আধখানা বসতি তাহার
১৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১৩
জানালার পর্দাগুলো এমন বেপরোয়া। বারবার উড়ে এসে আছড়ে পড়ছিল গায়ে। শোয়া থেকে উঠে গানের মনোযোগ হরণকারীকে থামাতে গেলাম। অমনি কলিং বেল বেজে উঠল।
মিষ্টির প্যাকেট হাতে রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি কেন?
ভেতরে আসি, তারপর বলি?
রাশেদ চাকরি পেয়েছে। বেশ ভালো চাকরি। মামু, চাচা, খালু ছাড়া নিজের যোগ্যতায় চাকরি পাওয়া কম কথা না। স্মার্টফোনের এ যুগে যোগ্যতা অর্জন করতে শক্ত মনোবল লাগে। জোরালো পরিশ্রম লাগে। রাশেদের তা আছে। অধিকাংশ অযোগ্য লোকের তা থাকে না। মামা, চাচা, খালু থাকে। আর আসমান সমান অজুহাত থাকে।
গানটা তখনো বেজেই চলছিল—
‘তুমি কোন পথে এলে জানি না মোর জীবনে/ সেই পথে এলো আমার ফাগুন ভুবনে/ জানি না কখন কুসুমের মতো/ আমারে কুড়ায়ে লয়েছো।/ আমি আপন করিয়া চাহিনি/ তবু তুমি তো আপন হয়েছ/ জীবনের পথে ডাকিনি তোমায়/ সাথে সাথে তুমি রয়েছ…’
আমি সবসময় বেদনার গান শুনি। কোনো ধামাকা, আনন্দের গান আমাকে টানে না। মরা গান। মরা নদী। নক্ষত্রহীন আকাশ আমাকে ভাবনার খোরাক দেয়।
গান রাশেদের কানেই ঢুকলো না। সে তার তরতাজা বক্তব্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল— আমি ভাবিইনি, চাকরিটা হবে। আমি যেইটা ভাবছিলাম, অবশ্য ওই চাকরিটা হয় নাই।
তাতে ক্ষতি কী হয়েছে ?
না, ক্ষতি না। বরং এটাই ভালো হইছে।
বলেছিলাম না, যোগ্য লোক তার জায়গা করে নেবেই।
রাশেদ হাসে। প্যাকেট খুলে মিষ্টি বের করে।
ডায়াবেটিস নেই। তারপরও মিষ্টি খাই না আমি। রাশেদের মিষ্টি না খেয়ে পারলাম না। বাকি মিষ্টি ফ্রিজে তুলে রাখলো রাশেদ। চিন্তায় পড়লাম, এই মিষ্টি কাকে খাওয়াব? কোথায় পাঠাব?
একা থাকি। ঘরের কাজ করে দিয়ে যায় যে ছেলেটা, সে সকালে এসে সারা দিনের সব কাজ সেরে যায়। তারপর আমার মতো আমি চালিয়ে নেই বাকিটা। মাঝে মধ্যে রাশেদ এসেও হাত মেলায় কাজেকর্মে। এককথায়, ও ভীষণ কাজের একটা ছেলে। কাজ ছাড়া এক দণ্ড সে বসে থাকতে পারে না।
প্রথম দিন থেকে রাশেদকে আমার অত্যন্ত করিৎকর্মা মনে হয়েছে। পরিচয়টা মেট্রোরেলে। আমাকে তার বসার সিট ছেড়ে দিয়ে বাকিটা পথ সে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সঙ্গত কারণেই কৃতজ্ঞতা ভর করল মাথায়। এককথায়, দুকথায় মোবাইল নম্বর আদান-প্রদান।
সে তখন হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিল। আমি তাকে বিভিন্ন বুদ্ধি-পরামর্শ দিতাম। প্রথম যেদিন সে বাসায় এলো, বাসায় কেউ নেই। দেখে ভীষণ অবাক হলো। চা খেতে চাইলে বললাম, আমি তো ভালো চা বানাতে পারি না।
আমি পারি।
সত্যি সত্যি সে অতুলনীয় চা বানাতে পারে। শুধু চা-ই না, সব রকম রান্না সে খুব ভালো জানে। কলাপাতায় মুড়ে মাছের পাতুরির রেসিপিও তার অজানা নয়। মাঝে মাঝে ও এসে রান্না করে দিয়ে যায়। বক্সে ভরে ফ্রিজেও রেখে যায়। রাশেদের রান্না খেতে খেতে কেমন যেন নির্ভরতা বাড়ে ওর ওপর। ওকে একটা চাকরি পাইয়ে দিতে, পড়াশোনায়, দক্ষতায় যত রকম তাল-তালিম আছে, সব ওকে শিখিয়ে দিতে গেলাম। মানুষ চাইলে সব হয়। শেষ পর্যন্ত জীবিকার বৈতরণী পার হলো রাশেদ।
মিষ্টির সাথে ও যে ঝাল পিঠা নিয়ে আসবে, ভাবিনি। এরপর চা পর্ব। ওর চা খেয়ে মন ভরে যায়। চাকরিতে জয়েনিংয়ের পর ওর আসা-যাওয়া আগের মতো আর অবাধ থাকবে না, ভেবে মন একটু খারাপও হয়।
চাকরি তো পেলে। এরপর কী করবে, ভেবেছ?
চাকরি করব। খাব-দাব, ঘুরব।
আর কিছু না?
আর কী?
কেন, বিয়ে করবে না?
বিয়ে! আমাকে বিয়ে করবে কে?
ওর শেষ কথায় এমনভাবে হেসে উঠি, যেন কোনো শিশুর প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলেছি অচেতনে।
প্লিজ, হাসবেন না, স্যার। আমি সত্যি বলছি। বিয়ে আমার কপালে নেই। আপনার যেমন…।
আমার যেমন…!
না, মানে আপনার যেমন সংসার নেই।
সংসার প্রসঙ্গে আমি চুপসে যাই। স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা, সম্পর্ক যত সহজ, সংসার ততই কঠিন। রাষ্ট্রপরিচালনার চেয়েও কঠিন সংসার চালনা।
রুবানা কিছুতেই আমার সাথে সংসার করতে চাইল না। আমার দোষটা কোথায়, তাও ভালো করে জানাল না। জানলাম, সে মোটেই সংসারী না। সংসার তার ভালো লাগে না। মা-বাবার চাপে পড়ে বিয়ে করেছিল আমাকে।
সেই থেকে আমি একা। মা-বাবার সংসার ছেড়ে আসতে হলো আমাকেও। বিয়ে করা বউ যে ছেলের সাথে সংসার করতে চায় না, সংসারে মুখ দেখানো তার জন্য বিরাট দায় হয়ে পড়ে।
পালিয়ে বেড়াই। সংসার থেকে পালিয়ে বেড়ালেও বয়স থেকে পালাতে পারি না। বয়স তার সব নিয়ম-কানুন আপাদমস্তক মেনে আমাকে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। ফোন করে মা-বাবার ওই একই মুখস্থ কথা— বিয়ে করবি কবে?
আমি সাহস পাই না আর। প্রথম জীবনের প্রত্যাখ্যান জীবনকে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে দিয়ে যায়। হামাগুড়ি দিয়ে চলা পাথর-নুড়ির রাস্তায় কি আর নতুন পথের সন্ধান মেলে! আমি আরও গুটিয়ে নেই নিজেকে।
রাশেদ তার কিছুটা বোঝে। কিছুটা বোঝে না। আমার মতো সে সংসারবিমুখ হতে চায়। আমি তাকে বোঝাই, সবার সংসার ভাগ্য সমান নয়। তোমার তো অভিজ্ঞতা নেই। অভিজ্ঞতা ছাড়া এ সংসারবিমুখতার কোনো মানে হয় না।
রাশেদ হাসে চুপি চুপি। ড্রয়িং রুমের পর্দা খুলে ভাঁজ করে রাখে। এগুলো লন্ড্রিতে পাঠানো দরকার। রান্নাঘরে সব কনটেইনারে মশলাপাতির নাম লিখে রাখে সযত্নে।
ছুটির দিন ছাড়া আমার সাথে দেখা করার ফুরসৎ মেলে না রাশেদের। ছুটির দিনটা তাই আনন্দে ভরপুর হয় আমাদের। সারা সপ্তাহের কথা জমিয়ে রাখে রাশেদ। সেখানে ঘুরেফিরে অফিসের কথা। এসব গল্প শেষই হতে চায় না।
বাসা থেকে বউয়ের ফোন এলো, কোন ভঙ্গিতে লাফিয়ে ওঠে বস! চায়ের কাপে দুলতে থাকে গ্রিন টির গাঢ় সবুজ পাতা। বসের কথা আর ভাবভঙ্গি অভিনয় করে দেখায় রাশেদ। পাশের টেবিলে বসা মিনহাজ সাহেব যে জোহরের নামাজ পড়তে গিয়ে আসর পর্যন্ত নিখোঁজ হয়ে যান, বাসা থেকে এক বাটিতে আনা হাসনা আপার ভাত-তরকারি-ডাল মিলে মিশে একাকার হয়ে খিচুড়ি হয়ে যায়, কম্পিউটার অপারেটর রাহাত যে ওয়েবসাইট ভিজিট করতে গিয়ে অ্যাপসে ঢুকে বসে থাকে, রুমে লোকজন কমে গেলে অ্যাকাউন্টসের সদ্য যোগদান করা ছেলেটা কাজের ফাঁকে ফাঁকে গার্লফ্রেন্ডকে ভিডিও কলে মুকাভিনয় দেখায়, হিসাবে ভুল করে— এসব গল্পের কোনো অংশই বাদ দেয় না রাশেদ।
শ্রোতা না হয়ে উপায় নেই আমার। এতটা আগ্রহ নিয়ে গল্পগুলো বলে যায় রাশেদ, এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। অবশ্য শুনতে আমার একঘেয়েও লাগে না।
অফিসের ট্যুরে রাশেদকে মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে যেতে হয়। সপ্তাহের ওই দিনগুলো ভীষণ পানসে লাগে আমার। দিনে দিনে কখন যে রাশেদ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে আমার জীবনে, বুঝতে পারিনি।
অনেকগুলো দিন পার হয়ে বুঝতে পারি, রাশেদ আমার পরমাত্মীয়। ঢাকায় ফিরে এসে সোজা বাসায় চলে আসে রাশেদ। অফিস থেকে ছুটি নেই আমি। আমরা দুজন শহর ঘুরতে বের হই। রেস্টুরেন্টে খেতে বসে রাশেদ বসের শ্যালিকার গল্প বলতে শুরু করে। রাশেদের কাছে সে কাজ শিখতে আসে। নির্মলা ফ্রন্টকে কীভাবে কনভার্টার দিয়ে নিকষে নিয়ে যেতে হয়, যে জানে না, সে চাকরি করে যাচ্ছে অবলীলায়! যোগ্যতা ছাড়া চাকরি কেবল এ দেশেই করা সম্ভব।
মেয়েটার নাম জানতে চাইলাম। রাশেদ পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, নাম দিয়ে কী করবেন?
এমনই জানতে ইচ্ছে হলো।
যোগ্য না হয়ে, পেছনের দরজা দিয়ে যারা চাকরি করতে আসে, তাদের নাম আমি মনে রাখতে চাই না।
এমনও তো হতে পারে মেয়েটি তোমার প্রেমে পড়েছে।
প্রেম!
এতে অবাক হচ্ছ কেন? তুমি দেখতে সুদর্শন…
আমার কথা কেড়ে নিয়ে রাশেদ বলল, এসব কী বলছেন? আমি কেন ওর প্রেমে পড়তে যাব?
আমি তোমার কথা বলিনি। বলেছি ওই মেয়েটির কথা।
হঠাৎ ব্রেক কষে, গাড়ি থেমে পড়ার মতো রাশেদের আঙুল ফ্রিজ হয়ে পড়ল। খাওয়া আর এগোতে চায় না। প্লেটে আঙুলগুলো ইতি-উতি ঘুরতে থাকে।
খাচ্ছ না কেন, রাশেদ?
আমার আর খেতে ইচ্ছে করছে না।
তুমিই তো পছন্দ করে কাচ্চি নিলে।
এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না।
গ্লাস ভরে পেপসি ঢেলে নিলো রাশেদ। গলায় ঢালতে লাগল একটু একটু করে। আনমনে। সে এখানে নেই। মন তার অজানা উদ্দেশে দিয়েছে উজাড় উড়াল। এই যে ওর কেবল শারীরিক উপস্থিতি, অস্বস্তি বাড়িয়ে চলছে আমার।
ওকে বিদায় করে বাসায় ফিরে এলাম। ভাবলাম, মন খারাপ তো হতেই পারে। সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়কে বয়ে যেতে দিলাম।
রাতে ফোনে পেলাম না ওকে। পরদিন প্রচণ্ড ব্যস্ততায় রাশেদের খবর নেওয়ার কথা মনে হলেও সময় বের করতে না পেরে রাতে আবার ফোন করলাম। মোবাইল বন্ধ।
সকালে ওর বাসায় গেলাম। ঠিকানা জানলেও এর আগে কখনো ওর বাসায় যাওয়া হয়নি। এভাবে হঠাৎ বাসায় যাব, ভাবতেই পারেনি রাশেদ।
মোবাইল অফ কেন তোমার?
হাত থেকে পড়ে গিয়ে মোবাইল ভেঙে গেছে।
আমাকে বলোনি কেন?
বলার সুযোগই তো পাইনি।
হঠাৎ ওর টেবিলে নতুন মোবাইল সেট চোখে পড়ল। একদম নতুন। মোড়ক খোলা হয়নি।
নতুন মোবাইল কিনেছ বুঝি?
না। বেতন না পেয়ে মোবাইল কিনব কীভাবে?
তাহলে এটা কোত্থেকে এলো?
ওই যে ওই আপদ জুটেছে একটা। ধুম করে মোবাইল গিফট করে বসল। আঠার মতো পেছনে লেগে আছে মেয়েটা। মনে হচ্ছে, বিয়ের জন্যই ওকে চাকরিতে ঢুকানো হয়েছে।
তুমি এত বিরক্ত হচ্ছো কেন? আমার তো মনে হচ্ছে, মেয়েটা সত্যিই তোমাকে ভালোবাসে।
আরে… ওর ভালবাসা দিয়ে আমি কী করব?
আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যদি তোমার ভালো না লাগে ওকে, সময় নাও। ভবিষ্যতে ভালো লাগতেও তো পারে। এসবের কি কোনো গ্যারান্টি দেওয়া যায়?
রাশেদ বলল, যায়। গ্যারান্টি দেওয়া যায়। আমার মনকে তো আমি চিনি। সে তো তার মতো চলে। একেবারে রাজার মতো বেপরোয়া। কাউকে ট্যাক্স দিয়ে চলে না। বেয়ারা মন।
ও আচ্ছা! এ জন্যই কাউকে তুমি তোয়াক্কা করো না? কাউকে তোমার মনে ধরে না? তুমি কাউকে পছন্দ করো না?
কে বলেছে আপনাকে, কাউকে আমার মনে ধরে না?
ও! তাহলে এই সমস্যা? আমাকে বলোনি কেন? চাকরি পেয়েছ, এখন ওসব লুকানোর কী আছে! বিয়ে করে ঘরে বউ আনবে, এসবে লেট কেন? তোমার বউ তুমি খাওয়াবে, বাঁধা দিতে যাবে কে! এবার বলো, সে কোন সৌভাগ্যবতী যে তোমার মনে লুকিয়ে আছে?
সে রমণী, এটা আপনাকে কে বলল?
কী বলছ এসব? সে রমণী নয়! তোমার মাথাটা গেছে একেবারে। বসের শালিকা তোমার মাথাটা একেবারে খেয়ে ফেলেছে।
ও কেন মাথা খেতে যাবে? মাথা খেয়েছে তো অন্য কেউ।
অন্য কেউ!
আমি হাসি চেপে রাখতে না পেরে বললাম, সেই অন্য কেউটা কে, সেটাই তো জানতে চাচ্ছি!
সেটা আপনি কোনোদিনও জানবেন না।
কোনোদিন না! আমি জানার মতো তাহলে কেউ না তোমার?
আপনি কেউ না, এটা কীভাবে ভাবলেন?
তাহলে ভালো করে হা-টা করো। মুখ বন্ধ রাখলে জানব কী করে?
আজ বলব না।
আজ বললে সমস্যা কোথায়?
সবসময় সব কথা কি বলা যায়!
আমি আর জোর করলাম না। রাতে বাসায় ফিরে অনেক ভাবলাম ওকে নিয়ে। এতগুলো দিন একসাথে আছি। কোনোদিন তো কোনো মেয়ের কোনো ফোনকল আসতে দেখলাম না। অনেকে অবশ্য বিয়ের আগে প্রেমিকের সাথে বেশি যোগাযোগ করতে চায় না। ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চায় না। দুজনার মাঝখানে রহস্যের জাল বিছিয়ে রাখতে ভালোবাসে। তারপর হঠাৎ একদিন এ জাল ছেড়ে বেরিয়ে আসাকেই বিয়ে বলে।
সারাদিন কাজের তোড়ে সব চিন্তা-দুশ্চিন্তা মাথা থেকে কোথায় হারিয়ে যায়, টের পাই না। রাতে অপেক্ষা করি, রাশেদ হয়তো ফোন করবে।
রাশেদের ফোন আসে না। ও এমন কেন করছে? ওর এই অচেনা রূপটা অবাক না করে পারে না আমাকে। একটা মেয়ে ভালোবেসেই মোবাইল ফোন গিফট করেছে তাকে, অথচ রাশেদ তার মর্মই বুঝতে চাচ্ছে না। ছেলেটার কী হলো!
সকালে আবার ওর বাসায় যাই। দরজার কড়ায় তালা ঝুলতে দেখে আঁতকে উঠি। রাশেদের এসব আনকোরা অচেনা কর্মকাণ্ডের কোনো অর্থ খুঁজে পাই না আমি।
কোথায় গেল ও! ওর অফিসের ঠিকানা তো আমার কাছে নেই। পাশের বাসায় খবর নিতে গিয়ে জানতে পারি, রাশেদ বাসা ছেড়ে চলে গেছে। ওর নতুন বাসার ঠিকানা কাউকে দিয়ে যায়নি।
তবে আমার জন্য রেখে গেছে একখানা চিঠি—
চিঠি পেয়ে অবাক হচ্ছেন?
অবাক তো হওয়ারই কথা। এমন হেয়ালিপনা কেন আমার! আপনি যাকে চেনেন, তার সাথে কি হেঁয়ালি ব্যাপারটা যায়? নারী হেয়ালি হবে, খেয়ালি হবে, একটুখানি উতলা হবে, উড়ু উড়ু মনমেজাজে পালিয়ে বেড়াবে, নিয়ম করে অভিমান- অনুযোগ তুলবে; আমি কেন এসবের মধ্যে?
নারী নই আমি। আমার কেন এত লুকোছাপা! কেমন আজব আজব লাগছে না আপনার? আজবই তো। সমাজে যারা ‘আজব চিড়িয়া’ নাম ধরে টিকে আছে, আমি তো তাদেরই একজন। চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মতো আমাদের পায়ের নিচে ঘাস আছে, মাটি আছে, আমাদের মাথার ওপরে উন্মুক্ত আকাশ আছে। সবই আছে। জৈবিক শ্বাস-প্রশ্বাসও আছে আমাদের। শুধু মুক্ত নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা নেই। শ্বাস-প্রশ্বাস সব দীর্ঘশ্বাস হয়ে যায় আমাদের। দীর্ঘশ্বাসই যে আমাদের নিয়তি।
পুরুষের শরীরে ষোল আনা নারীর মন! এই মন নিয়ে যে কী দুর্বিষহ বেঁচে থাকা! শতবার শতভাবে নিজেকে আড়ালে রাখি। খোলসের ভেতরে শরীর ডুবিয়ে, কোনোরকমে নাক ভাসিয়ে বেঁচে থাকি। তবুও শেষ পরিত্রাণ মেলে না!
মনের আকাশে হাজার তারার বাতি জ্বলে ওঠে। আকুল আরজি নিয়ে কোত্থেকে যেন চাঁদের আলো এসে ঠিকরে পড়ে। নিয়তি বড় ভয়ংকর। যার পায়ে নুপুরের এতো ঝংকার, নাচার স্বাধীনতা তার নেই। উতলা যে নদীর বুকে হাজার ঢেউয়ের মাতম, সে কি না সাগর ছুঁতে পারে না। মরুর বুকে তার অগ্নি সমাধি রচিত হয়।
আমি সেই অগ্নি নির্বাসনে চললাম। ভাগ্যিস আমার অফিসের ঠিকানা আপনার জানা নেই। আমাকে খুঁজে পাওয়ার সাধ্য আপনার নেই। আপনি কি জানেন, এই সমাজ ট্রান্সজেন্ডারদের যতটা বোকা ভাবে, তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি কৌশলী তারা?
আপনিও জানেন, মেধা ছাড়া আমি চাকরিটা পাইনি। বিনিময়ে আমাকে খোলসের আড়ালে থাকতে হয়েছে। আমি উন্মুক্ত হলে এই সমাজ আমাকে হিজড়া খেতাবে ভূষিত করবে। সেও তো আরেক বিড়ম্বনা। টেনেটুনে নারী হয়ে ওঠার প্রবল বাসনায়, দুমুঠো খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত আরেকজনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নিজেকে সঁপে দেওয়া। সেখানেও নিশ্চয়ই মধুর আখ্যান অপেক্ষা করে নেই আমাদের জন্য। গুরু মা ভালো হলে দিন দিনের মতো হয়। আর গুরু মা খারাপ মানে রাত-দিন সব এক হয়ে যায়। এই হলো আমাদের যাযাবর জীবন। কোনো ঘর নেই। মাথার উপরে কোনো আচ্ছাদন নেই। জন্ম থেকে শুধু ভেসে যাওয়া অজানায়। কী বিস্ময়কর আমাদের জন্ম! কী আশ্চর্যজনক আমাদের এই বেঁচে থাকা!
আপনি আমার কিছুই দেখলেন না। না মন, না রূপ! অফিসের এক নারী যখন আরেক নারীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, আপনি তখন তাকে স্বাভাবিক প্রেম মনে করে পুলকিত হন। কিন্তু যে মেয়েটাকে ছেলে মনে করছেন, একবারও কি তার চোখে চেয়ে দেখেছেন? তার মন ছুঁয়ে দেখেছেন— মন তার কী বলে, চোখ তার কোন ভাষায় কী সংকেত পাঠায়!
কী নিদারুণ নিয়তি! সাপের মতো শরীরের প্রয়োজনে বছরে দুচারবার খোলস খুলে ফেলতে পারি না। খোলসের আড়ালে অস্বস্তি বাড়ে। আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু হয় প্রতি মুহূর্তে।
আমার মা যেদিন মরে গেলেন, আমি কাঁদতে পারিনি এক ফোঁটাও। মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে ছটফট করছিলেন মা বুকে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। সাদা ব্যান্ডেজের ওপর ভেসে উঠছিল ফোঁটা ফোঁটা লাল রক্ত, কোনোভাবেই সাদা সাদা তুলোয় লাল রক্তকে লুকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না।
মায়ের কী চিৎকার! বাবার ঘরের দরজায় তখন শক্ত খিল। ভেতরে গান বাজছিল লাউড স্পিকারে—
‘একটা ছিল সোনার কন্যা/ মেঘ বরণ কেশ/ ভাটি অঞ্চলে ছিল/ সেই কন্যার দেশ…’
ভাগ্য কিীনির্মম খেলোয়াড়! আমার মায়ের রূপে-গুণে পাগল হয়ে বিয়ে করেছিলেন বাবা। মায়ের মাথা ভর্তি ছিল গোছা গোছা কুচকুচে কালো চুল। সেই কুচকুচে কালো কেশের মেয়েটি যখন মৃত্যু পথযাত্রী, বাবা তখন খোঁজও নিলেন না। বরং নতুন কোনো কালোকেশির স্বপ্নে তখন বিভোর তিনি। আর আমার মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের চোখে তখন একটাই আশঙ্কা— তার মৃত্যুর পর তার অনেক সাধনার ধন ছেলেটির কী হবে? কে তাকে ছায়া দিয়ে রাখবে?
মায়ের একটাই স্বপ্ন ছিল জীবনে— একটা ছেলের মা হওয়া। সেই স্বপ্নপূরণের পর পৃথিবীতে নতুন জন্ম পেয়েছিলেন মা। সেই আদরের ধন রেখে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার কষ্ট, নাকি শারীরিক অসুস্থতার কষ্ট— মায়ের কোন কষ্টটা বেশি ছিল, আমি জানতে পারিনি। শুধু জেনেছিলাম, পৃথিবী কোনো শান্তির জায়গা না।
আমি ছেলে হয়ে জন্মেছিলাম ঠিকই, সেটা শুধু মায়ের সান্ত্বনার জন্য। আদতে আমি ছিলাম নকল ছেলে। আমার ওপরটা নকল আবরণে ঢাকা। আর ভেতরের আমিটা নারীত্বের সব উপচারে গাঁথা এক অনাকাঙ্ক্ষিত মালা।
সেই কৈশোরে যখন বুঝে গিয়েছিলাম আমি মায়ের সেই তথাকথিত ছেলে নই, মাকে বুঝতে দেইনি। হাত পায়ের নড়ন-চড়ন, কথা বলার ধরন, চোখের দৃষ্টি— সবকিছুতেই এতটাই সাবধানী হলাম যে নিজের এই প্রাণপণ অভিনয়ে নিজেই নিজেকে চমকে দিতাম।
হাতের কাছে মায়ের চুলের ক্লিপ, লিপিস্টিক, গলার মালা পড়ে থাকতে দেখে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিতাম। ছুঁয়েও দেখতাম না, যদি বেখেয়ালে কিছু হাতে তুলে ফেলি। এ ভয়ে মায়ের কাছ থেকেও দূরে দূরে থাকতাম। আমার প্রকৃতির মানুষগুলো যেন কেমন। একটু বেশি সংবেদনশীল। বাতাসের আগে আমরা সব বুঝতে পারি। প্রতিকূল জন্মের কারণে অনুকূল কোনো কিছুতেই আর আমাদের আনন্দ আহলাদের কোনো সায় থাকে না।
আর আমাদের চারপাশে অনুকূল এমন কীই বা থাকে! ডানে, বামে, আসমানে, অন্তরীক্ষে অন্ধকার ছাড়া আমরা আর কিছুই দেখতে পাই না।
এর সবই তো জানা ছিল আপনার। শুধু আমার প্রকৃতি আপনার জানা ছিল না। আমাকে সমগোত্রীয় ভেবে আমার সাথে আরও অকপট ছিলেন আপনি। আপনার সেই মুক্ত মন আমাকে পেঁচিয়ে ধরল হাতির শুঁড়ের মতো। আপনার শার্টে যেদিন চা পড়ল, মনে নেই আমি কতটা সোহাগে আদরে, কতটা মোলায়েম আঙুলে ভিনেগার দিয়ে চায়ের দাগ মুছে দিয়েছিলাম? এরপর কী নিশ্চিন্তে বাইরে বের হলেন আপনি। দাগ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তাই রইল না। নারী ছাড়া এমন নিখুঁত মোলায়েম করে সাদা কাপড়ের ওপর থেকে চায়ের দাগ তুলে ফেলতে পারে কেউ? অথচ আপনি কিছু টের পেলেন না। মরলাম আমি একা জ্বলেপুড়ে।
চাকরির আগে ভালোই ছিলাম। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ কিছুতে পীড়াপীড়ি করত না। চাকরি হতে না হতেই বাড়ল বিয়ের জন্য পারিপার্শ্বিক চাপ। আপনি তখন আরও কয়েক সরস কাঠি এগিয়ে। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। প্রকৃতি তার নিয়ম মেনে চলতে গিয়ে আমাকে বিপাকে ফেলল।
লোহা আগুনে গলবেই। না গললে সেটা অস্বাভাবিক। প্রকৃতি বিরুদ্ধ তো বটেই। চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষণে কে ঠেকাতে পারে জোয়ার-ভাটার আগমন? প্রকৃতির কাছে আমি হেরে গেলাম। হেরে গিয়ে কঠিন সত্যকে আবারও আবিষ্কার করলাম। নারী হয়েও নারীর অবয়ব আমার নেই। আমাকে ফিরতেই হলো আমার স্বরূপের কাছে।
কতদিন, কতবার, কতভাবে যে স্বরূপে আপনার সামনে দাঁড়াতে চেয়েছি, তা আমি ছাড়া কেউ জানে না। সেসব বেহিসেবি দিনগুলো আমাকে আত্মগ্লানি ছাড়া কিছু দিতে পারেনি। সিনেমা হলে আপনার পাশে বসে কেঁদেছিলাম। একবারও কি ভেবেছিলেন, নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার অপারগতায় এক নারী তার বুকের পাঁজর ভেঙেচুড়ে, পুড়িয়ে নিজেকে বিলীন করে দিচ্ছে? সেই পুড়ে যাওয়া ছাই উড়িয়ে দিচ্ছে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে!
মৃত্যুর কোলে সঁপে দেওয়া নায়িকা নায়কের হাত ধরে কাঁদছিল আর বলছিল— নির্মম যে পৃথিবী আমাকে প্রাণভরে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিতে দিলো না, সঙ্গী হয়ে তোমার পাশে থেকে বেঁচে থাকতে দিলো না, সে পৃথিবীর ওপরে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। তুমি যা দিয়েছ, যেটুকু দিয়েছ তাতেই আমি তৃপ্ত-পরিপূর্ণ।
নায়িকার এই আর্তনাদ আপনার মনকে ভিজিয়ে দিয়েছে তরল মনোবেদনায়। আহা সে বেদনার কিঞ্চিত যদি আমার জন্য থাকত! একবার যদি আমার অন্তর্গত কান্না আপনি শুনতে পেতেন, আমিও জন্মের মতো পূর্ণ হতাম!
আমিও তো জন্ম থেকে আজব এক অসুখ বয়ে বেড়াচ্ছি শরীরে। আমার মৃত্যু প্রতিদিন। আমার কান্না দিনেরাতে পথেঘাটে। যখন কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক নারীকে দেখি, তখনই মরে যাই অর্ধ-নারী জন্মের গ্লানিতে। কতদিন, কতবার আপনার সামনে কোনো নারীকে দেখে কেঁদেছি আমি, আপনি ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারেননি। আমাদের সামনে যখনই জোড়ায় জোড়ায় কোনো নারী-পুরুষের হেঁটে যাওয়া দেখেছি, খুনসুঁটি করতে করতে একে অন্যের গায়ে হেলে পড়া দেখেছি, চোখের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাওয়া দেখেছি, আমি ততবার আপনার দিকে তাকিয়ে আমার জন্মকে ধিক্কার জানিয়েছি। ভেতরে জলধার পূর্ণ হয়েছে কানায় কানায়, জলে যন্ত্রণায়। আপনাকে এত কাছ থেকেও জানতে দেইনি, কতটা নির্মম আমার এই বেঁচে থাকা!
মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা নায়িকাকে দেখেছেন। আর আপনার পাশে বসা মানুষটির যন্ত্রণার বিষে নীল হয়ে যাওয়া দেখেননি। আপনি কেবল দেখেছেন তার হাসি। তার গান। গানের সাথে তার নিত্যনতুন করে বেঁচে থাকার ফন্দিফিকির।
যেদিন আমাকে টি-শার্ট গিফট করলেন, পাশেই ছিল সারি সারি শাড়ি। আমি কতবার মনে মনে চাইলাম, আহা ভুল করেও যদি কোনো ওজর, কোনো বাহানায় আপনি একটি শাড়ি কিনে দিতেন আমাকে! আমি হয়তো বেঁচে থাকার নতুন মন্ত্র খুঁজে পেতাম। দিন শেষে মাছের ঘর সংসার তো কোনো এক জলাধারের ভেতর মহলে।
চটপটি ফুচকার সাথে বাড়তি তেঁতুল খেতে দেখে আপনি কতবার আমাকে মহিলা বলেছেন নিজের অজান্তে! আপনার মন্তব্যে সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল আমার। কেবল আপনি সে কাঁপন দেখতে পাননি। আপনি আমাকে বলেননি, তারপরও আপনার মনের সব ক্ষতের সন্ধান আমি জানি।
যে নারী আপনাকে ছেড়ে গেল, সে যে কতটা অবুঝ, আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আপনি নিজেও না। মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, সে নিজেই নিজেকে চেনে না। আপনি কি জানেন, আপনার মতো হৃদয়বান মানুষের সংখ্যা এ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই? এমন মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায় না। আপনি আমাকে চিনেও চেনেননি। দেখেও দেখেননি। তাতে কী, আমি তো চিনেছি। আমি তো জেনেছি। আমার মতো করে, এতো ভালো আপনাকে আর কেউ চেনেনি। কেউ জানেনি। এই কারণেই তো আপনাকে ভালোবাসতে পেরেছি অন্ধের মতো।
ভালোবাসা তো এমনই হওয়া উচিত। দেখে-শুনে-বুঝে আর যাই হোক ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা এমনই এক আলো, এ আলোতে যে অন্ধ সে চোখে দেখে সবচেয়ে বেশি। তাই যে নারী আপনাকে চিনতে পারিনি, সে তো আমার মতো জন্মান্ধ ছিল না। এই জন্মান্ধ মানুষটির জন্য আপনার অনুশোচনাবোধে আক্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। অনুশোচনা শব্দটা কেবল আমার জন্য রেখে দিলাম। আমি কতটা ভাগ্যহীন যে আপনার মতো একজন হৃদয়বান মানুষের সাথে আমার নির্মল সুন্দর একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলাম।
আপনাকে কিংবা নিজেকে বিব্রত করার কোনো মানে হয় না। তাই ফিরতেই হলো আমাকে নিজের কাছে। আমি আমার মতো করে বেঁচে থাকব আমার আপন ভুবনে। আর কিছু না থাক, পেটে ভাত দেওয়ার মত সামর্থ্য তো আছে। আমার মতো মানুষের তো তাও থাকে না।
অনেক ভালো থাকবেন।
আপনার গুণমুগ্ধ রাশেদ।
রাশেদের চিঠি পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ বসে রইলাম স্থির। পৃথিবী এক মহাবিস্ময়ের নাম। কত রূপে কতজনকে আশপাশে দেখি। তাদের প্রকৃত রূপ কি ঠাওর করতে পারি? কত বৃক্ষ, কত তরুলতা, কত মানুষ! কত তার অভ্যন্তরীণ ব্যথা!
রাশেদ বরং চলেই যাক। কী দরকার তাকে পিছু ডাকার!
সারাবাংলা/টিআর
আধখানা বসতি তাহার ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা গল্প সাগরিকা নাসরিন