Friday 24 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা ঠেকাচ্ছে হালিমের ‘জীবাণুনাশক ফগ গেট’


২৬ এপ্রিল ২০২০ ০৮:৫৬ | আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২০ ১৫:১৩

ঢাকা: সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ম্যাচ বাক্স দিয়ে রেডিও বানিয়ে বিজ্ঞান মেলায় জেতেন প্রথম পুরস্কার। সেটা ১৯৯৭ সালের ঘটনা। সেই থেকে শুরু। এরপর প্রতি বছর বিজ্ঞান মেলায় প্রথম পুরস্কার তার হাতেই ধরা থাকতো। ওই সময় থেকেই বন্ধুদের কাছে তিনি বিজ্ঞানী নামে পরিচিত। তবে তার প্রকৃত নাম আব্দুল হালিম।

এই আব্দুল হালিম বড় হয়ে বিজ্ঞানী না হতে পারলেও ডিপ্লোমা করার পর হয়েছেন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। বর্তমানে কর্মরত আছেন পাবনা জেলার বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পেশা বদলালেও বদলায়নি তার বিভিন্ন জিনিস উদ্ভাবনের অভ্যাস। অফিসের কাজ শেষ করে এখনও রাতে এটা-সেটা বানান তিনি। এভাবেই উদ্ভাবন করেছেন নিজের বাসার দরজার রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থা এবং পেশাগত কাজের জন্য রক্তপাতহীন খৎনা দেওয়ার যন্ত্র।

বিজ্ঞাপন

সারাদেশে যখন করোনা আতঙ্কে ঘরে আবদ্ধ মানুষ তখন গৃহবন্দি থাকার উপায় নাই স্বাস্থ্যকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের। বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিলন মাহমুদ বলেন, ‘একদিন বিদেশি এক সংবাদমাধ্যমে দেখি হাসপাতালে ঢোকার আগে ডিজইনফেক্ট্যান্ট গেট পার হয়ে ঢুকতে হচ্ছে। ভাবছিলাম এমন কিছু বানাতে পারলে আমরাও কিছুটা নিরাপদে কর্মস্থলে ঢুকতে পারতাম। সেটা দেখেই সহকর্মী আব্দুল হালিমকে জানাই। এবং তাকে বলি, এটা বানিয়ে দিতে পারবেন? তিনি রাজি হয়ে যান।

তারপরই বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের নিজস্ব অর্থায়নে একটি ডিজইনফ্যাক্ট্যান্ট ফগ গেট বানান আব্দুল হালিম। বিশদিন আগে কাজ শুরু করে পাঁচদিনের মধ্যেই বানিয়ে ফেলেন এটি। সারাদিনে কাজের পাশাপাশি রাতে সময় দেওয়ায় পাঁচদিন লেগেছে। কিন্তু এখন দুদিনেই এমন একটি গেট বানাতে পারবেন বলে সারাবাংলাকে জানান আব্দুল হালিম।

বিজ্ঞাপন

সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই গেটটি বানাতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছেন স্থানীয় বাজার থেকে। একটি ড্রামে পঞ্চাশ লিটার পানির মধ্যে দিতে হবে আধা কেজি ডিটারজেন্ট পাউডার। এই পরিমাণ পানিতে দেড়শ জনকে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে মানুষের শরীরে ব্লিচিং পাউডার দিতে নিষেধ করার পর থেকে তারা ডিটারজেন্ট পাউডার ব্যবহার করছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গেটে দুটি বেসিন বসিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা স্বত্বেও মানুষ সেটি মানতে চায় না। এখন এই গেট দিয়ে প্রবেশ করলে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জীবাণুমুক্ত হয়ে যাচ্ছেন।

গেটটি কীভাবে কাজ করে জানতে চাইলে হালিম বলেন, ‘চার ফিট চওড়া ও ছয় ফিট লম্বা এই গেট দিয়ে দশ কেজির ওপরের ওজনের কেউ প্রবেশ করলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়। মেঝের পাটাতনের নিচে একটি পুশ সুইচ রয়েছে, যেটিতে পা পড়লে ওজন মাপা মেশিনে ওজন ধরা পড়ে ও কম্প্রেসার চালু হয়ে যায়। কম্প্রেসার চালু হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চারপাশ থেকে ডিটারজেন্ট মেশানো পানি স্প্রে হবে। পানিটা সরাসরি নয়, বাষ্পাকারে ধোঁয়ার মত মানুষের গায়ে স্প্রে হয়। এভাবে পায়ের তালু বাদে পুরো শরীরই জীবাণুমুক্ত হচ্ছে।’ স্থানীয় বাজারে সেন্সর খুঁজে পাননি। সেটি পাওয়া গেলে মেশিনটি আরও উন্নত হতো বলে জানান আব্দুল হালিম।

শিশুদের ক্ষেত্রে এই ডিটারজেন্ট মেশানো পানি ক্ষতির কারণ হবে কি-না?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিশুদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রেখেছেন। গেটে থাকা ওয়ার্ড বয় বা কেউ তাদের অন্য পথ দিয়ে প্রবেশ করাচ্ছেন অথবা অভিভাবকদের বলছেন ভালো করে চোখ মুখ ঢেকে যেন প্রবেশ করান।’

করোনা মোকাবিলায় এটি কতোটা কার্যকর?- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মিলন মাহমুদ বলেন, ‘চিকিৎসকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। তাই এই ডিজইনফেক্ট্যান্ট গেট কিছুটা হলেও জীবাণুমুক্ত করতে পারছে। এখন পর্যন্ত পাবনার বেড়ায় কোনো করোনা রোগী ধরা পড়েনি। তবে শুরু থেকেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

এখন তারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাইরে একটি নিরাপদ স্যাম্পল কালেকশন বুথ ও ফ্লু-কর্নার বানাচ্ছেন। প্লাস্টিকের তৈরি এই বুথে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে সরাসরি কোন শারীরিক যোগাযোগ হবে না। বুথের ভেতরে নিরাপদ পোশাক পরিহিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরাপদে নমুনা সংগ্রহ করতে পারবেন ও চিকিৎসা সেবা দিতে পারবেন।

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ফগ গেট বানানোর পর এখন আব্দুল হালিমের পরবর্তী প্রোজেক্ট পিপিইর পারসোনাল প্রোটেক্টিভ পোশাককে আরেকটু সহনশীল করা। আমরা অনেকেই জানি এই পোশাকগুলো অত্যন্ত গরম। সব জায়গায় এয়ার কন্ডিশনও নেই। তাই চিকিৎসকদের এই গরমে বেশ অস্বস্তি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। আব্দুল হালিম পোশাকের মধ্যে এসি লাগানোর চেষ্টা করছেন, যাতে ভেতর থেকে ঠাণ্ডা থাকে।

এদিকে বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই জীবাণুদূরীকরণ ফগ গেট সাড়া ফেলেছে পুরো জেলায়। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মিলন মাহমুদ জানান, ইতোমধ্যে স্থানীয় এমপি ও সিভিল সার্জন এসে পরিদর্শন করে গেছেন।

আব্দুল হালিম জানান, সাংসদ শামসুল হক টুকুসহ ইউএনও এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা এটি পরিদর্শন করেছেন। স্থানীয় থানা থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এখন অনেকেই এমন একটি গেট নির্মার্ণের কথা ভাবছেন। কেউ এরকম গেট নির্মাণ করতে চাইলে তিনি সহযোগিতা করবেন বলে জানান।

আব্দুল হালিম জীবাণুনাশক ফগ গেট বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে্‌লক্স