Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গব্বরের ঘাট

রাজকুমার শেখ
১৭ জুন ২০২৪ ১৫:২৩

শীতটা মরে এসেছে। রোদের তাপ বেশ বেড়েছে। ফাগুনের গুন গুন বাতাস। হু হু করে মাঠ পেরিয়ে আসছে। এবার খুব শীত পড়েছিল। তাদের বেড়া দেওয়া ঘরটাতে সে শীত আটকানো যায় না।ফাঁক ফোকার দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়ে। ছেলে মেয়ে নিয়ে তার খুব কষ্ট গেছে। যাক এবার বাঁচা গেল। ননি বিড়িটা ধরিয়ে নেয়। তারপর সুখ টান দিতে থাকে। আজ তার খুব খাটুনি গেছে। আর ফেরি করতে পারে না। মাঝে মাঝে তার বুকের ব্যথাটা জানান দেয়। অবহেলা করতে বারণ করেছেন ডাক্তার। ওষুধ কিনতে সব চলে যায়। ছেলে মেয়েদের মুখের রুজি টুকু মেনেজ করা অত সহজ নয়৷ ননি তবু হাল ছাড়ে না। বেরিয়ে পড়ে। প্লাস্টিকের সব তৈরি জিনিস। আজকাল এ গুলোই চলছে। গাঁ গ্রামের মেয়েরা নেয়। তা থেকে যা আয় হয় তাই কোনো রকমে দিন গুজরান। ননি সকালে দুটো পানতা খেয়ে আসে। তা বেশিক্ষণ থাকেও না পেটে। খিদে লেগেই থাকে। হাঁক দেয়। খরিদ্দার ডাকে। মা বোনদের দয়া হলে সব বিক্রি হয়ে যায়। আবার এক একদিন গোটা গাঁ গ্রাম ঘুরেও কিছুই হয়না। ফাজিল নগর, টোপলা, লাল নগরের মানুষজন ওকে ভালো চেনে। কত বছর ধরে তার যাতায়াত। কত ধরনের সে ব্যবসা করে। শীতের মরসুম সে খেজুর গুড় বেচে। ওদের গাঁয়ের আসপাশে অনেক খেজুর গাছ। উত্তরের হাওয়া শুরু হলেই তার কাজ বেড়ে যায়। শীত মানেই দুটো পয়সা গুড় বেচে করে। খেজুর গাছ গুলো চেঁচে রস বের করা। তারপর বাড়িতে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা। সে গুলো নিয়ে গাঁ গ্রাম এ যাওয়া। ওর বউ রেশমি বেশ পোক্ত হাতে গুড় তৈরি করে। শীতে কাজ বেড়ে যায়। ভোরে ওঠে রস সংগ্রহ করা। সে রসকে এক জায়গা করে জ্বাল দেওয়া। এবারের মরসুম তেমন ভালো যায়নি। রস তেমন হয়নি। গাছ আর কত রস দেবে? তারও তো বয়স হয়েছে। গাছ গুলো আসলে বুড়ো হয়ে গেছে। ননি মনে ভাবে কথাটা।

বিজ্ঞাপন

মানুষের মতোই সব। গাছ গুলোর আর গলা চাঁচতে ওর মনটা কেমন যেন করে। ওরও তো কষ্ট আছে। ব্যথা আছে। কত নিষ্ঠুর হলে তবে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। ননি মনে মনে ভেবে ওর বুকের ব্যথাটা বাড়তে থাকে। না এ সব কার কি এসে যায়? জগৎ সংসার এ ভাবেই চলছে। এ কাজ না করলে ওর ছেলে মেয়ে খেতে পাবে না। রেশমির মুখের হাসি টুক দেখে দুটো পয়সা ঘরে এলে। বড়োই আনন্দ অনুভব করে ও। রেশমিকে রাতে সেদিন একটু বেশিই আদর করে ও। রেশমি বাধা দেয় না। কি ভাবে যে রাত কেটে যায়? তকিয়া গাঁয়ে মসজিদের ফজরের আজান ভেসে আসে। পাখি গুলো ডাকে কেঁচর মেচর করে। রেশমি পাস ফিরে শোয়। ছেলে মেয়ে বেঘোরে ঘুমায়। ওদের ফোঁস ফোঁস নাকে শব্দ হয়। মোরগ ডাকে। ওদের ভেলা নগরে ভোর হয় একটু একটু করে।

বিজ্ঞাপন

এ সময় ঘাটে কেউ নেই। বাঁশের মাচানে ও আয়েশ করে বসে। সাইকেলটা বাঁশে ঠেকা দিয়ে রেখেছে। কত দিন ধরে এই গব্বরের ঘাট পারাপার করছে ও। এ ঘাট ডেকে নিয়েছে লজেন মন্ডল। তাদেরই দখলে আছে ঘাট। এ ঘাট কেউ দখল নিতে পারে না। জবরদখল। কেউ মুখ খোলে না। তা না হলে ব্রিজটার বাধা পড়ে?কবেই হয়ে যেত। কিন্তু লজেনের লোকজন হতে দেয়নি। সে অনেক কথা। সবই জানে ননি। তার সামনেই আব্দুর রউফ সাহেবকে নদীতে ফেলে মারে! তিনি চেয়েছিলেন কাজটা হোক। দুপারের মানুষজন সহজে আসা যাওয়া করুক। কিন্তু সে কাজ আর হল না। লজেনকে সবাই ভয় করে। ননি মুখ বুজে সব দেখে।এ ঘাট মাঝে মাঝে তার অজানা লাগে। একটু জিরিয়ে নেবার জন্য অনেকে এসে বসে মাচানে। ঘাট লাগোয়া কিছু দোকান পাসার। চায়ের দোকান সব সময় খোলা। নয়নার চায়ের দোকান। ওখানেই ওর বাস। নয়নার বিয়ে হয়েছিল। ওর বাপটা চা দোকান চালাতো। নয়না বসে এখন। নয়না বরের ঘর ছেড়ে হঠাৎ চলে আসে। সেখানে তার ঠাঁই হয়নি। ওর বর এক আদিবাসী মেয়ের সঙ্গে চলে যায়। তার খোঁজ কেউ জানে না। নয়না কি করবে ভেবে পায়না। আবার তাকে ফিরতে হয়। বাপের শরীর ভালো না বলে ও দোকানে বসে। নয়নার জন্য অনেক ফিসফাস শোনা যায়। ও নাকি গোরার মেয়ে না। এখানে নাকি এক তান্ত্রিক থাকতো এক সময়। ঘাটের কাছেই তার ঝুপড়ী ছিল। সেখানে বসে সাধনা করতো। গোরার বউ রোজ সকালে ঘাটে যেত গা ধুতে। গোরার বউ এর বাচ্চা আসছিল না। তো তান্ত্রিক তাকে কি যেন একটা দেয়। তার পরই নাকি নয়না পেটে আসে। গোরা তাকে সন্দেহ করতো। কিন্তু মুখে কিছু বলতো না। গোরা লোক লাগিয়ে তান্ত্রিক কে উচ্ছেদ করল একদিন। কিন্তু তার বউ হঠাৎ একটা অসুখে পড়লো। তা আর ভালো হল না। নয়না তখন ছোট। নয়নার সঙ্গে লজেনের খুব সুখ ভাব। সব খবর নয়না দেয় তাকে। ননি তার দোকানে চা খেলেও মুখে কিছু বলে না। নয়না অবশ্য ননিকে মান্য করে। ওর বাপের সঙ্গে ননির খুব ভাব ভালো বাসা। ননি খোঁজ নেয় ওর বাপের। মানুষটা ঘরের মধ্যে সব সময় শুয়ে থাকে। কাশির শব্দ শোনা যায়। এক সময় গোরার কি দাপট ছিল। এ ঘাটে তার হুকুম চলতো। আজ মানুষটা কেমন চুপসে গেছে। অবশ্য লজেন ডাক্তার বদ্যির খরচ দেয়। নয়না মাঝে মধ্যে কোথায় যে চলে যায়। তার খবর জানা যায় না। অবশ্য লোক মুখে ভেসে বেড়ায় ও নাকি লজেনের সঙ্গে গেছে। নয়না এখন উড়ছে। ওর পালে এখন হাওয়া। একটু সাজগোছ করে। চায়ের দোকানি নয়। যেন মোড়ল বাড়ির বেটি। মহারানী।

ননি বিড়ির শেষ অংশটা ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর থু করে মাটিতে থুতু ফেলে। বেশরম মাগী! ভাতারকে ছেড়ে এখন জুটিয়েছে লজেনকে। আর কত কলা করবি লো মাগী?
ননির গাটা কেমন রি রি করে ওঠে। এমন মেয়ে মানুষের মরণ হয়না? বাপটা মরণের সঙ্গে লড়ছে। আর ও মাগীর ফষ্টিনষ্টি গেল না! ছিঃ!

আবার ননি থুতু ফেলে শব্দ করে। এমন সময় কালু ডাক দেয়, ও ননি, আয় পার করি দিই। আমরা খেতি যাবো এবির।

মাথার ওপর সূর্য। আর একটু পরে হেলে পড়বে পশ্চিম দিকে। ননিরও বেশ খিদে পেয়েছে। আজ তেমন বেচাকেনা হয়নি। সাইকেল ঠেলে ঠেলে আর কত ঘোরা যায়? এই ঘাটে একটা তেলে ভাজা দোকান দিলে কেমন হয়? কিন্তু অনুমতি নিতে হবে। লজেন কি ওকে অনুমতি দেবে? ননি সাহস পায়না বলতে।

ননি সাইকেল নিয়ে ওঠে নৌকায়। একটা শীতল বাতাস এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। হেলে দুলে জল চিরে নৌকা চলে। ননির কতদিনের চেনা। চরে বাঁখারি লাগানো। এখানে খুব হয়। বাইরের বাজারে সব চলে যায়। ভালো ফলন। চৈত্র মাসে ওঠে। ননি বাঁখারির খেতের দিকে চেয়ে থাকে। বৈঠাতে জলের শব্দ। ছলাৎ ছলাৎ।

২.

কদিন ননি গাঁয়ে যেতে পারেনি। বুকের ব্যথাটা বেড়েছিল। রেশমি গাঁয়ের মিলন ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ এনে এনে খাইয়েছে। তবে ডাক্তার বলেছেন, বড়ো ডাক্তারকে দেখাতে। কদিন ওর কাজ বন্ধ থাকায় সংসার অচল হয়ে গেছে। ঘরে আর কিছুই নেই। রেশমি এ দুদিন ধার করে চালিয়েছে। অগত্যা ননিকে বের হতে হল।

ঘাটে এসে ও একটু বসে। পার হতে সময় লাগবে। নৌকাটা এখন ওপারে। কদিন ধরে ঘাটে নাকি ঝামেলা চলছে। লজেন নাকি কাকে আবার শাসিয়েছে। এ ঘাটের আয়টা নেহাতই কম না। লজেনের অনেক লোকজন। তাদের পুষতে হয়। নেতা গোতাদের পয়সা দিতে হয়। এই লজেন কোথাকার কেউ জানে না। অনেকে বলে, ও নাকি নদীর জলে ভেসে এসেছিল। একটা শিশু। ওই তান্ত্রিক নাকি ওকে মানুষ করে। লজেনের মা বাবা কে তা কেউ বলতে পারে না। তার এই ঘাটই সব। এ ঘাটে কেউ নজর দিলে তাকে ও ছাড়ে না। নেতা গোতার লোক ও। কথায় কথায় একজন বলে, এবির জমবে খেলা। হালি প্রধানের ছেলিকে ও মেরেছে। ঘাট উচ্ছেদ করে দিবি। শালার খুবই বার বেড়েছে। বুকের পাটা ভেঙি দেবে।
ননি সরে আসে। কেউ শুনলে আর রক্ষা নেই। এ সব ঝামেলাতে তার জড়িয়ে কোনো লাভ নেই। দুটো টাকা দিয়ে সে পার হয়। তার রোজকার ব্যাপার। কার ঘাট সে সবে তার কি বাপু? ও পার হয়। একটু হাঁপ লাগছে। নৌকা থেকে নামতেই ওর মাথাটা ঘুরে যায়। এমন সময় লজেন ওকে ধরে ফেলে। ও ঘাটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।

আরে তুই ননি না? শরীল খারাপ?

লজেন ওকে মাচানে এনে বসায়। মুখে জল দেয়। লজেনকে দেখে ও আরও ঘাবড়ে গেল। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। শালা আজ কপালে আছে। ওপারে যা কথা হয়েছে নিশ্চয় ও শুনেছে। তাই ও ঘাটে। ওর ভেতর শুকিয়ে কাঠ। লজেন ওকে জল দেয়। ও ঢক ঢক করে জল খায়। লজেন কাকে বলে, নয়নার দোকান থেকে বিস্কুট আনতে। লজেন ওকে রেখে আবার ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ওকে বেশ চঞ্চল দেখাচ্ছে। কিছু কি অঘটন ঘটবে নাকি?

ননি এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। লজেনের লুঙ্গি হাঁটু অবধি তোলা। ঘাড়ে গামছা। মাথার চুল এলোমেলো। এ ঘাট থেকে অনেক গুলো মানুষ করে খায়। লজেন তাদের ভাগ দেয়। ননি বসে থাকে মাচানে। আজ লোকজন কম। বেলা হয়ে এলো। গাঁয়ে ফেরি না করতে গেলে ওর হবে না। কিন্তু শরীরটা খারাপ করছে। সাইকেলটা বাঁশের মাচানে ঠেক দেওয়া। ওর সঙ্গী। বহু কাজের সাক্ষী। কত বৃষ্টি। ঝড় জল ওর ওপর দিয়ে গেছে। সাইকেলটার প্রতি ওর মায়া বসে আছে। সেই কবে ওকে কিনে ছিল। না এবার ওঠা দরকার। ও উঠতে যাবে এমন সময় লজেন বাধা দেয়।

ও ননে, মরবি নাকিরে? একে চলতি পারিস না। আজ বাড়ি ফিরে যা।

ও উদাস দৃষ্টিতে লজেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন সময় নয়না আসে। ওর জন্য জল আর বিস্কুট এনেছে। লজেন বলে, এটা খেয়ি নে ননে। সকাল থেকে কিছু খাসনি বোধহয়।
এ কোন লজেনকে দেখছে ও। মানুষটা কি বদলে গেল? না ও স্বপ্ন দেখছে? নয়নাও বসে মাচানে। তার লজেন না বললে যেন ও উঠবে না। বুকের দিকটা সবই দেখা যাচ্ছে। ননি মুখ ফিরিয়ে নেয়। নয়না সে সবের ধার ধারে না। ওর সঙ্গে বেশ লজেন মজেছে। এ ঘাটে কি চলে তা সবই ননির জানা? ও কিছু বলে না। বললে বিপদ আছে। নয়না ডাকে লজেনকে, ও পারের মাঝি, এসো চা খেয়ি যাও।

লজেন শুধু ওর দিকে একবার ফিরে তাকাই। হাসে। নয়নাও হাসে। লজেনের ভয়ডর নেই। ও কাউকে পরোয়া করে না। এবার যদি ঘাট নিয়ে প্রধানের বেটা আসমত আসে তাহলে তাকে ও আস্ত রাখবে না। ও মনে করে গব্বরের ঘাট তার জন্ম পিতা। সে এখানে মানুষ হয়েছে। দখল তারই থাকবে। লজেন ফিরে আসে। নয়না খিলখিল করে হাসে। লজেন ওর পাস ঘেঁষে বসে।

নয়ন, চা করগা গিয়ে। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

তা পাবিনি। সকাল থেকে যা করি বেড়াচ্ছো।

তুই বড্ড কথা বলিস।

নয়না আবার খিলখিল করে হাসে আর লজেনের ওপর গড়িয়ে পড়ে। এমন সময় মতু কাকা এসে হাজির। ওঁ এই ঘাটেই এক কোণে পড়ে থাকে। মতু কাকার বয়স হয়েছে। লজেন মান্য করে। মতুকাকা ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। এখানে যারা এসেছে তাদের কোনো ঠিকানা নেই। আছে ঘাট। ঘাটের জীবন। এই নিয়েই ওদের বেশ চলে যায়।
মতুকাকা, জিজ্ঞেস করেন, লজেন, ঘাট নিয়ে আবার কি হল?

আর বলোনি কাকা, জানোতো আমাদের উচ্ছেদ করতে চায়ছি। লজেনের জানটো থাকতি তা হবিনি কাকা।

তুই এ সবের মধ্যে যাসনি বাপ।

কেন কাকা?

ওদের দল বড়ো।

তা কি হবে? এতদিন লড়ে এসেছি। এই ঘাটটাকে আমি মা মনে করি কাকা! এখানি বড়ো হলিম! তোমরা মানুষ করে তুলেছো। এই মাকে ছেড়ি আর কুথা যাবোগো কাকা? বলো দেনি?

মতু কাকার চোখে জল চলে আসে। সেই কবে সব হারিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন কত মহাজনি নৌকা আসতো। জল পথে ব্যবসা চলতো। কত কাজ তখন। এই নদীর জলে লজেনকে কুড়িয়ে পান একদিন সকালে। একটি টুকরীতে ভেসে এসেছে।
কার পেটের কাঁটা গো!

মতুকাকা বাচ্চাটা বুকে জড়িয়ে ধরে তুলে আনেন। গোঁসাই গিন্নি বুকে তুলে নেয়। মাধুতান্ত্রিক বলে, ওরে আমাকে দে। ওকে মানুষ করি।

লজেন সবার চোখের মণি হয়ে উঠলো। একটু একটু করে বড়ো হল। ঘাট তার দখলে এলো। সেই থেকে চলে আসছে। নয়না উঠে গেল। যাবার সময় লজেনকে ইশারা করে। ননির চোখ এড়াই না।

না এবার তাকে উঠতে হবে। ও উসখুস করছে। এমন সময় লজেন বলে, ননি, তুমি আজ বাড়ি যাও।

বাড়ি গেলি হবে লজেন ভাই?

লজেন লুঙ্গীর খুট থেকে টাকা বের করে। ননির হাতে দেয়। দিয়ে বলে, ডাক্তার দেখাবি। আজ যা। গরীবের খোদা! যা।

ননি বেশ অবাক হয়। সে কাকে দেখছে? ননির চোখটা ভিজে ওঠে। বড়ো আপন মনে হয়। লজেনকে যেন বুকে জড়িয়ে ধরে ও। বেলা হয়ে এলো। নয়নার দেওয়া বিস্কুট খেয়ে ওর জানে জান আসে। লজেন চলে যায়। মতু কাকা বসে দূরে তাকিয়ে। বাতাস উঠেছে নদী থেকে। ননি আরও কিছুটা সময় বসে থাকে। সে টাকার গন্ধ নেয় বুক ভরে।

৩.

ঘাটে লোকজনের ভিড়। ননি গত রাতে দেরি করেই ঘুমোতে গেছিল। কদিন ও বাড়িতেই ছিল। রেশমিকে সঙ্গে করে ডাক্তার দেখিয়ে আনে। শরীর এখন বেশ ভালো। ও রাতে মাল গুলো সাইকেলে সাজিয়ে রাখে। আবার ওকে ফেরি করতে যেতে হবে। কাজে না গেলে ওরা খাবে কি? রেশমি সকালে ওঠে খাবার করে দেয়। ননি সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ ওর মনটা কেমন কু ডাকছিল। ঘাটে আসতেই খবরটা পেল ও। ওর বুকটা ধরাস করে ওঠে। এ কি হল? ও কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনটা কেমন যেন হয়ে গেল ওর। ও যেন আবার টলে পড়ে যাবে। নৌকা পাড় হয়। আজ অন্য একজন নৌকা পার করে দিল। পার হতেই নয়নার গলা পেল ও। ও চিৎকার করে কাঁদছে। মতু কাকা কাঁদছে। ওর বেটা আজ চলে গেল! ননি সাইকেল রাখে। চারপাশ থম থমে।ওর চোখ দুটো জ্বালা করছে। ঘাটটা আজ যেন শ্মশানপুরী। ননি এগিয়ে যায়। মানুষের বেশ ভিড়। পাশের গাঁ গ্রাম থেকে এসেছে। ফিসফাস কানে আসছে। এমন ঘটনা কি করে ঘটলো? নয়নার কাঁদন দেখে ননির অবাক লাগছে। যেন ওর বিয়ে করা বর মরে গেছে। আবার ওর রাগ হল। দাঁতে দাঁত পিষে ও। রাগে ওর গা জ্বালা করে। মনে হল গালে একটা কোষে থাপ্পড় মারে। হারামি মাগী কুথাকার!

মনে মনে বলে কথাটা ননি।

এমনিতেই যা ঘটেছে। তা সামাল দেওয়া যাবে না। লজেন এর পোষা লোকজন ছাড়বে না। ঠিক বেরিয়ে পড়বে। ননি কোনো কথা মুখ দিয়ে বের করে না। ও সাবধান অবলম্বন করে। ননিকে এ ঘাটের সকলে চেনে। কতকাল তার যাতায়াত। কত কিছুর সাক্ষী ও। কিন্তু তা হলে কি হবে? কার ঝড় কার ওপরে এসে পড়বে কে জানে! মতু কাকাকে দেখে ওর কষ্ট হয়। মানুষটা ভারি ভালো মানুষ। জীবনটা এখানেই কেটে গেল। কত বদল দেখলেন। সেই সময়ের রমরম। নৌকা করে মহাজনিরা আসতো। তাঁবু করে থাকতো। সব যেন নিমিষে হারিয়ে গেল। নদীর গতি হারিয়ে গেল। মতু কাকা কবে এখানে এসেছিলেন তা আজ তিনি মনে করতে পারেন না। বয়সের ভার। কোনো রকমে চলা ফেরা করেন। লজেন দেখভাল করতো। এবার মানুষটির কি হবে? ননির হঠাৎই মনটা খারাপ হয়ে যায়। মতু কাকাকে কখনো রাগ করতে দেখেননি। সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকে। এই মাচানে এসে বসেন। তাঁর ঘর বলতে ওই বেড়া দেওয়া ঘর। ওখানেই থাকেন। বৃষ্টি বাদলার ঝাট আসে। বেড়ার ফাঁক ফোকর দিয়ে জল ঢুকে পড়ে। অনেক কষ্ট। কিন্তু এই ঘাট ছেড়ে তিনি কখনো যাননি। লজেন তাঁর জান। তিনি বলেন, আর কুথা যাবোরে বাপ! আমার এটিই তীর্থস্থান। কত মানুষের পদধূলি পড়ি আছে। এ ছেড়ি কুথা যাবো ?

মানুষটির চোখ দুটো জলে চিকচিক করে উঠতো। মানুষটি বড়ো একা হয়ে গেল। ননিরও চোখ ভিজে আসে। মতু কাকার পাশ দিয়ে ও এগিয়ে যায়। নদীর জলে লজেন পড়ে। একদিন এই নদীতেই ভেসে এসেছিল। মতু কাকা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। আজ আবার সেই নদীতে। ননির চোখ ভিজে ওঠে আপনা থেকে। মানুষটির দেল ছিল বড়ো। নদী মা আজ আবার তাকে ডেকে নিল কাছে। যে নদী ছেড়ে সে কোথাও যায়নি। এই ঘাট তার বুকেই শেষ আশ্রয় দিল। মমতাময়ী নদীর বুকে সব পাপ ধুয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

গব্বরের ঘাট গল্প রাজকুমার শেখ সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর