না। আমার ম্যালা অভিজ্ঞতা।
: স্যার, অইন্য মেন্টালদের দ্বারা কী কী সম্ভব, জানি না। তয় এইটা জানি, এই রনি মিয়ার দ্বারা আর কিছুই সম্ভব না।
: এমনভাবে বলছো, যেন সে দুধ দিয়ে গোসল করে চিরতরে ভালো হয়ে গেছে। এই জন্য তার দ্বারা আর কোনো অপকর্ম সম্ভব না।
: স্যার, আমি কিন্তু একটু আগে বলছি, আমি একটা অপরাধ করছি। তারপরেও ক্যান বুঝতেছেন না, রনি বাঁইচা নাই। আমি তারে মাইরা ফেলছি। আর মরা মানুষের দ্বারা অপকর্ম, ভালা কর্ম, কোনোটাই করা সম্ভব না।
ওসি সাহেব বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকেন রিকশাওয়ালার দিকে। আর সে তাকিয়ে থাকে টেবিল-ক্লথের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়েই বলে চলে- রনিরে ওইদিন সন্ধ্যায় আমি ফোন দিছিলাম। সুমি আফা নাকি তখন ঘুমাইতেছিল। আমি তারে অনেক বোঝাইলাম, যাতে ভালো হইয়া যায়। যাতে বউটার উপরে আর নির্যাতন না করে। সে আমার সাথে দেখা করতে চাইলো। আমরা রাতের আন্ধারে দেখা করলাম। সে তখন আমারে কী বললো জানেন?
ওসি সাহেব কিছু বলেন না। তিনি তাকিয়ে থাকেন আগের মতোই। রিকশাওয়ালা বলে- সে আমারে প্রস্তাব দিলো সুমি আফার হাতটা যাতে আমি কাটি। কালাম বা খোরশেদরে যা টাকা দিছে, আমারে দিবো এর ডবল। আমি তখন তারে ‘জানোয়ার’ বইলা গালি দিলাম। সে আমারে থাবড়া মারলো। আমার মাথায় খুন চইড়া গেলো। পায়ের কাছে একটা ইট আছিল। এক বাড়ি দিয়া শেষ কইরা দিলাম। আর লাশ ফালায়া দিলাম ম্যানহোলের ভিত্রে। এই জন্য এখনও কেউ জানে না।
ওসি সাহেব ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেন। কারণ, তিনি এখন লাশের কাছে যাবেন।
। পনেরো।
কলিংবেল বেজে ওঠে।
দৌড়ে দরজার কাছে যায় সুমি।
আর চোখের পলকে খুলে ফেলে ছিটকিনি।
তারপর যেই প্রশ্ন করতে যাবে ‘এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে, মোবাইল বন্ধ ছিল কেন’, দেখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা রনি না। বরং সে, যে কিনা তার কাছে মৃত। সুমি চিৎকার করে উঠতে চায়। কিন্তু মানুষটা তাকে শান্ত থাকার অনুরোধ করে। আর শীতল গলায় বলে- আমি মরিনি। তোমার হাজব্যান্ড হয়তো এমনকিছু বলেছে বা করেছে, যাতে তুমি ধরে নাও আমি মরে গেছি। যাতে মাসুম নামের মানুষটার জন্য আর কোনো পিছুটান না থাকে। এই যে, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?
সুমিকে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্নটা করে মাসুম। এতে সে পলক ফেললেও উত্তর দিতে পারে না। পারে না চুল পরিমাণ নড়তে। মাসুম বলে- আমি আগামীকাল দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে যখন সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছিলাম, তখন আরিফ বললো তুমি নাকি বলেছো আমি কোনো একটা অপরাধ করতে গিয়ে গণপিটুনি খেয়ে মারা গেছি। কথাটা শুনে আমার মনে হলো, তোমার সঙ্গে দেখাটা করে যাওয়া দরকার।
সুমির মাথা চক্কর দিতে থাকে। তাই সে দরজা ধরে দাঁড়ায়। আর মাসুম বলে- গণপিটুনি খাওয়ার মতো অপরাধ যদি করে থাকি, সেটা করেছি একটু আগে। যা বুঝলাম, এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব কড়া। কাউকে সহজে ঢুকতে দেয় না। আর দারোয়ানের মেজাজও দেখলাম খুব খারাপ। সে নাকি ইন্টারকমে কার সঙ্গে কথা বলছিল, এই ফাঁকে কেউ একজন খাতায় নাম এন্ট্রি না করেই ঢুকে গেছে। কোন বাসায় গেছে, বোঝার উপায় নেই। তারপর সে যখন লোকটাকে খোঁজার জন্য দোতলার দিকে গেলো, আমি বাইরে থেকে চোরের মতো খিলটা খুলে ঢুকে পড়লাম। এই অপরাধের জন্য আমার গণপিটুনি প্রাপ্য ছিল, কী বলো?
মাসুম হাসে। তারপর সুমির কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য একপা সামনে এগোতেই তার চোখ চলে যায় আরও সামনে। দেখে ছাদের দিক থেকে মোটা রশি ফেলে কেউ ঝুলে ঝুলে নামছে অন্ধকারাচ্ছন্ন বারান্দায়। মাসুম ধারণা করে, চোর হবে। যে কিনা সুবিধাজনক সময়ে ছাদে উঠে বসে ছিল ঘাপটি মেরে। আর এখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে এসেছে চুরি নামের মহৎ কর্ম সম্পাদন করার জন্য।
মাসুম আঙুল দিয়ে দেখায় লোকটাকে। সুমি বারান্দার দিকে ঘোরে। কিছু বলতে চায়। কিন্তু এর আগেই চাপাতি উঁচিয়ে তেড়ে আসে লোকটা। কোপও বসিয়ে দিতে চায় সুমির হাতে। তবে মাসুম তাকে টেনে নিজের পেছনে নিয়ে নেয় বলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কোপটা। হাতের পরিবর্তে লাগে গলায়।
সুমির চিৎকারে ছুটে আসে প্রতিবেশীরা। তাড়া খাওয়া খোরশেদ লাফিয়ে পড়ে ছাদ থেকে। আর অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে মাসুম রওনা হয় গ্রামের উদ্দেশ্যে। যেখানে শুয়ে আছেন তার মা। কতদিন মায়ের পাশে শোয় না সে! এবার শোবে অনন্তকালের জন্য।
। সমাপ্ত।
সারাবাংলা/এসবিডিই
অন্য এক আঁধার (সপ্তম পর্ব) ইকবাল খন্দকার ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা উপন্যাস