প্রাণ ফিরে পেয়েছে লাউয়াছড়া
৩ মে ২০২০ ০৮:০৮
মৌলভীবাজার: কিছুদিন আগেও হাজারও পর্যটক আসায় তাদের ব্যবহৃত যানবাহন ও হৈ হুল্লোড়ে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান হারিয়ে ফেলেছিল তার শান্ত নিবিড় পরিবেশ। মানুষের অবাধ বিচরণে এ বনের প্রাণীরা অনেকটাই গা ঢাকা দিয়েছিল। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি নির্দেশনায় সারাদেশের মতো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও পর্যটক প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্যটকশূন্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এখন তার আগের শান্ত নিবিড় পরিবেশে ফিরে পেয়েছে। ফলে মনের আনন্দে বন্যপ্রাণীরা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে উদ্যানের ভেতরের সমতলে ও গাছ থেকে গাছে।
ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার আওতায় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলমান রেল ও সড়ক পথে যানবাহন চলা বন্ধ রয়েছে। ফলে বন্যপ্রাণীরা এখন স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে। শুনশান নীরবতায় বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে লাউয়াছড়া যেন ফিরে পেয়েছে তার প্রকৃত রুপ বৈচিত্র্য। সেই সঙ্গে গাছে গাছে সবুজ পাতার এই বিমোহিত রুপও যেন আগে কখনো দেখা যায়নি। মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজ হাতে নতুন করে গড়ে তুলেছে প্রাকৃতিক এই উদ্যানটিকে।
পুরো উদ্যানজুড়ে বন্যপ্রাণীরা এখন অবাধে চলাচল করতে পারছে। নেই কোন ধাওয়া করা বা ঢিল ছোড়াছুড়ি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, লাউয়াছড়া উদ্যানের সকল প্রাণী এখন মনুষ্য উপদ্রবমুক্ত।
বানরগুলো এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। চশমা পরা বানর বসে থাকতে দেখা যায় বনের বাঁশ গাছে। আগে যেখানে মানুষজনের উপস্থিতিতে বন মোরগের দেখা মিলত না, সেখানে এখন সারাদিন বনের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় তারা। বনের মধ্যে থাকা মায়া হরিণের দর্শন পাওয়া যেখানে দায় ছিল, সেখানে স্থানীয়রা এখন প্রায়ই মায়া হরিণের দেখা পাচ্ছেন। সকাল থেকে দুপুর অব্দি শোনা যাচ্ছে মহাবিপন্ন উল্লুকের আওয়াজ। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দ।
বাংলাদেশের ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। চিরহরিৎ এ বনাঞ্চল বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের নিরাপদ আবাসস্থল। এছাড়াও নানা ধরণের দুর্লভ প্রাণী, কীটপতঙ্গ আর গাছপালার জন্য এ অরণ্য বিখ্যাত।
লাউয়াছড়া উদ্যানের পুরোনো নাম ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। মৌলভীবাজার রেঞ্জের আওতাধীন কমলগঞ্জ উপজেলার প্রায় ২ হাজার ৭শ ৪০ হেক্টর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশে সংরক্ষিত এই বনের প্রায় ১ হাজার ২শ ৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ, সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালের ৭ জুলাই জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই বনে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ বন্যপ্রাণী ও গাছপালা। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরিসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি।
অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। পর্যটন ক্ষেত্রে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এই বনের পরিচিতি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একটি পর্যটন কেন্দ্র। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়ার অবস্থান। এটি কেবল পর্যটন কেন্দ্রই নয়, এ উদ্যান এক জীবন্ত প্রাকৃতিক গবেষণাগার।
করোনা পরিস্থিতি শেষ হওয়ার পর প্রতিবছর নির্দিষ্ট কোনো মাসে এই উদ্যান বন্ধ রাখলে বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে বলে মনে করেন প্রাণ প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি হৃদয় দেবনাথ বলেন, বনে পর্যটকের অবাধ বিচরণ, হৈ-হুল্লোড়, গাড়ির হর্ণ, রেল গাড়ির প্রচন্ড শব্দ ইত্যাদির কারণে লাউয়াছড়ার বণ্যপ্রাণীগুলো হাঁপিয়ে উঠেছিল। প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন, গাড়ির হর্ণের কারণে বনের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। যার ফলে বন্যপ্রাণী পর্যটকদের নাগালের বাইরে অবস্থান করত। এখন সব বন্ধ থাকায় আবারও প্রাণ ফিরে এসেছে এই উদ্যানে। এই পরিবেশ বজায় রাখতে বছরে এক দুইবার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারির পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তর করতে হবে।