ভাষার জন্য লড়াই
১৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৫১
অনেকে বলে, ভাষার জন্য বাঙালি ছাড়া আর কেউ বুকের রক্ত ঢেলে দেয়নি। কথাটি ঠিক নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই ভাষার জন্য লড়াই হয়েছে। লড়াই চলছে। মায়ের ভাষার জন্য দামাল ছেলেরা প্রাণ দিয়েছে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর শহরে ১১ জন বাঙালি আত্মদান করেন। এ ছাড়া নেপালে নেয়ার ভাষা রক্ষার জন্য নেপালিরা আন্দোলন চালিয়ে আসছে। পাঞ্জাব ও রাজস্থানেও ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলন হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তবে ঢাকার পরই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাষা আন্দোলনটি হয়েছে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে। তামিলদের এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল হিন্দি ভাষার আগ্রাসন রুখে দেওয়া।
তামিলনাড়ুতে হিন্দিবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ব্রিটিশ আমলে। ১৯৩৭ সালে রাজাগোপালচারীর নেতৃত্বে ভারতীয় কংগ্রেস মাদ্রাজে (বর্তমান তামিলনাড়ু) সরকার গঠন করে। তারপরই একটি অফিস আদেশ জারি হয়। তাতে বলা হয়, প্রাদেশিক সরকার পরিচালিত স্কুলগুলোতে হিন্দি বিষয়টি অবশ্যপাঠ্য হবে। ই ভি রামস্বামী পেরিয়ার এর বিরোধিতা করেন। তার জাসটিস পার্টি আন্দোলনে নামে।
আন্দোলন দমাতে ১১০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। পেরিয়ার ও তার বিশ্বস্ত অনুসারী সি এন আন্নাদুরাই অন্তরীণ হন। এর মধ্যে দুই কারাবন্দি থালামুথু ও নাতারাজান জেলে মৃত্যুবরণ করেন। এ দুই মৃত্যু যেন আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়।
১৯৩৯ সালের অক্টোবরে ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করে কংগ্রেস সরকার সব প্রদেশ থেকে পদত্যাগ করে। মাদ্রাজ এর ব্যতিক্রম হলো না। ব্রিটিশ সরকার গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করে। ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গভর্নর এরস্কিন বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষার আদেশ প্রত্যাহার করে নেন।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর আবার জাতি গঠনের স্বার্থে সব প্রদেশে সর্বভারতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি প্রবর্তনের চেষ্টা শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ৫ নভেম্বর ভারতের গণপরিষদের এক বিতর্কে কংগ্রেস দলীয় সদস্য টি টি কৃষ্ণামাচারি বলেন, ‘এটা আমার যুক্ত প্রদেশের বন্ধুদের ওপর নির্ভর করছে, পুরো ভারত থাকবে নাকি হিন্দি-ভারত হবে। পছন্দ তাদের।’
হিন্দিভাষী যুক্তপ্রদেশের এমএনএরা সর্বভারতে হিন্দি ভাষা প্রচলনের ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। কৃষ্ণামাচারি সেদিন একটি দুর্দান্ত সত্য উন্মোচন করেন, যেটি বছর চারেক পর পাকিস্তানেও সত্য হয়ে ওঠে।
অনেক বিতর্কের পর গণপরিষদ মুন্সি-আয়ঙ্গার ফর্মুলা নামে একটি সমঝোতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এতে নিশ্চিত করা হয়, ভারতের প্রস্তাবিত সংবিধানে কোনো জাতীয় ভাষা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে না। ইংরেজি ও হিন্দি ১৫ বছরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দাফতরিক ভাষা হবে। হিন্দি প্রচার করতে ও ইংরেজিকে পর্যায়ক্রমে বাদ দিতে একটি ভাষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সেই ১৫ বছরের বেঁধে দেওয়া সময় ১৯৬৩ সালে শেষ হয়। ভারত সরকার দাফতরিক ভাষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়।
পেরিয়ারের রাজনৈতিক শিষ্য সি এন আন্নাদুরাই এর বিরোধিতা করেন। প্রস্তাবিত আইনে ছিল, হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি দাফতরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আন্না দাবি করেন, ‘may’-এর পরিবর্তে ‘shall’ ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি দাফতরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু প্রতিশ্রুতি দেন, ইংরেজি দাফতরিক ভাষা হিসেবে থাকবে।
১৯৬৪ সালে জহরলাল নেহেরু মৃত্যুবরণ করেন। দাফতরিক ভাষা ইংরেজি থাকবে কি না, এ নিয়ে তামিলরা দ্বিধায় পড়ে যায়। এটা আরও জোরালো হয় যখন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকার মাদ্রাজ আইনসভায় তিন ভাষায় শিক্ষার ফর্মুলা উপস্থাপন করে। ছাত্রদের নেতৃত্বে হিন্দিবিরোধী আন্দোলন সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ওই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ছিন্নস্বামী নামে এক ছাত্র প্রথম পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে নতুন দাফতরিক ভাষা আইন কার্যকর করার ঘোষণা দেয়। আন্নাদুরাই এর প্রতিবাদে এই দিন ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করার আহ্বান জানান। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এম ভক্তভাৎসালাম বলেন, এ ‘ধর্ম অবমাননা’ ছাড়া আর কিছু নয়। আন্নাদুরাইসহ ডিএমকের তিন হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে মাদ্রাজ শহর থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে মাদুরাই শহরে হয় সবচেয়ে ভয়াবহ বিক্ষোভ। সেখানে বিক্ষোভ দাঙ্গায় রূপ নেয়। শত শত মানুষ আহত হয়। ৭০ জন নিহত হয়। প্রাদেশিক সরকারের ভূমিকায় নিন্দা জানিয়ে মাদ্রাজ থেকে নির্বাচিত দুই কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তা প্রত্যাখ্যান করেন।
শেষমেশ ১৯৬৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী রেডিও ভাষণে ঘোষণা দেন, জহরলাল নেহেরুর প্রতিশ্রুত হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি দাফতরিক ভাষা থাকবে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তামিলানাড়ুর পরীক্ষার্থীদের হিন্দিতে পরীক্ষা দিতে হবে না। আরেক ফেব্রুয়ারিতে আরেক জাতির ভাষার সংগ্রাম সফল হলো।
সাতষট্টির নির্বাচনে আন্নাদুরাইর দল ডিএমকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সর্বভারতীয় দল কংগ্রেসকে প্রাদেশিক সরকার থেকে বিদায় করে। তারপর থেকে আন্নার অনুসারী ও তাদের উত্তরাধিকারীরাই ক্ষমতায় আছে।
সারাবাংলা/টিআর
ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা জয়দীপ দে শাপলু নিবন্ধ ভাষার জন্য লড়াই