Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডিএসসিসির চোখে রাস্তাও টার্মিনাল, টোল আদায়ের নামে ‘চাঁদাবাজি’

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:১১

ঢাকা: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় নামমাত্র বাস টার্মিনাল রয়েছে তিনটি। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, গুলিস্তান-জয়কালি মন্দির ও ফুলবাড়িয়া স্টপওভার বাস টার্মিনাল। যদিও এসব টার্মিনালে নেই ন্যুনতম সুযোগ সুবিধা। তবুও বছরের পর বছর ধরে এসব স্থান বাস টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ডিএসসিসি নিজস্বভাবে এসব টার্মিনাল থেকে রাজস্ব আদায় করতো।

কিন্তু সম্প্রতি এসব টার্মিনাল ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসসিসি। তবে ডিএসসিসির এ সিদ্ধান্তে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সমগ্র এলাকা। অর্থাৎ এবারই প্রথমবারের মতো ডিএসসিসির সব রাস্তা অঘোষিত টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। আর এসব রাস্তায় কোনো বাস/মিনিবাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি, অটোরিকশা ও ট্রাক চলাচল করলেই দিতে হবে টোল। আর এ টোল আদায়ের নামে গণহারে চলছে চাঁদাবাজির উৎসব। এমনটাই অভিযোগ ভুক্তভোগী মালিক ও চালকদের।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত প্রায় ১৩ বছর ধরে ডিএসসিসি এলাকায় ওই তিনটি বাস টার্মিনাল থেকে রাজস্ব আদায় করতো করপোরেশনের পরিবহন বিভাগ। কিন্তু এতো বছর এসব টার্মিনাল থেকে কাঙ্ক্ষিত টোল বা ইজারার অর্থ আদায় করতে পারেনি ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগ। তাই ২০২০ সালে ডিএসসিসির নির্বাচনে মেয়র হিসেবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস নির্বাচিত হলে এসব টার্মিনাল নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মেয়র শেখ তাপস দায়িত্ব গ্রহণের পর গত অক্টোবরে এ তিনটি টার্মিনাল ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করেন।

দরপত্রে অংশ নিয়ে গত ১১ নভেম্বর গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির স্টপওভার টার্মিনালটি ইজারা পায় গুলশান চাকা লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনাল ফি ও কুলিমজুরি খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে ২ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৩ টাকায় টার্মিনালটি ইজারা পায়। কিন্তু গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির এলাকা ইজারা হিসেবে পেলেও ইজারাদার প্রতিষ্ঠানটিকে- মতিঝিল, কমলাপুর, জুরাইন, কদমতলী, পোস্তাগোলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, কোনাপাড়া, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার, মাতুয়াইল, মেরাদিয়া, নন্দীপাড়া, মাদারটেক ও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকেও টোল আদায়ের অনুমতি দিয়েছে ডিএসসিসি। এ জন্য এসব এলাকায় কোনো বাস ও মিনিবাস প্রবেশ করলেই ৬০ টাকা করে টোল আদায় করছে ইজারাদার। সেই সঙ্গে সিএনজি, অটোরিকশা, টেম্পু এবং ট্রাক থেকেও টোল আদায় করছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী এসব এলাকা কোনো টার্মিনাল হিসেবে অন্তভুর্ক্ত নয়। তবুও পরিবহন মালিকরা টোল পরিশোধে বাধ্য হচ্ছেন ইজারাদারদের চাপে।

বিজ্ঞাপন

কারণ এসব এলাকায় চলাচলকারী সব ধরনের পরিবহন থেকে টোল আদায়ে সাব-ইজারা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মূল ইজারাদার ঢাকা চাকার লিমিটেডের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে ইজারা পাওয়ার পর মূল ইজাদার ঢাকা চাকার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফতাব মাসুদ আবার এলাকাভিত্তিক সাব-ইজারাদার নিয়োগ দিয়েছেন মোটা অংকের টাকা নিয়ে। আর এ কারণেই এলাকা ভিত্তিক সাব-ইজারাদাররা আপসে টোল আদায় করতে না পারলে চাপ প্রয়োগ, এমনকি মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ সব এলাকায় টোল আদায়কারী সংশ্লিষ্টদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা সারাবাংলাকে জানায়, ইজারাদার আফতাব মাসুদের কাছ থেকে তাদের মালিকরা ইজারা নিয়েছে। তাই তারা শুধু টোল আদায়ের দায়িত্ব পালন করছে। তবে তারা তাদের মালিকের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।

বিষয়টি উল্লেখ করে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা চাকা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফতাব মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ সব এলাকা থেকে আমরা আমাদের নিজস্ব লোক দিয়ে টোল আদায় করি ডিএসসিসির দেওয়া নিয়মানুযায়ী। তবে যারা বলছে সাব ইজারা দেওয়া হয়েছে তা মিথ্যা। আমিও এমনটা শুনেছি। তাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ডিএসসিসিকে চিঠি দিয়েছি।’

একই অবস্থা- ফুলবাড়িয়া স্টপওভার বাস টার্মিনালটিও। এখানেও শুধুমাত্র ফুলবাড়িয়া এলাকার টার্মিনাল হিসেবে ইজারা দেয়া হয়েছে মিনহাজ এন্টারপ্রাইজকে। কিন্তু এ টার্মিনালটির বাহিরেও ইজারার টোল আদায় করা হচ্ছে- গোলাপশাহ মাজার, টিএনটির সম্মুভভাগ, বঙ্গবাজার, চাঁনখারপুল, ফজলুলহক মুসলিম হল সম্মুভভাগ, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নয়াবাজার, বাবুবাজার, আজিমপুর, নিউ মার্কেট, বকসি বাজার, দয়াগঞ্জ, শনির আখড়া, ধানমন্ডি এরিয়া সিদ্দিক বাজার সড়ক থেকে। এ সব এলাকার কোথাও নেই টার্মিনাল সুবিধা। তবুও ইজারাদারদের চাপে বাধ্য হয়ে টোল পরিশোধ করতে হয় পরিবহন মালিকদের।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগের মহা-ব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকাকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণের যে কোনো সড়ক গাড়ি চলাচল করতে হলে টোল দিতে হবে। একবার টোল দিলে আরেকবার দিতে হবে না। তবে ফিরতি পথে ফের টোল দিতে হবে।’

একটি যানবাহনকে যে কোনো স্থানে টোল দিতে বলে কেন, এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।’

এদিকে, টার্মিনাল ইজারার কারণে শধুমাত্র পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে টোল আদায়ের নির্দেশনা থাকলেও মার্কেটের মালামাল আনা নেওয়ার ক্ষেত্রেও টোল আদায় করছে ইজারাদাররা। মার্কেট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- যদি কোনো ব্যবসায়ী কুলি খাটিয়ে মালামাল আনা নেওয়া করে শুধুমাত্র তখন কুলির মজুরি বাবদ টোল আদায় করার কথা। কিন্তু কোনো ব্যবসাযী যদি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মালামাল আনা নেওয়া করে তাতেও কুলি না নিলেও টোল দিতে হচ্ছে। এর প্রতিবাদে সম্প্রতি ফুলবাড়িয়া মার্কেট ব্যবসায়ীরা রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভও করেছে। পাশাপাশি ডিএসসিসি মেয়র বরাবর লিখিদ অভিযোগও দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। তবুও বিষয়টির কার্যকরী সমাধান হয়নি বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

ফুলবাড়িয়া মার্কেটের একজন পাইকারি বিক্রেতা আব্দুর রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ইজারার নিয়ম অনুয়ায়ী যদি কোনো যাত্রী মালামাল উঠানো বা নামানোর জন্য কুলিদের সাহায্য চায় তবে সেজন্য টোল পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু যদি কুলির সাহায্য না লাগে তাহলে টোল দিতে হবে না। অথচ ইজারাদার ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালটি ইজারা পাওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও টোল আদায় করছে। কোনো কুলির সাহায্য নিলেও টোল দিতে হয়। না নিলেও টোল দিতে হবে তাদের এমন নির্দেশ। এসবের প্রতিবাদে গত ২০ অক্টোবর আমরা বিক্ষোভ করেছিলাম। পাশাপাশি মেয়রকে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু সমাধান হয়নি এখনও।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইজারাদারদের পক্ষ থেকে আমরা চিঠি পাওয়ার পর সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। পাশাপাশি যেসব অনিয়মের অভিযোগ পাচ্ছি তার সত্যতা যাছাইয়ে অচিরেই আমরাও ব্যবস্থা নিতে মাঠে নামবো। যদি কোনো অনিয়মের প্রমান পায় তবে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে সব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো যে একেবারেই অসত্য তা কিন্তু নয়। কারণ গত ১৩ বছরে ডিএসসিসি এসব টার্মিনাল থেকে রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব অর্থ লুটপাট করেছিল। কিন্তু এবার যখন ইজারা দেওয়া হয়েছে তখন তারা উঠেপড়ে লেগেছে আমাদের পেছনে। তাই আমরাও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সারাবাংলা/এসএইচ/একে

ইজারা গণপরিবহন টোল আদায় ডিএসসিস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর