সাগরের সাথে কথা বলা
১৬ জুন ২০২৪ ১৫:৩০
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি স্কুলে আমি স্ট্যান্ডার্ড থ্রি-তে পড়ি। স্কুলে কিছুদিন আগে জিওগ্রাফি টিচার আমাদের পড়াচ্ছিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। দেশের উপকূলে ১০টি জেলার প্রায় ৪০০ কিলোমিটার সী-বীচ আছে। এর মধ্যে বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সী-বীচ কক্সবাজার জেলায়। এর দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। কিন্তু সী-বীচটি অপরিচ্ছন্ন এবং সাগরের পানিও দিনদিন অপরিচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। এতে জলজ প্রাণীরা হুমকির মুখে পড়েছে। গত এক বছরেই সী-বীচে ভেসে এসেছে কয়েকটি ডলফিনের মৃতদেহ।
টিচারের কথা শুনে আমরা কষ্ট পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি পলিথিন, প্লাস্টিক ও খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলে সী-বীচ অপরিচ্ছন্ন করার কারণেই সাগরের পানি দুষিত হয় এবং জলজ প্রাণীরা মারা যাচ্ছে।
সী-বীচ পরিষ্কার করার কাজটি আমরা করতে পারি কিনা তা টিচারের কাছে জানতে চাই। টিচার আমাকে ও আমার বন্ধুদের এ ইচ্ছাকে স্বাগত জানালেন এবং উৎসাহ দিলেন। তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন বলে জানালেন।
পরদিন টিচার আমাদের জানালেন, সী-বীচ পরিষ্কার করার ধারণাটি কর্তৃপক্ষ সানন্দে গ্রহণ করেছে এবং স্কুল থেকে একটি টিম পাঠাবে ‘বীচ ক্লিন-আপ ক্যাম্পেইন প্রোগ্রাম’ হিসেবে।
আমাদের স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার ও শনিবার। পরের শুক্রবার সকালে আমরা ট্রেনে করে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম।েআগে থেকেই জানতেন বলে দুপুরে আমাদের রেলস্টেশনে স্বাগত জানালেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক। তার সাথে ছিলেন একজন প্রকৃতিবিদ ও একজন পানি বিশেষজ্ঞ। তাদের সাথে আমরা পরিচিত হলাম।
প্রকৃতিবিদ ও পানি বিশেষজ্ঞ— দু’জনই আমাদের সী-বীচ ও সাগরের পানি পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে জানালেন। বললেন, পরিবেশ ও প্রতিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা খুব দরকার।
সেদিন বিকেলে আমরা সী-বীচে যাই। সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। বিশাল সব ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সৈকতে। আর সে কি গর্জন! সী-বীচে দাঁড়িয়ে তখন অসংখ্য মানুষ সাগর দেখছেন। কেউ কেউ পানিতেও নেমেছেন।
সী-বীচে আমরা অনেক পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিকের তৈরি পানির খালি বোতল, ছেড়া কাগজ ও খাবারের উচ্ছিষ্ট দেখলাম। টিচার আমাদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। আমরা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে সী-বীচে থাকা মানুষদের কাছে যাই। তাদের অনুরোধ করি পলিথিন, প্লাস্টিক ও খাবারের উচ্ছিষ্ট সী-বীচে না ফেলার জন্য।
পরদিন খুব ভোরে আমরা আবার সী-বীচে যাই। আজ আমরা সী-বী পরিচ্ছন্নতার কাজ করবো। একই সাথে সী-বীচ পরিচ্ছন্ন রাখার আহ্বান জানিয়ে কিছু ব্যানার ও প্লে-কার্ড বসাবো বীচের নানান স্থানে।
সবাই যখন বীচে পৌঁছাই, তখনও দিনের আলো ফুটতে শুরু করেনি। আমরা অনেকগুলো ব্যাগ এনেছি বীচে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্যে।
কাজ শুরুর আগে আমি অন্যদের থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াই, একদম সাগরের কাছে। ঢেউয়ে আসা পানি আমার পায়ের গোড়ালি ছুঁয়ে যায়।
ঢেউয়ের গর্জন শুনছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, সাগরের এই গর্জন শুধু গর্জন নয়। ঢেউগুলো যেন আমাকে কিছু বলছে। আমি গভীর মনোযোগের সাথে শোনার চেষ্টা করি। হঠাৎই মনে হলো আমি বুঝি সাগরের সব কথা স্পষ্ট শুনতে ও বুঝতে পারছি। সাগর আমাকে বলছে, ‘ধন্যবাদ, প্রিয় বন্ধু’। জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
তারা করুণ কণ্ঠে বললো, ‘তুমিতো জানো, সাগরই আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়িটি দিন দিন নোংরা হয়ে যাচ্ছে। আর নোংরা সাগরে থাকা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছে’।
এরপর তারা আমাকে বলতে থাকে কীভাবে তাদের কচ্ছপ বন্ধুদের নাকে প্লাস্টিকের টুকরো আটকে পড়ায় দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিরল প্রজাতির সেই কচ্ছপগুলো মারা গিয়েছিল। ডলফিন বন্ধুরা মারা গিয়েছিল সাগরের পানিতে মানুষের ফেলা প্লাস্টিক খেয়ে এবং জেলিফিশরা পলিথিন ব্যাগে আটকে গিয়েছিল। পরে তারাও দম বন্ধ হয়ে মারা যায়।
আমি এই সব শুনে খুব দুঃখ পেলাম। তারপর আমি তাদের প্রতিশ্রুতি দিলাম, আমি তাদের ঘর পরিষ্কার করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব, কারণ এটিও প্রকৃতির একটি অংশ।
তারা আমাকে বললো, তুমি খুব ভালো ছেলে। তাদের কথা শুনে আমি খুশি হলাম। এরপর আমার বন্ধুদের নিয়ে সৈকত পরিষ্কার করতে শুরু করি। প্রথম দিনের পরিচ্ছন্নতা শেষ করার সময়, সৈকত বেশিরভাগ পরিষ্কার ছিল। তবে পুরোপুরি নয়, তাই আমরা পরিকল্পনা করি, আমরা শনিবার ঢাকায় ফেরার আগে আরেকবার সমুদ্র সৈকত পরিষ্কার করব।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমরা সৈকতের দিকে রওনা হলাম। আমি সেই মিষ্টি ছোট্ট সামুদ্রিক প্রাণীগুলোকে আবার দেখলাম। তাদের কাছে গিয়ে বললাম, ‘শুভ সকাল’। তারাও আমাকে সুপ্রভাত বলে শুভেচ্ছা জানালো। আমাকে বললো, তাদের বাড়ি পরিষ্কার দেখে তারা খুব খুশি। আমিও এতে খুশি হয়েছিলাম এবং আমি তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমিও পুরো প্রকৃতিকে পরিষ্কার রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
আমরা ঢাকায় ফিরে আসি। তবে যখনই আমি সমুদ্র সৈকত বা প্রকৃতির অন্যান্য অংশ পরিষ্কার করার সুযোগ পাবো, অবশ্যই সেই সুযোগটি নেব। কারণ, আমি বিশ্বাস করি “আমরা যদি প্রকৃতির জন্য ভালো কিছু করি তবে প্রকৃতি অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো কিছু করবে”।
লেখক: মেভেনউড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’র তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র
সারাবাংলা/এসবিডিই