Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পান্তা ইলিশ সমাচার


১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১৩

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রাচুর্যতার মানদণ্ডে একটি জাতির ভিত নির্ধারিত হয়— সংস্কৃতি যেখানে সেই জাতির অন্যতম পরিচায়ক। ভোজন রসিকতা যেমন মিশে আছে আপামর বাঙালি সংস্কৃতির সাথে। এই বাংলার উর্বর মাটিতে শতবছর ধরে জন্মেছে ধান আর নদীবহুল খাল-বিলে মিলেছে মাছ। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের সাথে মাছ-ভাতের সম্পর্কের এই হিসেব ঐতিহাসিক। ‘মাছে-ভাতে বাঙালির’ পরিচয় সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বলেছেন, ‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল, ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল’।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাসও তাই বলে, প্রাচীন পুণ্ড্রনগরে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে মৌর্য শাসনকালে খাদ্যাভাব দূর করতে ধান বিতরণ চালু হয়। আবার ভারতবর্ষে পাওয়া মাছের ফসিলের যার বয়স কোনোটার ১৮ কোটি তো কোনোটার ৩০ কোটি বছর। বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম এই পরিচায়ক মাছ-ভাত মিশে গেছে উৎসবের সাথেও। বাংলা নববর্ষের যোগসূত্র যেমন পান্তা-ইলিশের সাথে। বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের কথা মনে হতেই আমাদের উন্নত মস্তিষ্ক জানান দেয় লালপাড়ের সাদা শাড়ি, পাঞ্জাবি আর পান্তা-ইলিশের। পান্তা-ইলিশ যেন বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে, পান্তা-ইলিশ ও বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নিয়ে বেশ মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ এই সম্পর্ককে মেলাচ্ছে সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের সাথে।

বিজ্ঞাপন

২.
যে কোনো সমাজেই সাধারণত দু’টো শ্রেণি থাকে— শাসক ও শোষিত। শাসকশ্রেণির চর্চাকৃত বিভিন্ন মতবাদ, বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও নিয়মকানুন দ্বারা সমাজ পরিচালিত হয়; সামাজিক জীব হিসেবে শোষিত শ্রেণি ঐসকল মতবাদ, বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও নিয়কানুন পালনে বাধ্য হয়। একটি শ্রেণির উপর আর একটি শ্রেণির এই শাসনকে আমরা আধিপত্য বা কর্তৃত্ববাদ (Hegemony) নামে চিনে থাকি।
সমাজের একটি অন্যতম অংশ হিসেবে ‘সংস্কৃতি’ও এর বাইরে নয় যেমনটি বলেছেন ইটালিয়ান দার্শনিক অ্যান্টনিও গ্রাম্‌সী (Antonio Gramsci)। গ্রাম্‌সীর Prison Notebooksযেগুলোতে তিনি ১৯২৯-১৯৩৫ সালের মধ্যে লিখেছেন, সেগুলো ঘাঁটলে দেখা যায় সংস্কৃতির কর্তৃত্ববাদ (Cultural Hegemony) কীভাবে সমাজে মিশে আছে। তিনি বলেছেন, সমাজে সেই নিয়মকানুন ও চিন্তাধারাই প্রচলিত যেগুলো শাসক শ্রেণি বিশ্বাস করে ও মেনে থাকে। তিনি বলেন, এই মতবাদ, বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও নিয়মকানুন প্রচার হয়ে থাকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন, স্কুল, চার্চ, আদালত, গণমাধ্যম দ্বারা যেগুলো আবার পরিচালিত হয় ঐ শাসকশ্রেণি দ্বারা। এই সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদও (Cultural Hegemony) নাকি মিশে গেছে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম এই উৎসব বাংলা নববর্ষের সাথে।

৩.
শাসকশ্রেণির সুবিধার্থেই যে বাংলা সনের গণনা শুরু সেটি না মানার উপায় নেই। বাংলা অঞ্চল তখন হিজরী সনে পরিচালিত হতো। কিন্তু বাংলা ছিলো কৃষি প্রধান, ফলে খাজনা দেওয়াসহ নানা কাজে বছরের শুরুটা হিসেব করতে সমস্যা হতো। এ কারণেই সম্রাট আকবর তখন বাংলা সন প্রবর্তন করেছেন, পহেলা বৈশাখ দিয়ে যার শুরু; যেটি ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন এবং এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
১৯১৭ সাল থেকে আধুনিক নববর্ষ উদ্‌যাপন সম্পর্কে জানা যায়— প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোমকীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৮ সালেও একই কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং ১৯৬৭ সাল অব্দি পহেলা বৈশাখ পালন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। এই ১৯৬৭ সাল থেকেই রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় এবং ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়।
আর বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের সাথে পান্তা-ইলিশের সম্পর্ক একেবারেই নবীন। এ নিয়েও অনেক মতভেদও লক্ষ্যণীয় যেখানে দুজন গণমাধ্যম কর্মীর নাম জড়িয়ে। জানা গেছে, আশির দশকে তথা ১৯৮৩ সালের চৈত্রের কোনো এক বিকেলে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন সাংস্কৃতিককর্মী; তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সাংবাদিক বোরহান আহমেদ। তিনিই রমনার বটমূলে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রস্তাব দেন এবং তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে তার সহযোগীরা মিলে ৫ টাকা করে চাঁদা তুলে পুরো আয়োজনের ব্যবস্থা করলেন। বাজার করা হলো, রান্না হলো, রাতে ভাত রান্না করে পান্তা তৈরি করে তাতে কাঁচামরিচ-শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ ও ইলিশ ভাজা নিয়ে পরদিন বৈশাখের ভোরে হাজির হলেন বটমূলের রমনা রেস্টুরেন্টের সামনে। আর সেই প্রথমবার মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় সব পান্তা-ইলিশ। অন্যদিকে সাংবাদিক শহিদুল হক খান নিজেকেই এর উদ্যোক্তা বলে দাবী করেন। এ বিষয়ে বিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, নিজ হাতে পান্তার পোস্টার লিখেছেন, তার পরিবারের সদস্যরা ভাত রেঁধেছেন, ইলিশ মাছ ভেজেছেন, কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ কেটেছেন, মাটির সানকি সংগ্রহ করেছেন। আর সেই থেকেই নাকি রমনার বটমূলে খাওয়া শুরু হয় পান্তা ইলিশ। তবে বলা হয়ে থাকে, শহিদুল হক সাংবাদিক বোরহানের দুই বছর পর থেকে নিয়মিত পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশের আয়োজন করে থাকেন। সেই হিসেবে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার এই রীতির প্রবর্তক বলা যায় সাংবাদিক বোরহান আহমেদকেই।

৪.
ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির সাথে মাছ-ভাতের সম্পর্ক; নববর্ষ উদ্‌যাপনের সাথে ইলিশ মাছের প্রচলন বেশ নবীন হলেও পান্তাভাত সব সময়ই বাঙালি কৃষকের কাছে পরিচিত খাবার। এর সঙ্গে বিভিন্ন শাকসবজি ও শুঁটকি ভর্তা ছিল খাবারের তালিকায়। কিছু এলাকায় কচুশাকের ডাঁটা মিশিয়ে রূপচাঁদা মাছের শুঁটকির প্রচলন বেশি ছিল বলে জানা যায়। বাংলা নববর্ষের সাথে যেমন গ্রামীণ মেলা, নৌকা বাইচ, হৈ-হুল্লোড় করা গ্রামের পরিচিত দৃশ্য আবার ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে মেলায় মাছ, গরু, পাখি, ঘোড়ার আদলে মিষ্টি/মণ্ডা, বাতাসা, নকুল আর গরম গরম জিলাপি আর রসগোল্লার দোকান, তেমনি পান্তা-ইলিশও বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অন্যতম পরিচায়ক যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছাপিয়ে গেছে ওপার বাংলাতেও। সারাবছরের অপেক্ষার পালা মিটিয়ে দু’মুঠো পান্তাতে শুকনো পোড়া মরিচ ভেঙে ভাজা ইলিশের স্বাদ না নিলে বাঙালিয়ানা থাকলো কোথায়!

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারপার্সন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা তাওহিদা জাহান নিবন্ধ পান্তা ইলিশ সমাচার বৈশাখী আয়োজন ১৪৩১

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর