Saturday 22 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আল মাহমুদ: অপরাজনীতির ভয়াল থাবায় অবমূল্যায়িত এক কবি

ইমরান ইমন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:৩৩ | আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:৩৫

‘সোনালী কাবিন’ খ্যাত কবি আল মাহমুদের ষষ্ঠ প্রয়াণ দিবস আজ। ২০১৯ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে চলে যান বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এই কবি। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইলের মোল্লা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আল মাহমুদ। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ।

তুমুল আলোচিত-সমালোচিত কবি আল মাহমুদ তিন দশক ধরে আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে পরম আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে এনেছেন তার কবিতায়। বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন নতুন আঙ্গিকে, তৈরি করেছেন আধুনিক আবহ। আধুনিক বাংলা কবিতার ঝাঁঝ বুঝতে হলে আল মাহমুদের কবিতা পান করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

আল মাহমুদ কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল ও পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বেড়ে ওঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে। ১৮ বছর বয়স থেকে প্রকাশিত হতে থাকে তার কবিতা। সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে কবি ঢাকায় আসেন। সাহিত্যের প্রতি প্রতিশ্রুতির সূত্রে ‘সেন্ডেল পায়ে একটি টিনের বাক্স বগলদাবা করে’ ঢাকা শহরে আসার বৃত্তান্ত আল মাহমুদ তিনি তার লেখায় বর্ণণা করেছেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন তিনি। আর কর্মজীবনের শুরু হয় দৈনিক মিল্লাতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। ১৯৫৫ সালে কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন।

বিজ্ঞাপন

আল মাহমুদ একজন সংগ্রামী কবি। তিনি জীবনকে নাড়িয়ে দেখেছেন নানাভাবে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ও কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল, কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ, কৃত্তিবাস ও কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে সুপরিচিত হয়ে ওঠে তার নাম।

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘লোক লোকান্তর’, ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘কালের কলস’ ও ১৯৭৩ সালে ‘সোনালি কাবিন’ কবিতাগ্রন্থ বাংলা কবিতার প্রথম সারির একজন কবি হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। আল মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ সমকালীন বাংলা কবিতার একটি বাঁকের নাম। বলা হয়ে থাকে, তিনি যদি শুধু এই একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতেন, তাতেও বাংলা কবিতার রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে থাকতেন।

‘সোনালী কাবিন’ এর‌ প্রথম সনেটের শেষে আল মাহমুদ উচ্চারণ করেছেন: ‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা/ দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’ একই সনেটে কবি বলেছেন: ‘ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনী’। ‘কবিতা এমন’ কবিতায় আল মাহমুদ মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন এমন কালজয়ী লাইন লিখে: ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’। এসব লাইন বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে।

কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও বাংলা গল্পের এক আশ্চর্য সাহসী রূপকার আল মাহমুদ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত আল মাহমুদ ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বামপন্থীদের মুখপত্র এবং সরকারবিরোধী একমাত্র রেডিক্যাল পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’ বের হলে তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। গণকণ্ঠ সে সময় বেশ আলোচিত পত্রিকা। গণকণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি এক বছর কারাভোগ করেন। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহ-পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর অ্যাকাডেমির পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসরে যান আল মাহমুদ।

বাংলা কবিতায় অনন্য অবদানের জন্য ১৯৮৬ সালে আল মাহমুদ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা থেকে কবিতার জন্য কাফেলা সাহিত্য পুরস্কার এবং ছোটগল্পের জন্য বাংলাদেশে হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি হয়েও এদেশের অপরাজনীতির ভয়াল থাবায় আল মাহমুদ ছিলেন অবমূল্যায়িত। তাকে একটা গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, বিশেষ করে অতি প্রগতির ধ্বজাধারী ‘অগতিশীল’ গোষ্ঠী একটা রাজনৈতিক বলয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তার শিল্পসত্তা সবকিছুই এতে ম্লান হতে থাকে। প্রথমজীবনে আল মাহমুদ বামপন্থী ছিলেন, শেষজীবনে তিনি ইসলামিস্ট তথা ধর্মানুরাগী হয়ে ওঠেন। শুধু আল মাহমুদ কেন, পৃথিবীর বহু খ্যাতিমান লেখক ও শিল্পীর শেষজীবনে ধর্মের প্রতি দুর্বল হয়ে ওঠার, ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর এটাই তার শিল্পসত্তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে তার শেষজীবন কাটে পরম দুঃখ-কষ্ট, অবমূল্যায়ন আর অবহেলায়। যেখানে সাধারণ চুনোপুঁটির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক জানানো হয়, সেখানে আল মাহমুদের একজন শক্তিমান কবির মৃত্যুতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কেউই শোক প্রকাশ করেনি। এমনকি আল মাহমুদের মতো‌ একজন ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জাতীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন ও বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করতে দেওয়া হয়নি।

আল মাহমুদকে একটা রাজনৈতিক বলয়ে ঠেলে দেওয়া প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘দাড়ি রেখেছি বলে মৌলবাদী হয়ে গেছি’। অথচ আল মাহমুদ তারুণ্যে ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অসংখ্য কবিতা, গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কেন জামায়াতের অনুষ্ঠানে যেতেন!

এ প্রসঙ্গে আল মাহমুদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি সব সভা-সেমিনারেই যাওয়ার চেষ্টা করি। যেমন সমাজতন্ত্রের সেমিনারেও যাই, তেমনি জামায়াত-শিবিরের সেমিনারেও যাই। আর জামায়াত-শিবিরের সভাতে যাই বলে আমাকে রাজাকার বলা হয়, কিন্তু ওদের সভা-সেমিনারে গিয়ে আমি কী বলি সেটা শোনার জন্য কেউই যায় না। এখন মনে হয়, দেশের জন্য যুদ্ধ করে রাজাকার উপাধিটাই আমার প্রাপ্য।’

সেই সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ আরও বলেন, ‘প্রগতিশীল লেখকদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, তারা পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে পুরস্কার নিয়েছেন। শেখ মুজিবের ৬ দফা সমর্থন করেননি, তাদের বেশিরভাগই শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা করতেন, তারাই এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন।’

ব্রাত্য রাইসু ও রাজু আলাউদ্দিনের সঙ্গে আরেক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার একটা উপন্যাস আছে, নাম হলো উপমহাদেশ। আমি মনে করি যে আমি দেখে-লিখেছি, আমি এর মধ্যে দিয়ে গমন করেছি। আমাদের দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধের লেখক নেই। একজনও লেখক নাই, নট অ্যা সিঙ্গল। একমাত্র আমি ছাড়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা লেখক বাংলাদেশে নাই।’

বাংলাদেশে ‘জামায়াত’ বা ‘মৌলবাদী’ ট্যাগ দিয়ে আল মাহমুদকে কোণঠাসা করে রাখা হলেও ভারতে আল মাহমুদ বেশ প্রাসঙ্গিক। আল মাহমুদকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন এভাবে: ‘বাংলাদেশে দেড়খান কবি, একখান আল মাহমুদ আর আধখানা গুণ (নির্মলেন্দু গুণ)।’ আল মাহমুদের মৃত্যুর পর কলকাতার গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় কবি জয় গোস্বামী বলেছেন, ‘কবি আল মাহমুদের সাথে সাক্ষাতের ঘটনা আমার কাছে তীর্থ দর্শনের মতো, তিনি বড়ো কবি।’ একেই বলে শিল্পসত্তার আন্তর্জাতিকতাবাদ। আল মাহমুদ তার সৃষ্টিগুণে ছাড়িয়ে গেছেন সব সীমানা, লাভ করেছেন অমরত্ব।

একজন আল মাহমুদকে আমরা তার সৃষ্টি দিয়ে মূল্যায়ন করতে পারিনি। এদেশের অপরাজনীতির ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার শিকার আল মাহমুদ। এদেশে সব জায়গায় সুপরিকল্পিতভাবে রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি কোথাও বাদ যায় না রাজনীতির এই ভয়াল থাবা থেকে। এখানকার মতো বিশ্বের আর কোথাও এমন নোংরামি নেই।

কবি আল মাহমুদ নিজের মৃত্যুকে তার কবিতায় কামনা করেছেন এভাবে: ‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে/ অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’ কবির সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। কবির মৃত্যুর‌ দিন ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ছিল শুক্রবার, সেদিন বসন্তের মৃদু কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

আল মাহমুদ ইমরান ইমন সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

বজ্রপাতে ছোট ভাইয়ের মৃত্যু, বড় ভাই আহত
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৩৮

আরো

সম্পর্কিত খবর