ছিটেকল
১৬ জুন ২০২৪ ১৭:৩৬
বা হাতে নাইলনের ঝোলানো ব্যাগ। ব্যাগে সাতটা ছিটেকল, জলের বোতল, ঢাকনিতে সরু সরু গোটা কতক ছিদ্র করা মাঝারি সাইজের প্লাসটিকের কৌটো, বিড়ির প্যাকেট, দেশলাই, আর একখানা গামছা। ডান হাতটা ফাঁকা। মাথার ওপর শেষ ফাল্গুনের চড়বড়ে রোদ নিয়ে নন্দ চলেছে কামডোবের বিলে। নামে কামডোব হলেও আশপাশের গাঁ-গেরামের মানুষের মুখে তা ‘ কন্ডোবের বিল ‘। তা বিল খানা যেমন চওড়া, লম্বাতে তা তার চেয়েও বেশি। এ পাশ থেকে তাকালে ওপাশের গাছপালার গায়ে সারাবছরই ঝুলতে দেখা যায় পাতলা একটা কুয়াশার পর্দা। সেই পর্দার কারনেই গ্রামটাকে বড়ো ঝাঁপসা দেখায়। তবে গ্রামের মাথার ওপর দিয়ে আকাশটাকে দেখতে বেশ লাগে। মনে হয় এই বুঝি গ্রামটাকে সরিয়ে সে মাটিতে নেমে আসবে।
সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে নন্দ একবার থমকে দাঁড়ালো। বেশ বড়ো সড়ো একঝাঁক শামুকখোল পাখি লম্বা ডানা প্রসারিত করে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে সেখানে উড়ছে। নন্দর মনে হল, ‘ ইস, এট্টাবার যদি ওগের সবগুলোনরে ধত্তি পারতাম ‘।
তা নন্দ এমনটা ভাবতেই পারে। নেশাই বলো, আর পেশা – নন্দ হল গিয়ে পাখিমারা। সারা বছর সে পাখি ধরে বেড়ায়। এই গাঁ থেকে ওই গাঁ, এই বিল থেকে ওই বিল, এই মাঠ থেকে ওই মাঠ সে পাখি ধরে। তারপর সেই ধরা পাখি সে নিয়ে যায় বুড়োখালির বাজারে। সেখানে পাখি বিক্রি করে সেই টাকায় সে কিনে আনে নুন, তেল, চাল, হলুদ, আটা – আরও কত কি। সংসারটা বলতে গেলে তার এর ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত নন্দ তাই মনে করে। যদিও তার বৌ যমুনা ঘুঁটে বানিয়ে বিক্রি করে। গোরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পোষে। আবার সুযোগ পেলেই এর ওর হাতের কাজটাও করে দেয়। তাতে করে আলু টা, মুলো টা পেয়ে যায়। সেরটাক চালও হয়তো আগ বাড়িয়ে এগিয়ে দেয় কেউ।
তাতে করে চোখে মুখে খুশি ঝিলিক দিয়ে গেলেও সেটা কাউকে দেখতে দিতে চায় না যমুনা। সে বলে,”আবার এডা ক্যান।”
যে চাল টা, মুলো টা এগিয়ে দিয়েছে সে বলে, “রাখ দিনি।”
তা খুশি মনে আঁচলে গিঁট দিয়ে বেঁধে নেয় যমুনা। বলে,”তুমাগের পাঁচজনের দয়ায় বেঁচ্যে আছি। দুইবেলা দুই মুঠ খাতি পাচ্ছি। না হলি কি যে হত।”
“তা নন্দকে তো বলতে পারিস সারাদিন পাখি পাখি করে না ঘুরে একটা অন্য কিছু কাজ তো সে করতে পারে।”
“সে কি আর কই নে। তা আমার কথা শোনে কেডা। সে যা করবে তা করবেই।”
“ঘরের পুষ্যি মানুষ এমন হলে হয়?”
“কী করবো কও। আমি মেইয়ে মানুষ। শাসন তো কত্তি পারি নে তারে।”
“তা তো ঠিকই। তবে বোঝাতে তো পারিস।”
“সে তো নিত্যিদিনই বুঝাচ্ছি।”
হ্যাঁ, কথাটা একদমই মিথ্যে নয়। প্রতিদিনই নন্দকে বোঝায় যমুনা। বলে,”এই কাজ তুমি ছাড়্যে দেও।”
যমুনার দিকে গোল গোল চোখ করে তাকায় নন্দ। বলে,”ছাড়্যে দেও বললিই কী ছাড়া যায়? এই কইরেই তো দুইবেলা দুইমুঠ খাতি পাচ্ছি।”
খানিকটা মুখ ধামচেই ওঠে যমুনা,”হঃ, ক্যামুন যে খাতি পাচ্ছি তা তো আমিও জানি। তা এই পাখ ধরা ছাড়া দুনিয়ায় কী আর কাজ নাই?কত মানষে কত কিছু করে। আর তুমি জানো খালি ওই পাখ ধরা। ইডা এট্টা কাজ হল? এ্যাকবার ছেল্যেডার কথা তো ভাববা। ও বড়ো হচ্ছে। দিন দিন খরচ বাড়তিছে। আরও বড়ো হবে আরও খরচ বাড়বে। এই কাজ কইরে অতকিছু কী – “
তা যতই বোঝাক যমুনা নন্দ কিন্তু যে কে সেই। সকালের খাওয়া দাওয়া হতে যতক্ষণ। তারপরই সে বেরিয়ে পড়ে। যখন যে পাখি ধরার সময় তখন সেই পাখি ধরে সে। এখন বক ধরা মরশুম। আশপাশে যত যা বিল আছে সবেরই জল একেবারে তলানিতে। কাদা গোলা সেই জলই এখন মাছেদের শেষ আশ্রয়। তো সারাদিন ঝাঁকে ঝাঁকে বক সেই মাছেদের ধরার জন্য ওৎ পেতে বসে থাকে। আর নন্দ বসে থাকে ওই বকেদের ধরার জন্য। বিল থেকেই ছোট ছোট মাছ ধরে ছিটেকল এর বড়শিতে গেঁথে জায়গায় জায়গায় পেতে রাখে তা। বোকা বক সহজেই মাছ পেয়ে যাওয়ায় আচমকা খুশি হয়ে সেই মাছ ধরতে যেতেই ছিটেকল এ থাকা ফাঁদ তার গলায় আটকে যায়। নিজে হাতে ছিটেকল বানায় নন্দ। নিজে হাতেই মাছ ধরে সে। খরচ খরচা বলতে গেলে নেই। আর তাই দিনান্তে যা পায় তাই লাভ। বুড়োখালির বাজারে নিয়ে গেলেই নগদ কতগুলো টাকা। টাকা তো নয় যেন পকেট ভর্তি সুখ। সেই সুখ দিয়ে চাল, আটা কিনে যখন বাড়ি ফেরে মনে হয় জগতে তার মত সুখী আর নেই।
তো নন্দ সেই সুখ ধরতেই চলেছে। গাঁয়ের রাস্তাটা পেরিয়ে দক্ষিণের মাঠে নামলে মাঠ টা ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে কামডোব বিলে। এখন মাঠের সেই ঢাল বেয়ে হাঁটছে নন্দ। দুই পাশে ফসলের খেত। ফসল বলতে ধনে, তিসি, কলাই – আরও কত কি। এইসব খেতের আল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হালকা হাওয়ায় যখন ফসলের গায়ের গন্ধটা এসে নাকে ঝাঁপটা মারে তখন নন্দর কেবল মনে হয় এমন একখানি খেত যদি নন্দর থাকতো তাহলে সেও এমনি করে ফসল ফলাতো। সেই ফসলের গা ছুঁয়ে আদর করতো। বুক ভরে তার গন্ধ নিত।
এখনও এমনটাই মনে হল তার। আর মনে হতেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে। নিচু হয়ে একবার আলতো করে ছুঁয়ে দেখলো ধনে গাছের গা। খেত তো নয় যেন ফুলের ঝাড়। নরম ফুলগুলো নন্দর হাতের ছোঁয়া পেয়ে কেমন একটা আদুরে চোখে যেন তাকিয়ে আছে। শরীরে আজব একটা শিহরণ অনুভব করলো নন্দ। সেইসঙ্গে একটা ভালোলাগাও।
হ্যাঁ, খুব ভালো লাগছে নন্দর। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চারপাশ দেখে নিল সে। ফাঁকা জমি বলতে নেই। মাঠ জুড়ে কেবল ফসল আর ফসল। লোকে বলে, মাটি, তার আবার দাম কী? তা কি যে দাম তা বেশ বুঝছে নন্দ। মাটি মানে ভালো লাগা। মাটি মানে সুখ। ফসল তো মাটিতেই ফলে। ফসল ফলে মানে সুখ ফলে।
বুক ভরে বার কয় বড়ো বড়ো শ্বাস টেনে আসলে সুখটাকেই টেনে নিজের ভেতরে নিতে চাইলো নন্দ। তারপর ফের হাঁটতে লাগলো।
মাথার ওপর রোদ এখন চওড়া হতে শুরু করেছে। হোক ফাল্গুন, তবু তার গায়ে এখন চৈত্রের আঁচ। তাতে অবশ্য অসুবিধে নেই নন্দর। এমন রোদ গায়ে মাখা অভ্যেস তার আছে। এ আর কি রোদ। বোশেখ-জষ্ঠির রোদও সে মাথায় নিয়েই কাটায়।
ভাবতে ভাবতে একবার আকাশের দিকে তাকালো নন্দ। ফকফকে আকাশটায় কেবল রোদ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না তার। না, একফালি মেঘের ছোঁয়া নেই কোথাও। তাতে করে ভালোই লাগলো অবশ্য। মেঘ সে পছন্দ করে না। মেঘ মানেই বৃষ্টি। আর বৃষ্টি মানেই নন্দর কাজের একেবারে দফারফা। পাখি ধরা তো কাজই। যদিও যমুনা তা মানতেই চায় না। সে বলে,”এডা আবার কুনো কাজ হল?”
শুনে যেন অবাকই হয় নন্দ। বলে,”কও কী?কাজ না তো কী?”
যমুনা বলে,”কাজ না। কও সখ। হঃ, পাখ ধইরে কেবল সখ মিটাও তুমি।”
নন্দ তা শুনে হলুদ ছোপে ধরা দাঁত বের করে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। বলে,”যা কইরে প্যাট ভরে তারে কি কেউ সখ কয়?”
“তুমারডারে কয়।”
“হঃ, তুমারে কইছে।”
“কইছেই তো।”
“তা মানষে যদি কইয়ে আনন্দ পায় তো পাক। আমার কাজ আমি করি।”
হ্যাঁ, নন্দর কাজ নন্দ করে। কারও কথারই সে ধার ধারে না। পাখি ধরা তো নিছকই একটা কাজ নয়, এ হল তার ভালোলাগা। সেইসঙ্গে খানিক ভালো থাকাও। এই ভালো লাগা আর ভালো থাকা সবটাই অবশ্য শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল বাপ গুরুপদ। সেই মানুষটাও এমনি করে পাখি ধরে বেড়াতো। তো বাপের কাছ থেকেই পাখি ধরার কলাকৌশল শিখেছিল নন্দ। এক একদিন বাপের সঙ্গে সেও যেত পাখি ধরতে। চারপাশে কত পাখি তখন। গাঁ-গেরামে ঘরবাড়ি গুলোও তখন বেশ ফাঁকা ফাঁকা। মাঠ, ঘাট, বনবাদাড় – সবেতেই রাজ্যের পাখি। বাপ সারাদিন সে সব পাখি ধরে বেড়াতো। লোকে বলতো, ‘ পাখ মারা গুরুপদ ‘। তাতে বাপ যেমন খুশি হত, তেমনি নন্দও। বাপ বলতো,”শোন বাপ, যে কাজই করিস মন দিয়্যে করবি। ভালোবেস্যে কত্তি পারলি দেকপি সপ কাজের মধ্যিই এট্টা সুখ আছে। এই যে আমি সারাদিন রোদ-বিষ্টি মাথায় কইরে পাখ ধইরে বেড়াই এতেও যে কত সুখ আমার। ক্যান জানিস?আসলে কাজডারে আমি ভালোবাসি, তাই।”
তা কাজটাকে ভালোবাসে নন্দও। সেজন্যে যমুনা যতই তাকে এ কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু করতে বলে তা নিয়ে এতটুকু ভাবেও না নন্দ। এজন্যে যমুনার ভেতরে যে একটা অভিমান আছে তা নন্দ বেশ বুঝতে পারে। তবু না বোঝার ভান করে থাকে সে। সে জানে যমুনা যা ই বলুক নন্দকে সে ভীষণ ভালোবাসে।
হাঁটতে হাঁটতে এ সব কথাই ভাবছে নন্দ। এদিকে চড়বড়িয়ে বাড়তে থাকা রোদ ক্ষণে ক্ষণে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে নন্দর গায়ে-মাথায়। তাতে বেশ একটা গরম ছোঁয়া অনুভব করছে সে। আর গরম লাগছে যমুনার কথা মনে পড়ে। কাল রাতে যমুনার সঙ্গে – ভাবতে গিয়ে হেসে ফেললো নন্দ। এতগুলো বছর বিয়ে হয়েছে, অথচ আজও –
পায়ের গতি ঈষৎ বাড়িয়ে দিল নন্দ। এদিকটায় ঢালু জমি। এই ঢাল বেয়ে মাঠ টা নেমে গেছে বিলের ভেতর। দক্ষিণের হাওয়ায় এখান থেকেই একটা জোলো গন্ধ পাচ্ছে নাকে। যত এগোচ্ছে গন্ধের ঝাঁঝটা ততই বাড়ছে। আর ততই চলার গতি বাড়ছে তার। আর গতি যত বাড়ছে বিলটাও যেন ততই এগিয়ে আসছে নন্দর কাছে।
যমুনা বলে,”সারাজেবনে কত সোংসার ভাঙছো কওদিনি। অন্যের সোংসার ভাঙ্যে নিজির সোংসার গড়া যায়?”
কথাটা মাঝেমাঝেই বলে যমুনা। কেন যে বলে তা বেশ জানে নন্দ। তবু প্রতিবারই সে অবাক হওয়ার ভান করে। চোখেমুখে একরাশ কৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়ে বলে,”সোংসার ভাঙছি?আমি?”
“হঃ, তুমি।”
“কার সোংসার ভাঙছি কও?”
“ক্যান?এই যে এত যে পাখ ধইরে বিক্কিরি করো, তুমি কি ভাবো এগের সোংসার নাই?বৌ-সন্তান নাই?স্বামী নাই?না গো ঠিক ভাবো না তুমি। এগেরও বৌ আছে। স্বামী আছে। সন্তান আছে। সোংসার আছে। এগের মধ্যিও পেরেম আছে। ভালোবাসা আছে। সবাইরে নে এরাও তো সুখি থাকতি চায়। অথচ সেই সুখ তুমি – “
এ সব কথা শুনলে মনটা কেমন নরম হয়ে যায় নন্দর। ভেতরটাও অমনি ভিজে আসে তার। দিনের বেলা হলে সে তখন আকাশ দ্যাখে আর রাতের বেলা হলে আঁধার।
এই এখন যেমন যমুনার সেই কথা মনে পড়ে আকাশটাই দেখছে নন্দ। আকাশে এখন একরাশ রোদ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। একজোড়া পানকৌড়ি অবশ্য মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেছে খানিক আগেই। তাদের ডানায় ঝলকে ওঠা রোদ ঝিলিক দিয়ে গিয়েছিল নন্দর চোখে মুখে। মনে হয়েছিল, ‘ ইস, এট্টাবার যদি ধত্তি পরতাম ওগের। ‘
এখন যাকে বলে ভরদুপুর। আকাশ জোড়া রোদ আছাড় খেয়ে পড়েছে কামডোব বিলের ওপর। বিলের পুবে বাঘমারা। পশ্চিমে রাজারমাঠ। উত্তরে নিশ্চিন্দিপুর। দক্ষিণে সাতাশী। নন্দ দাঁড়িয়ে আছে বলতে গেলে বিলের মাঝামাঝি। ভরা বর্ষায় এখানে মানুষ ডোবা জল থাকে। কিন্তু এখন শেষ ফাল্গুন। পায়ের নিচের মাটি পর্যন্ত শুকিয়ে এসেছে। সামনে বিলের তলানিতে অল্প স্বল্প যা জল সেখানে কচুরিপানা, কোসলা, কলমি, আরও কত সব জলজ আগাছার জঙ্গল। ওই সব জঙ্গলের ফাঁক ফোঁকরে আড়াল আবডাল রেখে ছিটেকল গুলো পেতে রেখেছে নন্দ। ছিটেকলের পুরোটাই ঢেকে রেখেছে লতাপাতা ছিঁড়ে। শক্ত সুতোর ফাঁদটাই কেবল তার ওপরে বিছিয়ে রাখা। যা কিনা পাতা হয়ে যাওয়ার পরে নন্দরই চোখে পড়ে না তো বকে দেখবে কি। এসেই আগে ছিটেকলের বঁড়শিতে গাঁথার মত মাছ গুলো ধরে নিয়েছে সে। অল্প জল। জোড়া হাতে খানিক ঘাঁটাঘাঁটি করলেই ছোট ল্যাটা, গুঁতে, খলসের মত ছোট ছোট মাছ ধরা যায় খালি হাতেই। এসবই ধরেছে সে। তারপর তাই দিয়েই পেতেছে ছিটেকল। বিভিন্ন জায়গায় খানিক দূরত্ব রেখে পেতেছে ছিটেকল গুলো, যাতে একটায় বক বাঁধলে অন্য জায়গা থেকে তার ডানার ঝটাপটি টের পাওয়া না যায়।
ভরদুপুরের রোদে কান মাথা একেবারে ঝাঁ ঝাঁ। সারা বিলে মানুষ বলতে বোধকরি আর দ্বিতীয়টি নেই। একলা নন্দই কেবল নিঃসঙ্গ গাছটির মত দাঁড়িয়ে আছে। এমনটা অবশ্য নিত্যদিনই থাকতে হয় তার। কিন্তু ব্যাপারটাকে কিছুতেই নিঃসঙ্গতা বোধের মত মনে হয় না তার। উল্টে মনে হয় চারপাশের এই মাঠ, ফসলের খেত, বিল, জলা ঘাস, আগাছা, বক, পানকৌড়ি, শালিক – সবাই তার সঙ্গী। সঙ্গী মাথার ওপরের ওই অতবড়ো আকাশটাও। মনে মনে এদের সঙ্গেই কথা বলে নন্দ। কথা বলে আর আকাশ দ্যাখে মাঠ দ্যাখে। বিল দ্যাখে। পাখি দ্যাখে। দেখতে দেখতে বেলা ফুরোয়। নন্দর হাতেও ধরা দেয় একমুঠো সুখ। এখন এই ভরদুপুরের রোদে দাঁড়িয়ে সেই সুখ ধরার অপেক্ষাতেই আছে নন্দ। বেরোনোর সময় যমুনা বার বার করে বলে দিয়েছে,”ঘরে কিন্তুক চাল বাড়ন্ত। সনঝেবেলায় খালি হাতে ফিরলি কিন্তুক উনোনে হাঁড়ি চড়বে না।”
তা যে করেই হোক আজ একেবারেই খালি হাতে ফেরা চলবে না নন্দর। ভেতরে ভেতরে তাই একটা অস্থিরতা কাজ করছে নন্দর। কখনও বসছে। কখনও উঠে দাঁড়িয়ে চোখ রাখছে দূরে দূরে পেতে রাখা ছিটেকল গুলোর দিকে। ফাঁসে বক আটকালে বেশিক্ষণ ওভাবে থাকতে দেওয়া যায় না। প্রথম প্রথম পেছন টেনে গলা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে। তারপর না পেরে ডানা ঝাপটায়। সেই ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে বিপদের আঁচ পায় খানিক দূরের বক গুলোও।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ফের একবার যমুনার কথাটা ভাবলো নন্দ। নিজেকেই প্রশ্ন করলো তারপর, সত্যিই কী সে সংসার ভাঙছে?অনেকের সুখ কেড়ে নিচ্ছে?তাই কী বিয়ের এত বছর পরেও ছেলে মেয়ের মুখে ‘ বাবা ‘ ডাক শুনতে পেল না নন্দ?কী করবে এখন নন্দ?পাখি ধরা ছেড়ে দেবে?তাহলে সংসার চলবে কী করে?আর কোনও কাজও তো পারে না সে।
ক্ষণিকের জন্যে মন টা যেন দূর্বল হয়ে গেল নন্দর। ঈষৎ ছোট হয়ে আসা চোখ দু’টো দিয়ে শূন্যতায় ভরা আকাশের দিকে চেয়ে রইলো সে।
দক্ষিণের দিক থেকে বেশ একটা ফুরফুরে হাওয়া বইছে। তাতে বাইরেটা যেমন ভালো লাগছে নন্দর তেমনি ভেতরেও একটা দারুন রকমের ভালোলাগা থেকে থেকেই উথলে উঠছে। নন্দ এখন হরিনডাঙার মাঠের ঠিক মাঝ বরাবর হাঁটছে। দুই পায়ে বেশ একটা দ্রুত গতি তার। এই গতিতে না চললে হাট ধরা বেশ মুশকিল হয়ে যাবে। নন্দ অবশ্য মাঠে আর একাটি নয়। যাদের খেত খোলার কাজ তারা যেমন কাজে লেগে পড়েছে তেমনি অনেক হাটুরে লোকও চলছে হাটের দিকে। মাঠ টা খুব বড়ো না হলেও একেবারে ছোটটিও আবার নয়। তবে এলাকায় চোর ছ্যাচোড়ের উপদ্রব নেই বলে হাটুরে লোকগুলো রাতের বেলাতেও এ পথে ফিরতে ভয় পায় না। ভয় পায় না নন্দও কিই বা আর এমন থাকে তার কাছে। খানিক চাল, ডাল, তেল, আটা, নুন। খুব বেশি কিছু থাকলে বড়োজোর যমুনার জন্যে এক শিশি গন্ধ তেল। কিংবা দু’টো লাইফবয় সাবান। তাও সে দু’মাসে চার মাসে একদিন। আজ অবশ্য ও সব কেনার নেই। সের দুই চাল, খানিক তেল, আর অবশ্য নুনের কথা বলে দিয়েছে যমুনা। পারলে সের টাক আলুও। তা এ সব কিনতে আজ আর অসুবিধে নেই নন্দর। তার ছিটেকলে আজ চার চারটে বক ধরা পড়েছে। তার মধ্যে দু’টো খড়িবক আর দু’টো দাঁড়বক। না হলেও তিনশোটা টাকা তো সে পাবেই আজ। একবার মনে হয়েছিল একটা খড়িবক সে বাড়ির জন্যে রেখে দেয়। অনেকদিন হল টুকুন মাংস রান্না হয় না বাড়িতে। তা বহু কষ্টে সে লোভ সম্বরন করেছে নন্দ। ঘরে হাঁড়ির যা হাল তাতে জিবকে অমন ছেড়ে দিলে চলবে না তার।
এ সব ভাবতে ভাবতেই হাঁটছে নন্দ। সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে পশ্চিমে। পশ্চিম দিকে হাঁটছে বলে নিজের ছায়াটা একেবারেই দেখতে পাচ্ছে না সে। ভরদুপুরের খরতার বদলে রোদের গায়ে বেশ একটা নমনীয় ভাব। একটা মিঠে হাওয়াও বইছে দক্ষিণের দিক থেকে। গুনগুনিয়ে একটা গান গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হল নন্দর। আর ধরলোও সে – ‘ আমার সুখের ঘরে ময়না পাখি – ‘ না, গানটা পুরোপুরি গাওয়া হল না তার। তার আগেই পেছন থেকে ডাক পাড়লো কেউ, “এই নন্দ, দাঁড়া, দাঁড়া।”
দাঁড়িয়ে পড়ে পেছন পানে ঘুরে তাকালো নন্দ। খানিক দূরে বেশ জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে আসছে রসময় তালুকদারের ছেলে অবনী। ছেলেটাকে একেবারেই পছন্দ নয় নন্দর। যার মুখটা দেখলেই চোখ জ্বালা করে তার। কতবার সে নন্দর কাছ থেকে পাখি নিয়ে তার দাম দেয়নি সে কেবল নন্দই জানে। তালুকদার বাড়ি থেকে বাকি পয়সা আদায় করার সামর্থ্য নন্দর যে একেবারেই নেই নন্দ তা বেশ জানে। কারও কাছে নালিশটি পর্যন্ত দিতে পারে না সে।
নন্দ ভাবলো না দাঁড়িয়ে বরং একটু পা চালিয়েই এগিয়ে যায়। কিন্তু পারলো না। তার আগেই অবনী একেবারে তার গায়ে গায়ে পৌঁছে গেছে।
খানিকটা ফ্যাকাসে চোখেই অবনীর দিকে তাকালো নন্দ। অবনীর দৃষ্টি তখন নন্দর হাতের দিকে। তাতে ধরা আছে পা আর পাখনা বাঁধা চারটে বক। যাদের গায়ের গন্ধ এই বিকেল বেলাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে হরিনডাঙার মাঠে।
“কী ব্যাপার বল দেখি দাঁড়াতেই চাইছিস না?”জিজ্ঞেস করলো অবনী।
কি যে উত্তর দেবে নন্দ তা বুঝতে পারছে না। কোনওমতে অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ না – মানে – “
“কি পেয়েছিস দেখি।”
নন্দকে দেখাতে হল না। তার আগেই নন্দর হাত থেকে বক গুলো একপ্রকার ছোঁ মেরেই ছিনিয়ে নিল অবনী। একরাশ লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে বক গুলোকে দেখতে দেখতে বলল,”বাঃ, অনেকগুলো পেয়েছিস তো। তা এগুলো বেচে আজ কেমন পাবি শুনি?”
ছিটেকল এ আটকে পড়া বকের মতই অবস্থা এখন নন্দর। না সামনে এগোতে পারছে, না পেছনে।
কি একটা বলতে যাচ্ছিলো নন্দ। তার আগেই যেন দাবড়ে উঠলো অবনী,”কি রে, বললি না যে?”
“ইজ্ঞে শ’ তিনেক – “
“ঠিক আছে, তিনশো টাকা আমিই দিয়ে দেবো। বক গুলো আমায় দে। বাড়ি বোনজামাই এসেছে। শহুরে মানুষ তো, বক দেখলে বেজায় খুশি হবে সে।”
গলার কাছে কি একটা যেন আটকে গেছে নন্দর। গলা দিয়ে আর স্বর বেরোচ্ছে না। ফ্যাসফেসে গলায় বহু কষ্টে সে বলল,”ট্যা – কা -”
অবনী এবার ঈষৎ রূঢ় দৃষ্টিতেই বুঝি তাকালো নন্দর দিকে। বলল, “টাকা কি আমি মাঠে ঘাটে নিয়ে ঘুরি নাকি?এক সময় বাড়িতে যাস। দিয়ে দেবো।”
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না অবনী। বলতে বলতে পেছন ফিরে হাঁটতে লাগলো। নন্দর মনে হল একটা ফাঁস শক্ত হয়ে ক্রমশ এঁটে বসছে তার গলায়। তার দম আটকে আসছে। শরীর বেয়ে উঠে আসছে একটা অসাড়তা।
যমুনার মুখটা মনে পড়ে গেল নন্দর।
সারাবাংলা/এসবিডিই