Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্যাগোর || আন্দালিব রাশদী


১৬ জুন ২০১৮ ১০:৫২

ঠিকানা জানতে চান কেনো বাপু? সরকারের টিকটিকি নাকি? লিখুন: ৬ নম্বর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট কলিকাতা ৭০০০০১ ভারতবর্ষÑস্থায়ী বলুন, বর্তমান বলুন, ঠিকানা এটাই। একটাই। এরপর কেওড়াতলা শ্মশানঘাট।

দেখতে ঠাকুরের মতোই, তবে ঘাড়টা খানিক নোয়ানো, চুলে পাক ধরেছে অন্তত ৬০ বছর আগে, ডান হাতের মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুলে পুরু কড়। নামে ঠাকুর নেই, আছে বহুগুণা। আর এন বহুগুণা। রবীন্দ্র নাথ বহুগুণা। রবীন্দ্র ও নাথ আলাদা করে লিখেন। হেমবতী নন্দন বহুগুণা কী রকম ভাই হন। এই বহুগুণার ভাস্তে বিজয় বহুগুণা উত্তরখ-ের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার অনেক বছর আগেই কাকাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দূত পাঠিয়েছিলেন, চিঠিতে লিখেছিলেনও খান্দানি ঘরওয়ালি ব্রাহ্মণ বহুগুণাদের এসব মানায় না, চলে আসুন কাকা, হিন্দি ভাষার খেদমত করুণ, আপনার থাকা-খাওয়া-শেষকৃত্যের দায়িত্ব আমার! আপনার এ বয়সে যদি চান ভালো ঘরের কমবয়সী একটা মেয়েও যোগাড় করে দেয়া যাবে, বাংলাদেশের খুলনার ফুলতলায় ভবতারিণীর কোনো আত্মীয় মিলতেও পারে। অবশ্য বয়স বেশিতেই কী আর কমেই কী। আমিই যেখানে জনগণমন অধিনায়ক জয় হে না শুনলে দাঁড়াতে পারি না, আপনি কদ্দুর এগোতে পারবেন তা তো অনুমানই করতে পারি।

বিজ্ঞাপন

রবীন্দ্র নাথ বহুগুণা রাজি হননি। হিন্দি ছেড়েই তো বাংলা শিখেছিলেন, আবু সয়ীদ আইয়ুবও তা-ই করেছিলেন রবিপ্রেমে দিওয়ানা হয়ে উর্দু ছেড়েছেন, তাঁর নামডাক হয়েছে, নিজ নামে বইপত্র বেরিয়েছে। বেশি লিখেননি, যা লিখেছেন একেকটা আস্ত পাটালি গুড়।

বহুগুণাও কম লিখেননি। রবীন্দ্র নাথের নামে নয়, রবীন্দ্রনাথের নামে। খ্যাতি কম-বেশি বেড়েছে ঠাকুরের।

বাংলাটা এত ভালো শিখেছিলেন যে ওই ঠিকানার সাগরময় ঘোষ নামের মানুষটি বলে ফেললেন, লেগে যাও, প্রুফটা দেখতে থাকো, আর কালিঝুলি নিয়ে যদি মাথাব্যথা না থাকে, তাহলে কম্পোজিটরও হও। কাজটা তুমি করলে প্রুফরিডারকে আর পয়সা দিতে হবে না। দু’চার রুপি বাড়িয়েই দেবো।

বিজ্ঞাপন

তিনি বললেন, আজ্ঞে না, সিসা আমার সহ্য হয় না, সব ধাতু সবার জন্য নয়, বলতে পারেন আমার ধাতুদৌর্বল্য ওটা।

প্রুফ কাটতে থাকার সপ্তম দিনে বহুগুণা চার ভাজকরা হলদেটে একটি খসখসে কাগজ সাগরময় ঘোষের সামনে হাজির করলেন। হাতের লেখাটি অতিপরিচিত:
চারি দিক হতে এল পণ্ডিতের দল-
অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল।
উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস
কালিদাস কবীন্দ্রের ভাগিনেয় বংশ।
মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা,
ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা।
বড় বড় মস্তকের পাকা শস্যখেত
বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ-সমেত।
কেহ শ্রুতি, কেহ স্মৃতি, কেহ বা পুরাণ
কেহ ব্যাকরণ দেখে কেহ অভিধান।

সাগরময় ঘোষের চক্ষু ছানাবড়া। কোথায় পেলে এটা বহুগুণা? এ তো দ্বারকানাথের নাতিটার হাতের লেখা। সইও আছে দেখছি। স্থান ও তারিখও। শান্তিনিকেতন, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯।

কোথায় পেলে বহুগুণা?
সিঁড়িঘরে।
কোন সিঁড়িঘরে?
৬ নম্বর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট।

আশ্চর্য, আমরা এতদিন ধরে এখানেই আছি, কেউ পেলাম না, আর তুমি সপ্তাহ না যেতে পেয়ে গেলে!

বহুগুণার রাত কাটানোর মতো বহু জায়গা নেই, মেস যে খুঁজবেন, হাতে তো পয়সাকড়িও নেই। কেউ একজন বলেছেন কোনোভাবে মুক্তারাম স্ট্রিট পর্যন্ত পৌঁছে শিব্রাম চক্রবর্তীকে গিয়ে ধরো, একটা বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।

শিব্রাম চক্রবর্তী নামটা অপরিচিত নয়, লিখেন টিখেন, হাশি ঠাট্টা করেন। নারীসঙ্গ করেন না। কোনো সমস্যার কারণে নয়, এমনিতেই।

বহুগুনা একটু দূরে থাকতে চান, যাওয়া হয়নি।

সাগরময় ঘোষ বললেন, আপাতত মাদুর পেতে সিঁড়িঘরে শুয়ে পড়ো, শোবে রাত বারোটার পর, মাদুর গুটাবে ভোর পাঁচটার আগে। মালিকপক্ষের কারও চোখে না পড়লেই ভালো।

বহুগুণা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, রবীন্দ্রনাথের অন্য কোনো রচনার পা-ুলিপির দরকার হলে বলবেন। সিঁড়িঘরে সব আছে, আমি বের করে দেব।

সাগরময় ঘোষ বললেন, তুমি তো বড্ড কামেল মানুষ হে! আন্না তড়খড় কিংবা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লেখা রবীন্দ্রনাথের কোনো রগরগে প্রেমপত্র পাওয়া যাবে?

আলবত। ফরমায়েশ করুন স্যার।
আরে ধ্যাৎ, সবাই আমাকে সাগরদা বলে, তুমি স্যার বলতে যাবে কেন? দাদাই ডেকো। আমার ভাগ্নেরাও আমাকে সাগরদা ডাকে আর আমার দিদির কানমলা খায়।

মাসপূর্তিতে যখন বেতন পাওয়ার সময়টা এগিয়ে এল শ্রী আর এন বহুগুণা নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে সাগরময় ঘোষকে বললেন, আমি বাকি রাতগুলো এখানেই, মানে সিঁড়িঘরেই কাটাতে চাই, এ জন্য আমার বেতন থেকে অন্ততঃ টেন-ফিফটিন পার্সেন্ট কেটে রাখুন, তাতে আমি স্বস্তি বোধ করব, কাজটাও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারব।

বলো কী হে! তোমার ব্যাপারটা আমাদের মালিকের ছেলের চোখে পড়েছে। তিনি তো বললেন, নাইটগার্ড নাকি মাঝরাতে প্রায়ই স্ত্রীসঙ্গ করতে চলে যায়। এতে পুরুষমানুষের পরিশ্রমটা বেশিই হয়। স্ত্রীসঙ্গের পর হাঁপাতে হাঁপাতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ততক্ষণে চোর তো আমাদের অফিস খালি করে দিতে পারে। তুমি ব্যাচেলর মানুষ। নারীসঙ্গজনিত ক্লান্তিটা কেমন তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। শিব্রাম চক্রবর্তীকেও বোঝাতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন। একবার তো এমন ঘুম দিলেন, রাত ফুরিয়ে গেল। সকালে তাঁর সে কী লজ্জা! বাইরে বেরোলোই তো কথা উঠবেÑমহর্ষির এই ছেলেটা তাহলে বখে গেছে। কিছুটা অভিমান নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ওই গানটা লিখে ফেললেন:
কেন যামিনী না যেতে জাগালে না
বেলা হ’ল মরি লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথেরি মাঝে।

বগুগুণা বললেন, ওই গানটার পা-ুলিপি লাগবে?

না, যা বলছিলাম শোনো। মালিকের ছেলে বলেছেন, নাইটগার্ডকে স্থায়ীভাবে স্ত্রীসঙ্গ করার সুযোগ দিয়ে তোমার বেতনের সঙ্গে আরও ১০টি টাকা যোগ দিয়ে তোমার পদবিটা যেন প্রুফরিডার-কাম নাইটগার্ড করে দিই। তা ছাড়া তুমি নাকি ঘুমাও না, মাদুরের ওপর উবু হয়ে সারা রাতই কী সব লেখালেখি করো, মাথার ওপর জ্বলে পুরো এক শ ওয়াট একটি বাল্ব। সারা রাত এত কী কাজ তোমার?

বহুগুণা বললেন, শুনেছি নৌকাডুবি উপন্যাসের পা-ুলিপি বিশ্বভারতীতে নেই, শান্তিনিকেতনেও না। তাই রাত জেগে ওই কাজটাই করছি।

তা করো, কিন্তু আমাদের আগ্রহ অপ্রকাশিত বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে চিঠিপত্র। এমন সব চিঠিপত্রÑএক ডজন চিঠিতে অন্তত একটিতে যেন বোমা ফাটানোর মতো এক্সপ্লোসিভ থাকে।

একটু দম নিয়ে সাগরময় ঘোষ তিতকুটে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমাকে সিঁড়িঘরের ভাড়াও দিতে হবে না, নাইটগার্ডের কাজও করতে হবে না। বাঙালটাকে বাদ দিয়ে একটা মাড়োয়ারি নাইটগার্ড রাখব, যার স্ত্রী থাকবে তার কাছ থেকে আড়াই শ মাইল দূরে, স্ত্রীসঙ্গ পেতে অত দূর যেতে হবে, এটা মনে হলেই গরম গা আপসে ঠা-া হয়ে যাবে। তোমার প্রুফরিডিংয়ের কাজ শেষ করার পর ধীরেসুস্থে রীতিমতো গবেষণা করে প্রতি মাসে তুমি রবীন্দ্রনাথের হয়ে দুটো করে চিঠি লিখবে, বছরে ২৪টা। পুজোসংখ্যাটা রবীন্দ্রনাথের চিঠি দিয়ে জমিয়ে তুলতে পারব। জানো তো আমাদের এই সাপ্তাহিকটার জন্য পূর্ববঙ্গের মানুষও হাঁ করে বসে থাকে। রবীন্দ্রনাথ চিঠি কাকে লিখবেন তুমিই ঠিক করো।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কিংবা কাদম্বরী দেবী? নাকি প্রশান্তকুমার মহলানবিশ কিংবা রোদেনস্টাইন?

সেটা তুমি গবেষণা করে ঠিক করো। তোমার জন্য স্বস্তিকর একটা খবর দিতে চাই: ‘চারি দিক হতে এলো প-িতের দল’ ওই কবিতা আর বিশ্বভারতীতে সংরক্ষিত তাঁর হাতের লেখা হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তিনি হাইরেজ্যুলেশন ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে রায় দিয়েছেন, দুটোই একই লোকের হাতের লেখা। শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

বহুগুণা একটু মিষ্টি করে হাসলেন। এটাই তো কাজের স্বীকৃতি। আর এন বহুগুণার নিষ্ঠা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করবে না।

শোনো বহুগুণা, তুমি কাজ চালিয়ে যাও। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের দেহাবসান হয়, কিন্তু তাঁরা মরেন না। তুমি রবীন্দ্রনাথের হয়ে কাজ করছ, তুমিও অমর হয়ে থাকবে। অবশ্য তোমার ব্যাপারটা আমি ছাড়া অন্য কেউ যে জানল না, এ নিয়ে তোমার আফসোস থাকতে পারে। কিন্তু তোমাকে ধরে নিতে হবে, আমিও জানি না।

১৭ এপ্রিল ১৯৯০ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর জš§শতবর্ষে আর এন বহুগুণার একটি চিঠি সত্যিই বোমা ফাটাল।

৫ জানুয়ারি ১৯২৫ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো জাহাজের কাপ্তানের নিষেধ অগ্রাহ্য করে মিস্ত্রি দিয়ে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন তাঁর আতিথ্যকালে রবীন্দ্রনাথের বসা ইজিচেয়ার। তিনি যেন কষ্ট না পান। দুমাস পর রবীন্দ্রনাথ বিজয়ার চিঠি পেলেন। সোহাগ করে এই নামটিই তিনি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে দিয়েছিলেন।

দুই

মাই ভেরি ডিয়ার গুরুদেব,
একটি সুসংবাদ আপনাকে জানানো অনিবার্য হয়ে পড়েছে, কিন্তু সংবাদটি আপনাকে ঈষৎ বিচলিত করতে পারে।
আপনার বয়স ৬৩ বছর আমার এখনো ৩৫ হয়নি। আমিই আপনাকে বলেছি ৬৩ একটি সংখ্যামাত্র, এর বেশি কিছু নয়। আপনি চোখ তুলে নিঃশব্দে হেসেছেন, বলেছেন, আমি তোমার বাবা মিগুয়েল ওকাম্পোর সমবয়সী। আমি বলেছি, আরও বড় হলেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি মনে মনে চাইলেও আপনার গুরুভাব ধরে রাখার জন্য এগোতে চাননি, আমিই আপনার একটি হাত টেনে এনে আমার বুকের ওপর রেখেছি। মানুষ যেভাবে কোমল হাতে গাছের পাকা ফল স্পর্শ করে, আপনি সেভাবে আমার ডান স্তন স্পর্শ করেই হাত সরিয়ে নিয়ে বলেছেন, এল্মহার্স্ট চলে আসবে।

লেনার্ড এল্মহার্স্ট আপনার সেক্রেটারি। আমি বললাম, ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষ হুট করে কারও ঘরে ঢোকে না! বেল বাজায়, নক করে, অনুমতি পেলে তারপর আসে।

আপনি বললেন, তাহলে প্রতিমা ঢুকে পড়তে পারে।

প্রতিমা আপনার পুত্রবধূ এবং আপনার সফরসঙ্গী। আমি আপনার রুম থেকে বেরিয়ে গোটা বাড়িটা আরেকবার ঘুরে এলাম। এল্মহার্স্ট কিছু একটা টাইপ করছে, আমি জানি ও একটু ঈর্ষাকাতর ও বর্ণবাদী ধরনের মানুষ। আপনার সঙ্গে আমার সখ্য মেনে নিতে পারছে না। প্রতিমা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি জানি আমি আপনাকে চাই। আমি আমার বোন এঞ্জেলিকাকে বলেছি। এঞ্জেলিকা বলেছে, আপনাকে প্রেসবাইটেরিয়ান চার্চের প্রিস্টের মতো দেখায়। প্রিস্টদের সেক্সুয়াল আর্জ থাকতে নেই। আমি তখন ফিসফিস করে এই কথাটাই তো আপনাকে বলেছিলাম, আমার তরুণ স্বামী ডক্টর লুই বার্নার্দো দ্য এস্ত্রাদা- তারও তো আর্জ ছিল না। ১৯১২-তে তাকে বিয়ে করি ১৯১৩-তে তার সঙ্গে শেষবারের মতোই শুয়েছি, তারপর এক বাড়িতে দুজন দুই ফ্লোরে। এরপর আমার আর পুরুষসঙ্গ হয়নি। আমি জানি, সেই ১৯০২ সালে আপনার স্ত্রী প্রয়াত। ২২টি বছর আপনিও তো বঞ্চিত। অবশ্য আপনি ঋষিপুরুষ, আপনার হয়তো নারীসঙ্গের প্রয়োজন নেই। সব জেনেশুনেই সে রাতে আমি নাশপাতি কেটে খাওয়ানোর ছল করে আপনার ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিই। আমার কাতর চাহনি আপনাকে স্পর্শ করে থাকতে পারে। গুরুদেব, আপনি কিছু সময়ের জন্য হলেও নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করেছেন। আমি এর বেশি আর কী চাইতে পারি!
আপনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। বললেন, অনেক বছর পর!
আমি বললাম, আমারও।
আমি আপনাকে এক গ্লাস লেমোনেড খাওয়ালাম। আপনি বললেন, আমার এখন লজ্জা লাগছে।
আপনাকে আঁকড়ে ধরে বললাম, আর এক ঘণ্টা থাকি?
আপনি বললেন, না, কথা উঠবে।
আমি যখন আপনার রুম থেকে বেরিয়ে আসি, দেখি, দরজায় ফ্যানি দাঁড়িয়ে। ফ্যানি আমার পুরোনো পরিচারিকা, আপনার সার্বক্ষণিক নার্স কাম অ্যাটেন্ডেন্ট।
ফ্যানি জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বুড়োটার সঙ্গে শুয়েছিলে?
আমি বললাম, না তো।
তারপর দেখলাম এল্মহার্স্টের মুখে দেঁতো হাসি।
গুরুদেব, সুসংবাদটা আপনাকে এখন দিচ্ছি। চার তারিখে আমার রজঃস্রাব শুরু হবার কথা ছিল, আজ সতর, এখনো শুরু হয়নি। টেস্টটিউবে সকালবেলার খানিকটা মূত্র নিয়ে প্রায় দেড় মাইল দূরের একটি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে গিয়েছিলাম। ওরা পরীক্ষা করে বলল, পজিটিভ। আমি গুরুদেব গুরুদেব বলে আনন্দে চিৎকার করে উঠি। আমি জানি শিঘ্রই আমার বমি শুরু হয়ে যাবে।
গুরুদেব, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না আমার বাচ্চাটির বাবা কে। আমার ধারণা, আমার মেয়ে হবে। তবুও আপনি একটি ছেলে-নাম এবং একটি মেয়ে-নাম পাঠাবেন।
আপনার জন্য আমি আমার ভালোবাসার কসম খেয়ে বলছি, কেউ জানবে না, আপনি এতটুকুও বিব্রত হবেন না। আমি বাচ্চাটা চাই, এরপর কাউকে বিয়ে করলেও বয়সের কারণে সন্তান ধারণ করতে পারব না। আমার (এবং আপনার) সন্তানের জন্য কেবলই আশীর্বাদ চাই।
আপনাকে আপনারই একটা কবিতার অংশ পড়ে শোনাই:
এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর
পুণ্য হল অঙ্গ মম ধন্য হল অন্ত র
সুন্দর হে সুন্দর।
আলোকে মোর চক্ষু দুটি মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি
হƒদ্গগনে পবন হল সৌরভেতে মন্থর
সুন্দর হে সুন্দর।
গুরুদেব, আমার কি এখনই বমি বমি ভাব হচ্ছে নাকি? এতো আগেভাগ হয় নাকি? কাল আবার লিখব।
আপনি সুস্থ থাকুন, সুখে থাকুন।
আপনার শ্রীচরণতলায় নিত্যশায়িত
বিজয়া ভিক্টোরিয়া

তিন

আরও দুমাস পর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো চিঠির জবাব পেলেন। তত দিনে গর্ভাবস্থার ফার্স্ট টাইমেস্টার শেষ। বমি থেমে গেছে। ভিক্টোরিয়া গর্ভের সন্তানের অস্তিত্ব একটু একটু করে টের পেতে শুরু করেছেন।
চিঠিটা খুবই ‘সংক্ষিপ্ত’ ঠাকুর লিখেছেন:
মাই ডিয়ার বিজয়া
যা কিছু তোমার জন্যে কল্যাণকর ও মঙ্গলময় তার সবই তোমার প্রাপ্য হোক! কাল আমাকে প্রাচ্যদেশে শিক্ষার সংকট ও নৈতিকতার সমস্যা সম্পর্কে একটি ভাষণ দিতে হবে। কী বলব এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি।
কন্যাসন্তানই হোক, নাম হোক কাকাতুয়া। সান ইসিদ্রোর সেই চেয়ারটাতে বসে প্লাতা নদী বরাবর বৃক্ষরাজির দিকে তাকিয়েছিলাম, আমি একটি কি দুটি কাকাতুয়া দেখেছি। তোমার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
তোমার বাবা-মা ও মিরালরিউর বাড়িতে যিনি আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন, সেই রিকার্দো সাহেবকে আমার শুভেচ্ছা জানাবে।
নিত্য কল্যাণ কামনায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পুনশ্চ: তোমার চেয়ারটি এখন শান্তিনিকেতনে আমার আসন।

[প্রতিমা দেবী হয়তো এই বিদেশি মেয়েটির জন্য শ্বশুরের আকুলতা বুঝে উঠতে পারেননি, কিন্তু ভিক্টোরিয়ার উচ্ছ্বাস তো দেখেছেন। শ্বশুরের কথা উল্লেখ করে তাঁকেই উদ্ধৃত করেছেন:
‘যদিবা ফেরার জাহাজ পাওয়া গেল কিন্তু ভিক্টোরিয়া আমাকে কিছুতেই ছাড়তে চায় না। সাহেবের সঙ্গে তার ছিল একটু রেষারেষির সম্পর্ক, কারণ সাহেব সর্বদা আমার কাছাকাছি থাকত, সেটা সে সইতে পারত না। অবশেষে যে কারণে সাহেব আমাকে নিজের স্বার্থের জন্য এত তাড়াতাড়ি ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, গেল সাহেবের উপর খাপ্পা হয়ে। (এই সাহেব হচ্ছে রবীন্দ্রভক্ত সফরসঙ্গী একান্ত সচিব লেনার্ড এল্মহার্স্ট) স্প্যানিশরা ভাবপ্রবণ জাত, ওদের সামলানো বড় কঠিন, তবে এই জাতই আবার পারে আবেগে অনুরাগে উদ্দীপনায় আত্মোৎসর্র্গ করতে। এই বিদেশিনীর মধ্যে দেখেছিলুম সেই অনুরাগের আগুন।’

অনেক ঘটনার সাক্ষী প্রতিমা দেবী সেই বিদেশিনীকে নিয়ে লিখলেন, ‘…ভিক্টোরিয়া কেবিন ডি লাক্স রিজার্ভ করে দিলেন পাছে বাবামশায়ের সমুদ্রপথে কোনো কষ্ট বা অসুবিধা হয়। তাতেও তিনি সন্তুষ্ট হতে না পেরে তার নিজের ড্রয়িংরুমের একখানি আরাম চেয়ারকে জাহাজে তুলে দিলেন। এই নিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তার একবার তর্ক লাগল। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার সাথে কেউ পেরে উঠত না। অত বড় চেয়ার জাহাজের দরজায় প্রবেশ করবে না, এই ছিল ক্যাপ্টেনের আপত্তি, কিন্তু শেষকালে ম্যাডামেরই জয় হলো। মিস্ত্রি ডাকিয়ে দরজা খুলে চেয়ার কেবিনে নেওয়া হলো।
সেই চৌকিখানি সেবার নানা দেশ ঘুরে অবশেষে উত্তরায়ণে পৌঁছেছিল। অনেক দিন তিনি আর ওই চৌকি ব্যবহার করেননি, আমাদের কাছেই পড়েছিল। আজ আবার ব্যামোর মধ্যে দেখলুম ওই চৌকিখানিতে বসা তিনি পছন্দ করছেন, সমস্ত দিনই প্রায় ঘুম বা বিশ্রামান্তে ওই আসনের ওপর বসে থাকতেন। কোনো একদিন ওই কেদারায় বসে তাঁর বিদেশিনী ভক্তের কথা মনে পড়েছিল, তাই লিখেছেন:
বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে
যে প্রেয়সী পেতেছে আসন
চিরদিন রাখিব বাঁধিয়া
কানে কানে তাহারি ভাষণ।

ভাষা যার জানা ছিল নাকো
আঁখি যার কয়েছিল কথা
জাগায়ে রাখিবে চিরদিন
সকরুণ তাহারি বারতা।
…তিনি যখন নতজানু হয়ে বাবামশায়ের পায়ের কাছে বসতেন, মনে হতো ক্রাইস্টের পুরোনো কোনো ছবির পদতলে তাঁর হিব্রু ভক্ত মহিলার নিবেদনÑমূর্তি।]

এরপর ভিক্টোরিয়া হঠাৎ আড়ালে চলে যান। ১৯২৫-র আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে একটি ফুটফুটে বালিকার আগমন ঘটে। ঈষৎ ক্ষুব্ধ ভিক্টোরিয়া তার ভেরি ডিয়ার ট্যাগোরকে এ সংবাদ না জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। আরও সিদ্ধান্ত নেন, বালিকার নাম কখনো কাকাতুয়া হতে পারে না। প্রাচ্যদেশীয় শ্মশ্রুম-িত প্রেসবাইটেরিয়ান প্রিস্টের মতো দেখতে, ভালোবাসায় ভরপুর এই মানুষটি যেন কখনো মেয়ের ভাগ চাইতে না পারেন, তিনি থাকুন তাঁর মাধুরীলতা, রেণুকা আর অতসীলতাকে নিয়ে।

‘সে আমার সম্পূর্ণভাবে আমার।’ ভিক্টোরিয়ার স্বপ্ন ও রক্তমাংস দিয়ে গড়া এই মেয়েটির নাম ইসাবেলা ওকাম্পো।

সাগরময় ঘোষ ট্যাগোরের লেখা ও ট্যাগোরকে লেখা এতো চিঠি ছাপালেন এ দুটো চিঠি ছাপালেন না। আর এন বহুগুণার তদবিরের পরও না।

চার

১৯৯৯ সালে আমি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনস্টাইনের ফটোইলেকট্রিক এফেক্ট নিয়ে পড়াশোনার একপর্যায়ে যখন আইনস্টাইন আর্কাইভের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম, ইসাবেলা ওকাম্পো ট্যাগোর নামের একজন লাতিন আমেরিকান সুন্দরী গবেষককে পেয়ে যাই, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদেশ সফর নিয়ে কাজ করছেন, আইনস্টাইনের সঙ্গে ১৪ জুলাই ১৯৩০ প্রথম সাক্ষাতের সময় প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কি কিছু বলেছেন? এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা হতে পারে, আমার ধারণাই ছিল না।

ইসাবেলার নামের সঙ্গে ওকাম্পো এবং ট্যাগোর দুটোই আমার জন্য কৌতূহলের বিষয়। ইসাবেলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যখন ঘনিষ্ঠ এবং আবেগময় হয়ে উঠছে, ইসাবেলা আমার অগ্রগতি থামিয়ে দিল, বলল, আমি আমার নানি ভিক্টোরিয়ার মতো নই। আমি প্রেগন্যান্ট হতে রাজি আছি, কিন্তু একা বাচ্চা লালন-পালন করতে পারব না। ইন্ডিয়া থেকে কেউ এসে মেয়ের দাবি জানাতে পারে, এই ভয়ে আমার মা ইসাবেলা নামের সঙ্গে ট্যাগোর যোগ করেনি। কিন্তু আমি ট্যাগোর রিভাইভ করছি।

ইসাবেলা ওকাম্পো ট্যাগোর বলল, আমি আইনও পড়েছি। চলো, ঠাকুরদের প্রপার্টিতে আমার শেয়ারটা আদায় করব। তোমাকে দেব অর্ধেক এবং আর দেব আমার সন্তানের পিতৃত্ব।

আমি খোঁজ নিই, সাগরময় ঘোষ মারা গেছেন এবং চিঠি না ছাপায় রাগ করে আর এন বহুগুণা নিজেকে গুটিয়ে নেন, সম্প্রতি ওপারের ডাক পেয়ে অগস্ত্যযাত্রা করেছেন।

আমার এ গল্প তাহলে ছাপবে কে? আর ইসাবেলার প্রাপ্য ঠাকুরবাড়ির হিস্যা? ইসাবেলা ওকাম্পো ট্যাগোরের পেটে আমার সন্তান!

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর