জ্যোৎস্না নিভতে নিভতে
১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:০৪
মেয়েটির নাম জ্যোৎস্না। বয়স একুশ-বাইশ হবে। সঠিক করে বলতে পারে না। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মেয়েটির চোখ ও মুখভরা মায়া। মাথাভরা চুল, যদিও যত্নের অভাবে একটু ফ্যাকাশে দেখায়। থাকে মীরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে। স্বামী আর তিন সন্তান নিয়ে সংসার। মেয়েটির জন্ম হয়েছিল নাকি এক চাঁদনিপশর রাতে। বাবা নাম রেখেছিল জ্যোৎস্না। জন্মক্ষণে চাঁদের আলো পেলেও, সাংসারিক জীবনটা তার ঢেকে আছে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে। রিকশাচালক স্বামী আনোয়ার যা রোজগার করে তার সিংহভাগই উড়িয়ে দেয় জুয়ার আসরে। জুয়ায় হারে আর মাদকে বুঁদ হয় প্রতিরাতে। আজ সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ নেই জ্যোৎস্না ঘরে। চোরাই লাইন যে দিয়েছিল সে সকালে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ধরা খেয়েছে। বিদ্যুৎ লাইনও কেটে দিয়েছে অফিসের লোকজন। তিন সন্তান নিয়ে জ্যোৎস্নার নিদ্রাহীন রাত কাটছে স্বামীর অপেক্ষায়। নিজে আধপেট খেয়ে স্বামীর জন্য গুছিয়ে রেখেছে লালশাক-ডাল-ভাত। আনোয়ারের ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত ফুরিয়ে ভোর। এসেছে টলতে টলতে। এসেই জ্যোৎস্নার কাছে গরম ভাত চায়। জ্যোৎস্না বলে, রাইতের ভাত-তরকারি আছে। দিমু? আর এই ভোর রাইতে আপনার লাইগা গরম ভাত কই পামু? সদাইপাতি তো করেন না। ভুইলাই গ্যাছেন এই ঘরে চারটা মানুষ আছে, বাঁচার লাইগা একবেলা হইলেও তাগো খাওন লাগে। জ্যোৎস্নার কথাগুলো মাটিতে পড়তে দেয় না আনোয়ার। চিৎকার করে বলে, এত খাই খাই করস ক্যান বিটি, এত খাওন লাগলে রাইতের কালে রাস্তায় নাইমা পড়। বলেই শুরু করে জ্যোৎস্নাকে কিল-ঘুসি দেওয়া। বাবার হুংকার আর মায়ের কান্নায় বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে যায়। সকালও হয়। পেটে ক্ষুধার যন্ত্রণা আর শরীরে নির্যাতনের ব্যথা। অনেক না বলা কথা আর কষ্ট বুকে চেপে প্রতিটা দিন এভাবেই শুরু হয় জ্যোৎস্নার। সে তার স্বামীকে বলতে পারে না, এমন পরিবেশে একাকী রাত কতটা ভয়াল হয়ে ওঠে তার জন্য! সে বলতে পারে না, যখন তার স্বামী জুয়া আর মাদকের আসরে বুদ হয়ে থাকে তখন প্রতিরাতে প্রতিবেশীরূপী কিছু হায়েনা কড়া নাড়ে দরজায়। তারা কেড়ে নিতে চায় জ্যোৎস্নার সব আলো। নানা প্রলোভনে ভোলাতে চায় জ্যোৎস্নাকে। লক্ষ্য একটাই, জ্যোৎস্নার শরীর। এ যেন ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।’
আনোয়ার এসবের কিছুই জানে না। জানলেও জ্যোৎস্নার বিশেষ কোনো লাভ হবে না। বরং বিপদের সম্ভাবনাই বেশি। দেখা যাবে আনোয়ারই জ্যোৎস্নাকে ঠেলে দিচ্ছে লিপ্সু/ক্ষুধার্ত হায়েনাদের ডেরায়। জ্যোৎস্নার পরিস্থিতি যেন ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’। রাতের শেষে দিনের বেলাতেও বিপদ আসে ভিন্ন রূপে, ভিন্ন চরিত্রে। দিনের বেলায় বিপদ আসে ঝুপড়িওয়ালা রূপে। যে ঘরে জ্যোৎস্না-আনোয়ার থাকে সেই ঝুপড়িঘরের ৪ মাসের ভাড়া বাকি। ঝুপড়িওয়ালা যখন ভাড়ার জন্য আসে তখন আনোয়ার লাপাত্তা। আর জ্যোৎস্নার পালানোর কোনো জায়গা নেই। ভর্ৎসনার মুখে বারবার মাথা নত করা আর হাতজোড় করে সময় ভিক্ষা চাওয়া ছাড়া জ্যোৎস্নার কিছুই করার নেই। জ্যোৎস্না তাই-ই করেছে গত কয়েক মাস। এখন আর কথা শোনে না ঝুপড়িওয়ালা। ভাড়ার বদলে ইনিয়ে বিনিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গিতে সেও চায় জ্যোৎস্নার রূপ-রস-গন্ধ কেড়ে নিতে। গলির মাথার মুদি দোকানিরও কুনজর পড়েছে। কেননা সেখানেও জ্যোৎস্নার তেল-লবণ-চাল-ডালের বকেয়া আছে। শত-সহস্র সংকটের মধ্যেও কোনোরকমে যাচ্ছিল তার দিন। কিন্তু হঠাৎ এক সকালে জ্যোৎস্নার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। খবর আসে জুয়ায় হেরে প্রাণ হারিয়েছে আনোয়ার। হারের টাকা দিতে না পারায় গতরাতে তাকে পিটিয়ে মেরেছে অন্য জুয়াড়িরা। লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আছে। জ্যোৎস্না ছুটে যায় হাসপাতালে। ময়নাতদন্ত ও পুলিশি কার্যক্রম শেষে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করে স্বামীকে। স্বামীকে কবরে নামাতে দেখে জ্যোৎস্নার মনে হয় তার জীবনের অবশিষ্ট শক্তিটুকুরও দাফন হচ্ছে একসঙ্গে। হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে তার।
তবুও একাকী হাঁটতে শুরু করে সে। কীভাবে কীভাবে বস্তিতে ফিরে এলো নিজেও জানে না। পাঁচ, তিন আর দুই বছরের তিনটা শিশু নিয়ে জ্যোৎস্না এখন কোথায় যাবে, কী করবে! দিন-মজুরের কাজ করবে নাকি বাসাবাড়ির ছুটা বুয়া হবে। তাহলে দুধের শিশুগুলোকে কোথায় রেখে যাবে, কার কাছে থাকবে ওরা। এমন হাজারটা দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা জ্যোৎস্নাকে আঁকড়ে ধরেছে অক্টোপাসের মতো। চোখের জলে আর অনাহারে স্বামী হারানোর তিনটা দিন পার করলো জ্যোৎস্না। প্রতিবেশীরা কিছু খাবার দিয়ে গেছে। বলে গেছে, নিজের লাইগ্যা না হইলেও দুধের বাইচ্চাগো লাইগ্যা কিছু মুখে দে রে অভাগী, বাঁইচা থাক। সেসব কোনো কথাই যেন জ্যোৎস্না শুনতে পারছে না, তার চৈতন্য হারিয়ে গেছে কোনো এক অজানা ঠিকানায়। ঘরের দরজায় বসে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গলির শেষ প্রান্তের দিকে। ক্ষুধার্ত বাচ্চাগুলোর অবিরাম কান্নায় ঘোর ভাঙে জ্যোৎস্নার। বাচ্চাগুলোকে জড়িয়ে ধরে আবারো শুরু করে মেঘের মতো কান্না। দিন গড়িয়ে রাত হয়। পাশের ঘরের চাচি অল্প কিছু খাবার দিয়ে যায়। তার কিছুটা মুখে দিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ায় জ্যোৎস্না। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দীর্ঘ কান্নার জেরে আড়ষ্ট হয়ে গেছে কণ্ঠে। মৃদু স্বরে জ্যোৎস্না জিজ্ঞাসা করে, ক্যাডা? এত রাইতে ক্যাডা? কী চাই? দরজার ওপার থেকে পুরুষ কণ্ঠে উত্তর আসে, বইন, মুই রইছ। আনোয়াইরার দোস্ত। জ্যোৎস্না চেনে রইছকে। আনোয়ারের সঙ্গে একই গ্যারেজের রিকশা চালায়। বাড়িতেও এসেছে কয়েকবার। জ্যোৎস্নাকে ধর্মের বোন ডেকেছিল সে-সময়। জ্যোৎস্না দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করে, কী ভাই, এত রাইতে! রইছ আনোয়ারের মৃত্যুতে সমবেদনা জানায়। কথার ফাঁকে জ্যোৎস্নার ঘরে ঢুকে যায় সে। জ্যোৎস্না ইতঃস্তত বোধ করে। তবুও ঢুকতে দেয়। সে তো ধর্মের ভাই। শুরু হয় কথা।
জ্যোৎস্না অঝোরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে তার অনিশ্চিত জীবনের দিশাহীন অবস্থার কথা বলে। রইছ নানা কথায় কথায় জ্যোৎস্নার পাশে এসে বসে। সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে জ্যোৎস্নার হাত স্পর্শ করে। আস্তে আস্তে হাত বুলায় মাথায়। শোকমগ্ন জ্যোৎস্নার সেদিকে খেয়াল নেই, থাকারও কথা নয়। যখন রইছ তার পিঠে হাত দেয় তখন হঠাৎ জ্যোৎস্নার দৃষ্টি ফেরে। জ্যোৎস্না নড়েচড়ে বসে, একটু সরেও যায়। বলে ভাই অনেক রাইত হইছে, আপনি এবার বাড়িত যান, আশপাশের মাইনষে খারাপ কথা কইবো। কথাগুলো বলতে বলতে জ্যোৎস্না মুখ তুলে তাকায়, দেখে অন্য এক রইছকে। যার চোখের মধ্যে লোলুপতা, চেহারার মধ্যে সম্ভোগ-ক্ষুধা। সে এক বিষাক্ত চেহারা। তাড়াহুড়ো করে রইছকে বিদায় জানায় জ্যোৎস্না। দরজা খিল দিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে ঘরের এক কোণে। নির্ঘুম রাত কাটে তার। ফজরের আজানের সময় পথচারীর পায়ের শব্দে কিছুটা সাহস পায়।
জ্যোৎস্না ভাবে সন্তানদের জন্য তাকে বাঁচতে হবে, কিছু করতে হবে। সে অন্যের বাসায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাচ্চাদেরকে কার কাছে রেখে যাবে। দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় জ্যোৎস্না। হঠাৎ মনে পড়ে মিলনী বুড়িকে। মিলনী বুড়ি জ্যোৎস্নাদের বস্তিতেই থাকে। ভিক্ষা করে। প্রতিদিন সকালে সে একটা বাচ্চা ভাড়া নেয়। তাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে অচেতন করে। মাথায় গজব্যান্ডেজ বেঁধে তাতে একটু আয়োডিন লাগিয়ে ফুটপাথে শুইয়ে রাখে। মানুষ মনে করে শিশুটি দুর্ঘটনার শিকার। মানুষের দয়া হয়। ভিক্ষা দিয়ে সাহায্য করে মিলনী বুড়িকে। জ্যোৎস্না মিলনী বুড়ির মতো বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতে বসবে না। বাচ্চাদেরকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে কাজে যেতে চায়। শিশুগুলোকে নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে চায়। স্বামী হারানো পঞ্চম দিনে সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে জ্যোৎস্না বের হয় কাজের সন্ধানে। কাজ পেয়েও যায় এক বাসায়। রান্না ও ঘরের কাজ। মাসখানেক পার হতে না হতেই সেখানেও জ্যোৎস্নার দিকে নতুন হায়েনার থাবা। রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে পেছন দিক থেকে জাপটে ধরে গৃহকর্তা। টাকার প্রলোভনও দেখায়। জ্যোৎস্না কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে গৃহকর্তার পায়ে পড়ে যায়। চোখের জল ফেলে নিজের সম্ভ্রম ভিক্ষা চায়। বাসা থেকে বেরিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে পৌঁছায়। দু’পা মেলে বসে ঘরের দরজায়। পাশের ঝুপড়ির চাচি এসে জিজ্ঞাসা করে, কিরে এত হাঁপাইতেছস ক্যান? কে দাবড়াইছে তোরে? কোনো উত্তর দেয় না জ্যোৎস্না। শুধু বলে চাচি, এক কলসি পানি দিবা? খামু। খুব তেষ্টা পাইছে। চাচি বলে, কী কস! মাথা-টাথা গ্যাছে নাকি তোর? এক কলসি পানি একলা খাবি? কলস থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে জ্যোৎস্নার দিকে এগিয়ে দেয় চাচি। জ্যোৎস্না পানির গ্লাস ফেলে দিয়ে কলসের মুখে মুখ লাগিয়ে ঢক ঢক করে খেতে থাকে। সে-যেন এক অনন্ত তৃষ্ণা মেটানোর প্রাণপণ প্রচেষ্টা। কলস উঁচিয়ে বাকি পানিটুকু নিজের গায়ে ঢেলে দেয় জ্যোৎস্না। গৃহকর্তারূপী সেই পিশাচের গায়ের দুর্গন্ধ থেকে মুক্তির জন্যই এমন চেষ্টা।
মাসের শুরুতে কাজ হারিয়ে এখন দিশাহারা অবস্থা। তার ওপর ভাড়ার জন্য ঝুপড়িওয়ালার দৈনিক আনাগোনা সাথে অনৈতিক হাতছানি। এক মাস কাজ করে যে টাকা পেয়েছে তাতে কিছু দেনা শোধ হয়েছে। হাতে যেটুকু আছে তা দিয়ে কয়দিন পার হবে জানা নেই। জীবন নিয়ে চরম গ্লানিতে ভোগা জ্যোৎস্না ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সকাল হলো। তিন সন্তানকে নিয়ে গন্তব্যহীনভাবে বেরিয়ে পড়ে সে। হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেতে গিয়ে থামে। আশ্রয় নেয় উত্তর-নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার মোড়ে। সেখানে রাস্তার ওপরে একটা ডাস্টবিন আছে। ডাস্টবিন সংলগ্ন ফুটপাথের দেওয়ালে পলিথিন টাঙিয়ে জ্যোৎস্না নতুন সংসার পাতে। শুরু করে বোতল কুড়ানোর কাজ। সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বোতল কুড়ায় আর সন্ধ্যায় আনন্দবাজারে বিক্রি করে। বাচ্চাগুলো কোনোদিন ফুটপাথেই খেলা করে কাটিয়ে দেয়, কোনোদিন আবার মায়ের সঙ্গে বের হয়।
আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বিশ্ববিদ্যালয় ও চারপাশ দিয়ে সহস্র যুগলের আনন্দযাত্রা। কেউ হাতে হাত ধরে হাঁটছে। কেউ নানাভঙ্গিতে ছবি তুলছে, কেউবা আবার রিকশাযোগে পথ হারাবে বলেই পথে নেমেছে। জ্যোৎস্নার আজ খুব কর্মব্যস্ততা। ক্যাম্পাসজুড়ে প্লাস্টিকের অনেক বোতল কুড়াতে হবে। তাই বাচ্চাদেরকে ঝুপড়িতে রেখেই বেরিয়ে পড়েছে। বড়ো ছেলে রাজুর দায়িত্ব ছোটো দুই ভাই-বোনকে দেখে রাখা। রাখেও মোটামুটি। একজন ঘুমাচ্ছে আর দুই ভাই-বোন খেলছে ফুটপাথের ওপরে। পাশের ডাস্টবিন ঘিরে সারাদিন থাকে অনেকগুলো বেওয়ারিশ কুকুরের আনাগোনা। এখনো আছে। ময়লা ফেলা হলে কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবারের জন্য। রিকশাযোগে যাওয়ার সময় এক প্রণয়-যুগল ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলল বার্গারের অর্ধেক অংশ। খাবারটা ওদের মুখে খুব একটা জমেনি। রাজু দৌড়ে যায় ফেলে দেওয়া বার্গারের দিকে। পাশে থাকা একটা কুকুরও ঝাঁপিয়ে পড়লো। শুরু হয় এক টুকরো বার্গারের জন্য মানুষ-প্রাণীর লড়াই। সেকেন্ড দশেকের সে লড়াইয়ে জিতে যায় অবলা কুকুরটা। দুই-তিন কামড়ে খেয়ে ফেলে খাবার। চেয়ে চেয়ে দেখে অবোধ মানবশিশু। মুখটা কালো হয়ে যায়। নিঃশব্দে চোখ বেয়ে পড়ে অশ্রু। সে চেয়েছিল বার্গারের অংশটুকু বোনের সঙ্গে ভাগ করে খেতে। সে পারেনি। ফোটাতে পারেনি ছোট্ট বোনের মুখে হাসি। কুকুরটাও তার কষ্ট বুঝেছে। খাওয়া শেষে সে ছোট্ট শিশু দুটির গা ঘেঁষে বসে যায়। নানা ভঙ্গিমায় ওদের মান ভাঙানোর চেষ্টা করে। সেসবে মান ভাঙে না ওদের। ক্ষুধার্ত শিশু তিনটি অপেক্ষায় আছে মায়ের। দুপুরে অবশ্য জ্যোৎস্না অল্প সময়ের জন্য এসেছিল। বাচ্চাদের মুখে একটুখানি খাবার তুলে দিয়ে গেছে।
এভাবেই দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। ক্লান্ত-শ্রান্ত জ্যোৎস্না ফিরে আসে। নীলক্ষেত তেল পাম্পের শৌচাগার থেকে পানি এনে বাচ্চাগুলোকে গোসল করায়। মুখে তুলে দেয় কিছু খাবার। সকালের সেই কুকুরটা বসেই আছে পাশে। রাজু মাকে আধো আধো কথায় সকালের সব ঘটনা বলে। কুকুরটার ওপর ভীষণ অভিমান। জ্যোৎস্না ছেলেকে বোঝায়, থাক মন খারাপ করিস না বাপ। ওরও তো প্যাট আছে। ওরও ক্ষিদে লাগে। ওর তো আর তোর মতো মা নাই যে মুখে তুইল্যা খাইয়াইবো। এর লাইগ্যা কাইড়া খায়। রাজু কুকুরটার দিকে তাকায়, সেও রাজুর দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। হয়তো অপরাধবোধ থেকে অথবা রাজুর প্রতি তার মায়া জন্মে গেছে। জ্যোৎস্না বাচ্চাদের নিয়ে শুয়ে পড়ে। কুকুরটা জ্যোৎস্নার ঝুপড়ি ঘেঁষে শুয়ে পড়েছে। রাত পেরিয়ে হয় সকাল। শুরু হয় জ্যোৎস্নার প্রতিদিনকার জীবন-সংগ্রাম। এভাবেই কয়েকটা দিন পেরিয়ে যায়। কুকুরটাও রয়ে গেছে জ্যোৎস্নাদের সঙ্গে। রাজু ওর নাম দিয়েছে হাবলু। জ্যোৎস্না বুঝতে পারে হাবলু এখন পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে। শিশুগুলোও খেলার নতুন সঙ্গী পেয়ে যায়। সারাদিন হাবলুর সঙ্গে চলে খুনশুটি। জ্যোৎস্না যে খাবার নিয়ে আসে হাবলুও তাতে ভাগ পায়। খোলা আকাশের নিচে বিনা ভাড়ায় জ্যোৎস্নার এই ডাস্টবিন-জীবন বেশ দুশ্চিন্তামুক্তই যাচ্ছে। অভাব থাকলেও অনিশ্চয়তা নেই। সম্ভ্রম হারানোর শঙ্কাও কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
আজ রাজধানীতে বৃষ্টি হয়েছে প্রচণ্ড। সঙ্গে বৈশাখী ঝড়ো হাওয়া। সময় রাত ২টা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঢাকা শহর, জ্যোৎস্নারাও। হাবলুটা মাঝে মধ্যে অন্য কুকুরদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ডাকছে। তাতে অবশ্য জ্যোৎস্না ও তার বাচ্চাদের ঘুমের ক্ষতি হয় না। বরং তারা নিরাপদ বোধ করে। নির্ভার থাকে। হঠাৎ দুই-তিন জনের এক ভবঘুরে দল এসে হাজির জ্যোৎস্নার ঝুপড়ির সামনে। পলিথিন সরিয়ে উঁকি দেয় ভেতরে। হাতে থাকা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করে জ্যোৎস্নার মুখ ও অনাবৃত শরীর। জ্যোৎস্না জেগে ওঠে, রাতের অন্ধকারে আগন্তুক মুখগুলোকে আরও বীভৎস লাগে তার কাছে। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে সে, সঙ্গে হাবলুও। শিশুগুলোর ঘুম ভেঙে যায়। মাকে জড়িয়ে শুরু করে কান্না। এসবের মধ্যেই একজন জ্যোৎস্নার হাত ধরে টানতে থাকে। প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে যায় হাবলু। সক্ষমতার সবটুকু স্বরে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। বারবার এক একেকজনের সামনে লাফিয়ে ওঠে আর কামড়াতে উদ্ধত হয়। এমন প্রতিরোধের মুখে এক ভবঘুরে হাবলুকে লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। হাবলু লাথি খেয়েও রুখে দাঁড়ায়। জ্যোৎস্না ধস্তাধস্তি করছে লাগাতার। একপর্যায়ে হাবলু এক ভবঘুরের পায়ে দেয় কামড়, আরেকজনকে আঁচড়। অগত্যা তিনজন জ্যোৎস্নাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তি পেয়ে নির্বিকার বসে থাকে জ্যোৎস্না। শিশুগুলো মায়ের বুকে মুখ ঢুকিয়ে বোবাকান্নায় ফেটে পড়ে। হাবলু তখনও থামতে চায় না। ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করতে থাকে আর চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে। কিছুক্ষণ পর ডাক থামিয়ে জ্যোৎস্নার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় জ্যোৎস্না। পথের যে কুকুর সম্ভ্রম বাঁচিয়েছে সেই হাবলুও এখন ওর আরেক সন্তান। চার সন্তানকে আঁকড়ে ধরে জ্যোৎস্না বসে আছে প্রভাতি সূর্যের অপেক্ষায়, নিরাপদ আলোর প্রতীক্ষায়।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা গল্প জ্যোৎস্না নিভতে নিভতে বৈশাখী আয়োজন ১৪৩১ শেখ ফয়সল আমীন