আমন ধান কেনায় অনিয়ম, বঞ্চিত প্রকৃত কৃষকরা
১৬ জানুয়ারি ২০২০ ০৭:৫৫
মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারের রাজনগরে সরকারিভাবে আমন ধান কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে একটি চক্র প্রকৃত আমন চাষিদের বাদ দিয়ে কৃষক তালিকা তৈরি করেছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রকৃত আমন চাষিরা তালিকা ওই বাতিল করে নতুন তালিকা তৈরির দাবি জানিয়েছেন। তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে, তালিকায় স্থান পাওয়া কৃষকদের যাচাই-বাছাই করেই তাদের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে। আর প্রকৃত কৃষকদের নিয়ে নতুন তালিকাও করা হবে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, এ বছর সরকারিভাবে উপজেলা থেকে ১৪শ ১৭ টন আমন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর জন্য উপজেলার সাড়ে ৯ হাজার কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা তৈরি করেন ইউনিয়ন কৃষি কর্মকর্তারা। সেই তালিকা থেকে লটারির মাধ্যমে মনোনীত হন এক হাজার ৪১৭ জন কৃষক।
প্রান্তিক কৃষকদের অভিযোগ, মূল তালিকায় প্রকৃত কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বরং মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট আমন চাষিদের বাইরে বোরো চাষি ও সবজি চাষিদের কৃষি কার্ড কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে তাদের তালিকাভুক্ত করেছে।
ধান কেনার জন্য মনোনীত কৃষকদের চূড়ান্ত তালিকা যাচাই করে দেখা যায়, একজন কৃষকের নাম একাধিকবার এসেছে। একই মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করেছেন একাধিকজন। এর মধ্যে একটি ফোন নম্বর ব্যবহার করেছেন ৫৭ জন কৃষক। তালিকায় উত্তরভাগ ইউনিয়নের উত্তরভাগ গ্রামের ১৫৮ জন কৃষকের অর্ধকেরও বেশি ভুয়া বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তারা বলছেন, আমন ধান চাষ না করা কৃষকদের কার্ড অল্প টাকায় কিনে তালিকায় নাম তোলা হয়।
উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, কেবল ফতেহপুর ইউনিয়নে লটারিতে অংশ নেন ২২৫ জন কৃষক। এর মধ্যে মনোনীত হন ৩৬ জন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই করে দেখা যায়, এই ৩৬ জনের মধ্যে ২০ জনই ভুয়া— তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমন চাষই করেননি, কেউ কেউ দেশেই থাকেন না। যাচাই-বাচাই করে ভুয়া চাষিদের বাদ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানায় কৃষি বিভাগ। একই চিত্র দেখা গেছে অন্য ইউনিয়নগুলোতেও।
ফতেহপুর ইউনিয়নের ছোয়াব আলী গ্রামের কৃষক জলাল মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, যারা মনোনীত হয়েছে, তাদের অধিকাংশের কৃষি কার্ড হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। কেনো কোনো কৃষককে চার-পাঁচশ টাকা দিয়েও কার্ড নিতে নেওয়া হয়েছে। এসব কার্ড লটারিতে মনোনীত হলে প্রকৃত আমন চাষিরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারছেন না। তখন এই সিন্ডিকেট তাদের কাছ থেকে অল্প টাকায় ধান কিনে বেশি টাকায় সরকারের কাছে বিক্রি করছে।
গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক বদরুল আলম ও আয়াছ মিয়া বলেন, আমন চাষিদের যে তালিকা, তা তৈরির প্রক্রিয়া প্রকৃত চাষিদের জানতেই দেওয়া হয়নি। ইউনিয়ন কৃষি কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট চক্রকে নিয়ে গোপনে এই তালিকা করেছেন। ফলে সরকারের কাছে ধান বিক্রির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত আমন চাষিরা।
জানতে চাইলে রাজনগর উপজেলার কৃষি কর্মকতা মো. শাহাদুল ইসলাম সারাবাংলার কাছে কৃষক তালিকায় অসঙ্গতির অভিযোগ স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, লটারিতে নির্বাচিত কৃষকদের তালিকা আরও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রকৃত আমন চাষি না হলে কার্ড জব্দ করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকের কার্ড জব্দ করা হয়েছে। আর তালিকা তৈরির কাজে যারা যুক্ত ছিল, তাদেরও চিহ্নিত করতে কাজ চলছে।
উপজেলা ধান সংগ্রহ কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফেরদৌসী আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। অনিয়মের অভিযোগ শোনার পর আমন ধান বিক্রির জন্য কৃষকদের আরেকটি তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লটারিতে যারা মনোনীত হয়েছেন, তাদের কাছ থেকেও ধান কেনার আগে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যাচাইয়ে প্রকৃত চাষি হওয়ার প্রমাণ মিললেই ধান কেনা হচ্ছে। আর সংশোধিত তালিকা তৈরি হলে সেটি নিয়ে আরেকটি লটারি করা হবে। তখন আর প্রকৃত আমন চাষিরা বঞ্চিত হবেন না।
ইউএনও ফেরদৌসী আক্তার আরও বলেন, আগের তালিকায় কিভাবে ভুয়া কৃষকরা ঢুকেছে, তা বের করতে আমরা কাজ করছি। এর পেছনে কোনো সিন্ডিকেট থাকলে তাদের শনাক্ত করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।