Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাপ কিংবা প্রতারণা


১৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪২

বাসা বদল করা যে কঠিন ঝামেলার কাজ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। গত তিনটা বছর ভালোই শান্তিতে ছিলাম এক বাসায়। কিন্তু গরিবের কপালে সুখ বেশি দিন সইল না। বাড়িওয়ালার পক্ষ থেকে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ আসতেই আমাদের বাসা ছাড়ার ঘোষণা দিতে হলো।
গল্পের শুরুতে আমার পরিচয়টা দিয়ে নেই। আমি রাতুল। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আছি। আমার স্ত্রী দিশা। ক্লাস ফোরে পড়ুয়া আমাদের এক কন্যা সন্তান আফিয়া। আফিয়া নামটা আমার মায়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা। আছিয়া আর আফিয়া।
তো যা বলছিলাম, সারাদিন অফিস করি। রাতে ফিরতে ৮টা/ ৯টা বেজে যায়। দিশাকে বললাম, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে এসে বাসা খুঁজতে থাকো। তুমি প্রাথমিকভাবে বাছাই করলে দুজন মিলে গিয়ে দেখে অ্যাডভান্স করে আসব।
দিশা প্রতিদিনই বাসা খুঁজে। কিন্তু মনের মতো হয় না। কী আর করা বলুন, মধ্যবিত্তের সেই পুরনো জ্বালা— সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় হয় না! বাসা পছন্দ হয় তো ভাড়ায় পছন্দ হয় না, ভাড়া মেলে তো বাসা পছন্দ হয় না।
আমরা একটু খোলামেলা আলো-বাতাস পছন্দ করি। মেয়েটার আবার অ্যাজমার সমস্যা আছে। দিশার আবার শুচিবায়ুর বাতিক। তাতে আমার বরং লাভই হয়েছে। ঘরটা সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর টিপটপ থাকে। বাসায় ঢুকলেই এক অন্যরকম শান্তি অনুভব হয়।
কিছুটা অস্থিরতা নিয়ে চশমার গ্লাস পরিষ্কার করতে করতে ডা. সাহরিন বললেন, এ পর্যন্ত তো সব ঠিকঠাক চলছে। মানে, ঘটনার শুরুটা কবে থেকে?
সেটাই বলছি ম্যাডাম। বলার জন্যই তো খুঁজে খুঁজে আপনাকে বের করেছি। তো দিশা বাসা পেল না। ওদিকে মাসেরও প্রায় ২৪-২৫ তারিখ। হাতে একদম সময় নেই। আমাদের বাসাটাও ভাড়া হয়ে গেছে। নতুন বাসা না পেলে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে অবস্থা। তাই মাসের শেষ ছুটির দিনটায় নিজেই বেরিয়ে পড়লাম বাসার খোঁজে।
এ সময়ে টু-লেট সাইনবোর্ড থাকে না বললেই চলে। খুঁজে খুঁজে একটা গলির অনেকটা ভেতরে চলে এসেছি। রুপালি রঙের স্টিলের গেটের গোলাপি রঙের নতুন একটা বিল্ডিংয়ে টু-লেট পেলাম। নক করতেই দারোয়ান প্রাথমিক আলাপে জানাল, দোতলা দক্ষিণমুখী ফ্ল্যাট! ভাড়া আর বিল্ডিং দুইয়ে মিলে পছন্দই হয়েছে। বাকি শুধু বাসার ভেতরটা দেখা। দারোয়ান বেশ গম্ভীর মানুষ। প্রশ্ন করলে কিছুটা সময় নিয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছেন।
– বাসা তো একদম নতুন! এখন কি ভাড়াটিয়া আছেন?
– হুম।
‘হুম’ আর ‘না’-তেই জবাব। সুতরাং আলাপ জমার চান্স নাই। অতএব চুপ থাকাই শ্রেয়। তাকে ফলো করে ওপরে উঠছি। দোতলায় তিনটা ফ্ল্যাট। এক বন্ধ দরজার সামনে তিনি থেমে গেলেন। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে উনি বেল চাপলেন না, পকেটে হাত দিয়ে চাবি বের করলেন। ড্রইং রুমটা ছিমছাম গোছানো। তার পাশেই বাথরুম। উনি একেক রুমে যাচ্ছেন আর লাইট জ্বালাচ্ছেন। ড্রইং রুম পেরিয়ে মাস্টার বেডরুম। একটা সুন্দর বড় খাট। সেই খাটের বিছানার ওপর জামাকাপড় এমনভাবে রাখা যেন কেউ একটু আগেই তাড়াহুড়ায় চেঞ্জ করে কাপড়গুলো গোছগাছের সময় পায়নি, ওখানেই রেখে গেছে। পাশের রুমটা বেশ এলোমেলো।
– আচ্ছা! এখানে যারা থাকেন তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই কি চাকরিজীবী?
– না।
– উনারা কেন ছেড়ে দিচ্ছেন বাসাটা, জানেন কিছু?
– লোকটা সুইসাইড করছে এই রুমে এই ফ্যানের লগে। বাচ্চা দুইটা নিয়া বউ দ্যাশে চইল্যা গেছে। দুই-এক দিনের মধ্যে জিনিসপত্র নিতে লোক আসবে।
– কতদিন হয় এই ঘটনার?
– দিন দশেক হবে।
এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হলো। দমবন্ধ লাগছে। পরিবেশটা গুমোট আর ভারী। দক্ষিণের বারান্দাটাও যেন একটা লাশকাটা ঘর। নাহ! এখানে এক মুহূর্তও দাঁড়াব না।
শেষবারের মতো আশপাশটায় তাকালাম। ঘরভর্তি ফার্নিচার, কাপড়চোপড়, সৌখিন জিনিসপত্র। অভাবের চিহ্ন মাত্র নেই। অথচ কিছু একটার নিশ্চয়ই তীব্র অভাব ছিল। সাজানো সংসারটা পরে আছে। মানুষ দুজন শুধু দুই ভুবনের বাসিন্দা হয়ে গেছে। কত স্বপ্ন নিয়েই তারাও হয়তো একদিন সাজিয়েছিল এ ঘর। হাত ছোঁয়া দূরত্বে কিংবা হাত ধরাধরি করে দখিনা বারান্দায় হয়তো দেখেছিল পূর্ণিমার চাঁদ! সেখানেই এখন কবরের নিস্তব্ধতা। যোজন যোজনের দূরত্ব…
আহা জীবন!
দারোয়ানকে হ্যাঁ-না কিছুই বললাম না। ফোন নম্বর নিয়ে আসলাম। স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে রাতের মধ্যে কনফার্ম করব বললাম।
বাসায় এসে ভাবনায় পড়ে গেলাম, বাসাটা নেব কি নেব না। সুইসাইড পার্ট বাদ দিয়ে লজিক্যালি চিন্তা করলে মাসের এই শেষ সময় এমন বাসা পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। সুইসাইড করেছে তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দিশা শুনলে নিতে চাইবে না। ওর মধ্যে এক অদ্ভুত ধারণা, আগের ভাড়াটিয়া যে কারণে বাসা ছাড়ে, পরের ভাড়াটিয়ারও একই পরিণতি হয়। যেমন— আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের রুবেল সাহেব ফ্যামিলিসহ বিদেশে চলে গেছেন। তারপর আকমল সাহেবেরা উঠেছিলেন। করোনায় চাকরি হারিয়ে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপ হলো যে তারা তল্পিতল্পা নিয়ে গ্রামে চলে গেল। দিশার বদ্ধমূল ধারণা হলো— এই ফ্ল্যাটে যারাই উঠবে, ফ্ল্যাট ছাড়া, মানে তাদের ঢাকা ছাড়া হতে হবে। এমন আর কী!
নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়ার পর সুইসাইডের ব্যাপারটা দিশার কাছে গোপন রেখে বাসাটা নিয়ে ফেলার সিদ্বান্ত নিলাম। রাত প্রায় ৮টার দিকে দিশাকে নিয়ে গেলাম বাসা দেখে কনফার্ম করতে। এবার বাড়িওয়ালা এলেন। নিজ বাসার গুণকীর্তন করলেন। বাসা পরিষ্কার রাখা, ভাড়া ঠিকমতো দেওয়া ইত্যাদি কথা হলো। এখানে আসার পর দিশা অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল। কোনো প্রশ্ন করলো না। হঠাৎ দেখলাম আমাদের কথার মাঝে ও নেই। খুঁজতেই দেখলাম ড্রইং রুমে আগের ভাড়াটিয়ার ফ্যামিলি ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে। এই সোফায় বসেই তোলা। হাসিমুখ চারজনের। আমি গিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললাম, বাসা পছন্দ হয়েছে? অ্যাডভান্স করব?
– হুম।
যথাসময়ে আমরা বাসায় উঠলাম। দিশা তার হোস্টেল থাকা খালাতো বোন দীপা আর তার বান্ধবী সুজাতাকে নিয়ে বাসা গুছিয়ে ফেলল প্রায় দুদিনেই। দিন যায়। আমাদের রুটিনমাফিক দিন ভালোই চলছিল। এখানকার প্রতিবেশীরা একটু কেমন যেন, কেউ কারও বাসায় যায় না। পরিচিত হতেও চায় না। দিশা দুয়েকজনের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি।
এক রাতে ঘুম ভেঙে দেখলাম, দিশা বিছানায় নেই। আলো জ্বালালাম। নাহ! রুমের কোথাও নেই। লাগোয়া বারান্দায় গেলাম। সেখানেও নেই। জোরে ডাকলে মেয়ের ঘুম ভেঙে যাবে, তাই ডাকছি না। খুঁজতে গেলাম পাশের রুমে। এই রুমটা আমরা ওভাবে ব্যাবহার করি না। প্রয়োজন হয় না আসলে। আবছা আলোতে একটা নারীমূর্তি বসে আছে মনে হলো খাটের ওপর। হাতরে গিয়ে লাইটের সুইচ চাপলাম, দিশা বসে আছে। এলোমেলো চুল আর চোখের রঙ লাল। কী ভয়ংকর লাগছে তাকে!
– তুমি এখানে কী করছ? ঘুম আসছে না বুঝি?
– এখানে একজন সুইসাইড করেছে, তুমি আমায় বলনি কেন?
– কী বলছ এসব?
– ওহ! তুমি জানো না? নাকি জেনেশুনে চেপে যাচ্ছ সব?
– কী হয়েছে তোমার? এসব কী বলছ? এমন করছ কেন?
– একটা মানুষ এই ঘরে ফ্যানে ঝুলে মরে গেল, আর তুমি বলছ কিছুই হয়নি? তোমারা মানুষেরা এমন কেন? তোমাদের সব লোকদেখানো, সব অভিনয়। কেউ কাউকে ভালোবাসে না। কেউ কারও অপেক্ষায় থাকে না। স্বার্থপর সব।
সাহস করে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম, চলো তো এখান থেকে! ঘুমাবে।
কথা শেষ করার আগেই ও হেলে পড়ল আমার বুকে। বুঝলাম জ্ঞান হারিয়েছে।
ডা. সাহরীন: তার মানে বলতে চাচ্ছেন, সে নিজে থেকেই ঘটনাটা জেনে গেল!
রাতুল: জ্বি ম্যাম! আমি কখনো ভুলেও এটা বলিনি তার কাছে।
ডা. সাহরীন: হতে পারে দারোয়ান বা প্রতিবেশীদের কেউ বলেছে!
রাতুল: মনে হয় না। কারন এমন একটা ঘটনা জানলে ও আমাকে ফোন দিত সবার আগে। বাসা ছেড়ে দিতে বলত তাৎক্ষণিক।
ডা. সাহরীন: আচ্ছা। তারপর?
সকালে সব স্বাভাবিক। দিশা নাস্তা বানাচ্ছে, বাচ্চাকে রেডি করছে। রাতের কথা ও কিছু বলল না, আমিও তুললাম না। এরপর দুই রাত স্বাভাবিক। তৃতীয় রাতে আবার দিশা বিছানায় নেই। অন্য কোথাও না খুঁজে আমি চলে যাই পাশের রুমে। আজ আলো জ্বলছে আর দিশা একটা ওড়না ফ্যানের সঙ্গে বাঁধার চেষ্টা করছে। মুহূর্তেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। সে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলে আমাকে, আর অদ্ভুতভাবে হাসে সেই লাল চোখ বের করে। কেমন চাপা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, এই অভিশপ্ত বাসা থেকে তোর মুক্তি নেই। কোথাও যাওয়ার সাধ্য নেই।
-দিশা! দিশা! কী বলছো তুমি! এসব কী হচ্ছে!
আমি এবার সর্বশক্তি দিয়ে তাকে নামিয়ে আনলাম। আবার সে অজ্ঞান। এবার আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
ঠিক করলাম, প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে ওই রুমটা লক করে দিয়ে চাবি আমার কাছে রাখব। কিন্তু পরদিন অফিস থেকে ফিরে রাত বাড়তেই আমিও যেন কেমন আতঙ্কিত বোধ করতে লাগলাম। রাতের খাবারের জন্য দিশা চুলায় তরকারি গরম করতে গেছে। হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার শুনলাম তার। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম ও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। জড়সড় হয়ে আছে রান্নাঘরের এক কোনায়। আমাকে দেখেই দ্রুত এসে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
– ওই লোকটা এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার ঠিক পেছেনেই।
– কোন লোকটা? কার কথা বলছ।
– ওই লোকটা। ছবির সেই লোকটা।
ঘটনা বুঝতে পেরেও আমি বললাম, কী সব যা তা বলতেছ? ওই লোক/সেই লোক! এখানে কোন লোক আসবে কোত্থেকে!
– এখানে যারা আমাদের আগে থাকত, সেই গৃহকর্তা।
– ধুর! সে এখানে আসবে কী করে!
– কী করে আসবে তা তো জানি না। কিন্তু এসেছে। সত্যি করে বলো তো, এখানে কী ঘটেছে? কোনো অঘটন ঘটেছিল কি?
– কী ঘটবে আবার? তোমার সামনেই তো বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা হলো, দেখলে না!
কোনোমতে রাতের খাবার শেষ করলাম। অনেক বলেকয়েও দিশাকে খাওয়ানো গেল না। খাটে আধা-শোয়া হয়ে লেপ্টে আছে আমার সঙ্গে। এবার সেই কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটা করল সে আমাকে।
– আচ্ছা, আমাদের আগে যারা ছিল, তারা এ বাসা ছেড়ে গেল কেন?
– জানি না।
– কেন জানো না? তুমি জিজ্ঞাসা করোনি?
– নাহ! এমনিতেই বাসা পাই না, মাথা খারাপ হওয়ার জোগার। এর মধ্যে কে কী কারণে বাসা ছাড়ছে— এত কিছু জানার কী দরকার! এসব ফালতু চিন্তা কোরো না তো আর! ঘুমাও।
– তুমি ঘুমাও। আমার ঘুম আসবে না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এখানে এই বাড়িতে অশরীরী কিছু আছে। আমি যেদিকে যাই, কেউ একজন আড়াল থেকে আমার দিকে নজর রাখে। এমনকি বাথরুমে গেলেও আমি আয়নায় তাকাতে পারি না ভয়ে। মনে হয়, তাকালেই আমি আমাকে নয়, অন্য কাউকে দেখতে পাব। বীভৎস কোনো মুখ।
– কী সব বলতেছ! কতবার নিষেধ করেছি ভুতের সিনেমা, ভুতবিষয়ক ফেসবুক এসব দেখবা না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এসব দেখতে দেখতেই তোমার মাথায় এসব চিন্তা ভর করেছে। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে তোমার!
বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।
পরদিন অফিস থেকে ফিরতে রাত ১০টার কাছাকাছি। বাসায় এসে দেখি, ঘরের দরজা খোলা। আফিয়া মোবাইলে ব্যস্ত। জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার মা কোথায়? আর দরজাই বা খোলা কেন? ‘জানি না’ বলে সে আবার ডুবে রইল মোবাইলে। শুধু বলল, ওই আংকেলের সাথে গেছে মনে হয়।
– কোন আংকেল?
– আমাদের এই বাসায় যারা আগে থাকত, সেই আংকেলটা এসেছিল।
– মানে? কী বলছ এসব! তুমি দেখেছ তাকে?
– হ্যাঁ। ড্রইংরুমে বসে ছিল। মা চা বানিয়ে দিলো। আমি গল্প করলাম। উনি বললেন, তার একটা কম্বল কিনতে হবে। উনি যেখানে থাকেন সেখানে নাকি অনেক শীত লাগে। মাকে নিয়ে মার্কেটে যেতে পারে। মা-ও বলছিল, ঘরে তার দমবন্ধ লাগছে।
কী হচ্ছে এসব! আমি তো কিছু বুঝছিনা। পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। নাহ! কোথাও নেই। ফোন দিলাম। ড্রেসিং টেবিলের ওপর বাজছে সেটা। কী মনে করে ছাদে উঠে গেলাম। ছাদের এক কর্নারে দাঁড়িয়ে আছে দিশা। নিচুলয়ে কিছু বলছে, হাসছে। আমি কাছে যেতে যেতে দেখলাম, দিশা সামনের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে দেয়ালের ওপরে। যেন কারও হাত ধরে তাকে অনুসরণ করছে। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, দিশা! কী করছো তুমি! সে হাসিমুখে পেছন ফিরে বলল, চলে যাচ্ছি। তুমি তো এটাই চেয়েছিলে!
– প্লিজ! থামো! এসব কী বলছ তুমি!
– আর অভিনয় করতে হবে না রাতুল। আমি সব জানি। সত্যিটা আজ আমি জেনে গেছি।
কোনো অঘটন ঘটানোর আগেই আমি তাকে ধরে ফেললাম।
ডা. সাহরীন: এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, আপনি বাসা চেঞ্জের চিন্তা করেননি?
রাতুল: খুব দ্রুতই ঘটছিল ঘটনাগুলো। নতুন বাসায় উঠেছি, তার একমাসের মধ্যে এত কিছু। বাসায় দুই মাসের অ্যাডভান্স দেওয়া। আমাদের মতো সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে চাইলেই বাসা পরিবর্তন সম্ভব না। তবুও ছাদের ওই ঘটনার পর বাসা ছেড়ে দেবো মনস্থির করলাম। এভাবে আর টেনশন নিতে পারছিলাম না। অফিসের কাজে মন দিতে পারছিলাম না, পারফরম্যান্সও খারাপ হচ্ছিল।
যাই হোক, ছাদের ঘটনার পর দিশা অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ হয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিলো। সংসার, সন্তান কোনো কিছুর খেয়াল নেই তার। আমাকেও সহ্য করতে পারে না। দিন-রাত বিভিন্ন সময়ে ওই লোকের ছায়ামূর্তি দেখতে শুরু করল এবং তার সঙ্গে কথা বলতে থাকল। মাঝে মধ্যে অদ্ভুত আর অসংলগ্ন সব কথা বলে।
ডা. সাহরীন: যেমন? দুয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাবে?
– যেমন একদিন বলে, রাতুল তোমার বস কবে আমেরিকা যাচ্ছে?
– মানে? বস কেন আমেরিকা যাবে?
– তার মেয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। এই সময় তার থাকা উচিত পাশে। মা মরা মেয়েটার মৃত্যুর সময় প্রিয়জন পাশে না থাকাটা মর্মান্তিক বেদনাদায়ক। শূন্য ঘর থেকে একাকী বিদায় নেওয়া মৃত্যুর যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে দেয় শত গুণ। শেষ বিদায় বেলা কপালে একটা চুমু না জুটুক, অন্তত কাউকে বলা যাওয়া দরকার, ‘চলে যাচ্ছি।’
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, পরদিনই জানলাম, বস আমেরিকার যাচ্ছে। তার মেয়ে ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর একদিন পরই মৃত্যু সংবাদ!
ডা. সাহরীন: ইন্টারেস্টিং!
রাতুল: তবে ম্যাডাম, তার সব কথা সত্যি হয় না। এই যেমন আমাকে জিজ্ঞাসা করল, রাতুল তোমার ব্যাংকক ট্যুর কবে? অথচ আমার এমন কোনো পরিকল্পনাই নেই। আবার আমার কলিগ শিপ্রা ডিভোর্সের পর কোথায় উঠবে জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু শিপ্রার ডিভোর্সের প্রশ্নই আসে না। ওরা হ্যাপি কাপল।
ওর এসব আচরণ আমার শ্বশুড়-শাশুড়ি জানলেন। তাদের ধারণা, খারাপ জিন ভর করেছে নীরার ওপর। চিকিৎসা দরকার, তাই তারা এসে বেড়াতে নিয়ে গেলেন ওকে। আমিও বাসা ছেড়ে দেবো জানিয়েছি বাড়িওয়ালাকে। সিদ্ধান্ত হলো, বাসা ছাড়ার আগ পর্যন্ত ও মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি খুলনায় থাকবে। ঢাকায় এসে নতুন বাসায় উঠবে।
এখন সমস্যা হচ্ছে, একা বাসায় থাকা শুরু করার পর আমিও ওই লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি। সেদিন গোসল করছিলাম। আয়নায় চোখে যেতেই দেখলাম, লোকটা আমার দিকে অদ্ভুত খুনির মতো শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। হাত-পা নাড়াতে পারছিলাম না। যত দোয়া-দরুদ পারি, পড়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুই মনে আসছিল না। কতক্ষণ পড়ে রইলাম ওখানে, জানি না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি কোনো খাবার-দাবার নিয়ে এসে যেখানে রাখছি, সেখানে আর পাচ্ছি না। এক পিস কেক রেখেছি ডাইনিংয়ে, সেটা হয়তো পেলাম ময়লার ঝুড়িতে। সবচেয়ে ভয়ংকর যেটা হয়, আমি ঘুমালে মনে হয় কেউ তীক্ষ্ণ নজর রাখছে আমার ওপর। কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলছে। হকচকিয়ে ঘুম ভেঙে যায়। হার্টবিট এত দ্রুত হয় যে মনে হয় হৃদপিণ্ডটা বের হয়ে যাবে এখনি, আমি দমবন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি। ঠিক সেই মুহূর্তে পুরুষালি কণ্ঠের হাসির আওয়াজ শুনি। আমি খুব প্রাকটিক্যাল মানুষ। জিন-ভূত, প্রেতাত্মা, তাবিজ-কবচ এসব কিছুই বিশ্বাস করি না। কোনো কুসংস্কার মানি না। কিন্তু এ ঘটনায় নিজেকে যতই যুক্তি দিয়ে বোঝাতে যাই না কেন, কোনো যুক্তিই কাজ করছে না। এ জন্যই আপনাকে খুঁজে আপনার কাছে আসা। আমি আর পারছি না ম্যাডাম। আমাকে বাঁচান।
ডা. সাহরীন: আপনার ঘটনাটি আসলেই বেশ ইন্টারেস্টিং। জিন-ভূত আমিও বিশ্বাস করি না। কিন্তু আপনার গল্প শুনে আমারও জিন-ভূত দেখার আগ্রহ হচ্ছে। যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে একদিন নিয়ে যাবেন আপনার বাসায়? ধরে নিন এটা আপনার কেস সলভ করারই একটা অংশ।
রাতুল: ঠিক আছে ম্যাডাম। কিন্তু শুক্রবার ছাড়া তো আমার ছুটি নাই। আর অফিস থেকে ফিরতেও রাত হয়। ইয়ে মানে আপনাকে কখন যে নিয়ে যাই…
– আচ্ছা, তাহলে নেক্সট শুক্রবারেই যাব। হ্যালুসিনেশনে মানুষ অনেক কিছু দেখতে পায় চোখে, জানেন তো?
– জ্বি, জানি। কিন্তু দিশা, আমি, আফিয়া আমরা তিনজনই কেন দেখব, সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছি। আমাদের কথা বাদ দেই। আফিয়া তো এসব কিছুই বুঝে না। ও কেন দেখবে?
– হ্যাঁ। এটা ভালো প্রশ্ন। আর এ জন্যই আমি আপনার বাসায় যেতে চাচ্ছি। যাওয়াটা দরকার।
– ম্যাম! যদি কিছু মনে না করেন, আজই চলুন। আমি আর থাকতে পারছি না বাসায়। ভয়েই মরে যাব। প্লিজ ম্যাম!
ডা. সাহরীন ঘড়ি দেখলেন। এখন তো রাত সাড়ে ৯টা বাজে। চাইলে আজ যেতে পারি। আমার হাতের কাজটা শেষ করে নেই। আপনি কি আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবেন?
– অবশ্যই পারব, ম্যাডাম!
– ওকে। অপেক্ষা করুন তাহলে।
ডা. সাহরীন তুখোড় বুদ্ধিমতী। দেশ-বিদেশে পড়ালেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানুষের সাইকোলজি পড়ায় শহরজুড়ে খ্যাতি আছে তার। যত বড় বড় পুলিশ কেসের ক্রিমিনাল আছে, তাদের ইনভেস্টিগেশনেও মাঝে মাঝেই ডাক পড়ে। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার সাহরীন ব্লু জিন্স আর সাদা শার্টে যখন গাড়ি থেকে নামলেন রাতুলদের গেটে, দারোয়ান ভ্রু কুঁচকে দেখছে তাকে। জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কি চলে যাবেন না থাকবেন।
রাতুল অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না, না, উনি থাকবেন না। কিছুক্ষণ পরই চলে যাবেন।
– এখন তো ১১টার বেশি বাজে। ১২টা বাজলে গেটে তালা লাগাইয়া বাড়িওয়ালার বাসায় চাবি দিয়া আসতে হয় তো, তাই জিগাইলাম।
– আচ্ছা, সমস্যা নেই। ১২টার আগেই বের হব— আশ্বস্ত করল সাহরীন।
ঘরে ঢুকে সাহরীন প্রথমেই প্রতিটা রুম একবার চোখ বুলিয়ে প্রথমে দেখে নিলেন। এরপর আগের ভাড়াটিয়া যে রুমে আত্মহত্যা করেছিলেন, যে রুম নিয়ে এত রহস্য, সেখানে গিয়ে থামলেন। খাটের চাদর-তোশক উলটে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লেখার একটা প্যাড পেলেন। কিছু লেখা তাতে। মনযোগ দিয়ে পড়ছেন। রাতুল তার জন্য চা বানাতে গেল রান্নাঘরে।
– ম্যাম, চা কি এখানে আনব নাকি সামনের রুমে বসবেন?
সাহরীনের আপাতত চায়ের দিকে মন নেই। দৃষ্টি ফ্যানের দিকে।
– আচ্ছা, এটা তো সে সেই ফ্যান যেটাতে ভদ্রলোক ফাঁস নিয়েছেন?
– জ্বি।
– এটা সরানো হয়নি কেন?
– আসলে ম্যাম, এটা আমি খেয়াল করিনি। তারাও খুলে নিয়ে যায়নি। আর এ রুমে আমাদেরও ফ্যান লাগানোর প্রয়োজন পড়েনি। তাই বিষয়টা আমার মাথায় ছিল না।
– আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। আর ফ্যানটারও তো দেখি এমন দশা, যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে এখানে কোনো ঝামেলা আছে। তার উপর দিশার হাতে পড়েছিল এই নোট!
রাতুল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে।
আবার বলতে শুরু করেন সাহরীন, আসলে এটা কোনো সুইসাইড নোট না। বাচ্চাদের আঁকিবুঁকিও আছে এর মধ্যে অনেক। কিন্তু এমন কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথা আছে, যাতে স্পষ্ট হয় ভদ্রলোক নিজেই লিখতেন মাঝে মধ্যে। উনি একাকীত্বে ভুগতেন। উনি এখানে একা ঘুমাতেন। বাচ্চাদের নিয়ে স্ত্রী পাশের রুমে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে স্ত্রী ব্যাস্ত হতো ফোন আর ফেসবুকে।
একদিকে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে শারীরিক-মানসিক দূরত্ব, অন্যদিকে মা-বাবার অমতে বিয়ে করেছিলেন বলে তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল খারাপ। বলতে গেলে সবার মাঝে থেকেও ভীষণ একাকী ছিলেন তিনি। এ জন্যই একপর্যায়ে জীবন অর্থহীন মনে হতে থাকে তার কাছে। ভয়াবহ ডিপ্রেশন থেকে আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধন্ত। ওই যে আপনার স্ত্রী বলছিলেন, একাকী ঘর থেকে বিদায় নেওয়া… দেখুন ঠিক সেই লাইনটাই লেখা আছে এখানে। রাতুল যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রাতুল অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সাহরীনের দিকে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সাহরীন।
– মি. রাতুল, আমি এখন যা বলব তা হজম করতে আপনার কিছুটা কষ্ট হতে পারে। তবু বলতে তো আমাকে হবেই, যেহেতু আপনি আমার সাহায্য চেয়েছেন। পরামর্শের জন্য ফি দিয়েছেন।
রাতুলের চোখ নিবদ্ধ ফ্লোরে, যেন তার বড় কোনো কুকর্ম ধরা পড়েছে। নিচু গলায় বলল, যতই কষ্ট হোক, আমাকে হজম করতে হবে। তবু এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই। সারাক্ষণই মনে হয় কানের কাছে কেউ ফিসফিস করছে। শরীর ভারী লাগে। মনে হয় পেছনে কেউ হাঁটছে…
– তাহলে বলি। আপনার কলিগ শিপ্রার সঙ্গে আপনার এক্সট্রা ম্যারাইটাল রিলেশনশিপ আছে।
রাতুল অবাক হলো না। সে ধরেই নিয়েছিল, সাহরীন এটা জেনে যাবেন।
– তো সেই সম্পর্ককে একটা রূপ দিতে শিপ্রার তরফ থেকে চাপ ছিল। আপনিও দিশার সঙ্গে কাটানো একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি চাচ্ছিলেন। বিয়ের ১০-১২ বছর পার হলে আমাদের দেশে এমনিতেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কগুলো ভাই-বোন টাইপ হয়ে যায়। কোনো এক্সসাইটমেন্ট নেই, চার্ম নেই, পানসে আর একঘেয়ে। এখানেই মানুষ ভুলটা করে। পুরনো সম্পর্কটা ঝালাই করে রোমাঞ্চকর বানানোর পরিবর্তে নতুন সম্পর্কে ঝুঁকে পড়ে। অথচ ভুলে যায়, সব নতুন একদিন পুরনো হয়। সব পুরনোও একদিন নতুনই ছিল।
যাই হোক, আপনি যখন বাসা দেখতে এসে ঘটনা শুনলেন তখন ভয় পেয়েছেন বা দিশা রাজী হবে না ভেবেছেন, এটা সত্যি। আপনার অবচেতন মন সায় দেয়নি। কিন্তু আপনি যখন ভেবে দেখলেন, এটা একটা মোক্ষম উপায় হতে পারে দিশা নামক পথের কাটা সারানোর, তখনই আপনি বাসাটা নিতে মরিয়া হয়ে গেলেন। সে রাতেই বাসা নিয়ে ফেললেন। স্ত্রীকে জানালেন না, তবে জানতেন সে জানবে ঠিকই।
স্ত্রীর কাছে কিছু লুকানো যায় না মি. রাতুল! সব কিছু সবার আগে তার চোখেই ধরা পড়ে। এমনকি আপনারও আগে সে বুঝেছিল, আপনি কারও প্রেমে পড়েছেন। স্ত্রীরা স্বামীর শরীরের মানচিত্র জানার পাশাপাশি মনের বন্দরের প্রতিটি অলিগলিও চেনে খুব করে। টের পায়, কখন এ ঘাট ছেড়ে যায় মনের তরী, নোঙর ফেলে অন্য কোথাও। এরপর হয়তো কোনভাবে শিপ্রার নামটাও সামনে আসে। হতে পারে সেটা আপনার ফোন কিংবা ফেসবুকের কোনো অ্যাকটিভিটি থেকে।
দিশার হাতে যখন এই ভদ্রলোকের লেখা পড়ে, তখন সে ভয় পেয়ে যায়। ভাবে, তার পরিণতিও হবে ওই লোকের মতো। এ জন্য সে অবচেতন মনে কিংবা হ্যালুসিনেশনে বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। আর এসব দেখে আপনিও মনে মনে খুশি ছিলেন। কারণ দিশা আত্মহত্যা করলে তখন সহজেই সবাইকে বোঝানো যাবে যে সে মানসিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছে। আপনার ওপরও কোনো দায় পড়বে না। তাতে শিপ্রার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের পরিণতি দেওয়ার পথে আর কোনো বাধাই থাকবে না।
হ্যালুসিনেশ মানুষের অনেক ধরনের হতে পারে। এ পর্যায়ে দিশা একাত্মবোধ করে লোকটার সঙ্গে। আর ছবি যেহেতু দেখা ছিল। তাই ব্রেন মেটাভার্সের মতো ওরকম একটা মনুষ্য অবয়ব তৈরি করে তার সামনে, যার সঙ্গে সময় কাটাতে, মনের কথা বলতে ভালো লাগে তার। দিশা অসম্ভব বুদ্ধিমতী। সে নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করে অনেকটাই। কিন্তু আপনি গেম খেলছেন বুঝতে পেরে সে-ও অভিমান থেকে গেম কন্টিনিউ করতে থাকে। যেদিন রাতে ছাদে উঠেছিল, সেদিন আপনি শিপ্রার সঙ্গে ফাইনাল করছিলেন সব প্ল্যান। রাতে বাসায় ফিরবেন না, সেটাও চূড়ান্ত ছিল। শিপ্রা কবে ডিভোর্স দেবে, কোথায় উঠবে— এসব আলোচনা করছিলেন। আর তখনই কেউ আপনাকে জানায়, দিশাকে মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না। হতে পারে সেটা আপনার শাশুড়ি। আর আপনি এসে যা দেখেছেন, সবটুকু অভিনয়। মেয়েও বলেছে যা তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাতুল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
– উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিপ্রা এখন আর আপনাকে পাত্তা দিচ্ছে না। বসের মেয়ে মারা যাওয়ার শোক ভোলানোর অজুহাতে বসের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। আপনি এসব দেখে মর্মাহত। নিজ মনে অনুতপ্ত হয়ে দিশার দিকে ফিরতে চাইলেন। এ জন্যই বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর এখন আপনার সঙ্গে যা হচ্ছে, সবই আপনার মনের কল্পনা। যেহেতু আপনি ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং ভাবছেন আপনার কিছু শাস্তি প্রাপ্য, তাই কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আপনার দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখছে মনে হচ্ছে। আসলে তেমন কিছুই না। দুর্বল মনে এসব ভাবনা প্রশ্রয় পায় এবং ডালপালা মেলে।
জিনিসপত্র এখান থেকে ওখানে যাওয়ার ব্যাখ্যা হচ্ছে— শিপ্রা বাসায় এসেছিল। আপনার সঙ্গে সে রাতে ছিল। সে-ই ঘর গোছাতে গিয়ে জিনিসপত্র এদিক-সেদিক করে। শিপ্রা এখানে রাত কাটিয়েছিল, তা বাড়িতে পা দিয়েই বুঝেছি দারোয়ানের আমার দিকে তাকানো এবং কথা শুনে। আর সে রাতেই আপনি আয়নায় কিছু দেখেন। কারণ আপনার মনে পাপবোধ ছিল দিশার সাজানো বিছানায় শিপ্রাকে আদর করার জন্য। সুতরাং এসব আপনার মনের ভ্রান্তি মি. রাতুল! বেরিয়ে আসুন এর থেকে। চাইলেই পারবেন। এত কঠিন কিছু না আপনার জন্য। স্ত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার মতো সূক্ষ্ম ছক যে ব্রেইন আঁকতে পারে, তার কাছে এটা সামান্যই।
– আমি লজ্জিত, ম্যাডাম। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত।
– আমার কাছে অনুতপ্ত হয়ে লাভ নেই, দিশার কাছে অনুতপ্ত হওয়ার চেষ্টা করুন। তার প্রয়োজন আপনাকে। দ্রুতই যান তার কাছে। না হলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। আমি চলি।
রাতুল সাহরীনকে এগিয়ে দিতে নিচে নেমে এলো। ঠিক সে সময়ে দিশার ফোন থেকে আফিয়ার কল।
– বাবা, তাড়াতাড়ি এসো! মা অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলছে। আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।
রাতুলের হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় মাটিতে। সে যেন অচল হয়ে যায় কিছুক্ষণ জন্যে।
মাটি থেকে তাড়াহুড়ো করে ফোন তুলতে তুলতে বলে, এক্ষুণি আসছি, মা। আমি এক্ষুণি আসছি। কিচ্ছু হবে না দিশার। আমি তাকে কোথাও যেতে দেবো না…

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/টিআর

ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা গল্প পাপ কিংবা প্রতারণা শাহরিয়া দিনা