রাজকান্দি চিরহরিৎ বন: কর্মকর্তাদের সামনেই চুরি হচ্ছে গাছ
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৭:৫১
মৌলভীবাজার: ভারত সীমান্তঘেঁষা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার গহীন অরণ্যে অবস্থিত রাজকান্দি চিরহরিৎ বনাঞ্চল। এই বন থেকে প্রায় প্রতিদিনই সেগুন, গর্জন, লোহা কাঠ থেকে শুরু করে আকাশমনিসহ বিভিন্ন জাতের ৪০ থেকে ৫০টি গাছ চুরির অভিযোগ উঠেছে। এজন্য বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অবহেলাকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা।
রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট ধরেই যেতে হয় দেশের অন্যতম জলপ্রপাত হামহামে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পর্যটকরা হামহাম জলপ্রপাত দেখতে এই দুর্গম পাহাড়ি সড়ক ব্যবহার করেন। এই সড়ক ধরে এগুলেই দেখা যায়, কেটে ফেলা প্রচুর গাছের গুঁড়ি পরে আছে চারপাশে। এই গাছগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই অতি মূল্যবান সেগুন, গর্জন, লোহা কাঠ থেকে শুরু করে আকাশমনি।
হামহাম এ ঘুরতে আসা এক পর্যটক দলের প্রধান সোনালী রায়। পড়ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, এই রিজার্ভ ফরেস্টে যে হারে মূল্যবান গাছ নিধন চলছে, এভাবে দিনের পর দিন উজাড় হতে থাকলে খুব বেশি দিন বাকি নেই এই বন ধ্বংস হতে। কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানায় তার দল।
পরিবেশবাদী সংগঠন বাপা’র মৌলভীবাজার জেলার সমন্বয়ক আ স ম সালেহ সুহেল বলেন, জীববৈচিত্র্য আর গাছ গাছালিতে ভরপুর লাউয়াছড়ার মতো রাজকান্দি ফরেস্টও দ্রুত উজাড় হতে চলেছে। তাই দ্রুতই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি জানান তিনি।
বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল ৭১ টিভির পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিক হোসেন সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, এই বৃক্ষ নিধন বন্ধ না হলে খুব দ্রুতই লাউয়াছড়ার মতো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট। দ্রুতই কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান সারাবাংলাকে বলেন, দেশে যে কয়েকটি রিজার্ভ ফরেস্ট রয়েছে তার মধ্যে রাজকান্দির চিরহরিৎ বনাঞ্চল অন্যতম। এই বন রক্ষা করা না হলে বন এবং জীববৈচিত্র্য দুটিই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সেই সাথে নদী নালার পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হবে। ওই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশও চরম হুমকির মুখে পড়বে বলেও জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, অবৈধভাবে বৃক্ষ উজাড়ে চিহ্নিত একটি মহলকে সহায়তা করছেন খোদ বনবিভাগেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি। প্রতিদিন আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০টি গাছ এবং প্রচুর পরিমাণে বাঁশ এই বন থেকে রাতের আঁধারে পাচার হয়ে যায়। বনবিভাগের লোকজনের পাহারা দেওয়া সত্ত্বেও এত গাছ কিভাবে চুরি করে নিয়ে যায়?
আসলাম মিয়া স্থানীয় পর্যটন গাইড হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, ট্যুরিস্ট গাইড হবার কারণে প্রায় মাসের বেশিরভাগ দিন বিশেষ করে শীতের মৌসুমে পর্যটকদের নিয়ে হামহাম জলপ্রপাতে যাওয়া পরে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে লাউয়াছড়ায় সাধারণত রাতের বেলা বা গভীর রাতকেই গাছ কাটার জন্য টার্গেট করে চোরের দল। পরে দিনের বেলা পর্যটকদের সামনে সেগুলো নিয়ে যায়। তাদের সাথে দেশীয় অস্ত্র থাকায় আমরা প্রতিবাদ করিনা।
তবে এ বিষয়ে খোদ বন বিভাগের লোকজনকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা। বিষয়টি জানালে, রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবু তাহের অভিযোগ অস্বীকার করে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার জানামতে এমন কোনো অনিয়ম এই রাজকান্দি ফরেস্টে নেই। আমি এবং আমাদের অনেক স্টাফদের প্রায়ই এই ফরেস্টে আসা যাওয়া আছে। গাছ চুরির হাত থেকে এই বন রক্ষায় আমাদের লোকজন সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছেন। এ বিষয়ে আমাদের বনবিভাগের প্রত্যেকেই সতর্ক অবস্থায় কাজ করছেন। যেহেতু অভিযোগ পেয়েছি তাই এ অভিযোগটি আমি দ্রুতই খতিয়ে দেখবো।’
স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন সারাবাংলাকে বলেন, বনবিভাগের সাথে কথা বলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন তিনি। বলেন, যদি অবৈধভাবে বনের গাছ কাটা হয়। তবে আমরা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।