চট্টগ্রাম ব্যুরো: বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের আমলে চট্টগ্রামে যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর সেসব এখন আসছে মানুষের আলোচনায়। শিক্ষা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য- চট্টগ্রামে প্রায় সবখানেই ছড়িয়ে আছে নানা কীর্তি। নব্বই পরবর্তী সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রায় যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সূচনা খালেদা জিয়া বা বিএনপির হাত ধরে শুরু হয়েছিল, কালক্রমে সেগুলোই আরও যুগোপযোগী হিসেবে সম্প্রসারণ হয়েছে, এমনটাই মত বন্দরনগরীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে ক্রমে এ অঞ্চল গড়ে ওঠে বাণিজ্যনগরী হিসেবে। হালকা, মাঝারি, ভারি শিল্পের গোড়াপত্তন হয় এ চট্টগ্রামেই, যা ক্রমে দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্রপথে কনটেইনারে দেশের মোট আমদানি-রফতানির ৯৮ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। পণ্য হিসেবে চট্টগ্রাম দিয়ে পরিবহণ হয় ৯৩ শতাংশ। বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় আড়াই দশক আগে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আপামর মানুষের দাবি ওঠেছিল চট্টগ্রামকে দেশের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ ঘোষণার।
এ দাবি যখন ক্রমে জোরালো হতে থাকে, ২০০৩ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকার চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার প্রস্তাব মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করে। সেই প্রস্তাবে ১৬টি কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা ছিল। বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নগরীর আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম চেম্বারকে ‘বাণিজ্যনগরের প্রতীক’ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ২০১৬ সালে সেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার চালু হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-কে নিজস্ব কার্যালয় নির্মাণের জন্য নগরীর ওয়ারল্যাস এলাকায় জমি বরাদ্দ দিয়েছিল বিএনপি সরকার।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নের যাত্রাও শুরু হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে। বন্দরের প্রথম স্বতন্ত্র সবচেয়ে দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনালটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। ২০০৭ সালে টার্মিনালটি চালু হয়। এর ধারাবাহিকতায় বন্দর কর্তৃপক্ষ এনসিটি-২, সিসিটি, পিসিটি নির্মাণ করে।
তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে উন্নয়নের সূচনাটাই ম্যাডাম খালেদা জিয়ার হাত ধরে হয়েছে। বন্দরে যত উন্নয়ন হয়েছে, আমরা এনসিটি করেছিলাম, আরও বিভিন্ন অবকাঠামো বিএনপির আমলে হয়েছিল, সবই বিএনপির আমলে হয়েছে, এরপর বন্দরে আর কোনো উন্নয়ন হয়নি। এটা আমার নির্বাচনি এলাকা। শুধু বন্দরের উন্নয়ন নয়, এই এলাকায় পতেঙ্গায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজও বিএনপির আমলেই হয়েছে।’
প্রাণী চিকিৎসাবিদ্যায় গুরুত্ব দিয়ে বিএনপির ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সালের শাসনামলে দেশে দুটি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়, এর একটি চট্টগ্রামে ও আরেকটি সিলেটে। সেই সরকারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান। ১৯৯৫ সালের ২৮ নভেম্বর সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া চট্টগ্রামে আসেন এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে সেই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার আন্দোলন শুরু করেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস ইউনিভার্সিটি’। ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এটি উদ্বোধন করেন এবং ৭ আগস্ট এটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে দেশে এটিই একমাত্র ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে কর্ণফুলী নদীর ওপর তৃতীয় সেতু নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছিল বিএনপি সরকার। কুয়েত সরকারের অর্থায়নে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালের ৮ আগস্ট। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ২০১১ সালে সেতুটি চালু হয়। সেতুটি নির্মাণের বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তৎকালীন চসিক মেয়র বর্তমানে প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন ওই সেতু হলে কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নাব্যতা সংকট তৈরি হবে। কিন্তু সকল বিরোধ উপেক্ষা করে বেগম খালেদা জিয়া সেই সেতু নির্মাণে অনড় ছিলেন।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড ভবন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরেস্ট ইনস্টিটিউট ভবন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অতিরিক্ত শয্যা সংযোজন ও অবকাঠামো নির্মাণ, বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণসহ আরও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সাক্ষ্য দিচ্ছে বেগম খালেদা জিয়ার কীর্তির।
সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত আবদুল্লাহ আল নোমানের সন্তান ও চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-পাহাড়তলী) আসনে বিএনপির সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী সাঈদ আল নোমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আধুনিক চট্টলা কিংবা উন্নত চট্টগ্রাম গড়ার সোপানটা কিন্তু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াই রচনা করেছিলেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পর তৎকালীন মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করার। দেশনেত্রী পরবর্তীতে বাণিজ্যিক রাজধানীর ঘোষণাই শুধু দেননি, সেটি মন্ত্রীসভায়ও অনুমোদন করেছেন। একইভাবে আবদুল্লাহ আল নোমানের প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরের মেয়াদে ভেরেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন। বেগম খালেদা জিয়া তৃতীয় কর্নফুলী সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানকে সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত করেন।’