Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জর্জ অরওয়েলের স্কুল জীবন

মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী
২৬ জুন ২০২৪ ১৮:১৩

তরুণ এরিক আর্থার ব্লেয়ারের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা একটি কনভেন্ট স্কুলে শুরু হয়। জীবনীকার গর্ডন বোকার বলেন, যেমনটি আগে ভাবা হতো যে অ্যাংলিকান নানদের দ্বারা স্কুলটি পরিচালিত হতো, আশলে তা নয়। স্কুলটি পরিচালিত হতো ফরাসি ক্যাথলিক নানদের দ্বারা। ১৯০৩ সালে ফ্রান্সে ধর্মীয় শিক্ষা সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার পর উরসুলিন অর্ডারের সদস্যরা নির্বাসিত হয়ে ব্রিটেনে স্কুল খোলেন। ছোটবেলায় এই স্কুলের প্রাথমিক স্মৃতি অরওয়েলের ক্যাথলিক ধর্ম সম্পর্কে তীব্র এবং কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত অনুভূতি তৈরিতে ভূমিকা রাখে। ক্যাথলিক ধর্মমতের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতার আধা-সর্বগ্রাসী অভিমুখীতার তীব্র ঘৃণা, ঐতিহাসিক সহনশীলতা এবং ধর্মতাত্ত্বিক পরিশীলিত রীতির কৃপণ প্রশংসায় খুব সামান্য মাত্রায় ভারসাম্য করা—একটি তর্কযোগ্য প্রশ্ন।

বিজ্ঞাপন

আট বছর বয়সে অরওয়েল একটি প্রিপ স্কুলে ভর্তির জন্য যোগ্য হন। এই ধরনের স্কুলগুলোর প্রস্তুতিমূলক বৈশিষ্ট্যটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলগুলোর লক্ষ্য ছিল ১৩ বা ১৪ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের একটি উন্নত স্কুল বা ‘ইটন’ ও ‘হ্যারো’র মতো কোনো চমৎকার পাবলিক স্কুলে ভর্তির যোগ্য করে তোলা। প্রিপারেটরি স্কুলগুলোর ছাত্ররা যে পরিমাণে বৃত্তি অর্জন করতো, বৃত্তিপ্রাপ্তদের প্রস্তুতকারক হিসাবে সেই খ্যাতির অনুপাতে স্কুলগুলো বেঁচে ছিল বা মারা গিয়েছিল। সুনাম বাড়ানোর জন্য স্কুলগুলো মেধাবীদের সল্প বেতনে শিক্ষালাভের সুযোগ দিত। তার মা তাকে পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার পরিবার ফি বহন করতে সক্ষম ছিল না। ইডা ব্লেয়ারের ভাই চার্লস লিমুজিনের সামাজিক সুসম্পর্কের কারণে অরওয়েল পূর্ব সাসেক্সের ইস্টবোর্নের সেন্ট সাইপ্রিয়ানস স্কুলে বৃত্তি অর্জন করেন। সম্ভবত ইডা ব্লেয়ার ইস্টবোর্নের সেন্ট সাইপ্রিয়ানস স্কুল পরিদর্শন করার সময় তেমনটিই আশা করেছিলেন। সেন্ট সাইপ্রিয়ানস স্কুলটি কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে পূর্ব সাসেক্সের ইস্টবোর্নে শিক্ষা প্রসারে খ্যাতি অর্জন করে। সরকারী পেনশনের ওপর নির্ভর একটি পরিবারের জন্য বাৎসরিক ফি ১৮০ পাউন্ডের পরিবর্তে একটি অসমর্থ ফি বাবত এরিকের জন্য দিতে হবে মাত্র ৯০ পাউন্ড। এই অর্ধ-বৃত্তির বিষয়টি ছেলেটির কাছে প্রকাশ করা হয়নি। ইতোমধ্যে সে কয়েক বছর পার করেছে। এই কয়েক বছর ধরে ধনী ছেলেদের স্কুলে নিজেকে দরিদ্র ছাত্রদের একজন হিশেবে দেখার অপমান সহ্য করতে হয়েছে। প্রধান শিক্ষিকা সিসিলি এবং প্রধান শিক্ষক লুইস ভন উইল্কস (যিনি তাকে অকৃতজ্ঞতার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন) উভয়েই তার মর্যাদা প্রকাশ করে দেন। স্কুলের প্রতি তার ঘৃণা আরও প্রবল হয়ে ওঠে যখন আট বছরের শিশুটিকে কয়েকবার বিছানায় প্রশ্রাব করার দায়ে প্রকাশ্যে বেশ কয়েকবার বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয়। তার নিপীড়করা সঠিক ছিল –এই অনুভূতিটি ছিল ব্যথার যন্ত্রণা এবং অপমানের চেয়েও নিকৃষ্ট। শিশু অরওয়েল বিছানা ভিজিয়ে ফেলতেন। ঘটনাটিতে তার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিজ মনের কোণে তিনি অপরাধী ছিলেন এবং কৃতকর্মের প্রাপ্য তিনি পেয়েছেন। অতএব, তিনি নিজেকে একজন শিকার হিশেবে দেখেছেন তবে নির্দোষ নয়।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় সংবাদপত্রে অরওয়েলের দুটি কবিতা প্রকাশ হয় (যার মধ্যে একটি কবিতা পুরো স্কুলে উচ্চস্বরে পড়ানো হয়)। তিনি ইটন এবং ওয়েস্টমিনস্টারে স্কলারশিপ জিতেছিলেন। তবুও সেন্ট সাইপ্রিয়ানস থেকে তিনি দূরে সরে এসেছিলেন, কারন কিছু মৌলিক নৈতিক স্তরে তার ব্যর্থতা ছিল। ত্রিশ বছর পর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জর্জ অরওয়েল তার “সাচ, সাচ উইয়ার দ্য জয়েস” প্রবন্ধে আট বছর বয়সী এরিক ব্লেয়ারের জন্য সঠিক প্রতিশোধ নেন, তার ইংরেজি বোর্ডিং স্কুলটির প্রতি তিনি অভিযোগ তোলেন, যেমনটি তিনি “নাইনটিন এইটি ফোর” উপন্যাসে সর্বগ্রাসী বিশ্বের বিরুদ্ধে তুলেছিলেন। আদতে অরওয়েল স্কুলটিকে ঘৃণাই করতেন।

লুইস ভন উইলকস এবং তার স্ত্রী সিসিলি কমিন নামের তরুণ এক নব বিবাহিত দম্পতি ১৮৯৯ সালে সেন্ট সাইপ্রিয়ানস স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মূলত কার্লাইসেল রোডের একটি বড় বাড়িতে পরিচালিত হতো। স্কুলটির খ্যাতি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯০৬ সাল নাগাদ সামারডাউন রোডের পিছনে বিস্তৃত খেলার মাঠ সহ নব নির্মিত ভবনে যেতে বাধ্য হয়। স্কুলটি মাসকুলার খ্রিস্টধর্মের প্রচলিত নীতির সাথে পরিচালিত হতো যা রাগবি ঘরানার টমাস আর্নল্ডের সময় থেকে ব্যক্তিগত শিক্ষারীতিকে অনুসরণ করে এবং আত্মনির্ভরতা এবং চারিত্রিক সততা বিকাশের উপর অত্যন্ত জোর দেয়। এসবের পাশাপাশি অন্যান্য অনেক দিক থেকে সেন্ট সাইপ্রিয়ানস ছিল সেই সময়ের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় প্রিপ স্কুল থেকে একটু আলাদা ধরনের। অক্সফোর্ডের অল সোলস কলেজের ফেলো স্যার চার্লস গ্রান্ট রবার্টসন কর্তৃক পরিচালিত একটি স্বাধীন একাডেমিক মূল্যায়নে স্কুলটি প্রতি বছর নিজেকে উপস্থাপন করতো। স্কুলের ইউনিফর্মটি ছিল একটি ফ্যাকাশে নীল কলারের একটি সবুজ শার্ট, কর্ডুরয় ব্রীচ এবং একটি প্রতীক হিশেবে মাল্টিজ ক্রসসহ একটি টুপি।

মাসকুলার খ্রিস্টধর্ম ছিল একটি দার্শনিক আন্দোলন যা ১৯ শতকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডে উদ্ভূত হয়েছিল। দেশপ্রেমের দায়িত্ব কর্তব্য, শৃঙ্খলা, আত্মত্যাগ, পুরুষত্ব এবং ক্রীড়াবিষয়ক নৈতিক ও শারীরিক সৌন্দর্যে বিশ্বাসের রীতিতে চিহ্নিত হয়েছিল এই আন্দোলন। আন্দোলনটি ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজ পাবলিক স্কুলে ছাত্রদের চরিত্র গঠনের একটি পদ্ধতি হিসাবে প্রচলিত হয়। আমেরিকান রাষ্ট্রপতি থিওডোর রুজভেল্ট এমন একটি পরিবারে বেড়ে ওঠেন যেটি মাসকুলার খ্রিস্টধর্ম অনুশীলন করত এবং তিনি এই আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট অনুগামী ছিলেন। রুজভেল্ট, কিংসলে এবং হিউজ শারীরিক শক্তি এবং স্বাস্থ্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনীতিতে খ্রিস্টীয় আদর্শের সক্রিয় সাধনাকে উন্নীত করেছিলেন। মাসকুলার খ্রিস্টধর্ম শারীরিক এবং খ্রিস্টীয় আধ্যাত্মিক বিকাশকে সমন্বয়কারী সংস্থাসমূহের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। এটি ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্টবাদ উভয়ের মধ্যেই প্রভাবশালী। মাসকুলার খ্রিস্টধর্ম আন্দোলন কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত হয়নি। বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রবণতা যা বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব এবং গীর্জা কর্তৃক সমর্থিত হয়েছিল।

ইটন এবং হ্যারো সহ শীর্ষস্থানীয় পাবলিক স্কুলসমূহে বৃত্তি অর্জনে উচ্চ সাফল্যের হার উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিভাবকদের সেন্ট সাইপ্রিয়ানসের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। যাইহোক, উইলকসরা প্রশংসা করেছেন যে পাবলিক স্কুল স্কলারশিপগুলো সত্যিই কম সচ্ছল পরিবারের প্রতিভাবান শিশুদের জন্য বরাদ্দ ছিল। এই বৃত্তিসমূহ অর্জন করার আশায় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাসকৃত ফিতে সেন্ট সাইপ্রিয়ানস-এ সেই ছাত্রদের স্থান দিত। আরও দুটি বৈশিষ্ট্য সেন্ট সাইপ্রিয়ানসকে আলাদা করেছে। প্রথম বৈশিষ্ট্যটি ছিল সাউথ ডাউনস উপত্যকার নৈকট্য। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় কাউন্টিগুলি জুড়ে পশ্চিমে হ্যাম্পশায়ারের ইটচেন উপত্যকা থেকে ইস্টবোর্নের সমূদ্র উপকূল পর্যন্ত প্রায় ৬৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় কাউন্টিগুলোর পূর্ব সাসেক্সের ডাউনল্যান্ড এস্টেটের চুনাপাথর পাহাড়ের বিশাল পরিসর এই সাউথ ডাউন। সাউথ ডাউন উপত্যকা ইংল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চুনাপাথর সমৃদ্ধ অঞ্চল হিশেবে স্বীকৃত। এই অঞ্চলটি দক্ষিণ ইংল্যান্ডের চুনাপাথর সমৃদ্ধ বিক্ষিপ্ত মাটির চারটি উচ্চভূমির প্রধান এলাকার একটি। মনোরম এলাকাটিতে ছেলেদের বন্য দৌড়, প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যয়ন, হাঁটা, বনভোজন, অশ্বারোহণ এবং এমনকি সংলগ্ন মাঠগুলিতে গল্ফ খেলার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানো হয়েছিল। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি ছিল মিসেস উইলকসের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব (তিনি ‘মম’ নামে পরিচিত ছিলেন)। তিনি স্কুলটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন এবং নারীমুক্তির আগেকার যুগে এটি তার অভিযোগের উপর একটি দুর্দান্ত ছাপ ফেলেছিল। মিসেস উইলকস ইতিহাস শিক্ষাদানে একজন মহান বিশ্বাসী ছিলেন এবং হ্যারো ইতিহাস পুরস্কারকে প্রধান পাঠ্যক্রমের মধ্যে আনার একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন। মিসেস উইলকস ইংরেজিও শেখাতেন। তিনি স্পষ্ট ও উচ্চ মানের রচনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে লেখকদের প্রজন্মকে উদ্দীপিত করেন। মিসেস উইলকস ছাড়াও, একটি বড় প্রভাব ছিল দ্বিতীয় মাস্টার আর এল সিলারের। তিনি স্কুলটি উদ্বোধনের পরপরই যোগ দেন এবং ৩০ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষাদানে রত ছিলেন।

চল্লিশতম বছরে স্কুল ভবনটি ১৯৩৯ সালের ১৪ মে আগুনে পুড়ে যায় এবং উপরের জানালা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে একজন গৃহকর্মী মারা যায়। সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া ইস্টবোর্নের একটি প্রিপারেটরি স্কুল আসচাম সেন্ট ভিনসেন্ট স্কুলের ভবনে জরুরি আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৯ সালের ২০ জুলাই সেন্ট সাইপ্রিয়ানস পশ্চিম সাসেক্সের মিডহার্স্টের কাছে হুইস্পার্সে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী কর্তৃক ভবনটি অধিগ্রহন না করা পর্যন্ত স্কুলটি ১৮ মাস সেখানেই অবস্থান করে। এরকম দুইবারের আঘাতের ফলে ছাত্র সংখ্যা হ্রাস পায় এবং গ্লুচেস্টারশায়ারের রোজহিল স্কুলের সাথে সংক্ষিপ্ত সংমিশ্রণের পরে অবশিষ্ট ছাত্ররা অক্সফোর্ড অঞ্চলের পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী সামার ফিল্ডস স্কুলে যোগ দিতে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ডব্লিউ জে ভি টমলিনসন (বিল) -এর সাথে চলে যায়। স্কুলের খেলার মাঠ ইস্টবোর্ন কলেজের কাছে বিক্রি হয়ে যায়।

জর্জ অরওয়েল আধা-আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ “সাচ, সাচ ওয়্যার দ্য জয়স”-এ স্কুল থেকে পাওয়া অপমানজনক তিক্ততা বিষয় প্রসঙ্গে লিখেছেন। লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় পার্টিসান রিভিউ সাময়িকীতে (সেপ্টেম্বর- অক্টোবর ১৯৫২)। অরওয়েলের নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ি এটি মুদ্রণের জন্য খুব মানহানিকর লেখা ছিল। তাই ব্রিটিশ মানহানি আইনের আওতায় প্রবন্ধটিতে বর্ণিত ব্যক্তিবর্গ বেঁচে থাকার সময় প্রকাশ করা যায়নি। প্রবন্ধটি ১৯৫২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয় এবং স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ‘ক্রসগেটস’ রাখা হয়, কিন্তু মিসেস উইলকসের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়নি।

প্রবন্ধটিতে অরওয়েলের সমালোচনার খোঁচা বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষার পদ্ধতিকে আঘাত করে যেখানে শিশুদেরকে ৭ বা ৮ বছর বয়সে তাদের বাড়ি থেকে দূরে পাঠানো হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেনের অপ্রতিফলিত অভিজাতবাদ এবং শ্রেণীবাদকেও প্রবন্ধটি প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি অরওয়েলের প্রবন্ধের একটি সমাপনী অনুচ্ছেদ থেকে স্পষ্ট :

“সেন্ট সাইপ্রিয়ানস এখন আমার কাছে কেমন দেখাবে, যদি আমি আমার বর্তমান বয়সে ফিরে যেতে পারি এবং এটিকে ১৯১৫ সালের মতো করে ফিরে দেখতে পারি ? সাম্বো এবং ফ্লিপ নামের সেই ভয়ঙ্কর, শক্তিমান দানবদের সম্পর্কে আমার কী ভাবনা পোষণ করা উচিত? তাদেরকে আমার নজরে সাগ্রহে সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কতিপয় মূর্খ, অগভীর, অকার্যকর লোক হিশেবে দেখা উচিত। যেকোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই বুঝতে পারবে বিষয়টি কতখানি যন্ত্রণার দিকে নিয়ে যেতে পারে।”

স্কুলটিতে নব্য ধনী এবং অভিজাত ছাত্রদের উপস্থিতিকে কটাক্ষ করেছেন অরওয়েল। তাদের তিনি বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বলে মনে করতেন। “রিং অফ ব্রাইট ওয়াটার” খ্যাত প্রকৃতিবিদ এবং লেখক গ্যাভিন ম্যাক্সওয়েল একটি ধনী জমিদার পরিবার থেকে এসেছিলেন এবং তার মা ছিলেন নর্থম্বারল্যান্ডের ৭ম পার্সি ডিউকের পঞ্চম কন্যা। গ্যাভিন ম্যাক্সওয়েলকে সেন্ট সাইপ্রিয়ানসে পাঠানো হয়েছিল কারণ তার বাবা-মা ভেবেছিলেন নিম্ন-সামাজিক অবস্থানের ছেলেদের সাথে মিশলে তার দৃষ্টিভঙ্গি ভাল হবে! মিস্টার এবং মিসেস উইল্কস তার সম্পর্কে যাই ভাবুন না কেন অন্য ছেলেরা ম্যাক্সওয়েলকে বিরক্ত করত, এর ফলে তিনি অন্যত্র চলে যান। ম্যাক্সওয়েল স্কুলটিকে কঠিন বলে মনে করেন এবং ত্যাগ করেন কারণ তিনি অনুভব করেছেন যে স্কটিশ সম্পত্তি ও তার অভিজাত পিতামাতার কারণে তিনি অসন্তোষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। লংহার্স্ট স্কুলের এবং মিসেস উইলকসের প্রচুর প্রশংসা করেন। অরওয়েলের সাথে স্কুলে সহপাঠি ছিলেন সেসিল বিটন। তার একটি ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ছিল, প্রবন্ধটিকে “হাস্যকর মজার – কিন্তু অতিরঞ্জিত” হিসাবে বর্ণনা করেন। অরওয়েলের প্রবন্ধটি বিশদভাবে ব্যবচ্ছেদ করা হয় এবং পিয়ারস এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

প্রাক্তন ছাত্রদের প্রায় সমস্ত বিবরণ থেকে জানা যায় যে স্কুলটি তাদের জীবনে একটি ভাল সূচনা করেছে কিন্তু মিসেস উইলকসের মতামত ভিন্ন। ডেভিড ওগিলভি সমালোচনামূলক, কিন্তু অ্যালারিক জ্যাকব তার শিক্ষার প্রশংসা করেন এবং ফুট, রিভেট-কারনাক এবং রাইট তাকে অত্যন্ত স্নেহের সাথে উল্লেখ করেন। কনোলিই তার বাবা-মায়ের কাগজপত্র পাঠের পর ক্ষমাপ্রার্থীভাবে লিখেছিলেন: “উইলকস সত্যিকারের বন্ধু ছিলেন এবং আমি তাদের আচরণের ব্যঙ্গ করেছিলাম” … তিনি মিসেস উইলকসকে “একজন উষ্ণ হৃদয় এবং অনুপ্রেরণাদায়ি শিক্ষক” হিসাবে বর্ণনা করেন। ।

জর্জ অরওয়েল লুইস এবং সিসিলি উইলকসকে অহংকারী বলে অভিযুক্ত করেন। তারা খুব ধনী শিশুদের, সাধারণ ধনী শিশুদের এবং অরওয়েলের মতো দরিদ্র বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে বলে অভিযোগ করেন। এটি শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে পকেটের টাকা পর্যন্ত প্রযোজ্য। খুব ধনী শিশুদের কখনই বেত মারা হতো না, অপরদিকে সাধারণ ধনী শিশুদের খুব কমই বেত মারা হতো এবং তিনি সহ অপরাপর দরিদ্র বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদেরকে নিয়মিত বেত্রাঘাত সহ্য করতে হতো। মিস্টার এবং মিসেস উইলকস হয়তো আর্থিক বিবেচনার দ্বারা তাড়িত হয়েছেন। যে সব বাচ্চাদের বাবা-মা সম্পূর্ণ ফি দিয়ে পড়তে পাঠাতেন তাদের তাড়িয়ে দেওয়া নির্বুদ্ধিতা হবে বরং দরিদ্র বৃত্তিপ্রাপ্ত ছেলেদের দূরে সরিয়ে রাখা অপেক্ষাকৃত সহজতর। এছাড়াও খুব ধনী সন্তান যারা খারাপ ফলাফল করেছিল তারা এখনও প্রচুর সম্পদের উত্তরাধিকারী। অরওয়েল বুঝে গিয়েছিলেন যে দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের জীবনে সাফল্য পেতে হলে কঠোর পড়াশোনা করতে হবে।অরওয়েলের উল্লিখিত অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন অক্সফোর্ডের ওরচেস্টার কলেজ থেকে উত্তীর্ণ দ্বিতীয় শিক্ষক রবার্ট লরেন্স সিলার। জর্জ অরওয়েল তার সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করেছিলেন কিন্তু সিলারকে “সাচ, সাচ ওয়্যার দ্য জয়স“-এর আগের সংস্করণে মিস্টার ব্রাউন বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেন্ট সাইপ্রিয়ানের অন্য একজন শিক্ষক মিঃ ফস্টার নোলসকে অরওয়েল খুব সম্মান করতেন, তিনি ছিলেন অনাবাসী এবং অরওয়েল তাকে মিস্টার ব্যাচেলর বলে ডাকতেন।

সেন্ট সাইপ্রিয়ানের জনৈক শিক্ষককে অরওয়েল অপছন্দ করতেন। তিনি চার্লস এডগার লোসেবি। সেন্ট সাইপ্রিয়ানের সমকামিতা নিয়ে একটি অভ্যন্তরীণ কেলেঙ্কারির পরে জর্জ অরওয়েল লোসবিকে অপছন্দ করতেন, কারণ এই গম্ভীর, কালো কেশবিশিষ্ট, জড়বুদ্ধি একজন সহকারী শিক্ষক যিনি পরে সংসদ সদস্যও হন; বড় ছেলেদের একটি নির্জন ঘরে নিয়ে গিয়ে শরীর একটি মন্দির বিষয়ক গতানুগতিক বক্তৃতা ঝাড়তেন। সেই যুগে সমকামিতার মতো অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হতো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং চরম অশ্লীলতার সর্বোচ্চ শাস্তি হতো দুই বছরের কঠোর শ্রম। এই ধরনের কেলেঙ্কারি যদি ফাঁস হয়ে যায় তাহলে একটি স্কুলের সুনাম নষ্ট হতে পারত, বিশেষ করে ঘটনাস্থল যখন সেন্ট সাইপ্রিয়ানসের মতো একটি নতুন স্কুল।

সেন্ট সাইপ্রিয়ানের ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে মিস্টার এবং মিসেস উইলকস এবং তাদের চার সন্তানের তালিকা রয়েছে। তাদের গভর্নেস ইভলিন মেরি জেনার বিশ, ম্যাট্রন হিশেবে সুসান্না ইয়াং, সিলার সহ পাঁচজন আবাসিক শিক্ষক বাষট্টিজন ছাত্র; এবং মার্গারেট বন্ড সহ নয়জন নারী পরিচারক, নয়জন নারীর মধ্যে দ্বিতীয় সবচেয়ে বয়স্ক মার্গারেট অরওয়েলকে ম্যাট্রন হিসাবে স্মরণ করা যেতে পারে। এরিক আর্থার ব্লেয়ারকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। আদমশুমারির পর তিনি সেখানে ছাত্র হিশেবে যোগ দেন।

লুইস এবং সিসিলি উইলকস, তাদের পাঁচজন আবাসিক শিক্ষক এবং অনাবাসিক শিক্ষকগণ একটি পাঠ্যক্রম শিক্ষা দিতেন যা ইটন এবং হ্যারো কলেজে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ছাত্রদেরকে এগিয়ে রাখত। স্কুলটিতে ল্যাটিন এবং গ্রীক ক্লাসিক, ধর্মগ্রন্থ, ইতিহাস, ফরাসি, ইংরেজি সাহিত্য এবং অঙ্কন বিষয়ের আধিপত্য ছিল। গণিত এবং ভূগোলকে তুচ্ছ করা হতো, পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চাকেও। রবার্ট লরেন্স সিলার ছাত্রদেরকে প্রাকৃতিক ইতিহাস বিষয়ক প্রমোদ ভ্রমণে নিয়ে যেতেন কিন্তু মিসেস উইলকস খোলাখুলিভাবে তাদের উপহাস করতেন।

জর্জ অরওয়েলের বন্ধু এবং সেন্ট সাইপ্রিয়ানস ও ইটনে তার সমসাময়িক সিরিল ভার্নন কনোলি তার “এনিমিজ অব প্রমিজ” গ্রন্থে সেন্ট সাইপ্রিয়ানের বর্ণনা করেছেন ‘সেন্ট উলফ্রিকস’ নামে, মিস্টার এবং মিসেস উইলকসকে সাম্বো এবং ফ্লিপ নাম দিয়ে। কনোলি সেন্ট সাইপ্রিয়ান স্কুলে শিক্ষালাভ করেন এবং সেখানে তিনি জর্জ অরওয়েল এবং সেসিল বিটনের সঙ্গ উপভোগ করেন। তিনি শক্তিশালী প্রধান শিক্ষিকা মিসেস উইলকসের প্রিয় ছাত্র ছিলেন কিন্তু পরে তিনি স্কুলের “চরিত্র-নির্মাণ” নীতির সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, “অরওয়েল আমার কাছে প্রমাণ করেছেন যে চরিত্রের একটি বিকল্প আছে, সেটি হল বুদ্ধিমত্তা। সেসিল বিটনকে আমার একজন সংবেদনশীল মানুষ বলে মনে হয়েছে।” কনোলি ‘হ্যারো হিস্ট্রি প্রাইজ’ জিতেছিলেন, অরওয়েল দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। অরওয়েল ‘ইংলিশ প্রাইজ’ পুরস্কারটি জিতে নেন। অরওয়েলের এক বছর পর কনোলিও ইটন কলেজে বৃত্তি লাভ করেন।
সেন্ট সাইপ্রিয়ানসে থাকাকালীন অরওয়েল দুটি কবিতা লেখেন যা হেনলি এবং সাউথ অক্সফোর্ডশায়ার স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার লেখা স্কুলের বহিরাগত পরীক্ষক দ্বারা প্রশংসিত হয় এবং তিনি ওয়েলিংটন ও ইটনে বৃত্তি অর্জন করেন। কিন্তু ইটনে স্কলারশিপ লাভ করলেও থাকার বাসস্থানের নিশ্চয়তা ছিল না। ইটনে একটি বাসস্থান জোটানোর আগ পর্যন্ত তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সেন্ট সাইপ্রিয়ানসে থেকে যান। জানুয়ারিতে তিনি ওয়েলিংটনে স্থানান্তরিত হন।

স্বাভাবিক বয়সের আগেই শিশুদের তাদের পিতামাতার কাছ থেকে আলাদা করার জন্য বেসরকারী স্কুল ব্যবস্থার সমালোচনা করেন সিরিল কনোলি। কিন্তু তিনি বলেন যে ‘সেন্ট উলফ্রিকস’ ছিল একটি ভাল ব্যবস্থাপনার জোরালো উদাহরণ যা আমার জন্য একটি উন্নত বিশ্ব উপহার দিয়েছে। তিনি বলেন যে মিসেস উইলকস ছিলেন সক্ষম, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, মেজাজী এবং উদ্যমী। অরওয়েলের আক্রমণাত্মক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর কনোলি স্কুল এবং মিসেস উইলকসের পক্ষ অবলম্বন করেন। তিনি তার নিজের মৃদু সমালোচনার অন্যায্যতা নিয়েও কথা বলেন। মনে রাখা প্রয়োজন, সিরিল কনোলি সেন্ট সাইপ্রিয়ানসে শিক্ষা শুরু করেন এগারো বছর বয়সে এবং অরওয়েল শুরু করেন আট বছর বয়সে। বোর্ডিং স্কুলের ভর্তি এবং পিতামাতার কাছ থেকে আলাদা করার প্রসঙ্গে আলোকপাত করলে দেখা যাবে আট বছরের শিশুটির চেয়ে এগারো বছরের বালকটির বেদনা অপেক্ষাকৃত কম। সিরিল কনোলি সম্ভবত সেন্ট সাইপ্রিয়ানসে কখনো তার বিছানা ভেজাননি।
উইলকস ১৯৪৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী দক্ষিণ পূর্ব ইংল্যান্ডের আনুষ্ঠানিক কাউন্টি সারে-এর ভার্জিনিয়া ওয়াটারের হলওয়ে স্যানাটোরিয়ামে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল সাতাত্তর।

তথ্য কৃতজ্ঞতা :
The Complete Works of George Orwell, ed. Peter Davison (London: Secker & Warburg, 1998).
W H J Christie. St Cyprian’s Days, Blackwood’s Magazine, May 1971.
St Cyprian’s Chronicle 1914–1930.
Enemies of Promise. By Cyril Connolly. (1938).
Such, Such Were The Joys, By George Orwell.
“St. Cyprian’s Days,” By W. H. J. Christie. Blackwood’s Magazine, 309 (May 1971), 391.

সারাবাংলা/এসবিডিই

জর্জ অরওয়েলের স্কুল জীবন মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী