আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (শেষ পর্ব)
১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৩৮
জীবন বদল বা আত্মা প্রতিস্থাপন
মায়ের খুনের স্বীকারোক্তি দানের পর প্রথমে কিছুটা ড্যামকেয়ার ভাব এবং নিজেকে জেলবন্দী ও ফাঁসির দড়িতে ঝুলার মানসিক প্রস্তুতি নিলেও বৃদ্ধের প্রস্তাবে সে কিছুটা আশ্বস্ত হলো। মরণাপন্ন বৃদ্ধ যদি তার মুখের কথা রাখে এবং যে হিপনোটিষ্ট তাকে সম্মোহন করিয়ে এই স্বীকারোক্তি আদায় করেছে সেও যদি গাইগুই না করে তাহলে হয়তো এ যাত্রায় সে ফাঁসির দড়ির হাত থেকে বেচেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বৃদ্ধের উদ্ভট অদ্ভুত প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া উপায় কি? আর প্রস্তাবটা এখনও খুব বেশি অদ্ভুত আর উদ্ভট লাগছে না। সে কারোশি কেয়ারের মাধ্যমে চাকরির জন্য যখন বৃদ্ধের ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারছে তখন বৃদ্ধের ফেলা আসা জন্মভূমি গ্রামে গিয়ে বৃদ্ধের ছেলের ভূমিকায় কেন অভিনয় করতে পারবে না?
কিছুদিনের মধ্যেই কাছের মানুষ হয়ে ওঠা নার্স শশীর সাথে এই ব্যাপারটা শেয়ার করেছিল সে, শুধু ভুলেও নিজের মায়ের হত্যাকারীর কথাটা মুখ ফসকে বলেনি। সব শুনেটুনে শশী বলল, ‘তুমি এখানে যে কাজ করছো, কতকটা তো সেই কাজ। তবে তোমার ওভারটাইমের পেমেন্ট নেওয়া উচিত। আর যাতায়াত থাকাসহ সব খরচ খরচা তো স্যারই দেবেন, তাই না?’
সামিউল উপর নিচ মাথা নাড়াল। শশীর এই জিনিসটাই তাকে অস্বস্তি দেয়। সবকিছুর মধ্যে টাকা পয়সার খোঁজ। পরিচয় এবং তুমি ডাকার মতো কিছুটা ঘনিষ্টতা হওয়ার পর থেকে শশী আকারে প্রকারে তার অর্থনৈতিক অবস্থার খোঁজ খবর নিতে থাকে। একমাত্র সন্তান শুনে যেরকম আহলাদিত হয়ে উঠেছিল বাড়ির জমাজমি বন্ধক রেখে টাকা পয়সা নিয়ে শুধু কবিতা লিখবে বলে ঢাকায় এসেছে শুনে তেমনি চুপসে গেল। এখন একটু কথাবার্তার পরপরই বন্ধকী জমাজমি ছাড়ানোর কোন ব্যবস্থা করছে কিনা, বেতনের টাকা ব্যাংকে রাখছে কিনা, নাকি সম্পাদকদের বিরিয়ানী খাইয়ে উড়িয়ে দিয়েছে এসব কথাই বেশি আসে। অথচ সে শশীর সমন্ধে তেমন কোন খোঁজখবরই করেনা, শুধু মন্ডলের কাছে জেনেছে, মেয়েটার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, কি কারণে স্বামীর সাথে বনিবনা হয়নি বলে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, এখন মায়ের কাছে থাকে, শশীর ইনকামেই সংসার চলে। কি কারণে স্বামীর সাথে বনিবনা হয়নি সামিউল বুঝতে পারে, সবসময় টাকার খোঁজ করা এমন মেয়েকে কেইবা সহ্য করতে পারে? সামিউলের মনে হয় শশী বন্ধু বা স্বামী নয়, টাকাওয়ালা মানুষ খুজছে।
শশী বলল, ‘তুমি স্যারের সাথে ভালভাবে ক্লিয়ারকাট কথা বলো। তোমার সেন্টার থেকে তো মাস শেষে সালারি ঢুকবে, কিন্তু স্যারের জন্য কাজ করলে তোমার বেনিফিট কি? কষ্ট করে যাওয়া আসা মানুষের সাথে মেলামেশা এর একটা বিল তৈরি করো। আমি এখানে ডিউটির বাইরে এক ঘন্টা বেশি থাকলেও তার বিল নেই।’
সামিউল মিনমিনে গলায় বলল, ‘দেখি, বলতে হবে স্যারকে।’
‘কবে যাচ্ছ ঢাকার বাইরে?’
‘এখনও ঠিক জানি না। স্যার যেদিন বলেন। মন্ডল চাচা বললেন, এখনও নাকি কিছু কাজ বাকি আছে। শেষ হলে তারপরে।’
‘কি কাজ?’
‘জানি না। কে নাকি আসবে। তারপর সিদ্ধান্ত হবে। তোমার কি আর স্যারের সাথে কাজ আছে?’
‘হ্যা, আছে বলেই তো বসে আছি। স্যার ঘুম থেকে উঠলে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিয়ে তারপর আমার ছুটি।’
বৃদ্ধ ঘুম থেকে জাগতেই তার ঘরে সামিউলের ডাক পড়ল। নার্স শশীর ডিউটি টাইম শেষ, সে সামিউলের সাথে দেখা করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘টাকা পয়সার ব্যাপারটা আগেভাগে ক্লিয়ারকাট করে নিও। তুমি যা মুখ বোজা স্বভাবের মানুষ। ভূতের বেগার খেটে যাবা কিছু বলবা না।’
সামিউল বৃদ্ধের বিছানার পাশে বসল। বৃদ্ধ শীর্ণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে সামিউলের হাত ধরে বললেন, ‘তুমি আমার গ্রামের বাড়িতে যাবে আর আমি ভেতরে ভেতরে এক ধরণের উত্তেজনা বোধ করছি। মনে হচ্ছে যেন তুমি নয় আমিই গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। তোমার চোখ দিয়ে নয়, আমার চোখ দিয়েই আমি আমার ছায়া সুনিবিড় গ্রামের দৃশ্য আবার দেখতে পাব, আমার সেই শৈশবের মার্বেল খেলা, লাটিম খেলা বন্ধুদের আবার দেখতে পাব, ভাবতেই আমার শরীর যেন চনমনে হয়ে উঠছে, যেন আমার শরীরের সব অসুখ ভাল হয়ে যাচ্ছে। এখনই আমার যে অনুভূতি হচ্ছে তুমি গ্রামে গেলে সেই অনুভূতি হয়তো আরো বেড়ে যাবে।’ বৃদ্ধ একটানা কথাগুলো বলে একটু থামলেন, একটু যেন হাঁপিয়ে গিয়েছেন, ‘ও শোন, তুমি মন্ডলের কাছ থেকে বুঝে একটা ক্যামেরা মোবাইল নিয়ে যাবে, যাতে সর্বক্ষণ ইন্টারনেট থাকে। আর তোমার যাত্রা থেকে শুরু করে গ্রামে পৌছুনো অবধি এবং গ্রামে পৌছে আমার বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাতের মুহূর্তগুলো তুমি লাইভ আমাকে দেখাবে, আমি যতক্ষণ ভাল থাকি, জেগে থাকি দেখব, বুঝেছো? মন্ডল তোমার সব ব্যবস্থা করে দেবে। যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচখরচাসহ সব কিছু ওর কাছ থেকেই বুঝে নিও। আর আমার হয়ে এই ডিউটি বাবদ তোমাকে একটা এ্যামাউন্ট দেওয়া হবে এবং যা দেব তুমি অসন্তুষ্ট হবে না।’
সামিউল মিনমিন করে বলল, ‘কোন অসুবিধে নেই স্যার।’ তার শশীর বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল, সেই সাথে মনে পড়ে গেল স্যারের কাছে তার অসহায়ত্বের কথা, মায়ের হত্যার স্বীকারোক্তির কথা, স্যার যদি তাকে কানাকড়িও না দেন, তাহলেও সে এখন থেকে আমৃত্যু স্যারের কথা শুনে যেতে বাধ্য। ‘স্যার, গ্রামে কবে যেতে হবে? আমার একটু মেস থেকে ঘুরে আসা দরকার।’
‘তোমাকে তো এখানে কেউ আটকে রাখেনি, যখন খুশি যাও ঘুরে আসো মেস থেকে। কোন জিনিসপত্র থেকে থাকলে নিয়ে আসো। আর কবে যেতে হবে সেটা দুএকদিনের মধ্যে জানাচ্ছি। আরো একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে বলে এখনই যাওয়া হচ্ছে না।’
‘কি কাজ?’
‘তা তোমার না জানলেও চলবে!’
মন্ডল কাচুমাচু স্বরে বলল, ‘স্যার, আধাত্বিক গুরুর খোঁজে দুদিন করে গিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি এ তল্লাটে নেই। গুরু তো আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। সাগরেদ করে। কল দিয়েছিলাম। বন্ধ। শেষে ওখানে জানিয়ে এসেছি। আর মোবাইলেও ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছি।’
বৃদ্ধ তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, ‘আমার শরীরের অবস্থাটা তো তুমি ভাল করেই জানো। তোমাদের জন্য দিনগুলো ঘন্টার মতো হলেও আমার জন্য একটা দিন একেকটা মাস বছরের সমান। তাই যা করবার তাড়াতাড়ি করো। আমার তো আর তর সইছে না। ভেতরে ভেতরে বড়ো অস্থির হয়ে পড়েছি। সবচেয়ে বড়ো অস্থিরতা কিসের জন্য জানো? তোমার আধাত্মিক গুরুর আত্মা বদলে কতখানি কাজ হয় সেটা দেখার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি। আমার এই নিশ্চল শরীরটা বিছানায় পড়ে থাকবে অথচ আমি সারা দিন দুনিয়া ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে জীবনের সব অপূর্ণতাগুলো একে একে পূর্ণ করব, এও কি সম্ভব? তুমি যেভাবেই হোক আজ রাতের মধ্যে আধাত্বিক গুরুকে হাজির করার ব্যবস্থা করো। আর আত্মা বদল করার জন্য যদি আচার উপাচারের আয়োজন করতে হয় সেই ব্যবস্থার জন্য কোন ত্রুটি না হয়। আমার পাওয়ার অব এর্টনি দিয়ে ব্যাংক থেকে থোক টাকা তোলার ব্যবস্থা করো।’
‘জি¦ স্যার, টাকা তোলার জন্য আমি এখন ব্যাংকে যাচ্ছি। তারপর আধাত্বিক গুরুর খোঁজে বের হবো। গুরুর দেখা পেলে আজ রাতেই আয়োজন করতে চেষ্টা করছি স্যার।’
‘শোনো, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। সামিউল ছেলেটা ওর মেসে দেখা করতে যেতে চাইছে। আমি চাই তুমি ফিরে এলে ও ঘুরে আসুক। আর ওই কেয়ারে ফোন করে আমার কথা বলে জানিয়ে দিও যে সামিউল আমার কাজেই আছে। ছেলেরা যে পেমেন্ট ওদের দেয়, তার পাশাপাশি আমিও কিছু দেব। ঠিক আছে?’
‘স্যার আপনি নিজেকে একটু সুস্থ রাখার চেষ্টা করবেন। ভাল রাখার চেষ্টা করবেন। যতদূর শুনেছি, আত্মা বদলের ব্যাপারটাতে নাকি বেশ ঝক্কি আছে। দুর্বল দেহে দুর্বল আত্মা হলে অনেক সময় নাকি হিতে বিপরীত হয়ে যায়।’
‘কিরকম?’
‘মানে স্যার আত্মা অন্য দেহে ঢোকার আগেই মুত্যুবরণ করে!’
আধাত্মিক গুরুকে ডেরায় পাওয়া গেল। একটা কন্টাক্টে ঢাকার বাইরে মুন্সিগঞ্জে গিয়েছিল এক গুরুতর অসুস্থ রুগীকে সারিয়ে তুলতে। কিন্তু রোগী মারা যাওয়ায় ডেরায় ফিরে এসে মুষড়ে পড়েছে। মন্ডলের সাথে অনেক আগে একবার এক আধাত্কিতায় পরিচয় হয়েছিল। গুরু এখনও যে মন্ডলকে দেখে চিনতে পেরেছে, মনে রেখেছে দেখে অবাক হলো। মুখে হাসির রেখা টেনে বলল, ‘অনেকদিন পরে দেখলাম। কেমন আছেন? এখনও ওখানেই কেয়ারটেকার হিসাবে আছেন?’
‘জি¦ গুরু। কোথায় আর যাব বলেন? মানুষটার উপর বড়ো মায়া পড়ে গেছে। দেখভাল করার কেউ নেই।’
গুরু দুচোখ মুদে বললেন, ‘মায়া! মায়া বড়ো মায়াময় জিনিস। দুনিয়া চলে মায়ার উপরে। মায়ার মোহ কেটে গেলেও দুনিয়া চলবে। কিন্তু সেই দুনিয়া বড়ো নির্মম দুনিয়া, তখন আর মানুষের মধ্যে মায়ামমতা থাকবে না। কেউ কারোর বিপদে পাশে এসে দাড়াবে না, সম্পত্তির জন্য ছেলে বাবাকে খুন করবে, পরকীয়ায় মত্ত হয়ে মা শিশু সন্তানদের হত্যা করবে। উফ, ভাবলেও গা শিহরে ওঠে! আপনি কি জন্য এসেছেন বলেন?’
‘গুরু, আমার মালিক গুরুতর দুরারোগ্য ব্যাধিতে বিছানায় শয্যাশায়ী। মৃত্যু পথযাত্রীই বলতে পারেন। এই শেষ সময়ে ওনার খায়েশ হয়েছে দুনিয়া দেখার, এক জীবনে যা যা অপূর্ণতা রয়ে গেছে সেগুলো পূর্ণ করার। আর সেটা আপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।’
‘তাতে আমি কি করতে পারি? আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘গুরু, আমি জানি আপনিই ওনাকে সাহায্য করতে পারেন। আপনার সাগরেদের কাছে আপনার অর্থনেতিক অবস্থার কথা জেনেছি। আশা করি, সেই দুরবস্থা মালিক দুর করে দিতে পারবেন। শুধু আপনি মালিকের কাজটা করে দেন।’
টাকার কথা আধাত্বিক গুরু নরম হলো। লোকটা নামে কামে আধাত্বিক গুরু হলেও অর্থনেতিকভাবে নড়বড়ে। এখানে ্এসব মানুষের কাছে খুব বেশি মানুষ আনাগোনা করে না। যন্ত্র যুগে আধাত্কিতার উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস একেবারে উঠে গেছেই বলা চলে। যাও দুএকটা কেসকাস আসে তাতে সফল না হলে কেউ সহজে একটা পয়সা ঠেকায় না। মানিকগঞ্জ মরণাপন্ন বুড়োকে আধাতিক্সতা দিয়ে সারিয়ে তুলতে না পারায় যাতায়াত খরচটা পর্যন্ত ওঠেনি। মরা বাড়িতে টাকা চেয়ে নেওয়া তার মতো মানুষের কম্মো নয়। ‘কাজটা কি তাই তো বলবেন ভাই? আধাত্কিতা দিয়ে দুনিয়ার সব কাজ যেমন করা যায় তেমনি আবার আধাতিক্সতায় বিশ্বাস না থাকলে কোন কাজই হয় না।’
‘গুরু, কাজটা আত্মা বদলে দেওয়া। আমার মালিকের আত্মা অন্য আরেকজনের সাথে বদলে দিতে হবে। আর কিছু নয়।’
আধাত্বিক গুরু চমকে উঠল, এই জাতীয় কাজের কথা শুনতে হবে আশা করেনি, এখনকার সময়ে কে আর নিজের আত্মা বদল করতে চায়। আত্মা বদল করা মানেই জীবন বদলে ফেলা। সে শিহরে উঠে বলল, ‘এখন তো আর বাপু আমি এসব আত্মা বদলের কাজটাজ করি না, অনেকদিন হলো ছেড়ে দিয়েছি। আপনার সঙ্গে যখন পরিচয় হয়েছিল তখনই সর্বশেষ করেছিলাম। আত্মা বদল করা সার্জনদের অপারেশন করার মতো, প্রাকিটিস থাকলেই দক্ষতা আসে। অনেকদিন যাবৎ প্রাকটিস নেই। ভুলভাল হলে দুটি মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।’
মন্ডলের চোখ চকচক করে উঠল, সামিউল মাকে নিজ হাতে হত্যা করে মুক্তির স্বাদ নিয়েছে, বৃদ্ধ যদি আত্মা বদলের সময় মৃত্যুবরণ করে তাহলে তারও মুক্তি ঘটতে পারে, ‘জি¦ গুরু, ওটা জেনেশুনেই এখানে এসেছি। মৃত্যু ঘটে গেলেও দুজনের কারোর কোন আপত্তি থাকবে না।’ মন্ডল সদ্য ব্যাংক থেকে তোলা দশ হাজার টাকা সামনে রাখল, ‘কাজ শেষে হলো আরো দশ পাবেন।’
চকচকে নোটগুলোর দিকে আধাত্কি গুরুর চোখ চকচক করে উঠল, ‘মৃুত্যুর পরে মানুষের কোন আপত্তি থাকে না জানি। কিন্তু বেচে থাকা কেউ কি আপত্তি করতে পারে?’ গুরু টাকাগুলো গুনে নিল।
‘না, আপত্তি করার কেউ নেই। আপনি আর আমি ছাড়া এই কথা আর কেউ জানে না। কাজেই আমি যদি আপত্তি না করি আপনাকে ক্লেম দেওয়ার কেউ থাকবে না। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আত্মা বদলের কাজটা করতে পারেন।’
গুরু বসা থেকে উঠে দাড়াল। পুরানো ঘরের পুরানো আলমারি খুলে ফেনসিডিলের বোতলের মতো একটা বোতল বের করে মন্ডলের দিকে বাড়িয়ে দিল, ‘এই বোতলের তরলটুকু দুভাগ করে দুজনকে সন্ধ্যের পরপরই খাইয়ে দিতে হবে। ঠিক মাঝরাতে জিরো আওয়ারে যখন দুনিয়ার জগত আর অন্য জগতের অদলবদল ঘটে তখনই আত্মা বদলের কাজ হবে।’
মন্ডল শিশিটা হাতে নিতে নিতে বলল, ‘এর মধ্যে কি?’
‘সার্জনরা অপারেশনের আগে যেমন এ্যান্সেথেশিয়া দিয়ে অজ্ঞান করে নেয়, মনে করেন এই সেরকম একটা তরল, আত্মা বদলের আগে দুজনের দেহ অবশ করে ভরশূণ্য করে নিতে হবে, এটা সেই ভরশূণ্য করার দাওয়াই। মানুষের দেহ ভর শূণ্য হলেই আত্মা বেরিয়ে আসে!’
সন্ধ্যের আগেই এখানে ফিরে আসার শর্তে সামিউল মেসের উদ্দেশ্যে বের হলো। জহিরকে ফোন করে জেনেছিল সে দুপুরের পর থেকেই মেসে আছে। কারোশি কেয়ারে একবার ঢু দিয়েই মেসে যাবে ভাবল সামিউল।
কারোশিতে এসেই বাদল ভাইয়ের খপ্পরে পড়তে হলো। সেই একই ঘ্যানঘানানি কথা, তার ব্যাপার নিয়ে শেলীর সাথে আলাপ হয়েছে কিনা, সামিঊল মিথ্যে করে বলল, ‘আপনাকে একটু কথা তুলেছিলাম ওর কাছে কিন্তু ওর হাবভাবে অন্যরকম মনে হলো।’
বাদল ভাই আগ্রহী স্বরে বলল, ‘কিরকম? কিরকম?’
‘মনে হলো, আপনার দুইটা জিনিসকে ও ঠিক পছন্দ করে না।’ সামিউল মজা করবে মনে করল, এরকম জিনিস নিয়ে মজা করবে যা বাদল ভাই মুখ ফুটে শেলীর সামনে বলতে পারবে না। ‘আপনার বেঢপ বিশাল ভূড়ি আর…’
‘আর?’
‘কামানো মাথা!’
বাদল ভাই বিমর্ষ হয়ে পড়ল, ‘এই দুই জিনিসের জন্য আমিও শেলীর সামনে ঠিক সহজ হতে পারি না। ঠিকই বুঝতে পারি এই দুই জিনিস সবসময় দেওয়াল হয়ে খাড়া হয়ে থাকবে। ভুড়িটা না হয় মেদভুড়ি কি করির সাহায্য নিয়ে কমিয়ে ফেলতে পারি, কিন্তু টাক মাথা ঢাকব কিভাবে?’
মুষড়ে পড়া বাদল ভাইকে ওই অবস্থায় রেখে সামিউল বেরিয়ে এলো। বাদল ভাই শেলীর কথা জিজেজ্ঞস করার কারণে কিনা কে জানে, তার শেলীকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করল। শুধু চোখের দেখা। জানে মাত্র কয়েকদিনের জন্য সে গ্রামের দিকে যাচ্ছে কিন্তু তার কেন জানি মনে হচ্ছে অনেক দিন হয়তো সে আর শেলীকে দেখতে পাবে না। সামিউল শেলীকে কল করে দেখা করার কথা জানাল, এও জানাল, চাকরির কাজে তাকে গ্রামে যেতে হবে, সেজন্যই দেখা করতে চায়।
কদিনে শেলী যেন আরো ভারিক্কী হয়ে উঠেছে। কফি শপে কফিতে চুমুক দিতে দিতে শেলী বলল, ‘তোমাকে দেখে বেশ ভাল লাগছে। একটু স্বা¯স্থ্যও ভাল হয়েছে দেখছি। নিয়মিত চাকরি আর নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কেমন যেন সুখী মানুষ সুখী মানুষ একটা ভাব এসেছে তোমার শরীরে। কি আমাকে না জানিয়ে বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছো নাকি?’
সামিউল একটু লজ্জা পেল, গায়ে গতরে যে একটু লেগেছে তা সে নিজেও বুঝতে পারে কিন্তু চেহারায় সুখী সুখী ভাবটা সে এতোদিন ধরতে পারিনি, সেটা কি নার্স শেলীর সাথে সর্ম্পকের কারণে? ‘আরে না না, সেসব কিছু না। কাজকাম নেই, শুয়ে বসে থাকি তো এইজন্যই বোধ হয় তোমার কাছে অমন লাগছে।’
‘উহু, আমার তো মনে হচ্ছে বিয়েশাদি না করলেও সেই দিকেই হয়তো এগুচ্ছো। কোন মেয়ের সাথে চক্কর চলছে নাকি? আমাকে বন্ধু মনে করে বলতে পারো। আমি মোটেই মাইন্ড করব না।’ শেলী তরল গলায় বলল, তারপর হঠাৎ ওর গলাটা একটু ভারী হয়ে গেল, ‘আমি যে আর তোমার মনের মধ্যে নেই তা এতোদিনে বুঝে গেছি। তাও ভেবেছিলাম হয়তো ঢাকায় এসেছো, আবার নতুন করে পুরানো প্রেম জাগতে পারে, কিন্তু তোমার নিরবতায় বলে দেয় পুরনো প্রেম জাগা তো দূরে থাক, একটু ঢেউও জাগেনি। ঠিক আছে, তোমার প্রেমিকার কথা বলতে হবে না। দোয়া করি, তোমরা সুখী হও।’
হঠাৎ করে সামিউল কাপা কাপা গলায় বলল, ‘তোমাকে এখনও ভাল না বাসলে এই কটা দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাব তাতে দেখা করতে এলাম কেন? তুমি একটা দেওয়াল তুলে রেখেছো বলেই আমার বলতে ভয় হয়। এতোদিন ঢাকায় থাকছি, দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে অথচ কোনদিন তুমি আমাকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলোনি, একটিবারের জন্য তোমার বাসায় নিয়ে যাওনি, তোমার মা মেয়ের সাথে দেখা করাও নি, তাহলে আমি কিভাবে বুঝবো যে আমার প্রতি তোমার সেই টান এখনও বহাল আছে?’
শেলী কফির মগ সরিয়ে রেখে সামিউলের হাত নিজের হাতের মুঠোও তুলে নিল। আবেগী কণ্ঠে বলল, তোমাকে আমি কখনই বুঝতে পারি না, বুঝতে পারি না বলেই ভয় হয়, আর যেখানে ভয় থাকে সেখানে ভালবাসতেও ভয় থাকে। একসময় তোমার দুঃসময়ে তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম এখন আবার কি করে সেখানে তোমাকে ভালবাসার কথা বলি? তুমি হয়তো ভাবতে পারো স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে আছি বলে একজন পুরুষের অবলম্বনের জন্যই তোমাকে আবার আকড়ে ধরতে চাইছি, তাইতো বলতে পারিনি। তোমাকে বাসায় ডাকতে পারিনি, কাছে ডাকতে পারিনি, শুধু দুর থেকে ভালবেসে গেছি।’ শেলীর মোবাইলে কল এলো। অফিস ডাকছে। ক্লায়েন্ট এসে খোঁজ করছে। সে ‘এক্ষুণি আসছি’ বলে কল কেটে দিল। তারপর সামিউলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দুজনের মনের মেঘ মনের পর্দা যখন সরে গেছে তখন আর ভালবাসাতে কাছে আসাতে বাধা নেই। তুমি কোথায় যেতে হচ্ছে সেখান থেকে ঘুরে এসে তারপর দুজনে আবার বারো বছর আগের সময়ে ফিরে যাব।’
জহির সব শুনেটুনে হেসে বলল, ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে ধরে এতোদিন প্রবাদ বাক্য হিসাবে শুনে এসেছি, এখন তোর মুখে শুনে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলাম। তা তোকে গ্রামে যেয়ে কি করতে হবে? বুড়োর বন্ধুদের সাথে মার্বেল খেলতে হবে? লাটিম ঘুরাতে হবে? ডাংগুলি খেলতে হবে?’
‘হুম, সেরকমই। বুড়ো চায় আমি তার শৈশব পালন করি, যে শৈশব বুড়ো পালন করতে পারেনি।’
‘আামি তো ব্যাপারটার কোন মাথামুন্ড বুঝতে পারছি না। বুড়োর যে বয়স তাতে তার বন্ধু সহপাঠীরা কেউ বেচে আছে কিনা সন্দেহ। আর তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম বেচে আছে কিন্তু বুড়ো নিজেই যেখানে বিছানায় শোনা সেখানে ওরা কি মার্বেলটার্বেল খেলতে পারবে?’
‘আগে গিয়ে দেখি, কি হয়? যদি বেচে থাকে আর খেলতে পারে খেলবো?’
‘আচ্ছা, সেটাও না হয় হলো। কিন্তু তুই বুড়োর সহপাঠীদের সাথে দেখা করলে বুড়োর শৈশবে ফিরে গেলে বুড়োর কি লাভ?’
‘জানিনে। বলেছে ক্যামেরায় লাইভ ভিডিও করে দেখাতে। আর আমাকে ওখানে যেতে হবে বুড়োর ছোটছেলের পরিচয়ে।’
‘পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে গোলমেলে লাগছে। তবে গ্রামের দিকে যাওয়ার সুযোগ যখন পাচ্ছিস ঘুরে আয়। গ্রামের আলো হাওয়া লাগিয়ে আয়। তোর চাকরির ডিউটিই যখন তখন তো করতেই হবে। তবে শোন, এই ফাকে নিজের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের কবরটা একটু জিয়ারত করে আসতে পারিস কিনা দেখিস?’
‘কিন্তু দুই গ্রাম তো সম্পূর্ণ দুই এলাকায়।’
‘তাতে কি? একবার বেরিয়ে যখন পড়েছিস তখন ফেরার সময় নিজের ভিটেমাটিতে দেখা দিয়ে আয়। নিজের ভিটেমাটির চেয়ে আপন আর কিছু নেই। অনেক দিন না দেখায় সেই আপন পর হয়ে যায়। তখন শতচেষ্টাতেও আর আপন হয়ে ওঠে না। শেষমেষ তখন এই বুড়োর মতোই আরেকজনের চোখ দিয়ে নিজের গ্রাম ভিটেমাটি দেখতে হবে, তাতে কি তৃষ্ণা মিটবে?’
সন্ধ্যে নামার আগে আগেই ফেরার কথা থাকলেও সামিউলের ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে উতরে গেল। এর মধ্যে মন্ডল বার কয়েক ফোন দিয়ে সামিউলকে তাড়া লাগিয়েছে। সামিউল বাসায় ফিরে রুমে গেল বাইরের পোশাক বদলাতে। এবং বলা যায় প্রায় রুটিন মতোই মন্ডল একটা সেই পরিচিত কাঠের ট্রেতে করে সৃদুশ্য কাচের গ্লাসে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি ও সবজেটে শরবত নিয়ে হাজির হলো। ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, মালিক তোমাকে দেখার জন্য তোমার সাথে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে আছে।’
‘একটু ধকল মরতে দেন চাচা। এক বিকেলে অনেকগুলো জায়গায় ঢু দিয়ে এসেছি। ঢাকার বাইরে কোন ধ্যাধধেড়ে গোবিন্দপুর যেতে হবে কবে ফিরতে হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। বন্ধু পরিচিত জনের সাথে দেখা করে এলাম।’
মন্ডল বিড়বিড় করে বলল, ‘এরকমভাবে বলছো যেন চিরজীবনের জন্য চলে যাচ্ছো।’ সে ট্রেটা টেবিলে রেখে সবজেটে গ্লাস সামিউলের হাতে ধরিয়ে দিল। সামিউল বাইরের পোশাক বদলে ঢিলেঢালা কবিতার পংক্তি লেখা টিশার্ট গায়ে ও চেককাটা ট্রাউজার পরনে। শরবতটা হাতে নিতে নিতে সামিউল জিজ্ঞেস করল, ‘আজকে এটা কিসের শরবত চাচা?’
‘পুদিনা পাতার। সাথে আরো কিছু ভেষজ মেশানো আছে। নাও। পান করো।’ মন্ডলের পুরো মনোযোগ গ্লাসের দিকে, একটা ফোটাও যাতে কোনমতে অপচয় না হয়, ওতে যে পুদিনা পাতার রসের সাথে আত্মা বদলের রসও মেশানো আছে!
গ্লাসে কয়েক চুমুক দিয়ে সামিউল বলল, ‘আর খেতে ইচ্ছে করছে না চাচা। পেট এমনিতেই ভরা আছে। বাইরে দুই দুই বিশাল কাপ কফি খেয়ে এসেছি একটু আগে। পেটে আর জায়গা নেই। তাছাড়া শরবতটা যেন ঠিক যুত লাগছে না, কেমন যেন অন্যরকম একটা গন্ধ। কৃমির ওষুধের গন্ধের মতো!’
মন্ডল বিড়বিড় করে বললেন, ‘তুমি তো জানোই শরবত পুরোটা খাওনি শুনলে মালিক কেমন গোস্বা করেন। দুই কাপ কফি খাইলেও এক গ্লাস শরবত খাওয়া যায়। শরবত তো পানির মতোই। প্রসাব হয়ে বেরিয়ে গেলেই হলো। নাও। শেষ করো।’
সামিউল জানে জোরাজুরি করে লাভ হবে না। এই বিদঘুটে কৃমির ওষধুগন্ধা শরবত পুরোটাই খেয়ে শেষ করতে হবে। সে দম বন্ধ করে এক নিশ্বাসে পুরোটা ঢক ঢক করে মেরে দিল। তারপর ঝাঝালো কণ্ঠে বলল, ‘এখন খুশ? এবারে আমার উপর কি আদেশ শুনি।’
‘মালিকের রুমে আসো।’ মন্ডল ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মালিকের রুমে এসে একটু অবাক হলো সামিউল। আলো সবসময়ই কম থাকে এই রুমে যাতে চোখে না লাগে। সেই স্বল্প আলোয় মনে হলো রুমের মধ্যে কিছু অদল বদল হয়েছে। তখনই চোখে পড়ল জিনিসটা। বৃদ্ধের পালংকের প্রায় গা ঘেষে একটা ছোট্ট কট খাট এনে রাখা হয়েছে। আজ দুপুরের আগেও যখন বৃদ্ধের রুমে ঢুকেছিল এই হাসপাতালের বেড টাইপের খাটটা চোখে পড়েনি। এই খাটটা এরকম বেখাপ্পা জায়গায় কেন?
বৃদ্ধ শীর্ণ হাতে নতুন বিছানাপাতা খাটটা দেখিয়ে বললেন, ‘বসো। ওইটাতে বসো। তোমার জন্যই এনেছি। রোগীর খাটে বসাটা সুস্থ মানুষের জন্য ঠিক না, কি বলো? তাতে ছোঁয়াছে জীবাণু তোমার দেহেও ঢুকে যেতে পারে।’
শুধু মাথাটাই নয়, গোটা শরীরটাই কেমন যেন ঝিমঝিম অবশ অবশ নেশা নেশা ঢুলুঢুলু একটা ভাব লগছিল সামিউলের। সে নতুন খাটের আগমনের আগ পিছ না ভেবেই বসে পড়ল। কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তার পরই সে না ঘুম না জাগরণ না সচেতন না অচেতন না অবচেতন এক ধরণের ঘোর লাগা জগতের মধ্যে চলে গেল।
আধাত্মিক গুরু মাফিউল কাদির মন্ডলের পিছু পিছু প্রায়ান্ধকার রুমে ঢুকল। তার আস্তানায় সে একটা সোনালী পাড় দেওয়া সাদা লুঙ্গি ও একটা সাদা থান কাপড় পরে বসে ছিল। কিন্তু এখানে সে এসেছে অন্য পোশাকে। কালো এক প্রস্ত চাদর গায়ে এবং তার নিচে কালো আলিফলায়লা স্টাইলের পাজামা। মাথায় একটা কালো ফেট্টি বেধে চুলগুলোকে ঢেকে দিয়েছে। রাতেও কালো চশমা দিয়ে দুচোখ ঢাকা। হাতে একটা ছোট্ট কালো ঝোলা। সব যেন কালোরই কারবার। মাফিউল বিছানায় শায়িত বৃদ্ধকে সালাম বা সম্ভাষণের ধারটার দিয়ে না গিয়ে বলল, ‘আপনি ধকল সইতে পারবেন কিনা আমি জানি না। তবে আমার জন্য যখন কোন রিস্ক নেই, আর সম্মানি পাচ্ছি তবে পিছপা হব কেন?’
বৃদ্ধ খনখনে গলায় বললেন, ‘আমার ধকল সওয়া নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। শরীরে তাকত না থাকলেও মনের মানে আপনাদের ভাষায় আত্মার তাকত আমার যথেষ্টই আছে। আপনি আপনার যা যা করণীয় শুরু করে দেন।’
‘আপনার কথা শুনে খুব ভাল লাগল। এর আগে এক ঘাড়ের মড়া বুড়োর আত্মা বদলের ডাকে গিয়েছিলাম, কিন্তু ধকল সইতে না পেরে সেখানেই পটকে গেল। তারপর তো একপ্রকার পালিয়েই এলাম। ছেড়ে দিলাম সেই তল্লাট। আশা করি আপনি পটকে গিয়ে আমাকে তল্লাট ছাড়তে হবে না।’
বৃদ্ধর রাগ উঠে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই রাগ সামলে নিয়ে বললেন, ‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করি না। ওই জোয়ান ছেলেটার কিছু হবে না তো?’
‘বলা যাচ্ছে না। তবে জোয়ান আত্মার ক্ষতির ভয় কম। কোন গ্যারান্টি দিতে পারব না আগেই বলেছি।’ তারপর মন্ডলের দিকে তাকিয়ে মাফি বলল, ‘উনি এখনও এতো টনটন করে কথা বলে যাচ্ছেন কি করে? আমার পাঠানো আরকটা মনে হয় এখনও গেলানো হয়নি। গিললে এতোক্ষণ এটার মতো আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকার কথা।’
বৃদ্ধই জবাব দিলেন, ‘আমিই ইচ্ছে করে না করেছি। আপনার সাথে দেখা করে দুটো কথা বলেই তবে আছন্ন হতে চেয়েছি। মন্ডলই আশ্বস্থ করল কোন অসুবিধে হবে না। আছন্ন হওয়ার জন্য তো পুরো রাতই পড়ে রয়েছে। নাইট ইজ স্টিল ইয়ং।’
বৃদ্ধ মন্ডলের দিকে হাত দিয়ে গ্লাসের আকৃতি দেখিয়ে ইশারা করলেন। মন্ডল প্রায় সাথে সাথেই বেড সাইডের টেবিলের উপর থেকে ঢেকে রাখা সবজেটে গ্লাস বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে দিল। বৃদ্ধ গ্লাস হাতে নিয়ে মাফিউলের দিকে সম্মতির জন্য তাকালেন। মাফিউল তাই দেখে বলল, ‘খেতে পারেন। সমস্যা নেই। খাওয়ার পরেও কিছুটা সময় বাতচিৎ করার জন্য পাওয়া যাবে। আর বাতচিৎ করার তেমন কিছু নেই। আত্মা যেমন অদৃশ্য আত্মা বদলের কাজটাও তেমনি অদৃশ্য। অদৃশ্য কাজ অদৃশ্যভাবেই হবে। শুধু যেটা সৃষ্টি হবে সেটা হচ্ছে অনুভব। রবি ঠাকুরের ইচ্ছেপূরণ গল্পের মতো আপনার ইচ্ছে পূরণ হবে। ঘুম থেকে জেগে আপনি শারীরিকভাবে সেই আগের মানুষটি থাকলেও মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ বদলে যাবেন, তফাত এই যা। আর আপনার ইচ্ছে পূরণের ইচ্ছেঠাকুরন আমাকে বলতে পারেন।’
বৃদ্ধ তরলটুকু পান করে গ্লাসটা মন্ডলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তারপর মাফিউলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখন কি আমি আগের মতোই শুয়ে থাকব?’
‘হ্যা। আপনি খালি গায়ে থাকায় আপনার আর তেমন কিছু করার নেই। শুধু এই ছেলেটার গা থেকে জামাটা খুলে নিতে হবে। কারবারটা আত্মার হলেও দুজনের শরীরের বন্ধনও জরুরী। আত্মার শত্রু কে জানেন? আত্মার শত্রু শরীর। সেই শত্রুকে বশ করতে হবে। শরীরভ’ত পঞ্চভ’তের ওতপ্রোত- ক্ষিপি, অপ, তেজ, মরুৎ, বোম। তারপর আত্মা বশীভূত হবে।’ মাফিউল কালো ঝোলা থেকে একটা সুগন্ধীর শিশি বের করল, তারপর বের হলে ডাক্তারদের স্টেথোস্কোপের মতো একটা লম্বা নল, শুধু এর আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো দু মাথাতেই সাকশান কাপের মতো লাগানো।
আরকের প্রভাবে বৃদ্ধ ইতমধ্যে আছন্নের মতো হয়ে পড়েছে। মন্ডলও অনেক কসরত করে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা সামিউলের গা থেকে কষ্টেসৃষ্টে কোনমতে টিশার্ট খুলে খালি গা করে দিল।
মাফিউল প্রথমে বৃদ্ধের হৃদপিন্ডের কাছে এবং তারপরে সামিউলের হৃদপিন্ডের বরাবর হাতের শিশির সুগন্ধি তেলটা ঘষে ঘষে দিতে দিতে নিজের মনেই বলল, ‘মানব শরীরে আত্মা কোথায় থাকে কেউ বলতে পারে না, তবে আত্মা যে থাকে এই বিষয়টা সবাই জানে। তবে তা কি মাথায় নাকি হৃদয়ে তাও কারোর পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তবে মনুষের সব আবেগের উৎস হৃদয়ে ধরে নিয়েই আমরা হৃদয় থেকে হৃদয়ে আত্মা সঞ্চালনের ব্যবস্থা করি। হৃদয়ই আমাদের আত্মার প্রবেশ এবং বাহির পথ ধরে নিয়েই এই সাধনায় মত্ত হই।’ মাফিউল কথা বলার সাথে সাথে হাতের কাজও করতে লাগল, স্টেথোস্কোপের মতো নলটার দুই সাকশান কাপ দুজনের হৃদপিন্ডের উপর লাগিয়ে দিল।
মন্ডল প্রায় শোনা যায় না এরকম গলায় বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করল, ‘কাজ কি শুরু হয়ে গেছে?”
‘হ্যা, শুরু হয়েছে তবে এখনও অনেক কাজ বাকি।’ মাফিউল স্বাভাবিক গলায় বলতে বলতে কালো ঝোলার ভেতর থেকে একটা কালো পুথির মালা বের করল। বের করল কংকালের পাশার গুটির মতো কিছু গুটি। ‘আত্মা ট্রান্সফার হতে হতে প্রায় সারারাত লেগে যাবে। মূল কাজ শুরু করব রাত ঠিক বারোটায়। জিরো আওয়ারে। তার আগে সারারাতের জন্য আমার একটু বিশ্রামের জায়গা দরকার। আমি তো শরীরী মানুষ, কোন আত্মা তো আর নই, যে আমার বিশ্রাম লাগবে না।’
‘সে ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। পাশের গেস্টরুমেই আপনি রাতের বিশ্রামের জন্য থাকবেন। যখন ইচ্ছে তখনই এই রুমে চলে আসতে পারবেন। আপনার খাবার দাবারও ওই রুমে দিয়ে রাখছি।’
‘ঠিক আছে। আমাকে আমার কাজ করতে দেন। এখানে আর আপনার থাকার দরকার নেই। আপনি সকালে আমার পেমেন্টটা রেডি রাইখেন। আর রাতের মধ্যে যদি কোন বেগড়বাই দেখি, কি বলছি বুঝতেই পারছেন তো, আত্মা বেরিয়ে বুড়োর পরান পাখি উড়ে গেলে আমিও কিন্তু রাতের অন্ধকার উড়াল দেব। আমার টিকিটিরও খোঁজ পাবেন না।’
সারাবাংলা/এসবিডিই
আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (শেষ পর্ব) ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা উপন্যাস প্রিন্স আশরাফ