লেট করা ট্রেনের অপেক্ষায়
১৭ জুন ২০২৪ ১৬:০৬
ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল নয়টা পঞ্চাশে। এখন বাজে এগারোটা।
ট্রেন ছাড়া তো দূরের কথা বগিতে ইঞ্জিন লাগানোর কোন নামগন্ধ নেই। ট্রেনের যাত্রীরা যে যার মত এদিকওদিক ঘুরাঘুরি করছে। কেউ কেউ হকারের কাছ থেকে চা, সিগারেট খাচ্ছে, কেউ একঢুক পানি গিলে গলা ভিজিয়ে অস্থিরতা কাটাচ্ছে। কয়েকটা ছোট বাচ্চা ছুটাছুটি করে এখন কিছুটা ক্লান্ত, এখন বসে হাপাচ্ছে। কয়েকজন তরুণ তরুণী প্লাটফরমের শেষ দিকটায় কি যেন বলে হেসে একজন আরেকজনের গায়ের উপর গড়িয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে কিছু মানুষের চোখে মুখে শুধুই অস্থিরতার ছাপ লেগে রয়েছে। গন্তেব্যে পৌছানোর তাড়ায় অশান্ত হয়ে রয়েছে।
কার্ত্তিক মাসের রাত। একটু ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। দিনের বেলা গরম আবার শেষ রাত্রিতে বেজায় ঠান্ডা। এ হলো কার্ত্তিক মাস।
শহুরে জীবনে কেউ আর এখন বাংলা মাসের তারিখ মনে রাখে না। আজকাল স্কুলের ছেলেমেয়েদের জিগ্যেস করলে হয়তো বারো মাসের নামও বলতে পারবে না। মুকিত বারো মাসের নাম বলতে পারে। ছেলেবেলায় শিখেছিল বলে এখনো মনে আছে তার। তবে এটা যে কার্ত্তিক মাস সেটা হয়তো চট করে বলতে পারতো না। আজ স্টেশনে আসার সময় একটা খবরের কাগজের বিকালের সংখ্যা কিনেছিল। সেটাতেই চোখে বুলানোর সময় বুঝতে পেরেছে এখন কার্ত্তিক মাস।
আজকাল কিছু কিছু নামসর্বস্ব কাগজ বিকেলের সংখ্যা বের করে। হকাররা ডেকে ডেকে চটকদার কথা বলে কাগজ বিক্রি করে। এর বেশি ভাগই অশ্লিল ছবি ও বাড়াবাড়ি রকমের গুজব সম্বলিত শিরোনামবিশিষ্ট। তবুও এই কাগজটা একটা কাজে লেগেছে আজ। বাংলা মাস তাকে মনে করাতে পেরেছে। কিন্তু তারিখটা সে ভুলে গেছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে তারিখটা বের করতে চাইলো, পারলো না। এখন অনেক কিছুই মনে রাখতে পাওে না। তারিখ হয়তো অন্যসব কথার মত স্মৃতি থেকে সরে গেছে। সম্ভবত তার বয়স বাড়ছে। এটা বয়সের সাইড ইফেক্ট।
খোলা প্লাটফরমের উত্তর পাশ একেবারে ফাঁকা। চারিদিকে নিরবতা। মাঝেমাঝে স্টেশনে আগমনী ও ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের দুই একটা হুইসেল নিরবতা ভেঙ্গে দিচ্ছে। ট্রেন আসছে, যাচ্ছে। কিন্তু তাদের ট্রেনটা এখনো নিশ্চল। একা ভাবতে ভাবতে মুকিত অনেক দূর চলে এসেছে। দূরের চাঁদ আর ভাবনার আকাশ যেন মিতালী করেছে তার সাথে।
হঠাৎ সে পেছনে তাকিয়ে দেখে গাড়িতে ইঞ্জিন লাগানো হচ্ছে। এটা ট্রেন ছাড়ার প্রস্তুতির অংশ।
যাক দেরিতে হলেও ছাড়বে তো। তাতেই স্বস্তি। এখন ট্রেন না ছাড়লে কাল আটটার আগে সিলেট পৌছাতে পারবে না। দশটায় অফিস। সব এলোমেলো হয়ে যাবে।
সিলেটে নতুন চাকরি। সবে মাত্র তিনমাস হলো। প্রতি সপ্তাহেই এভাবে সে যাতায়াত করে। মা বাবা থাকে ঢাকায় থাকেন। তাদের দেখতে আসতে হয়। প্রতি সপ্তাহে না আসলেও হতো কিন্তু না আসলে পরবর্তী সপ্তাহটা তার কাছে অনেক বড় মনে হয়। সেই সপ্তাহ আর শেষ হতে চায়না। একেই বলে মায়ার বাঁধন, একবার ধরলে আর ছাড়ে না। এই বাঁধনের টানে বারবার কাছে আসতে হয়।
একবার সিলেটে অফিসের একটা কাজ পড়েছিল শনিবার। সে সপ্তাহে সে ঢাকায় আসতে পারেনি। তখন তার রবিবারের পর সোমবার আসে না। সোমবার আসলেও মঙ্গলবার তো আসেই না। ঐ দিকে না দেখতে পেয়ে অসুস্থ মায়ের কান্নাকাটি। নতুন চাকরি ছুটি নেয়া যাবে না। অনেক বড় একটা সপ্তাহ গিয়েছিল সেটা। মনে হয়েছিল একদিন তো নয় যেন এক বছর। কষ্ট হলেও প্রতি সপ্তাহে আসা যাওয়া করতে হয়।
এরকম আরো একদিন ট্রেন ছাড়তে দেরি করেছিল। সে বার রাত একটায় ট্রেন ছাড়লো। গার্ডকে জিগ্যেস করল যে, ট্রেন আনুমানিক কয়টায় সিলেট পৌছাবে। সে যে উত্তর দিল, তা শুনে মুকিতের চোখ ছানাবড়া। ট্রেন নাকি সকাল দশটার আগেই পৌছাবে।
– সকাল দশটা বাজবে ?
– কেন কাল ট্রেন সাড়ে দশটায় সিলেট পৌছাইছে।
– কালকেও কি ছাড়তে দেরি করেছিল?
– কুলাউড়ার পর ইঞ্জিনে কি যেন সমস্যা হয়েছিল, তাই একটু দেরি হয়েছে। তাছাড়া প্রতিদিনই এমন দুই-তিন ঘন্টা দেরি করে।
-একটু দেরি! যে ট্রেন ছয়টায় পৌছানোর কথা, সেটা দশটায় পৌছালে একটু দেরি হয় বুঝি!
গার্ড চেয়ে থাকে। একটু মুচকি হেসে, চলে যায়। মুকিত তো চিন্তায় অস্থির। যদি আজও দেরি করে। স্টেশন থেকে বাসা যেতে লাগে আধঘন্টা, বাসা থেকে অফিস প্রায় একঘন্টা। তার মানে সাড়ে আটটার আগে সিলেট পৌছালেই কেবল শান্তি। বাসে আসা যাওয়া নিষেধ। মা বাবার কড়া আদেশ ট্রেনেই চলাচল করতে হবে। বহুবার বুঝিয়েছে, লাভ হয়নি। অগত্যা সমস্যা হলেও তাকে ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়।
সেইবার ট্রেন পৌছালো নয়টায়। বাসা যাওয়া হয়নি। সরাসরি অফিস। সারারাত ট্রেন যাত্রার পর সারাদিন ঘুম চোখে অফিস। গোছল, সকালের নাস্তা সবই সেদিন ছুটি নিয়েছিল, শুধু তার ছুটি হয়নি। অসহ্য রকমের একটা দিন ছিল। মনে মনে দোয়া করে, এমন দিন যেন তার জীবনে আর না আসে।
আজও মনে হয় ঐ রকম কিছু হতে চলেছে। এখন বাজে রাত এগারোটা চল্লিশ। ইতোমধ্যে প্রায় দুই ঘন্টা লেট। তার মানে সিলেট পৌছাবে সকাল আটটায়। ওহ! আর আধ ঘন্টার মধ্যে যদি ট্রেনটা ছেড়ে দিত।
ভাবতেই হুইসেলের শব্দে হুঁশ এলো।
“উপবন এক্সপ্রেস” কিছুটা নড়ে উঠলো। সবাই ট্রেনে উঠার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করে দিয়েছে। সেও উঠে নিজের সিটে আটসাঁট হয়ে বসে পড়লো। সিটটা যেমন চেয়েছিল, ঠিক তেমনি। জানালার পাশে। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। একমুহুর্তেই চিন্তায় অস্থির শরীরটা জুড়িয়ে গেল।
রাত বারোটা বাজে। এখন বোধহয় ট্রেন ছাড়বে। গার্ডের বাশিঁর শব্দ পাওয়া গেলো। চোখের সামনে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার মত একটা অনুভূতি নাড়া দিচ্ছে সবার চোখেমুখে। একটা স্বস্তির হাওয়া এক ঝটকায় সমস্ত বিষণœতাকে দূরে সরিয়ে নিল।
ট্রেন নড়েচড়ে উঠেই আবার থামলো। সবাই অবাক, আবার হলো কি। কি মুশকিল! মুকিতও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিছুই বুঝতে পারছে না। মন ফের বিষন্ন হয়ে গেল। এভাবে কি হয়। আর পারা যায় না। পরেরবার ঢাকা আসলে বাসে যাওয়ার অনুমতি নিতে হবে। এভাবে আর বেশি চলাচল করা যাবে না। মনের ভেতরকার সুপ্ত জেদ যেন তার চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
-হ্যা, হ্যা এই সিটটাই। সি-৩৮।
এক মাঝবয়সী ভদ্রলোকের কথা শুনে হুশ ফিরে পায় মুকিত। সাথে ছোট ছোট দুইটা লাগেজ। উপরে তুললো। মুকিত একটু এদিক তাকিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরের দিকে একবুক হতাশা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। লোকটা তার লাগেজগুলো উঠানোর শেষে কাকে যেন বসতে বলল।
-বস, মা। বস। রাত জেগে ট্রেনে বসে পড়বে না। খিদে লাগলে খাবারটা খেয়ে নিও। আমাদের জন্য চিন্তা করো না আরো কত কি।
তার কথা শুনে মুকিত এদিক তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে তার পাশে বসে আছে। একটু ইতস্তত। লোকটা সম্ভবত তার বাবা। সে তাকিয়ে আছে মুকিত এর দিকে। কিছু একটা বলবে মনে হয়। না দেখার ভান করে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। গম্ভীর মুখ করে বাইরে তাকায়। মনের অস্থিরতা তার চোখেমুখে প্রচ্ছন্ন ছায়া ফেলে রেখেছে।
গার্ডের বাঁশি ফের বেজে উঠে। মোবাইলে দেখে, এখন সময় বারোটা দশ। লোকটা নেমে যাবার জন্য তাড়াহুড়া করছে। মেয়েটা ইশারায় তার বাবাকে কিছু একটা বলল। বুঝতে পারলো না মুকিত। মাঝবয়সী লোকের চোখে চোখ পড়তেই বিদ্যুৎ বেগে চোখ ফিরিয়ে নিল। ভদ্রলোক কিছুটা অনুরোধের স্বরে বলল,
-আপনার যদি কোন কষ্ট না হয় তবে কি আমার মেয়েকে জানালার পাশের এ সিটটায় বসতে দিবেন? মানে এক্সচেঞ্জ।
এমন সময় মেয়েও মুকিতের দিকে তাকিয়ে। কি বলব বুঝতে পারছে না। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। ভদ্রলোক নেমে যাবেন। উত্তরের আশায় ছটফট করছে। মুকিত বলল,
-ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে, আপনি যান। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি।
তবুও উনি দাঁড়িয়ে আছেন। নড়ছেন না। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। তীব্রবেগে হুইসেল বাজছে। মেয়েটা তার বাবাকে নামতে বলছে। লোকটা এখনো ঠাঁই দাড়িয়ে। মুকিত ওঠে দাড়ালো।
-আমি সিটটা চেঞ্জ করছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি নেমে যান।
লোকটা নেমে গেলেন। জানালা দিয়ে মেয়েকে শেষ বারের মত বিদায় দিয়ে গেলেন।
-সুমনা, চিন্তা করোনা মা। ক্লাস বন্ধ দিলেই চলে এসো। আমাদের জন্য কোন চিন্তা করোনা। ফোন দিও। বেশি রাত জেগে পড়ো না। সময়মতো খাবার খেয়ো।
লোকটাও ট্রেনের সাথে কিছুক্ষণ ছুটলো। আশ্চর্য ব্যাপার এতক্ষণ মেয়েটার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হলো না। বাবা এত কথা বলল। মেয়ে একটা উত্তরও দিল না। বোবা নাকি?
শব্দহীন ঝর্ণার মত একটা নির্মোহ নারী আবহ তার পাশে বিরাজ করছে। এতে কিছুটা বিরক্ত মুকিত। মনে হচ্ছে একটা দৃষ্টি শীতল করা ছবি পাশে কেউ সেঁটে দিয়ে গেছে।
ট্রেন ছুটছে। তাড়া খাওয়া কুকুরের মত ছুটছে। মুকিত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ কিছুটা শীত শীত করছিল। এখন তেমনটা মনে হচ্ছে না। ঠান্ডা বাতাসে রূক্ষপ্রায় প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। মনের ভেতর এক প্রশান্তির পরশ ছুঁয়ে যাবার পর মনটা শান্ত লাগছে। গ্রীষ্মের কাঠফাঁটা পতিত জমি একটু বৃষ্টি তে যেমন সিক্ত হয়, প্রাণ পায় মুকিতের মন তেমন হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ পর হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে দেখে মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রেন ছুঁটে চলছে হেলেদুলে। বিমানবন্দর স্টেশন ছেড়েছে অনেক আগেই। আনমনে রাতের আঁধারের আড়ালে ঢেঁকে যাওয়া চেনা শহরের অচেনা রুপে মুগ্ধ সে। প্রকৃতির সুবিন্যস্ত সৌন্দর্য্য দেখে বিরাট এক রহস্যের ভেতর হারিয়ে যেতে যেন মন চাইছে তার।
আজ বোধ হয় কার্ত্তিকের পূর্ণিমা। থালার মত একটা চাঁদ উত্তর-পশ্চিম দিকে কিছুটা হেলানো। তার শুভ্র আভায় ডুবে আছে ধানক্ষেত, পথের ধার এখানেওখানে ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর। জোছনার শরীর ভেদ করে ট্রেন ছুটে চলছে। একটু দাঁড়ানোর সময় নেই তার। মুকিত জোছনার ভালোবাসায় মুগ্ধ। সে তার হাত বাইরের দিকে মেলে ধরলো। একটু জোছনা ছুঁয়ে দেবার আশায় হাতটা নেড়েচেড়ে নিষ্পলক বাইরে দৃষ্টি স্ফীত করে অজানা এক রাজ্য ভ্রমণে বের হয়ে গেলো।
মাঝরাতের জো¯œামাখা ঠান্ডা বাতাস ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকছে। চুলে, গালে হাত রেখে আগমনী শীতের হুংকার হতে নিজেকে কিছুটা সামলে নেয়ার চেষ্টা করলো। হিমবাতাস তাকে ভেতরের নির্মোহ পরিবেশটায় ফিরে আসতে বাধ্য করলো। শরীরে হাত দিতেই বুঝতে পারলো এতক্ষণ সে একটা মোহের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিল, যার ধরুন কখন যে সে নিজে জমে বরফপ্রায় শীতল হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ওপাশে তাকাতেই দেখে মেয়েটা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটাকে দেখে তার বাবাকে দেয়া কথাটা মনে পড়ে গেল।
ছিঃ ছিঃ, সে একেবারেই ভুলে গিয়েছে। টিকিট কাটার সময় কাউন্টার হতে জানালার পাশের সিটটা চেয়ে নিয়েছিল মুকিত। একটু আরাম করে বসে প্রকৃতি দেখে যাবে বলে। এখন পূর্ণিমা। ভরা পূর্ণিমা। কার্ত্তিক মাসের পূর্ণিমা রাত। দেখলেই মন ভরে যায়। আকঁশ পরিস্কার। চাঁদ আর মুকিতের মাঝখানে কেউ থাকবে না। কত কিছু ভেবে এসেছে। ছোটবেলা বেড়ার ফাঁক দিয়ে কতই না রাত চাঁদ দেখে দেখে কাঁটিয়ে দিয়েছে সে। একসময় ঘরের চাল চুইয়ে জোছনা ঝরতো। আর সেই জোছনায় নিজেকে ভিজিয়ে নিত মনের মতো করে। এখন শহুরে পরিবেশে চাঁদ দেখার সময় কই?
কিন্ত এখন আর কি করার আছে। অগত্যা সে এপাশে এসে মেয়েটিকে ইশারায় দিল, সে জানালার পাশের সিটটাতে এখন বসতে পারে। মেয়েটা লাজুক ভঙ্গিতে এমন একটা ভাব করলো যে খুব বাধ্য হয়ে তাকে বসতে হচ্ছে। ঐ সিটটায় না বসলে তার মৃত্যু অনিবার্য কিংবা অনিবার্য কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। তাই বসছে। মুকিত পাশের সিটটায় বসলো। ভদ্রতা সূচক একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছিল। সেটাও দিল না।
“অভদ্র নাকি” একা একা ভাবে মুকিত।
সুমনা আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখদুটো তার দূর আকাশে। তার চাহনি দেখে মনে হচ্ছে আকাশের ঐ সীমনায় কিছু একটা ভুলে ফেলে এসেছে। ঠিক আফসোস করলে যেমনভাবে তাকায় ঠিক তেমন। আজব একটা মেয়ে। কোন কথা নাই। মুখে একটু হাসি নাই। চোখদুটো দেখা যাচ্ছে না। দেখতে পেলে মুকিত বুঝতে পারতো মেয়েটার চোখে কোনো স্বপ্ন আছে কিনা। মেয়েটা হয়তো বোবা। যদি না হবে তাহলে বাবাকে বিদায় দেওয়ার সময় অন্তত একটা কথা বলতে পারতো।
“পারতো না!” মুকিত একা একাই ভাবতে ভাবতে অবাক হয় ।
চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে মুকিত। এমন সময় সুমনার ফোন বেজে উঠে। শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে শুধু হু,হা জাতীয় উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। এবার বুঝা গেল যে বোবা না। কিছুক্ষণ পর ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলো। অনিচ্ছাকৃত ভাবেই মুকিত বইটার কভার পেজে তাকিয়ে বুঝলো এটা মেডিকেলের বই। তার মানে কি মেয়েটা মেডিকেলে পড়ে?
সুমনা গভীর মনোযোগে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম মুকিত সুমনার মুখের দিকে তাকালো। পাতলা ফ্রেমের চশমা চোখে, একপাশ থেকে সৌন্দর্য্য তেমনটা বুঝা যাচ্ছে না। চুলগুলো তখনো ভেজা। পিংক রঙের সিল্কের থ্রিপিস পরনে। মধ্যবিত্ত ঘরের পড়ুয়া মেয়েরা যেমন হয়, ঠিক তেমনি। জীবনের একটা স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যায় তারা। পারিপার্শ্বিক কোন অবস্থাই তাদের টলাতে পারে না। প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব তাদের জীবনের সাথে একদম মানাতে পারে না। মানে মেনে নিতে পারে না। এমন ব্রিলিয়ান্ট মেয়েগুলো একরোখা টাইপের হয়। যেটা একবার বলেছে সেটাই ধরে রাখবে। বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণে কোন ছাড় দিতে চায় না তারা।
সুমনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কখন যে মুকিত ঘুমিয়ে পড়লো, বুঝতে পারেনি। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্বপ্নেরা তার ঘুমে এসে ঝেঁকে বসেছে। সে অচেনা এক নদীর ধাঁর দিয়ে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট নৌকা দেখা যাচ্ছে। ইঞ্জিনহীন বড় নৌকাগুলোকে দাঁড় বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন লোক। মুকিত অবাক, এসময়ে মানুষ কেন দাঁড় বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে সব কিছুই যখন স্বয়ংক্রিয় তবে এত কষ্ট করে কেন দাঁড় বেয়ে নৌকা নিয়ে যাচ্ছে। মুকিত স্বপ্নে চিন্তায় পড়ে যায়।
নৌকার ভেতরে কয়েকজন লোক জড়োসরো হয়ে বসে আছে। তাদের পেছনে একটা মেয়ে লম্বা ঘোমটা পড়ে মাথা নিচু করে আছে। দেখে মনে হচ্ছে নতুন বৌ। বিয়ে করে কনেসহ বরযাত্রী যাচ্ছে মনে হয়। সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ঘাটের কাছে এসে দেখে ছোটছোট ছেলে মেয়েরা নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। আহ! কি মনোরম দৃশ্য। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। গাঁয়ের বউয়েরা মাটির কলসি ভরে পানি নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকজন কিশোরী ভেজা কাপড়ে লাজুক পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর আড়চোখে এদিক তাকাচ্ছে। মুকিত নিজের অজান্তেই কয়েকজনের পিছু নিল। মেয়েগুলো মাঝেমধ্যে পেছনে তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। মুকিত মুখ ফিরিয়ে নেয়। আস্তে আস্তে মেয়েগুলো একটা বাগানের ভেতর লুকিয়ে পড়ে। মুকিত পিছু নেয়। খুঁজতে থাকে। বাগানটা নানান ফুলে ভরপুর। আচ্ছা কি ফুল এগুলো। এমন ফুলতো আগে কখনো দেখেনি সে। অপরুপ সুন্দর চারপাশ।
হঠাৎ একটা মৃদু মিষ্টি ঘ্রাণে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে দেখে সুমনা তার ভেজা চুলগুলো খুলে দিচ্ছে। বাতাসের ঝাপটায় শ্যাম্পু করা ভেজা চুলের ঘ্রাণে তার এত সুন্দর একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। প্রথমে একটু বিরক্ত হলো। পরক্ষণেই মিষ্টি ঘ্রাণে ভুলে গেল তার মন। সুমনা বাইরের দিকে তাকিয়ে বারবার হাতের চিকন আঙুলগুলো দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করছে আর তার সুবাস ভেসে আসছে মুকিতের নাকে। মন্দ লাগছে না। একটা মেয়ের চুলের ঘ্রাণে এত নেশা থাকতে পারে আগে কখনো ভাবতে পারেনি।
সে চোখ বন্ধ করে তার নাক’কে সুমনার চুলের ঘ্রাণ পাহারায় বসালো। সুমনার দিকে তাকালো না। সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে তাকালেই এ সুবাস ছড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে। সে চায় না এ মিষ্টক্ষণ থেমে যাক। আহ, এ সুবাস কভু যদি না ফুরাতো! একা ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই নিঃশব্দে হেসে ওঠে মুকিত। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় তার। এভাবে একটা মেয়ের চুলের ঘ্রাণ চুপিচুপি নেওয়া ঠিক হচ্ছে না। যদি জানতে পারে তবে ব্যাপারটা কেমন হবে? এখন ন্যায় অন্যায় মানতে ইচ্ছে করছে না তার।
কিচুক্ষণ পর চোখ মেলে চেয়ে দেখে সুমনা তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই কিছুটা লজ্জায় সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তাহলে কি সে বুঝতে পেরেছে। কি লজ্জার ব্যাপার! সে যদি বুঝতে পারে কেমন বিশ্রী ব্যাপার হবে। মেয়েটা কী ভাববে! ঘুমে ফের মুকিতের চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসে। সিগ্ধ সুবাস সঙ্গী করে, একটা মধুর ক্ষণকে সঙ্গী করে অফিসের লগো ওয়ালা ক্যাপটা মুখের উপর চেপে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
মানুষের শব্দে মুকিতের ঘুম ভেঙ্গে গেল। আধো খোলা চোখে মোবাইলের দিকে তাকায়। ছয়টা পঁয়ত্রিশ। বাইরে তাকিয়ে দেখে সিলেট স্টেশন। এত তাড়াতাড়ি চলে আসলো! সুমনা তার লাগেজগুলো নামানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। কাউকে কিছু বলছে না। মুকিত কিছু জিগ্যেস না করেই লাগেজগুলো নামানোর জন্য হাত বাড়ালো। সুমনা বাধা দিলনা। একটা লাগেজ মুকিত নিল আরেকটা নিল সুমনা। তারা দুজন নেমে আসলো। সুমনার একহাতে লাগেজ, কাঁধে ব্যাগ, অপর হাতে মোবাইল। স্টেশনের বাইরে যাবে। হাঁটছে তারা দুজন। চারিদেকে হাজার মানুষের ভীড় এড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দুজন। কারো সাথে কারো কোনো কথা নেই। সামনে মুকিত, তার একটু পেছনে সুমনা। সুমনা জোরে হাঁটছে কিন্তু মুকিতকে ধরতে পারছে না।
স্টেশনের বাইরে এসে মুকিত একটা সিএনজি অটোরিকশা নিল, সিলেট মেডিকেল।
– আপনি কিভাবে জানলেন আমি সিলেট মেডিকেলে যাবো?
এই প্রথম তার মুখ নিঃসৃত কথা শুনতে পেল মুকিত। এত সুন্দর কন্ঠ! মনে হলো একটা পাখি প্রভাতি গান গেয়ে ওঠলো। তার প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে। সেই গানের সুরে ভেসে যাচ্ছে জীবনের সব কোলাহল। মুকিত সেই প্রতিধ্বনির অপেক্ষায় আছে।
– আমি এমনিতেই বুঝতে পেরেছি। তাছাড়া আপনি ট্রেনে বসে মেডিকেলের বই পড়ছিলেন, তাই মনে হলো। ঠিক আছে তো?
– হ্যা, ঠিক আছে। কিন্তু সিলেট মেডিকেল কিভাবে বুঝলেন ? অন্য কোন মেডিকেল কলেজও হতো পারতো?
– থাক না সেসব কথা। আপনি উঠুন।
– আগে বলুন, অন্য মেডিকেলও তো হতে পারতো, পারতো না ?
– তা হতো।
– তো কিভাবে বুঝলেন, সিলেট মেডিকেল? বলতেই হবে।
– কথা বাড়াচ্ছেন? আমার কিন্তু সময় নেই। আর আপনাকে দেখেই এমনটা মনে হয়েছে।
কথাটা শুনে সুমনা অবাক। এভাবে মুখের উপর লোকটা কিভাবে বলতে পারলো? এভাবে বলা যায়? তাছাড়া একটা মেয়ের মুখের উপর এভাবে বলতে পারা দুরুহ ব্যাপার আর সে এই ব্যাপারটা সহজেই করে ফেললো। সুমনা এইবার চুপ।
লাগেজগুলো উঠিয়ে দিয়ে সুমনাকে বিদায় জানালো মুকিত।
অটোরিকশা চলা শুরু করলো। পেছনে তাকিয়ে আছে মুকিত। সেও হাঁটছে। কিছুদূর গিয়ে অটোরিশাটা থেমে গেল। বের হয়ে আসলো সুমনা। মুকিত সামনে এগিয়ে এলো।
-ছেলেদের এত মুডি ভালো লাগে না!
সুমনার কথা শুনে মুকিত অবাক। কে মুড দেখালো, কে মুডি? কোন কথা বলে না সে। শুধু একটু হাসে।
-সুমনা, ফার্স্ট ইয়ার। মুড ভাঙ্গলে আসবেন।
বলেই সে চলে গেল। মুকিত ভাবলো মোবাইল নাম্বার টা চেয়ে নিবে। হয়তো মুকিত মোবাইল নাম্বারটা চাইবে এবং তার নাম্বারটাও দিবে ভেবে সর্বক্ষণ সুমনার হাতে নোকিয়া-৫১৩০ এক্সপ্রেস মিউজিক ফোনটা শোভা পাচ্ছিল। মুকিত চায়নি, সুমনাও দেয়নি।
মুকিত হাঁটতে থাকে। ক্বীন ব্রীজটাকে আজ বেশি ঢালু মনে হচ্ছে। সে কিছুতেই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এগুতে পারছে না। মনে হচ্ছে পেছন থেকে কেউ জোরে ধাক্কা দিচ্ছে একটু না সামলালে পড়ে যাবে সে। আগে তো কখনো এমন হয়নি। আগেও তো ট্রেন লেট করে এসেছে। আগেও এই পথ ধরে হেটে গেছে, বন্দর, জিন্দাবাজার তারপর . . .
আজ ব্যাগটা অনেক ভারি মনে হচ্ছে নাকি অন্যকিছু। ভাবতে পারছে না মুকিত। সবকিছু এলামেলো হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, আগামী সপ্তাহেও কি ট্রেন লেট করে ছাড়বে? সেই লেট করা ট্রেনে সুমনা কি আসবে? পাশের সিটটায় বসবে? তখনো কি জানালার পাশে বসার জন্য একটু অনুনয় করবে? আর সেই ভেজাচুলের ঘ্রাণে কি মনটা তখনও উদাস হবে?
শিশির¯œাত সকালের হিম হাওয়ায় মন ভেজাতে ভেজাতে সামনে এগিয়ে যায় মুকিত। পেছন ফেলে আসে এক ঘোর, সেই ঘোর কাঁটছে না কিছুতেই। এখন মনে হচ্ছে কিছুতেই যেন সেই ঘোর না কাঁটে।
অটোরিকশাটা দ্রুত বেগে সরে যাচ্ছে সামনে থেকে। পেছনে তাকিয়ে আছে মুকিত। সে এখন কিছুই ভাবতে পারছে না। এসময় কিছু ভাবা যায় না। এখন ভাবলেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।
সারাবাংলা/এসবিডিই