আহসান হাবীব-এর রম্যগল্প ‘ফুটবল সমর্থকের ঈদ দর্শন!’
১৩ জুন ২০১৮ ১৭:৫৬
আহসান হাবীব ।।
এপার্টমেন্টের শহর ঢাকা। এইরকম এক এপার্টমেন্টে সবাই ব্রাজিলের সাপোর্টার। বিশটা ফ্লাটের সবাই ব্রাজিলের সাপোর্টার। প্রত্যেক ফ্লাটের ব্যালকনিতে একটা করে ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে। এর মধ্যে একদিন দেখা গেল একজন তার ব্যালকনিতে মানে বারান্দায় আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ টানিয়েছেন। অন্যরা হতভম্ব! এই এপার্টমেন্টে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার আছে? তাকে একদিন ধরা হল। সভাপতিই এগিয়ে গেলেন।
– আপনি এই এপার্টমেন্টের বাসিন্দা ?
– হ্যাঁ, আমিতো আটতলায় সেভেন বি’তে থাকি।
– আপনি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার?
– হ্যাঁ
– কিন্তু এই এপার্টমেন্টেতো আমরা সবাই ব্রাজিলের সাপোটার্র
– তাতে সমস্যা কি? আমি আর্জেন্টিনার…
দ্রুতই এই নিয়ে সভাপতি এপার্টমেন্টের দোতলার হল রুমে মিটিং ডাকলেন। সেভেন বি এর ভাড়াটে বদরুল সাহেব আর্জেন্টিনার সাপোর্টার এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তাকে হয় ব্রাজিল সাপোর্ট করতে হবে নইলে এই ফ্লাট ছাড়তে হবে, মানে এপার্টমেন্ট ছাড়তে হবে। উনি যেহেতু ভাড়াটিয়া ফ্লাটের মালিক না কাজেই তাকে সহজেই নোটিশ দেয়া যায়। তার যে বাড়িওয়ালা মানে সেভেন বি ফ্লাটের মূল মালিক তাকে সবাই চাপ দিল
– দেখুন আপনার ভাড়াটিয়াকে হয় ব্রাজিল সাপোর্ট করতে বলুন… নইলে ফ্লাট ছাড়তে হবে।
– হ্যাঁ ঠিক, এখন যেভাবেই হোক ওকে বিদেয় করুন।
– ইয়ে এটা কিভাবে করি? …মানে… সেভেন বি এর ফ্লাটের মালিক আমতা আমতা করেন।
অন্যরা একজোট হয়। নো, এটা করতেই হবে। দরকার হলে ঈদের আগেই আমরা আপনার জন্য ভাড়াটিয়া জোগাড় করে দিব। কিন্তু এই আর্জেন্টিার সাপোর্টারকে এই এপার্টমেন্টে রাখা যাবে না, কভি নেহি! ঘরের শত্রু বিভিষন… দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষা যাবে না… নানাজন নানা বিশেষন দিতে লাগলেন।
পরে সত্যি সত্যিই সেই আর্জেন্টিনার সাপোর্টারকে নোটিশ দেয়া হল। এবং বলাই বাহুল্য আর্জেন্টিনার সেই সাপোর্টার বিশিষ্ট ভদ্রলোক, বলামাত্র তিনি ফ্লাট ছেড়ে চলে গেলেন। কোন আপত্তি করলেন না, (তার এই বদান্যতায় দু-একজন ভিতরে ভিতরে আর্জেন্টিার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লেন যেন!)। তবে তার জায়গায় খুঁজে পেতে আরেকজন ভাড়াটিয়াকে আনা হল। এতে অবশ্য সেভেন বি এর মালিকের বেশ লাভই হল। তিনি এই সুবাদে বাড়ি ভাড়া আরো দু হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলেন। এডভান্সও এক মাস বেশী পেলেন। মন্দ কি।
কিন্তু সর্বনাশটা হল ক’দিন পর। সেই লোক, মানে নতুন ভাড়াটিয়া তার ব্যালকনিতে বিশাল এক জার্মানির পতাকা ঝুলালো যা মোটামোটি অন্যান্য তিন চারটে ব্যালকনির ব্রাজিল পতাকা টপকে ভূমি স্পর্শ করে ঝুলতে লাগলো সদর্পে! তার মানে নতুন এই ভাড়াটিয়া জার্মানীর সাপোর্টার?? যে জামার্নী গত বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে সাত সাতটা গোল দিয়েছিল? হায় আল্লাহ…এখন কি করা??
সভাপতির সভাপতিত্বে এপার্টমেন্টের হল রুমে আবার মিটিং বসল।
– এই ভাড়াটেকে কে এনেছে? এপার্টমেন্টের সভাপতি মোটামোটি একটা হুঙ্কার দিলেন।
– কেউ আনে নি। ‘টু লেট’ দেখে উনি নিজেই … সেভেন বি’র মালিক মিন মিন করেন।
– আপনি বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেন নি? সে কোন দলের সাপোর্টার…?
– এটা কি জিজ্ঞেস করা যায় ? আরেকজন ফ্লাট মালিক আপত্তি জানায়। {আর্জেন্টিনার সেই অতি ভদ্র সাপোর্টারের বদান্যতায় ( যিনি এক কথায় বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন… ) যে দুয়েকজন আর্জেন্টিনার প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি তাদের একজন!}
শেষ মেষ মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হল যেহেতু লোকটি মানে সেভেন বি এর নতুন ভাড়াটিয়া সবে মাত্র ঢুকেছে এবং তিন মাসের এডভান্স করেছে। তাকে হুট করে বাড়ি ছারার নোটিশ দেয়া যায় না। এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই লোকের আত্মীয়-স্বজন বেশ প্রভাবশালী। তো এক কাজ করা যেতে পারে তাকে ভদ্রভাবে অনুরোধ করে ব্রাজিলের পক্ষে আনা যেতে পারে। এবং এই দায়িত্ব পালন করবেন স্বয়ং সভাপতি নিজেই।
যথারীতি একদিন সভাপতি সেই নতুন ভাড়াটিয়াকে পাকড়াও করলেন। মানে ভদ্রভাবেই ধরলেন আরকি!
– স্লামালিকমু
-ওয়ালাইকুম…
– আপনার কাছে একটা অনুরোধ করব।
– কী অনুরোধ?
– দেখুন এই এপার্টমেন্টে আমরা সবাই ব্রাজিল সমর্থক। কিন্তু আপনি দেখছি জার্মান সমর্থক…
– তা অনুুরোধটা কি?
– মানে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে
– কী কথা?
– আপনাকে ব্রাজিল সাপোর্ট করতে হবে
– কিন্তু আমিতো কথা দিয়ে ফেলেছি
– কাকে কথা দিয়েছেন?
– আমার স্ত্রী কন্যা পুত্র সবাইকে … তাদের কথা দিয়েছি এবার আমরা সবাই মিলে জার্মানকে সাপোর্ট করব
– কথা দিলেই কি কথা রাখি আমরা সবসময়?
– রাখি না? তাহলে যান আপনাকেও কথা দিলাম! বলে মুচকি হাসলেন নতুন ভাড়াটিয়া।
ক’দিন পর দেখা গেল। সেই নতুন ভাড়াটিয়ার ব্যালকনির জার্মানির পতাকা তখনো ভূমি স্পর্শ করে ঝুলছে। আরো দু একটা ব্যালকনিতে আর্জেন্টিনার পতাকাও দিব্যি ঝুলছে! এক ব্যালকনিতে মিশরের একটা ছোট্ট পতাকাও দেখা গেল সদর্পে পত পত করে উড়ছে। সবাই ভেবেছিল এইসব নিয়ে ক্ষুদ্ধ সভাপতি ফের মিটিং ডাকবেন। তা হল না। বরং নতুন ভাড়াটিয়া একদিন সভাপতিকে ডেকে বললেন-“ ভাই সাহেব আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত ‘মন রমজানেরও ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ… ’ গানে আছে না ধনী-গরীব দোস্ত-দুশমন সব সমান … এর সঙ্গে এ বছর ফুটবল দলের সব সাপোর্টাররাও সমান… এটাও একটু মাথায় রেখেন…!”