রংপুর: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গার হঠাৎ দলে ফেরায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। দলের একাংশ তাকে স্বাগত জানালেও রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় জাতীয় পার্টির বড় অংশ বিরোধিতা করছে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা তাকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ বলে প্রতিহতের ডাক দিয়েছেন।
তবে রাঙ্গা নিজে দাবি করেন, তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতি করে এতদূর এসেছেন, তাই দলে ফিরেছেন এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের দোসর বলা অস্বাভাবিক নয়।
এর আগে, গত ১৫ ডিসেম্বর ফেসবুকে লাইভে এসে জিএম কাদেরের কাছে ক্ষমা চেয়ে দলে ফেরার ঘোষণা দেন তিনি, এবং পরদিন কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় মঞ্চে উপস্থিত হয়ে রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেন। তবে দুর্নীতি, হত্যা ও ভাঙচুরের অভিযোগে একাধিক মামলা এবং দেশত্যাগ নিষেধাজ্ঞা তার ফেরাকে ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে।
জুলাই বিপ্লবের পর আত্মগোপনে থাকা রাঙ্গা গত ১৫ ডিসেম্বর রংপুর-১ আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চেয়ে চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেখা করেন। ওইদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে তিনি বলেন, “জাতীয় পার্টির সঙ্গে আমার দীর্ঘ যাত্রা। কোনো কারণে চেয়ারম্যান আমার ওপর দুঃখ পেয়ে পদ থেকে অব্যাহতি দেন। পরে বহিষ্কার হলে কষ্ট পেয়ে প্রেস কনফারেন্স করে অনেক কথা বলি। এখন বুঝি, এগুলো ঠিক হয়নি। জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য কোনো দলে যুক্ত ছিলাম না। নিঃশর্ত ক্ষমা চাই এবং শেষ জীবনে দলে দায়িত্ব পেলে খুশি হব।”
পরের দিন রাজধানীর গুলশান-১ এর আইরিশ হলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় মঞ্চে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, “আমি আমৃত্যু জাতীয় পার্টির হয়ে থাকব।”
এ সময় দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের রাঙ্গাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “যোগদানকারী নেতাদের স্বাগত।”
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর মহানগর সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির বলেন, “উনি (রাঙ্গা) নতুন করে যোগ দিয়েছেন। এটা চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত। তিনি চেয়ারম্যানের পক্ষে থাকলে আমরা তার পক্ষে থাকব।”
তবে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় জাতীয় পার্টির একাংশ তীব্র বিরোধিতা করছে। উপজেলা আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “মসিউর রহমান রাঙ্গা স্থানীয় নন। গঙ্গাচড়ার লোকজন স্থানীয় প্রার্থী চান। বাইরের লোকের পক্ষে কাজ করলে মানুষ আমাদের দালাল মনে করে।”
উপজেলা সদস্যসচিব গোলাম ফারুক বলেন, “আমরা লন্ডনপ্রবাসী মঞ্জুম আলীর পক্ষে কাজ করব। তার পক্ষে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছি। চেয়ারম্যানও তাকে আশ্বাস দিয়েছেন।”
এদিকে রাঙ্গাকে আওয়ামী লীগের দোসর অ্যাখ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাঙ্গার ছবি পোস্ট করে প্রতিহতের ডাক দিয়েছেন। রংপুর মহানগরের সাবেক আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, “মসিউর রহমান রাঙ্গা জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য পূরণ করতেন। তার ফেরা মানে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন। তিনি দেশে থাকা মানে শেখ হাসিনার একজন মুখপাত্র হিসেবে থাকা। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বি টিম জাতীয় পার্টিতে তাকে নিয়ে এসে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা।”
তবে এ বিষয়ে রাঙ্গা বলেন, “আমরা জোটে ছিলাম। আওয়ামী লীগের মন্ত্রিপরিষদে মন্ত্রী হয়েছি। এটা দোষের নয়। যদি অন্যায় করে থাকি, শাস্তি হবে।”
রাঙ্গার রাজনৈতিক যাত্রা বিতর্কময়। ২০০১ সালে রংপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিএনপি শাসনামলে প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়েন। ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে জয়ী হয়ে পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৮ সালে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ এবং মহাসচিব হন। কিন্তু রওশন এরশাদের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগে ২০২৩ সালে অব্যাহতি পান।
২০২৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে হারেন। জুলাই বিপ্লবের পর আত্মগোপনে যান। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ভাঙচুরসহ চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আবেদনে ৪ আগস্ট ২০২৪ আদালত তার এবং ছেলে রাফাত রহমান জিতু, মেয়ে মালিহা তাসনিম জুঁই, পুত্রবধূ শাকিলা খানম কাকনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। দুদক সূত্রে জানা যায়, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত চলছে, যার মূল্য কয়েকশ কোটি টাকা।
জাতীয় পার্টির সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গার ফেরার সঙ্গে আওয়ামী লীগের থেকে বেড়িয়ে এসে রংপুর ৬ আসনের প্রার্থী হিসেবে নূর মোহাম্মদ মণ্ডলও দলে ফিরেছেন। দলটি ৩০০ আসনে এককভাবে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাঙ্গার অতীত বিতর্ক এবং দুর্নীতির অভিযোগ দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে যেখানে আন্দোলনকারীদের প্রভাব শক্তিশালী।
তবে রাঙ্গা দাবি করে বলেন, “আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর রাজনীতি করার অবস্থা ছিল না। কিন্তু জাতীয় পার্টি করে এতদূর এসেছি, তাই ফিরেছি।”